রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ও মৃণাল সেন

শুভদীপ ঘোষ

 



প্রাবন্ধিক, কবি ও সম্পাদক

 

 

 

প্রতিটি চলচ্চিত্রই রাজনৈতিক চলচ্চিত্র! এই ধরনের মতামত পূর্বেও ছিল, আজও আছে। বলা-বাহুল্য যাঁরা এই মতের পক্ষে তাঁরা যে কোনও শিল্পকলাই রাজনৈতিক, আসলে এটা বলতে চান। শাসকশ্রেণি পরিপার্শ্ব বা অবস্থা রচনা করে এবং তার বিরোধিতা করে বিরোধীপক্ষ। ফলত যে পরিস্থিতির মধ্যে একটি চলচ্চিত্র জন্ম নেয়, সেই অবস্থার অনুকূল বা প্রতিকূল হতে সেই চলচ্চিত্রটি বাধ্য। অনুকূল বা প্রতিকূল ব্যাপারটা আসলে ধরা দেয় মানুষের চেতনায় এবং এর সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্কই মনে হয় যেন বেশি সান্দ্র। কিন্তু এই চেতনার উদ্ভব হয় আমরা চাই বা না-চাই একটা রাজনৈতিক পরিসরেই। ফলত সব চলচ্চিত্রই রাজনৈতিক। আবার দর্শন, মনস্তত্ত্ব, আইন বা অর্থনীতি সব কিছুর সঙ্গেই রাজনীতির যোগ আছে এটা ঠিক, কিন্তু তাই বলে এগুলির স্বকীয় অস্তিত্বকে উপেক্ষা করাও কোনওভাবেই বিচক্ষণতার পরিচয় নয়। চলচ্চিত্র মাত্রেই রাজনৈতিক এটার উপর বেশি জোর দিলে চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য অনেক সঙ্কুচিত হয়ে যায়। সাহিত্য, সঙ্গীত, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, নৃত্য ইত্যাদির সংমিশ্রণে তৈরি নবতম চলচ্চিত্র আসলে একটি সঙ্কর শিল্পকলা। এবং বাকি সমস্ত শিল্পের মত এরও অভিপ্রায় হল স্থান-কাল-পাত্রের উপলব্ধির ভিতর দিয়ে মানুষের সৌন্দর্যবোধকে আলোড়িত করা। সব ছবিই রাজনৈতিক এই বিশেষ মতামতের মধ্যে না গিয়ে, বরং যে চলচ্চিত্রে রাজনীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিই বিষয় হিসেবে প্রধান তাকেই রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বলা উচিত এই ধরে এগোলে অবশ্যই আমাদের দেশে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের পুরোধা হিসেবে মৃণাল সেন (১৪ মে, ১৯২৩-৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮)-কেই স্মরণ করতে হয়।

কর্মব্যস্ত মৃণাল সেন

১৯৬৬ সালে কালিন্দীচরণ পানিগ্রাহীর গল্প থেকে ওড়িয়া ভাষায় নির্মিত হয় ‘মাটির মনিষ’। তিনের দশকের ওড়িশার একটি কৃষক যৌথপরিবারের সমস্যা নিয়ে লেখা এই গল্পে মৃণাল সেন পরিবর্তন নিয়ে আসেন একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে বর্তমান ও আগত যন্ত্রসভ্যতার এবং অতীতের সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার দ্বন্দ্বে স্থাপন করে। খেয়াল রাখতে হবে এ সেই সময়কার কথা যখন সারা পৃথিবীর বৌদ্ধিক-মহলে অ-মার্কসবাদী প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। ফলে ভারতীয় কৃষক পরিবারের সমস্যাকে চলচ্চিত্রে তিনিই প্রথম মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধরার চেষ্টা করেন। ‘মাটির মনিষ’-এর পূর্বে নির্মিত রাত ভোর (১৯৫৬) থেকে আকাশ কুসুম (১৯৬৫), তাঁর অরাজনৈতিক ছবির পর্ব। ১৯৬৯ সালে নির্মিত ‘ভুবন সোম’ ভারতীয় চলচ্চিত্রে কাল্ট হিসেবে স্বীকৃত। ছবির বিষয় রেলের আপাত সৎ জাঁদরেল অফিসার ভুবন সোমের ক্ষমতার নেশায় দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া। অর্থাৎ রাজনীতি এখানেও আছে এবং ছবিটির নির্মাণশৈলীর মধ্যে আছে এমন এক নতুনত্ব যা সেই সময় পর্যন্ত ভারতীয় ছবিতে পরিলক্ষিত হয়নি। অনেকে এই ছবিটিকে হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে প্রথম প্যারালাল ছবি বলে মনে করেন। ‘ভুবন সোম’ হিট করেছিল। ফিজিক্সের ছাত্র মৃণাল সেন মনে করতেন, এক—

