রঞ্জন প্রসাদ
৯৬ বছর বয়সে চলে গেলেন হ্যারি বেলাফন্টে। আর দীর্ঘ অর্ধশতক আগে বাংলার আপামর শ্রোতাদের সঙ্গে যিনি হ্যারি বেলাফন্টের গানের প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তাঁর নাম প্রসাদ রঞ্জন দাশ, অবশ্য আমরা তাঁকে রঞ্জন প্রসাদ নামেই চিনি। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মকে নিজের স্মৃতির ভাণ্ডার উপুড় করে দিলেন এই বিদগ্ধ বর্ষীয়ান গায়ক ও ব্যালাডিয়ার।
চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম: আপনার কাছে নিশ্চয়ই এখন হ্যারি বেলাফন্টে নিয়ে লেখার বা কথা বলার জন্য অনেক অনুরোধ আসছে…
রঞ্জন প্রসাদ: ঠিক তাই। গত কয়েকদিন ধরেই আমার কাছে প্রচুর ফোন আসছে, লেখার অনুরোধ, ইন্টারভিউ, হ্যারিকে নিয়ে কিছু বলার জন্য। বেলাফন্টের প্রয়াণ হঠাৎ আমার মতো একজন বিস্মৃতপ্রায় মানুষকে ব্যস্ত করে দিয়েছে।
‘বিস্মৃতপ্রায়’ এই কথাটা কি ঠিক হল? আমাদের মতো অনেকেই যারা নয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি, তাদের কিন্তু আপনার গাওয়া বাংলা গানের মাধ্যমেই বেলাফন্টের মূল গানের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। সেই সময়টার কথা যদি কিছু বলেন…
সেই সময়টার কথা যদি বলি তোমরা অনেকেই বিশ্বাস করবে না। আমি ষাটের দশকের শেষে প্রথম এইসব গান বাংলা ভাষায় গাইতে শুরু করি। রীতিমতো ব্যালাডের মতো এইসব গান আমি রাস্তায় রাস্তায় মানুষের মাঝে গিয়ে গাইতাম। আজ আমি এত সম্মান ও প্রশংসা পাচ্ছি, তখন এইসব গান বেশি কেউ নিতে পারেনি, তরুণ সমাজের একাংশের কাছে সেসব গান জনপ্রিয় হলেও সামগ্রিকভাবে শ্রোতারা তখনও এইসব গান গ্রহণ করার মতো অবস্থায় আসেনি।
কিন্তু আপনার গাওয়া গান তো অনেক পরিচিতি পেয়েছিল, তরুণ প্রজন্ম আপনার গান শুনত, কলেজ ফেস্টেও আপনার ডাক পড়ত…
হ্যাঁ, তা হয়েছে বটে। সেটা ১৯৬৯ সাল। আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। একুশ পেরিয়ে সবে বাইশে পা দিয়েছি ও এইসব গান গাওয়া শুরু করেছি। হ্যারি বেলাফন্টের গান, পিট সিগারের গান, নিজে বাংলায় অনুবাদ করছি, সুর দিচ্ছি, গিটার বাজিয়ে গাইছি। চারিদিকে একটা সাড়া পড়ে গেছিল, নানা জায়গায় বিশেষত তরুণ প্রজন্ম আমার গান শুনতে চাইত। সত্তর দশকের মাঝামাঝি এইচএমভি আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমার গান রেকর্ড করে। প্রথম যখন ওদের স্টুডিওতে ঢুকলাম, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, ভাবছি এই সেই জায়গা কাজী নজরুল ইসলাম যেখানে কাজ করেছেন, রবীন্দ্রনাথ রেকর্ড করেছেন। পরবর্তীকালে এইচএমভি-র হাজার হাজার গানের মধ্যে থেকে শতবর্ষের সেরা গানের তালিকায় আমার গাওয়া বেলাফন্টের ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’ স্থান পেয়েছে। আমারই করা বাংলা অনুবাদে সে গান ছিল ‘পথের প্রান্তে ওই সুদূর গাঁয়ে’। তবু বলব, সাধারণভাবে বাঙালি আমার ব্যালাডের জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমার মতো কাউকেই তারা আগে কখনও দেখেনি। কলকাতা তখনও বাবু কালচারে মজে আছে। হ্যারি বেলাফন্টের গানের সুর, কথা, তাঁর যাপন এগুলো অনেকেই তখন বুঝতেও পারেননি, নিতে পারেননি।
