নিরুপম চক্রবর্তী
সুদূর চেন্নাই থেকে একদিন শ্রীহরিহরণ
সারা ইউরোপ ঘুরে অবশেষে রায়ান এয়ারে
নাপোলি, ইতালি থেকে পৌঁছে যায় প্রাগে।
শহরে শীতের খেলা, ছোট হয়ে আসে বেলা, সামান্য বরফ পড়ে
ঠাণ্ডা লাগে বেশ।
তারমধ্যে ব্রহ্মতেজে, সুতির জামাতে সেজে
শ্রীহরিহরণ একে ভাবেনি বিদেশ!
শ্রীহরিহরণ:
ভেগান ধাবায় গিয়ে কিনে নিয়ে পোয়াটাক আলুর শিঙাড়া
ঘুরেঘুরে বেড়িয়েছে মাদ্রাজের মতো এই প্রাগ শহরের যত
পাড়া ও বেপাড়া।
নদীতে সাঁতরে গেছে কুশ্রী নিউট্রিয়া
মূষিক গোত্রের প্রাণী
কমলা রঙের দাঁত
তাদের দেখেও বুঝি হরিহরণের আজ
সে যে কী বিপুল হাত নাড়া!
আমি তার সঙ্গে গেছি পুরনো গির্জার কনসার্টে।
কেউ নেই,
অন্ধকার টেবিলেতে বাতি জ্বলে,
কে যেন উঠেছে হেসে: কীসের কনসার্ট?
কেউ নেই এইখানে, গায়কেরা নিরুদ্দেশ
তোমরা আসার আগে কনসার্ট শেষ,
তোমাদের ও টিকিট কবেই তামাদি হয়ে গেছে!
খোনা খোনা ভাঙা গলা, ক্রমাগত বেজে গেছে
আটকে যাওয়া প্রাচীন রেকর্ডে।
পুরনো ক্রিপ্ট-এ বাজে কার যেন কণ্ঠস্বর
আমরা শুনেছি সেইখানে
মৃত কিছু মানুষের গানে, হয়েছি অবাক:
গির্জার সম্মুখে গাছে, ন্যাড়া ডালে বসে আছে
দিব্যোন্মাদ নিশাচর কাক!
চলে গেছে শ্রীহরিহরণ।
জীবনের প্রতি এক অসীম বিশ্বাসে বুঝি স্মিত হেসে ছুঁয়ে গেছে
সেই রাতে, সে গাছের রিক্ত শাখাগুলি।
তারপরে আরও শীত,
আরও শীত পার হলে, তারপরে আরও আরও শীত।
তারপরে এ বসন্তে
হরিহরণের ছোঁয়া সেইসব ডালগুলি
হলুদ ফুলেতে ভরে আছে!
প্রাগ শহরের দস্তানার আখ্যান
আমার দস্তানা আমি বহুবার হারিয়েছি প্রাগ শহরেতে।
সে জাদু-দস্তানা এক: বারবার চলে যায়, অবশেষে ঠিকই ফিরে আসে।
আবার সে নিরুদ্দেশ, তাকেই খুঁজতে গিয়ে দেখি
সারসার সাইকেল ঢেকে যায় প্রাগে তুষারেতে।
পরিচিত কেউ বুঝি? অজানিত রাজপথে সাইকেল ফেলে রেখে চলে গেছে কারা?
বাংলাদ্যাইশের থিকা আতিকুর ইছলাম আইসিলো নাকি আজ? নাকি ওই কেরালার অচ্চুতনন্দন?
অথবা সে রিষড়ার স্যমন্তক পাল?
তাদের সবার পিঠে ব্যাগ। খাবারের ডেলিভারি করে।
প্রত্যেকেই ছাত্র এরা: লেখাপড়া, পার্টটাইম কাজ।
এদের তো ডানা নেই, তবু এরা স্বপ্নে থাকে স্থিত
তুষারে দাঁড়িয়ে আছে গতিহীন সাইকেলগুলি:
আজ সব স্বপ্নগুলি মৃত।
এখনও আসেনি ফিরে নিরুদ্দেশ দস্তানা আমার।
খুঁজতে খুঁজতে হাঁটি: চিহ্ন তার পড়ে আছে সমগ্র শহরে,
তুষারে আবছা হয় দৃশ্যপট, অলীক মানুষজন হাঁটে,
বাসস্টপে ছিল ওরা, আমার দস্তানাজোড়া, ঠিক আমি পৌঁছবার আগে
দস্তানা সমেত সেই বাসটিও বুঝি ছেড়ে গেছে!