ছবির ফর্মের যে বৈশিষ্ট্য তা নির্ভর করছে ছবিতে যে হাতিয়ার নিয়োজিত হয় তার উপর, অর্থাৎ ক্যামেরা ও সাউন্ড, যা পুরোপুরি নির্দিষ্ট ‘বাই দা ফিজিক্যাল প্রপার্টিস অফ টু ভেরি ইম্পরট্যান্ট ব্রাঞ্চেস অফ ফিজিক্স— অপটিক্স অ্যান্ড সাউন্ড… এতদিন পর্যন্ত, আমাদের দেশে গল্পকে ছবিতে বলা হত, এ যেন ছিল লিটেরারী ফর্মের ভিতর আর একটা বিশেষ স্টাইল; কিন্তু ছবিকে সেই হিসেবে দেখব কেন? সাহিত্যের সঙ্গে ঝগড়া করতে বলছি না, সাহিত্যের সঙ্গে সমঝোতা করেই, অন্য শিল্প দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েও ছবি আলাদা ভাষা হয়ে উঠবে না কেন?[1]

দুই—

ছবিতে কী বলব? চারপাশের মানুষ, পৃথিবী, নানান ঘটনা— সেগুলোর মুখোমুখি প্রতি মুহূর্তেই হচ্ছি ও রিঅ্যাক্ট করছি; রিঅ্যাক্ট করে সেটাই বলতে চাইছি আমি। তাই যে কোনও ফিল্মমেকার, অথবা অন্য যে কোনও ধরনের শিল্পী কমিটেড টু রিয়ালিটি অ্যারাউন্ড হিম্…।[2]

ভুবন সোম

ইতালির নিও-রিয়ালিজামের অন্যতম তাত্ত্বিক-চলচ্চিত্রকার সিজার জাভাত্তিনির দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত মৃণাল সেন বোঝা যায় একটা সময়ের পর সাংঘাতিকভাবে আঙ্গিক-সচেতন হয়ে পড়েছিলেন। সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের (ঋত্বিক যদিও অনেক বেশি করে রাশিয়ার কিনো-প্রাভদা অনুগামী) মতই নিও-রিয়ালিজামের মূল ভিত্তিটিকে নিজের ধারায় আত্মস্থ করে চাইছিলেন আঙ্গিকে একটা মৌলিকতা নিয়ে আসতে এবং সেই আঙ্গিক বহন করবে মার্কসীয়-ভাবনাকে। ৭১-৭২-৭৩-এর দমবন্ধ করা পরিবেশে তাই তাঁর কলকাতা ট্রিলজি অর্থাৎ ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১ ও পদাতিক বেশ আলোড়ন ফেলেছিল। সরাসরি রাজনৈতিক ছবি শুরু হয় ‘ইন্টারভিউ’ থেকেই এবং ন্যারেটিভ ফর্মকে ভেঙে ফেলার সূত্রপাতও এখানেই। ইন্টারভিউ শেষ হয় খানিক ফ্যান্টাসি-সুলভ বাতাবরণে। নায়ককে কিছু প্রশ্ন করা হয়, নায়কও নানান প্রশ্ন উত্থাপন করার সঙ্গে চারপাশে ভাঙচুর করতে থাকে। রক্তমাংসের নায়ক যেন  রূপান্তরিত হয় একটা আইডিয়াতে। ‘কলকাতা ৭১’-এর ছেলেটি দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমাকে যারা গুলি করেছে তাদের আপনারা খুঁজে বার করুন।” কে তাকে মেরেছিল ছেলেটি জানত, জানতেন পরিচালকও। ‘পদাতিক’ একটা ডিপারচার। বহু ভাগে বিভক্ত বাম-ভাবধারাগুলির উগ্র অংশে যদি প্রথম দুটি ছবিকে রাখা হয় তাহলে ‘পদাতিক’কে রাখতে হবে সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থাবান মধ্যপথের বাম-ভাবধারার সঙ্গে। ‘পদাতিক’ যেন বলতে চায় ধর্মঘট মিছিল ধরনা অব্দি ঠিক আছে কিন্তু শিক্ষা-ব্যবস্থা বানচাল বা দেশের মনিষীদের মূর্তি-ভাঙা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। উগ্র-বামপন্থীরা মৃণাল সেনকে শোধনবাদী বলা শুরু করেন। ‘পদাতিক’-এ সুমিত ও সীমা মিত্রের রসায়নকে তাদের নিজ-নিজ শ্রেণির পরিপ্রেক্ষিত থেকে সঠিকভাবে ন্যায্যতা প্রদান করা যায়নি বলেই যেন ব্যাপারটা জোর করে তেল-জল মেশানোর মত অবাস্তব হয়ে গেছে।

ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, পদাতিক

ছবিগুলির শরীরে এদিকে কীরকম এক ধরনের প্রবন্ধ-সুলভ মেজাজ। বোঝা যায় সবকিছু আগে থেকে চিত্রনাট্যে লেখা থাকে না। রাস্তায় কাজ করতে নেমে ঘটে প্রভূত ইম্প্রোভাইজেশান। কোনও আগাম অনুমোদন ছাড়াই হ্যান্ড-হেল্ড ক্যামেরায় যত্রতত্র ছবি তোলা হয়। গেরিলা ফিল্মমেকিং-এ মৃণাল সেন ছিলেন সিদ্ধহস্ত। চরিত্রগুলির কথাবার্তা, হাবভাব ইত্যাদির ভিতর দিয়ে যেন খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবে অন্তরালের ভাষ্যটিকে টেনে আনা হচ্ছে সরাসরি বিবৃতির আকারে। ঠিক এই কারণেই ‘প্রোপ্যাগান্ডা’ শব্দটি এ-সময় থেকে তাঁর ছবির সঙ্গে জুড়ে যায়। ‘প্রোপ্যাগান্ডা’ মনে হওয়া ছবিগুলির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মার্কসীয় প্রোপ্যাগান্ডার ক্ষেত্রে অসুবিধে হল যারা মার্কসবাদী নয় তাদের কাছে এই ছবিগুলির আকর্ষণ এমনিতেই অর্ধেক হয়ে যায়। বাকি অর্ধেক আকর্ষণ নির্ভর করে এই প্রোপ্যাগান্ডাকে নিয়ে বা তাকে অতিক্রম করে ছবি-গুলি নান্দনিকভাবে কতটা মনকে স্পর্শ করল তার উপর। মৃণাল সেন কিন্তু তাঁর ছবির কাঙ্ক্ষিত দর্শক হিসেবে ভেবেছিলেন—

ছবি যেহেতু অ্যাট এ লার্জ এক্সটেন্ট টেকনোলজিক্যাল পারফর্মেন্স, ছবি যেহেতু একটা স্পেশালাইজড শিল্প, তাই ছবি দেখতে গেলে বিশেষ ধরনের দর্শকই দরকার আমি মনে করি। সাদামাটা গল্পে সাদামাটাভাবে বলতে গেলে বিশেষ ধরনের দর্শক দরকার নেই, কিন্তু আমি যে ধরনের ছবি করতে চাই, সে ছবি ভাল লাগতে বা বর্জন করতে বিশেষ ধরনের দর্শক দরকার।[3]

