ড.তাপসী ঘোষ
অল ইন্ডিয়া রেডিওর শিল্পী ড. তাপসী ঘোষ প্রয়াত পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশীজীর একমাত্র ‘গাণ্ডাবন্ধ’ ছাত্রী । যোশীজীর প্রয়াণের পর আগ্রা ঘরানার উস্তাদ শফি আহমদ খানের কাছে তালিম নিয়েছেন। আগ্রা ঘরানার বিশিষ্ট শিল্পী উস্তাদ বিলায়েত হুসেইন খানকে নিয়ে নিজস্ব গবেষণার নিরিখে ‘প্রাণ পিয়া’ নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। দেশের বিভিন্ন অংশে ও টেলিভিশনের নানান চ্যানেলে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করে চলা এই শিল্পী কর্মজীবনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসোসিয়েট প্রফেসর।
কেউ চিরকাল থাকার জন্য পৃথিবীতে আসেন না, সে তো আমাদের অজানা নয়। তবু পূরব অঙ্গ গায়কীর অন্যতম ধরোহর, আমাদের আপ্পাজী গিরিজা দেবীর চলে যাওয়া ইস্তক মনটা ভারী হয়ে আছে। কত সুখস্মৃতি ভীড় করে আসছে মাথার ভিতরে।
আমি পণ্ডিত ধ্রবতারা যোশীর ছাত্রী। আমার মনে আছে, উনি পণ্ডিতজীর এক জন্মদিনে গান করতে এসেছিলেন। সেই প্রথম আপ্পাজীকে দেখলাম। এখনকার মহান শিল্পী উস্তাদ রশিদ খান তখন অনেক ছোট। আমার মনে আছে, রশিদ তানপুরা ধরেছিলেন, আর মাঝে মাঝে কণ্ঠ মেলাচ্ছিলেন গিরিজা দেবীর সঙ্গে। আশির দশকের গোড়ার দিকের কথা। প্রথমে যোগ গেয়েছিলেন। এত ভালো গেয়েছিলেন যে আমি এখনও শুনতে পাই। এটাই আমার প্রথম ওঁকে শোনা।
আমি বর্ধমানে মানুষ। পরবর্তীকালে কর্মসূত্রে কলকাতায় এসে ওঁর অনেক সান্নিধ্য পেয়েছি। বেশ কয়েক বছর আগে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুবাদে আমি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে একটি প্রজেক্টের কাজ পাই। সেই প্রজেক্ট ছিল পেডাগজি, বা শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে। সেই প্রজেক্টে ওখানকার প্রায় সমস্ত গুরুদের সঙ্গেই কথা বলার সৌভাগ্য হয়। সকলের সঙ্গে কথা বলে চেষ্টা হচ্ছিল যদি একটা সাধারণ শিক্ষাপদ্ধতির ধারণা পাওয়া যায়। আপ্পাজীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের সেখানেই শুরু। সেই সম্পর্ক অটুট ছিল একেবারে শেষ পর্যন্ত।
আমি প্রথাগতভাবে আপ্পাজীর ছাত্রী কোনওদিনই ছিলাম না। তবে বাড়িতে যাতায়াতের সুবাদে কখনও ক্লাসের সময়ে পৌঁছে গেলে উনি সব ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আমাকেও বসিয়ে নিয়েছেন। গান করিয়েছেন। ‘গানটা লিখে নেব?’ – এই প্রশ্ন করে ফেলেছি কখনও কখনও। মনে ভয়, আমি তো ওঁকে গুরুদক্ষিণা দিই না। আমার কি সেই অধিকার আছে? উনি বরাবর স্মিত হেসে আমাকে বলেছেন,– কেন লিখবে না? এতটাই স্নেহবৎসলা ছিলেন আপ্পাজী। সাধারণ দেনা-পাওনার অনেক ঊর্ধ্বে এক অনন্যসাধারণ সাধিকা।
