প্রসেনজিৎ বসু ও সমীরণ সেনগুপ্ত
প্রসেনজিৎ অর্থনীতিবিদ ও সমাজকর্মী; সমীরণ ডেটা অ্যানালিস্ট
আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা এবং প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেউচা-পাঁচামির কয়লাখনি প্রকল্প স্পষ্টতই জনস্বার্থ-বিরোধী। আদিবাসীরা দীর্ঘ এক বছর ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে সমস্যার সমাধান চাইছেন। এই কারণেই দেউচা-পাঁচামির আদিবাসী আন্দোলন রাজ্যের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার লড়াই
বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার ব্লকে দেউচা-পাঁচামি ও দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা অঞ্চলে প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্প ঘিরে স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা এবং পরিবেশ সংক্রান্ত যে প্রশ্নগুলি উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেগুলোর কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণ করা হবে না বলে মুখ্যমন্ত্রী মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিলেও জেলা প্রশাসন এবং শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস আইনকানুন শিকেয় তুলে স্থানীয় মানুষকে বিভ্রান্ত করে, ভয় দেখিয়ে এই প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে চাইছে।
রাজ্য সরকারের এই অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ওই অঞ্চলের আদিবাসীরা বিগত এক বছর ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। আদিবাসীদের জমি-জীবিকা এবং প্রকৃতির অধিকার খর্ব করে বেআইনি প্রক্রিয়ায় জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জেলা এবং রাজ্য প্রশাসনের কাছে বারংবার স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। সম্প্রতি দেউচা-পাঁচামি থেকে ২০০ কিলোমিটার যাত্রা করে কলকাতায় রাজভবনে এসে স্মারকলিপি দিয়েছে ‘আদিবাসী অধিকার মহাসভা’, যারা স্থানীয় আদিবাসী মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
প্রস্তাবিত কয়লাখনি কি আদৌ বাস্তবোচিত?
অতীতে দুইবার দেউচা-পাঁচামিতে কয়লাখনি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত খনন সংস্থা ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (এনএমডিসি) মউ সই করে রাজ্য সরকারের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ওয়েস্ট বেঙ্গল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড (ডব্লিউবিএমডিটিসিএল)-এর সঙ্গে। কোল ইন্ডিয়ার সঙ্গে মিলে এনএমডিসি এবং ডব্লিউবিএমডিটিসিএল যৌথ উদ্যোগে খনিপ্রকল্প শুরু করার প্রচেষ্টা করে, কিন্তু কোল ইন্ডিয়া উৎসাহ না দেখানোয় প্রকল্প এগোয়নি।
এরপর ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক পশ্চিমবঙ্গ সহ ছয়টি রাজ্যকে দেউচা-পাঁচামি কয়লা ব্লকটি বরাদ্দ করেছিল। ২০১৪-তে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেই কয়লা ব্লক বণ্টন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর যখন নতুন করে বরাদ্দ করা হয় তখন উত্তরপ্রদেশ, বিহার, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং পাঞ্জাবের রাজ্য সরকারগুলি আর আগ্রহ দেখায়নি। ফলে ২০১৯-এর ডিসেম্বরে কেবলমাত্র ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনকে এই কয়লা ব্লকটি পুনঃবরাদ্দ করা হয়।
প্রশ্ন হল মজুত কয়লার পরিমাণ আনুমানিক ২০০ কোটি টন সত্ত্বেও অন্যান্য রাজ্যগুলো এই প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নিল কেন? দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা উত্তোলনকারী সংস্থা কোল ইন্ডিয়াও এই প্রকল্পে আগ্রহী নয় কেন? কারণ জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সমীক্ষা অনুযায়ী এখানে কয়লার স্তর চাপা পড়ে আছে অতি পুরু কঠিন ব্যাসল্টের নিচে (৯০ থেকে ২৪৫ মিটার) এবং এই কয়লার গ্রেডও উৎকৃষ্ট মানের নয়। এত গভীরের কয়লার স্তর থেকে কয়লা উত্তোলন বেশ কঠিন, সাধারণভাবে কয়লা উত্তোলনে যে সময় লাগে এক্ষেত্রে তার থেকে অনেক বেশি সময় লাগবে, বিনিয়োগের পরিমাণ হতে হবে অনেক বেশি এবং যে প্রযুক্তি প্রয়োজন তা দেশে নেই, বিদেশ থেকে আনতে হবে। সুতরাং অর্থনৈতিকভাবে প্রকল্পটি লাভজনক হবে কিনা তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই।