সমাজের এক বড় অংশ মার্কসীয় ধারায় নতুন সমাজ তৈরির ভাবনায় মশগুল। ফলে নতুন সমাজের এই ভাবনাকে প্রাণ দেওয়ার জন্য মৃণাল সেন অভিলাষী চিত্রের নতুন এক ধরনের আঙ্গিক নির্মাণে। ‘ভুবন সোম’ বা কলকাতা ট্রিলজির ছবিগুলিতে চলিত চিত্রভাষার বারংবার ভাঙন আমরা দেখেছি। বিশেষ ধরনের দর্শকের চাহিদা আসলে সেই জায়গা থেকেই। কিন্তু ছবির বিষয়ের চাইতেও আঙ্গিক বা নির্মাণশৈলীর মারপ্যাঁচই যদি ছবির শেষে দর্শক চিত্তে প্রকট হয়ে থেকে যায়, তাহলে তা পরিচালকের অভিপ্রায় সিদ্ধ করে কি না এই প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশেষত মৃণাল সেন যেখানে চলচ্চিত্রকে বা অন্য যে কোনও শিল্পকেই সমাজ-পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার করা যায় বলে মনে করতেন। এ ব্যাপারে দু-ধরনের মতামতই আছে। বাম-মনস্ক দর্শককুলের বড় অংশের কাছে তাঁর ঐ সময়ের ছবি-গুলি প্রকরণ ও বিষয়ের সমতুল্যতায় প্রকৃত-অর্থে এ-দেশে নির্মিত প্রগতিশীল চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আবার একটা বড় অংশের কাছে যেমন পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে বাম-আইডিওলজির প্রতি বিরূপ মনোভাবের দরুন (সাধারণভাবে বাম-বিরোধী হতে পারে আবার বামপন্থার নামে বামদলগুলির কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ হয়েও হতে পারে) এবং তা ছাড়াও চলচ্চিত্র-হিসেবেই সর্বোপরি তাঁর ছবিগুলি কলা-কৈবল্যে দীর্ণ বলে প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ তাদের কাছে ছবিগুলি শেষপর্যন্ত কৃত্রিম ও একেবারেই হৃদয়গ্রাহী নয়। ঋত্বিক ঘটকও মার্কসবাদী মানসিকতা থেকে ছবি করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য নানা অভিযোগ থাকলেও প্রোপ্যাগান্ডার অভিযোগ তাঁর ছবি সম্পর্কে তেমনভাবে কখনওই ওঠেনি। যাবতীয় আদর্শবাদকে ছাপিয়ে তাঁর ছবিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে শাশ্বত মানবিকতা। মাক্সিম গোর্কির উপন্যাস ‘মা’ থেকে নির্মিত ভেসেভোলোদ পুডোভকিনের ১৯২৯-এর ছবি ‘মা’ যেরকম কিংবা টমাস গুতেরেজ আলেয়ার ১৯৬৮-র ছবি ‘মেমারিজ অফ আন্ডারডেভেলপমেন্ট’ যেরকম। কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না মৃণাল সেনের ছবি নিয়ে প্রোপ্যাগান্ডার বিতর্ক সেদিনও ছিল আজও আছে।

আরেকটি ব্যাপার হল, মার্কসবাদ নামক আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ থেকেই সম্ভবত তিনি ওই সময় চলচ্চিত্র-ভাষার আন্তর্জাতিকতার কথাও ভেবেছিলেন! প্রযুক্তি যেরকম দেশজ গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয় তেমনি প্রযুক্তির-শিল্প চলচ্চিত্রকেও বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদের আন্তর্জাতিকতাবাদের সঙ্গে মিশিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। ফলে প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে চলচ্চিত্রশিল্পে দেশজ বৈশিষ্ট্য ফোটাবার চেষ্টা করা উচিত এই মতের তিনি সেইসময় বিরোধিতা করেন! অর্থাৎ, বলিভিয়ার একজন যুবক তার বাস্তবতায় অংশগ্রহণ করে, হাঙ্গেরির একজন যুবক তার বাস্তবতায় অংশগ্রহণ করে আবার কলকাতার একজনও তার বাস্তবতায় অংশগ্রহণ করে, কিন্তু তিনজনেরই মনোজগতে যদি একই আন্তর্জাতিকতাবাদ থাকে তাহলে মৃণাল সেনের মতে—

ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই জাতীয় চরিত্রের আন্দাজ পাওয়া যায়, আমি তা মানতে নারাজ।

যাই হোক, একটা ব্যাপার পরিষ্কার, ‘মাটির মনিষ’ থেকে মোটামুটি ‘ওকা উরি কথা’ (১৯৭৭) পর্যন্ত তাঁর অনুসন্ধান ছিল বাইরের শত্রু চিহ্নিত করা। ১৯৭৮-র ‘পরশুরাম’-উত্তর ছবিগুলিতেও শত্রুর সন্ধান জারি ছিল কিন্তু তা বাইরের নয়, তা ভিতরের! একটি ব্যতিক্রম হল ১৯৮০ সালে নির্মিত ‘আকালের সন্ধানে’। ১৯৭৩-এ সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিটিকে বিখ্যাত ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকায় সমালোচনা করা হয়েছিল ‘চকলেট ক্রিম হাঙ্গার’ শিরোনামে। ‘আকালের সন্ধানে’ এইসব সমালোচকদের খানিকটা পরিতৃপ্ত করেছিল এবং সন্দেহ নেই ছবিটির নির্মাণশৈলীও চমকপ্রদ। ফিল্ম উইদিন ফিল্ম প্রকরণের অভিনব প্রয়োগ ছবিটি।

একদিন প্রতিদিন

১৯৭৯-র ‘একদিন প্রতিদিন’ খুবই ভাল চলেছিল। চাকুরীজীবী মেয়েটি যথা সময়ে বাড়ি ফেরে না। তার এই না ফেরাকে কেন্দ্র করে পরিবার ও সমাজের নীচতা ও স্বার্থপরতা গোটা ছবি জুড়ে উন্মোচিত হতে থাকে। মেয়েটি শেষে বাড়ি ফিরে এলেও তার কী হয়েছিল বা কীভাবে মেয়েটি রাত কাটাল তা জানানো হয় না। এমনকি পরিচালককে জিজ্ঞেস করা হলে তিনিও বলেন, “আমি জানি না মেয়েটার কী হয়েছিল!” এই নিয়ে অনেক পরে সত্যজিৎ রায় চিদানন্দ দাশগুপ্তকে একটি চিঠি লিখে সমালোচনার সুরে বলেছিলেন, ‘যদি চরিত্রের স্রষ্টা না জানে চরিত্রের সঙ্গে ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে, কী করে সে রাত কাটাচ্ছে…’ ইত্যাদি। আসলে মেয়েটির সময়মত বাড়ি না-ফেরা স্রেফ একটা উপলক্ষ মাত্র। আসল হল এর প্রতিক্রিয়ায় মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির চেহারাটা খুলে দেখানো। ফলে মেয়েটি কোথায় ছিল তা জানার তো কোনও প্রয়োজনই নেই। এটা জানতে চাওয়াটাই তো ছবিটির মূল স্পিরিটের বিরোধিতা করে। সত্যজিৎ রায় সম্ভবত এই ব্যাপারটি অতটা তলিয়ে ভাবেননি। ১৯৮৯-র ছবি ‘একদিন আচানক’-এ এক প্রৌঢ় অধ্যাপক ঝড়বৃষ্টির রাতে অন্তর্হিত হন। বিবিধ নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ভাবনা ঘুরেফিরে আসতে থাকে ছবিটিতে। ‘একদিন প্রতিদিন’-এর সঙ্গে এই ছবির বিন্যাসে মিল থাকলেও পটভূমিতে ও শৈলীতে তফাত আছে। ‘একদিন প্রতিদিন’-এর জায়গাটি যদি হয় নৈতিকতার উপর অর্থনৈতিক সমস্যার প্রভাব, তাহলে ‘একদিন আচানক’-এর প্রেক্ষিতটি হল নৈতিকতার উপর সামাজিক মূল্যবোধের প্রভাব। ‘একদিন প্রতিদিন’-এ মেয়েটি ফিরে এসেছিল কিন্তু ‘একদিন আচানক’-এ প্রৌঢ় আর ফেরেননি। লক্ষ করার বিষয় দুটি ছবিরই অভিনবত্ব হল ছবির মূল ভাবনা বিন্যস্ত হচ্ছে যখন কেন্দ্রীয় চরিত্রটি অনুপস্থিতি। মার্কসীয় বীক্ষা তথাপি অন্তঃসলিলা।