খুব মনে পড়ছে দিল্লীর ঠুমরী উৎসবের কথা। আপ্পাজীর সঙ্গে একসঙ্গে থাকা, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা। ঘুম থেকে উঠেই আপ্পাজীর কাছে চলে আসা। সারাদিন একসঙ্গে কাটিয়ে সন্ধেয় একসঙ্গেই অনুষ্ঠানে যাওয়া, গান গাওয়া, শোনা। তারপর থাকার জায়গায় ফিরে আপ্পাজীর কথা শোনা। কার কোনটা ভালো হয়েছে, কার কোথায় আরেকটু পরিশীলন দরকার – এইসব। কী যে অসামান্য সময় কাটিয়েছিলাম! সেই সঙ্গকে গুরুসঙ্গই বলব। আপ্পাজী আমাদের মুগ্ধ করে রাখতেন তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে, আচরণে। নীরবে শেখাতেন যাপনের শীলিত রূপ। এই সময়েই আপ্পাজীর সঙ্গে হৃদ্যতার শুরু। তারপর যতবারই দেখা হয়েছে, আমি ওঁর কাছে কম যাই বলে অনুযোগ জানিয়েছেন। এতটাই স্নেহশীলা ছিলেন আপ্পাজী।
নারীত্বের যে সাবেক ধারণা আমাদের দেশে চলে, অর্থাৎ ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ – এই প্রাচীন আপ্তবাক্যের উপর আপ্পাজীর খুব ভরসা ছিল। মেয়েদের উপার্জন করার বিরোধী উনি ছিলেন না ঠিকই। বরং তাতে খুশীই হতেন। তবু চাইতেন, মেয়েরা সব করেও সংসারটা সামলাক। নিজেও ছিলেন অত্যন্ত অতিথিপরায়ণা। আমি শুনেছি, কম বয়সে, শরীরে যখন সামর্থ্য ছিল তখন, আপ্পাজী নিজের হাতে রেঁধে বেড়ে ছাত্রছাত্রী ও অতিথিদের খাইয়েছেন। উস্তাদ আলী আকবর খান সাহেবকে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন আপ্পাজী। বড় ভাই মানতেন। আর মানতেন পণ্ডিত রবিশংকরজীকেও। নিজের হাতে রান্না করে ওঁদের খাইয়েছেন বহুবার। ওঁরাও ছিলেন আপ্পাজীর ব্যঞ্জনের কদরদান। আর এতই মাটির মানুষ ছিলেন, যে নিজেই গিয়ে কেনাকাটা করে আনতে ওঁর বাধত না। আমি নিজেও দেখেছি ওঁকে, দক্ষিণাপণে কেনাকাটা করতে।
পূরব অঙ্গের ঠুমরীর শিল্পী হিসাবে বিশ্বজোড়া নাম হলেও অনেক অনুষ্ঠানেই খেয়াল দিয়ে শুরু করতেন আপ্পাজী। শেষের দিকের অনুষ্ঠানগুলিতে অবশ্য ঠুমরী দিয়েই শুরু করতেন। উনি মনে করতেন না উনি কেবল ঠুমরী, দাদরার শিল্পী। আপ্পাজী বলতেন একেবারে ছেলেবেলা থেকে তাঁর শিক্ষার কথা – শুধু ঠুমরী, দাদরা নয়, ধ্রুপদ, ধামার ও খেয়ালেও তাঁর ছিল নিবিড় শিক্ষা ও ব্যুৎপত্তি। ওঁর ক্লাসেও আমি দেখেছি, কিভাবে নিজের ছাত্রছাত্রীদের উনি খেয়ালের শিক্ষা দিতেন। গলার দানা পরিষ্কার করা, দ্রুত তানের ক্ষমতা তৈরী করা, শ্বাস নিয়ন্ত্রণের অভ্যাস, লয়কারীর ক্ষমতা – যেগুলো সাধারণত খেয়ালশিক্ষার অঙ্গ – সেগুলো আপ্পাজী তাঁর ছাত্রছাত্রীদেরও নিষ্ঠাভরে করাতেন। উনি বারবার বলতেন, খেয়ালে খুব ভালোরকম দক্ষতা না এলে ঠুমরী গায়নের প্রতি সুবিচার করা হবে না।