এটা কেন হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়? এই ধরনের গান কি সময়ের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে ছিল বলেই বাঙালি নিতে পারেনি। কারণ পরবর্তীকালে মহীনের ঘোড়াগুলি থেকে শুরু করে প্রতুল মুখোপাধ্যায়, সুমন চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতির নতুন ধারার গান কিন্তু খুব জনপ্রিয় হয়েছিল…
সময়টা তো একটা বড় ফ্যাক্টর বটেই। সে সময় আমি যেরকম গান গাইছি, সেটা এঁদের সকলের আগে, আমার গান নতুন ধারার হলেও সকলের মাঝে পৌঁছনোর জন্য যে প্ল্যাটফর্ম দরকার, আমি তখন তা পাইনি। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইতাম। তরুণ প্রজন্মের একটা অংশের কাছে সেই গান গ্রহণযোগ্য হলেও বৃহত্তর সমাজের অংশ সেইসব গান নিতে পারেনি, রিফিউজ করেছিল। তারা ভাবত, গায়ক থাকবে মঞ্চে, অথবা সে প্লেব্যাক করবে, এ কেমন গায়ক যে রাস্তায় গিটার নিয়ে ঘুরে ঘুরে গান গায়! তাই আমি বৃহত্তর জনতাকে শ্রোতা হিসেবে পেলাম না৷ অনেক পরে আমার সেইসব গান আবার জনপ্রিয় হয়েছিল, তবে ততদিনে অবশ্য আমার কাজ করার সময়, নতুন কিছু করার সময় পেরিয়ে গেছে…।
হ্যারি বেলাফন্টের গানই আপনি বেছে নিয়েছিলেন কেন?
শুধু হ্যারি বেলাফন্টে কেন, আমি পিট সিগারের গানও গেয়েছি, এমনকি পল রোবসনের গানও। হ্যারি বেলাফন্টের গানের গুরু-ই ছিলেন পল রোবসন। আর বেলাফন্টের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। বেলাফন্টের গান ও তাঁর জীবন, একে অপরের চেয়ে কখনওই আলাদা ছিল না। তিনি কালো মানুষদের জীবনের লড়াইয়ে প্রথম দিন থেকেই সামিল ছিলেন, আর তাদের জীবন নিয়েই গান বেঁধেছেন, গেয়েছেন। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে গুলি খেয়েছিলেন। আর সেই মার্টিন লুথারের সহযোদ্ধা ছিলেন বেলাফন্টে। একইভাবে তাঁর গায়েও গুলি লাগতে পারত। শুধু কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অধিকারের লড়াই নয়, আজীবন প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলতে যা বোঝায়, হ্যারি ছিলেন ঠিক তাই। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় শহরে শহরে গিয়ে গান গেয়েছেন হ্যারি বেলাফন্টে। পরবর্তীকালেও যেকোনও রাষ্ট্রীয় শোষণ, অমানবিক সিদ্ধান্ত, বর্ণবৈষম্য— সবকিছু নিয়ে রাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন। কোনও সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য মুখ বন্ধ করে বসে থাকেননি। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ থেকে শুরু করে ডোনাল্ড ট্রাম্প— হ্যারি বেলাফন্টে কাউকেই রেয়াত করেননি, এই সেদিন পর্যন্ত। এইরকম একজন চরিত্র তো আজকের পৃথিবীতে একজন রূপকথার মানুষ বলে মনে হয়। আমার হ্যারি বেলাফন্টে, পিট সিগার ইত্যাদির গান বেছে নেওয়ার কারণও তাই, শোষিত মানুষের পক্ষে তাঁদের দ্বিধাহীন অবস্থান। তাঁদের গান রাজনীতিবিবর্জিত ছিল না, আর সেই রাজনীতি সবসময় শোষিত মানুষের হয়ে কথা বলেছে।
হ্যারি বেলাফন্টে প্রমুখের গান তাঁদের দর্শন নিয়ে আপনার যা যা করার পরিকল্পনা ছিল, সেগুলি কি আপনি পূর্ণ করতে পেরেছেন? নাকি কিছু অতৃপ্তি রয়ে গেছে।