তুষারেতে দানা খুঁটে খেতে থাকে নির্বিকার পায়রার ঝাঁক।
শীতেতে অকুতোভয়:
তাদের সর্বাঙ্গ জুড়ে
পালকের উষ্ণ ওম এ শীতল দিনে লেগে আছে।
দীর্ঘতর হতে থাকে নিরুদ্দেশ দস্তানা-দস্তান।
দিন কাটে।
বরফের দিন শেষ। ঘুম ভেঙে উঠে দেখি জানালায় জেগে আছে গোলাপী আকাশ।
ন্যাড়া গাছ, পাতা নেই, এ শহরে তবু আজ ‘মাসোপুস্ত’— মাংসাহারী বসন্তের ব্রত!
রাস্তার দুধারে স্টল, ঝলসানো শূকরের ঘ্রাণ,
লোলজিহ্বা খুঁজে ফেরে তাকে,
বালক-বালিকাগুলি মুখেতে মুখোশ এঁটে হাঁটে কার্নিভালে।
এ রাস্তায় ভীড় আর মিশ্র কলরব
পোগোস্টিক চড়ে হাঁটে ফ্যাচাটু সাহেব আর
হাত ধরে হাঁটে তার
বিবাহের শুভ্র সাজে, গুম্ফশ্মশ্রু সমন্বিত বধূ
(সেও পোগোস্টিকে!)
সুবিশাল রণপায়ে পড়িমরি ছুটে যায় ডেভিল স্বয়ং,
বেয়াড়া বাতাস এসে আছড়ায় শিঙে তার—
হাততালি দিয়ে হাসে সবুজ মুখোশ পরা একটি বালক আর
রামধনু পতাকায় সুসজ্জিত সঙ্গী বালিকাটি।
মাংসের উৎসব তবু ভেগানেরা দোকান খুলেছে।
দস্তানার চিহ্নমাত্র নেই।
এভাবেই কেটে যায় বেশ কিছুদিন আরও
দস্তানা খোঁজার দোলাচলে।
মুস্টেক অঞ্চলে দেখি রাস্তাজুড়ে গান গায়
পেরুদেশ থেকে আসা রুক্ষ গায়কেরা।
যুবক-যুবতী তারা, কণ্ঠস্বরে যন্ত্রণা ও ক্ষোভ,
তাদের গানের সুরে শোণিতের ফোঁটাগুলি ঝরে।
তাদের দেশেতে নাকি অত্যাচার, গড়ে ওঠে নাকি প্রতিরোধ:
শুয়ে থাকে সারিসারি প্রতিবাদী লাশ।
সঙ্গীতের সঙ্গে বয় কাঁচা খিস্তি,
ধূসর মানুষগুলি গায়—
পাহারার পুলিশেরা হেসে ওঠে তাদের গেরিলা গান শুনে।
আমি তো এসবই দেখি, কেবলই দাঁড়িয়ে এক কোণে
ওরা তো সঙ্গীত শেষে ফিরবার আয়োজন করে:
গিটার গুছিয়ে নেয়, হাতে নিয়ে স্যাক্সোফোনটিকে
লালরঙা কোট পরা পেরুভীয় গায়িকা যুবতী
আমার দিকেতে চেয়ে আচমকা দেখি হেসে ওঠে
(সে হাসি যে উপেক্ষার, সেটুকু আমার আছে জানা!)
তারপরে সর্বশক্তি দিয়ে
আকাশে সে ছুঁড়ে দ্যায়
সারা প্রাগ চষে খুঁজে ফেরা
আমার ওই হারানো দস্তানা।।
*হেডারে কোলাজের ছবিগুলি কবির তোলা
অধুনা প্রবাসী কবি অধ্যাপক নিরুপমের কবিতাগুলি আমি আজকাল কম পড়ি। কারণ কবির কবিতাগুলি তাদের নিখুঁত শব্দচয়নে, অজয় চক্রবর্তীর খেয়ালের তানকর্তবের মত impeccable ছন্দের perfection এ আমাকে কেমন এক অলিখিত বিষন্নতায় নিক্ষেপ করে। চিত্রকল্প গুলিও আমাকে প্রায়শঃই নিয়ে যায় শীতার্ত কোনো প্রান্তরে , নয় জনহীন কোনো মরু প্রদেশে।
আমি কবিতা লিখতে পারিনা, বুঝিও কম, কিন্তু নিরূপমের নিজস্ব বাতাসের কবিতাবলী আমাতে যে অনুভূতি নিয়ে আসে, সেগুলি একান্তই আন্তরিক এবং অবশ্যই ব্যক্তিগত।
চমৎকার আপনার এই প্রাগ কবিতাগুলি। সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভুগোল, মানুষ আর কাব্য –সবের সুচারু মিশেল। নিরুপময়ীয় শব্দ চয়ন এবং স্টাইল। শেষ দুটি কিস্তি এক সঙ্গে পড়লাম এবারে।