বেআইনি জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া
প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের গোটা প্রক্রিয়াটাই দুরভিসন্ধিমূলক এবং বেআইনি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যুৎ দপ্তর ১৬ নভেম্বর ২০২১ তারিখে একটি বিজ্ঞপ্তি (131-POW-20011/2/2020) জারি করে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। এই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা কয়লা ব্লকের আয়তন ১২.৩ বর্গ কিমি। মহম্মদবাজার ব্লকের অন্তর্গত দশটি মৌজায় সর্বসাকুল্যে ৩৪০০ একর জমি এই কয়লাখনি প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২৬৭ একর জমি আছে ব্যক্তিগত মালিকানায়, ২০৩ একর বনাঞ্চল এবং বাকিটা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের অধীনে। এই কয়লাখনি করতে গেলে ৪৩১৪টি পরিবারের ২১০৩৩ জন মানুষকে উচ্ছেদ করতে হবে, যার মধ্যে ৯০৩৪ জন আদিবাসী এবং ৩৬০১ জন তফসিলি জাতির মানুষ।
এই ধরনের বড় প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ২০১৩ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন এবং ২০১৪-র জমি অধিগ্রহণ নিয়মাবলিতে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা রয়েছে। প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা করে সেই সমীক্ষার খসড়ার ভিত্তিতে প্রকল্প অঞ্চলে গ্রামসভা ডেকে গণশুনানি করে করে প্রতিটি সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সম্মতি নিয়ে তবেই জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কথা। রাজ্য সরকার এসব কিছুই না করে সবার আগে একটি ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ ঘোষণা করে দিয়েছে। প্রস্তাবিত খনি এলাকায় ২০০ একরের বেশি বনাঞ্চল রয়েছে, বনাঞ্চল সংরক্ষন আইন ২০০৬ এলাকার আদিবাসীদের যে অধিকার দিয়েছে তাও এখানে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। উপরন্তু, খনি প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রকে জমা করে সেখান থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে, যেটাও সঠিক পদ্ধতি নয়।
রাজ্য সরকারের ১৬ নভেম্বর ২০২১-এর বিজ্ঞপ্তিতে এক জায়গায় জমি ক্রয়ের মাধ্যমে সংগ্রহ করার কথা বলা আছে, আবার আরেক জায়গায় ভূমি অধিগ্রহণের কথা বলা আছে। ফলে রাজ্য সরকার জমি কিনছে না অধিগ্রহণ করছে তাই নিয়েই বিভ্রান্তি রয়েছে। সব জমিহারাদের পুলিশের জুনিয়র কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বীরভূম জেলা প্রশাসন ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার পরিবারের থেকে জমি বিক্রির ‘সম্মতি’ আদায় করে নিয়েছে, কিন্তু এই তথাকথিত সম্মতির একেবারেই আইনসম্মত নয়। কয়লা খনি প্রকল্পটি যদি এরপর পরিবেশগত ছাড়পত্র না পায় তখন রাজ্য সরকার কী করবে, সেটাও অনিশ্চিত।
রাজ্য সরকারের আইনবহির্ভূত কার্যকলাপ দেখে আশঙ্কা হচ্ছে যে কয়লা খনির নামে ওই অঞ্চলের উৎকৃষ্ট ব্যাসল্ট বা কালো পাথরের ভাণ্ডার কোনও বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাকে পাইয়ে দেওয়া হবে না তো? প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কের যে সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়েছে, তার পানাগড় থেকে পালশিট পর্যন্ত অংশের বরাত পেয়েছে আদানি রোড ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড। সড়ক নির্মাণে ব্যাসল্টের বিপুল চাহিদা। একদিকে রাজ্য সরকারের বেআইনি কার্যকলাপ, অন্যদিকে আদানি গোষ্ঠী সড়ক প্রকল্পের দায়িত্বে আসায় এই ধরনের সন্দেহ ক্রমশ বাড়ছে।
কয়লা খনিতে কি এক লক্ষ কর্মসংস্থান হবে?