অতৃপ্তি তো রয়ে যাওয়ারই কথা। আরও বেশি করে আরও কাজ করার জন্য যে উৎসাহ-উদ্দীপনা, যে প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজন ছিল, আমি তো তা কোনওদিন পাইনি। আর প্ল্যাটফর্ম পাওয়ার জন্যে নিজের গানের সঙ্গে আপস করিনি কোনওদিন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে।
যতদূর জানি প্রসাদ রঞ্জন দাশের অন্য একটি পরিচয় আছে, যা আপনার একান্ত ঘনিষ্ঠজন ছাড়া খুব বেশি লোকে জানে না।
তুমি যে পরিচয়টার কথা বলছ সেটা হল আমার একজন পূর্বপুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। আমরা বিক্রমপুরের বিখ্যাত দাশদের বংশ। আমার বাবা ও জ্যাঠামশাই সুধী রঞ্জন সম্পর্কে জ্যাঠতুতো দাদা চিত্তরঞ্জন দাশকে বড়দাদা বলেই ডাকতেন। এখানে বলে রাখি, সুধী রঞ্জন পরে ভারতের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। চিত্তরঞ্জন দাশ আমার বাবা ও জ্যাঠামশাই দুজনকেই বড় স্নেহ করতেন। আর চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে তাঁরা বড় বউঠান বলে ডাকতেন। কী সুন্দর ডাক এই ‘বউঠান’! বড় জ্যাঠামশাই চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ সালে দার্জিলিং-এ মারা যান, কিন্তু আমার বড়জ্যেম্মা বাসন্তী দেবী তারপরেও অনেকদিন, প্রায় পঞ্চাশ বছর ১৯৭৪ সাল অবধি বেঁচেছিলেন। দেশবন্ধু কোর্টে যা রোজগার করতেন বাড়ি আসার পথে প্রায় সবই দেশের কাজে বিলিয়ে দিতেন। বাড়ি এসে স্ত্রীকে বলতেন, আজ তেমন কিছু রোজগার হল না, বুঝলে? বড়জ্যেম্মা বলতেন চিন্তা কোরো না, আজ হল না, কাল নিশ্চয়ই হবে। দুজনেই জানতেন কে কী বলছেন, কে কী করছেন, কিন্তু তাঁদের দাম্পত্য কোনওদিনই তাঁদের দেশপ্রেমের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বড়জ্যেম্মার কাছে ছোটবেলায় অনেকবার গেছি। আমার সৌভাগ্য, যে হাত স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বোসের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছে, সেই হাত আমি আমার মাথাতেও পেয়েছি।
শেষ প্রশ্ন করি। হ্যারি বেলাফন্টেকে আগামী প্রজন্ম কীভাবে মনে রাখবে?
আগামী প্রজন্মের কথা আমি বলতে পারব না। নিজের কথা বলতে পারি। হ্যারি বেলাফন্টে বা পিট সিগার, এঁদের গান শুনে সেই নবীন বয়সেই আমার মনে হয়েছিল, এই গানগুলো নির্দিষ্ট কোনও দেশের সম্পত্তি নয়। গানগুলোর মধ্যে যে আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বমানবতাবোধের বার্তা রয়েছে, সেগুলো মানবসভ্যতার চিরন্তন সম্পদ। গানগুলোয় সুর আর মানবতাবোধ যেন হাতে হাত রেখে চলছে। হ্যারি বেলাফন্টের গানগুলো শুনে আমার মনে হয়েছিল এ গান শুনলে যে কোনও মানুষ অকুতোভয় হয়ে বেয়নেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি ভেবেছিলাম, আমি যদি এই গানগুলোর ভাষার সীমানাটা ভেঙে দিতে পারি, তাহলে গানের সুর ও বাণী আরও বেশি সংখ্যক মানূষের কাছে পৌঁছে যাবে। সেই ইচ্ছে থেকেই আমার ব্যালাড রচনা, আমার গান গাওয়া। হ্যারি বেলাফন্টের অসামান্য কাজকে আমি আমার দেশের আরও কিছু মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি, বাংলাভাষী মানুষের কাছে হ্যারি বেলাফন্টের গানের অমরত্বে রঞ্জন প্রসাদেরও কিছু ভূমিকা থেকে গেল, এটাই আমার কাছে পরম গৌরবের বিষয়।