১৯৮৯-তে সত্যজিৎ নির্মিত ‘গণশত্রু’ নিয়ে আরেকটি অভিনব বিতর্ক আছে। বিশেষত ‘গণশত্রু’র শেষটি নিয়ে। Henrik Ibsen-র নাটক An enemy of the people-এ যেখানে প্রোটাগনিস্ট সম্পূর্ণ একা হয়ে গেছেন তাঁর সঙ্গে কেউ নেই, সেখানে ‘গণশত্রু’র ডাক্তারের সঙ্গে আছে ইনভেস্টিগেটিং প্রেস, প্রগতিশীল রাজনৈতিক মনোভাবাপন্ন তরুণ প্রজন্ম। আশ্চর্যের বিষয় হল, সত্যজিৎ-কৃত এই শেষটিকে মেনে নিতে পারেননি মৃণাল সেন! তাঁর মতে ইতিহাসে যুগে যুগে দেখা গেছে মানুষ যখনই কোনও সত্যের সন্ধান পেয়েছে সত্যের মুখোমুখি হয়েছে সে একা হয়ে গেছে, গ্যালিলিও থেকে জিওর্দানো ব্রুনো এর সাক্ষ্য বহন করছে, আর এটাই Henrik Ibsen-এর An enemy of the people-এর স্পিরিট। নাটকের এই শেষটি মানুষের সত্তার মর্মমূল ধরে নাড়া দেয়, তাকে অনুপ্রাণিত করে। অর্থাৎ প্রগতিশীল মার্কসবাদী মৃণাল সেন এই কথা বলছেন, ব্যক্তিমানুষের পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, সমষ্টির পক্ষে নয়! অথচ যাকে কোনওভাবেই মার্কসবাদী বলা যাবে না সেই সত্যজিৎ, Ibsen-এর যুগ আর নেই, আজ আর কেউ একা হয়ে যায় না (ইনভেস্টিগেটিং প্রেস আছে, প্রগতিশীল রাজনৈতিক মনোভাবাপন্ন তরুণ প্রজন্ম আছে) এই যুক্তিতে শেষটিকে বদলে দিয়ে সমষ্টির পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। আসলে গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় মৃণাল সেনই সঠিকভাবে Ibsen-এর সত্যটিকে কালনিরপেক্ষ বলতে চেয়েছিলেন। শৈল্পিক নৈপুণ্যে যশস্বী হলেই যে একজন প্রজ্ঞার অধিকারী হবেন তা সবসময় সত্য নয়— সত্যজিৎ ও মৃণালের আলাদা অবস্থান সেই কথাটাই আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রজ্ঞা দুর্লভ বস্তু এবং এ-ব্যাপারে বহুক্ষেত্রেই মৃণাল সেন তাঁর ব্যক্তিগত অনুরক্তির ঊর্ধ্বে উঠে এক মৌলিক অবস্থান নিতে পেরেছিলেন। আদুর গোপালাকৃষ্ণান তাই সঠিকভাবেই ভারতীয় চলচ্চিত্রের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর হিসেবে নির্দিষ্ট করেছিলেন সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালকে।


[1] সেন, মৃণাল। ‘আমি ও চলচ্চিত্র’। অন্যমনে। ১৯৭৯।
[2] পূর্বোক্ত।
[3] পূর্বোক্ত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...