মুখ্যমন্ত্রী বারংবার বলেছেন এই কয়লা খনি প্রকল্পের মাধ্যমে নাকি এক লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এই কথা বলছেন তা পরিষ্কার নয়। বরং কয়লাখনি শিল্পে প্রযুক্তিগত কারণে কর্মসংস্থানের প্রবণতা নিম্নগামী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ কয়লা উৎপাদক সংস্থা কোল ইন্ডিয়া, দেশজুড়ে ৩৪৫টি কয়লাখনি চালিয়ে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ৫৪ কোটি টন কয়লা উৎপাদন করেছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে কোল ইন্ডিয়ার মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল ২.৫ লক্ষ। এক দশক আগে, ২০১১-১২ অর্থবর্ষে কোল ইন্ডিয়ার মোট উৎপাদন ছিল ৪৩ কোটি টন, মোট কর্মী ছিল ৩.৭ লক্ষের বেশি। অর্থাৎ দশ বছরে কোল ইন্ডিয়ার কয়লা উৎপাদন ১১ কোটি টন বাড়লেও কর্মীসংখ্যা কমে গেছে ১.২ লক্ষ। এই তথ্য থেকেই কয়লাশিল্পে কর্মসংস্থানের দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা বোঝা যায়।
দেউচা-পাঁচামিতে কয়লাখনি হলে যদি এক লক্ষ মানুষেরই কর্মসংস্থান হয় তবে জমিহারা-বাস্তুহারা পরিবারদের রাজ্য পুলিশের জুনিয়র কনস্টেবল পদে অস্থায়ী চাকরি দেওয়া হচ্ছে কেন? কয়লাখনি প্রকল্পে পুলিশ কনস্টেবলের তো কোনও প্রয়োজন থাকার কথা নয়। এই জুনিয়র কনস্টেবলের চাকরির জন্য এখন পর্যন্ত ৩০০০ আবেদন হয়েছে, অথচ চাকরির নিয়োগপত্র পেয়েছে মাত্র ৪৬০ জন। তাদের নিয়োগপত্রে পরিষ্কার করেই লেখা আছে যে এই পুলিশের চাকরি অস্থায়ী। আসলে ১ লক্ষ কর্মসংস্থান বা সমস্ত জমিহারা পরিবারের জন্য পুলিশ কনস্টেবলের চাকরি দেওয়ার মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে স্থানীয় মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে।
জলবায়ু সঙ্কটের প্রেক্ষিতে নতুন কয়লাখনি জনস্বার্থ-বিরোধী
এই ধরনের প্রকল্পের জন্য পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করা পরিবেশ সুরক্ষা আইন অনুযায়ী বাধ্যতামূলক। এই কয়লাখনি প্রকল্প হলে এলাকার চারপাশের গ্রাম ও শহরাঞ্চলের আকাশ-বাতাস এবং জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। এলাকায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর এবং কৃষিক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সর্বোপরি নতুন করে ২০০ কোটি টন কয়লা পোড়ালে যে বিপুল কার্বন নিঃসরণ ঘটবে তা বিশ্ব-উষ্ণায়নকেও ত্বরান্বিত করবে।
ইতিমধ্যেই আগামী কয়েক দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে সুন্দরবন সহ উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলের তলায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছে। জলবায়ু সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ নভেম্বরের গ্লাসগো সম্মেলনে কয়লার ব্যবহার কমানো হবে বলে আন্তর্জাতিক স্তরে চুক্তি হয়েছে, ভারত সরকারও যার শরিক। এই অবস্থায় নতুন করে একটি কয়লাখনি প্রকল্প করে জলবায়ুর আরও ক্ষতিসাধন জনস্বার্থের পরিপন্থী।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ বিষয়ক দপ্তরের ‘স্টেট অ্যাকশন প্ল্যান’ অনুযায়ী, কয়লার মতন ফসিল জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে রাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তির ব্যবহারকে বর্তমান ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০৩০-৩১ অর্থবর্ষে ২২ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার কথা লেখা আছে। এই লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করতে পারলে প্রতি বছর ১৮০০০ গিগাগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমন কম হবে বলে উল্লেখ করা আছে। অথচ যে রাজ্য সরকার লিখিতভাবে এই লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে, সেই সরকার কোনও নতুন সোলার বা উইন্ড পাওয়ার প্রকল্প শুরু না করে বীরভূমের ২১ হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করে একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ, অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক কয়লাখনির বাস্তবায়নে অধীর হয়ে উঠছে কেন তা বোঝা দায়। দুনিয়াজুড়ে যখন কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনা হচ্ছে তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার উল্টোপথে হাঁটতে চাইছে।
দেউচা-পাঁচামির অবৈধ কালো পাথরের ব্যবসা
দেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা অঞ্চলে গত চার দশক ধরে কালো পাথরের খনন চলছে যার সিংহভাগই বেআইনি। পাথর খাদান-ক্রাশারের বেলাগাম বৃদ্ধির ফলে ওই অঞ্চলের পরিবেশ এবং জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারাত্মক ধুলো এবং বায়ুদূষণের ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই ফুসফুসের অসুখে আক্রান্ত। পাথরবাহী বড় বড় ডাম্পার ট্রাকের অবিরত যাতায়াতের কারণে গ্রামের রাস্তাঘাট ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে।
নিয়ম-কানুন না মেনে, আদিবাসীদের জমিতে বেআইনি খাদান-ক্রাশার চালিয়ে অনেকেই কোটি-কোটি টাকা মুনাফা লুটে যাচ্ছে, কিন্তু স্থানীয় আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার কোনও উন্নতি হয়নি। হাজার-হাজার ডাম্পার ট্রাককে ভুয়ো ডিসিআর স্লিপ ধরিয়ে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা তোলাবাজি করে আদায় করা হয়। পুলিশ-প্রশাসন এবং শাসকদলের মদতেই এইসব বেআইনি কারবার চলছে। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের রায় সত্ত্বেও বীরভূম জেলাপ্রশাসন অবৈধ পাথরব্যবসাতে লাগাম পরাতে পারেনি।
স্থানীয় আদিবাসীদের আন্দোলন
দেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ এই কয়লাখনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে। বিশেষত ওই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী সাঁওতাল আদিবাসীরা। রাজ্য প্রশাসন মুখে সংবেদনশীল হওয়ার কথা বললেও কার্যক্ষেত্রে প্রথম থেকেই নানা ধরনের ছল-চাতুরি এবং দমন-পীড়ন চালিয়ে এই প্রকল্প চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। ওই অঞ্চলের আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা এবং প্রকৃতি-পরিবেশ সংক্রান্ত যে আশঙ্কা তাদের মনে দানা বেঁধেছে তার কোনও সদুত্তর না পেয়ে তারা প্রকল্পের বিরোধিতায় সংগঠিত হয়ে গত এক বছর ধরে গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।
জেলা প্রশাসন, রাজ্য প্রশাসনের কাছে বারংবার স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। গ্রামসভার মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গণতান্ত্রিক পথের কথাই আদিবাসীরা প্রথম থেকে বলে আসছেন। রাজ্য সরকার যখন আইনবহির্ভূত কাজ করছে আদিবাসীরা তখন আইন রক্ষায় আদালতের দ্বারস্থ হয়ে জনস্বার্থ মামলা করেছেন। আন্দোলনের ঝাঁঝ বৃদ্ধি পেতেই আন্দোলনকারীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে পুলিশ-প্রশাসন।
আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার এই অপচেষ্টাকে ব্যর্থ করে সম্প্রতি আদিবাসীরা পাঁচামি থেকে কলকাতা পর্যন্ত পাঁচদিনের যাত্রা সংগঠিত করেছেন, ‘আদিবাসী অধিকার মহাসভা’র নেতৃত্বে। গ্রীষ্মের দাবদাহ উপেক্ষা করে, খানিকটা পায়ে হেঁটে, বাকি পথ বাসে চেপে সিউড়ি, বোলপুর, বর্ধমান, উত্তর চব্বিশ পরগণা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত ২০০ কিলোমিটার যাত্রা শেষ হয় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। স্মারকলিপিতে কয়লা খনি প্রকল্প বাতিল করা, বেআইনি পাথর খাদান-ক্রাশার বন্ধ করার দাবির পাশাপাশি উত্থাপিত হয়েছে ভারতের সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে প্রদত্ত অধিকারের আদলে পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে গ্রামসভার বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতির দাবি।
আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা এবং প্রকৃতি-পরিবেশ রক্ষার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেউচা-পাঁচামির কয়লাখনি প্রকল্প স্পষ্টতই জনস্বার্থ-বিরোধী। শাসকদলের ছত্রছায়ায় বালি-পাথর-মাটি-কয়লা নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম হয়েছে, বীরভূম জেলা হয়ে উঠেছে তার পীঠস্থান। রাজ্য ও জেলা প্রশাসন গণতান্ত্রিক পথে আস্থাশীল নয়। অথচ আদিবাসীরা দীর্ঘ এক বছর ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথেই সমস্যার সমাধান চাইছেন। এই কারণেই দেউচা-পাঁচামির আদিবাসী আন্দোলন রাজ্যের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার লড়াই। স্থানীয় আদিবাসীরা এই লড়াইয়ে রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকল নাগরিকদের সমর্থন ও সংহতি প্রত্যাশা করেন।