আপ্পাজীর কোনও একটি বিশেষত্বকে যদি তুলে ধরতে হয়, আমি বলব ওঁর ‘বোল বনাও’-এর কথা। উনি বলতেন, খেয়ালে পারদর্শিতা না থাকলে বোল বনাও ‘সহি’ হয় না।
খেয়াল যদি রাগপ্রধান হয়ে থাকে, ঠুমরীকে বলা চলে ভাবপ্রধান। খেয়ালে গানের বাণীর গুরুত্ব ততটা নয়, যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার রাগদারী। ঠুমরীতে গানের বাণীর গুরুত্ব তো আছেই, তদুপরি আছে তার সার্বিক ভাবপ্রকাশের গুরুত্ব। ঠুমরীর এই ভাবপ্রকাশই হল ‘বোল বনানা’। ধরা যাক রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ-এর বিখ্যাত রচনা ‘বাবুল মোরা’-র কথা। এই গানের কথা নিম্নরূপ –
বাবুল মোরা, নৈহর ছুটো হী যায়ে
বাবুল মোরা, নৈহর ছুটো হী যায়ে
চার কহার মিল, মোরী ডোলিয়াঁ সজাবেঁ
মোরা অপনা বেগানা ছুটো হী যায়ে…
আঙ্গনা তো পর্বত ভয়ো অওর দেহরী ভয়ো বিদেশ
জায়ে বাবুল ঘর অপনোঁ ম্যায় চলী পীয়া কে দেশ…
এই গানের তিনরকমের ব্যাখ্যা হতে পারে। প্রথমটা স্বাভাবিকভাবে একটি মেয়ের বিবাহের পর বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরালয় গমন ও তজ্জনিত বিচ্ছেদবেদনার প্রকাশ। দ্বিতীয়, মরজগতের পরিচিত অঙ্গন, বাড়ি ও স্বজনকে ছেড়ে ঈশ্বরের দিকে যাত্রা। আর তৃতীয়ত, রাজা ওয়াজিদের চিরদিনের মতো লক্ষ্ণৌ ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি। বোল বনানার উদ্দেশ্য হবে – এই তিনটি ভাবের প্রতিষ্ঠা করা। এমন সুচারুভাবে সে-কাজটি সম্পন্ন করা, যাতে তা শ্রোতাকেও সেইভাবে ভাবিত করে তোলে। গানের বাণী অপরিবর্তিত রেখে তাতে ভাবের বদল আনতে চূড়ান্ত পারঙ্গম ছিলেন আমাদের আপ্পাজী।
আপ্পাজী ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞানের সমুদ্রস্বরূপা। বিদুষী সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পর পূরব অঙ্গের সবথেকে দৃঢ় স্তম্ভ আপ্পাজীর কাছে আমরা এমন অনেক সঙ্গীতশৈলীর কথা শুনেছি যা আমরা কোনও প্রচলিত বইয়ে পাইনি। আপ্পাজী বলতেন মাথা পরমাথা, গুল গুল নক্স ইত্যাদি শৈলীর কথা। অল্প গেয়েও শোনাতেন কখনও-সখনও। কিন্তু দেড়েকষে শোনাবার আবদার করলেই বলতেন – হাঁ বেটা, উও তো থা পুরানে জমানে কী চীজ। অব কিসকো সুনায়ে, ইত্যাদি। ওঁর চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে এই একটা অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। এই সমস্ত অধুনা-অপ্রচলিত এবং বিস্মৃত গীতশৈলী একেবারে হারিয়ে গেল। আমি ভেবেছিলাম এই ধরণের লুপ্ত শৈলীগুলি নিয়ে ওঁর একটা সাক্ষাৎকার নেব, কিন্তু সে আর হয়ে উঠল না। আমার এ আক্ষেপ যাবার নয়।