কণিষ্ক চৌধুরী
প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিক্ষক
রণজিৎ গুহ তাঁর ১০১তম জন্মদিন ছোঁয়ার আগেই চলে গেলেন। সাম্রাজ্যবাদ ও এলিট জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার বিপরীতে তাঁর অবদান নিশ্চয়ই মাইলফলক হয়ে থাকবে। নানা বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও নিজেকে ভেঙেচুরে গড়ে নেওয়ার গল্পই তাঁর জীবন। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার পথপ্রদর্শক হিসেবে গোটা পৃথিবীর মানুষ তাঁকে জানে চেনে। জীবনের শেষ পর্বে কিন্তু ইতিহাসের অঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে সাহিত্য ও দর্শন চর্চায় অভিনিবেশ করেন। আর সেখানেও জন্ম দেন সার্থক সাহিত্যচর্চার, যা শুধু বিস্ময়েরই জন্ম দেবে। শেষের কথা নয়, শুরু করতে হবে গোড়ার কথা দিয়েই।
দুই.
রণজিৎ গুহর জন্ম পূর্ববঙ্গের বাখরগঞ্জের সিদ্ধকাটি গ্রামে। ২৩ মে ১৯২৩। স্বচ্ছল তালুকদার পরিবারের এই সন্তানটির একটি স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল মননশীলতা। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯৩৪-এ চলে আসেন কলকাতা শহরে। পাকাপাকিভাবে। ভর্তি হন তৎকালীন হ্যারিসন রোডের মিত্র ইনস্টিটিউশনে। বিদ্যালয় পর্ব শেষ করে ১৯৩৮-এ প্রেসিডেন্সি কলেজ। এখানে তাঁর মার্কসবাদের সঙ্গে সংযোগ। সাংগঠনিক কাজের চাপে পাঠ্য বিষয় ততটা পড়া হয়ে ওঠেনি যতটা হয়েছে মার্কসবাদ চর্চা। ফলে অনার্স ছাড়াই গ্রাজুয়েট হলেন। সেই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিখ্যাত অধ্যাপক সুশোভন সরকার কেবল পড়াতেন না, শেখাতেনও বটে। তিনি ঠিক চিনতে পেরেছিলেন এই রত্নটিকে। তাই পড়াশোনা কেবল বদ্ধ শ্রেণিকক্ষে আটকে থাকেনি। ১৯৪৬-এ রণজিৎ গুহ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ (ইতিহাস) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি সহ পাশ করেন। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী ছিলেন। সাংগঠনিক কাজের জন্যই তাঁকে আফ্রিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ঘুরতে হয়। ১৯৫৩-তে দেশে ফিরলেন। বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপক জীবনের সূত্রপাত। এ-চাকরি চলে যায় কয়েকদিনের মধ্যেই। অপরাধ একটাই— ‘কমিউনিস্ট কর্মী’।
১৯৫৬-তে জীবনে একটি বাঁক আসে। এ-সময়ের কথা বলতে গিয়ে রণজিৎ গুহ লিখেছেন:
…কমিউনিস্ট পার্টিতে দলাদলির আবহাওয়া এত বিষাক্ত হয়ে উঠছে যে বাকি জীবনটা স্বেচ্ছাবৃত দারিদ্র্যে তারই মধ্যে কাটাবার উৎসাহ আর পাই না তেমন। তবু যথাসাধ্য মাস্টারির সঙ্গে সঙ্গেই পার্টির কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু দু’দিক রক্ষা করা গেল না। হঠাৎ এক বিকেলে শুনি রাশিয়া হাঙ্গেরি আক্রমণ করেছে, সোভিয়েত ট্যাঙ্ক বুদাপেস্তের রাস্তায় টহল দিচ্ছে, প্রতিবাদী জনতার উপর গোলাগুলির হামলা চলছে। স্বাধীনতা পত্রিকার টেলিপ্রিন্টারে খবরটা স্বচক্ষে দেখে সেদিনই পার্টির সদস্যপদে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে এলুম। বহুকালের অভ্যস্ত একটা পাটাতন সরে গেল পায়ের তলা থেকে। পাছে শূন্যতায় ভরাডুবি হয় সেই আশঙ্কায় শিক্ষকতা ও গবেষণার পরিশ্রম আঁকড়ে থাকি। [১৯৫৮-৫৯-এ তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন]। অনেকটা সময় কাটে রাইটার্স বিল্ডিং-এর নথিখানায়। ভাবি দেশের কাজ যখন আমাকে দিয়ে হল না, তখন নিদেনপক্ষে বাংলার কৃষি ও কৃষকদের ইতিহাস নিয়ে কিছু লিখে আমার আধা-সামন্ত ঐতিহ্যের দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। সেই সংকল্পও যে একপ্রকার ঐতিহ্যনিষ্ঠা তা বলা বাহুল্য। কারণ, এভাবেই তো ভদ্রসন্তানগণ উনিশ শতক থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, বিবেকের সঙ্গে মোকাবিলা করে এসেছে কত না বিচিত্র গোঁজামিল দিয়ে।[1]
নিজের জীবনকথা বলতে গিয়ে কতজন মানুষ এমন আত্মসমালোচনা করতে পারেন, তা জানা নেই। উদ্ধৃত অংশের শেষ বাক্যটিই প্রমাণ করে দেয় রণজিৎ গুহর সততা ও বিনয়। এটা কেবল সাধারণ আত্মসমালোচনা নয়, প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর পরিচয়।
তিন.
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছাড়েন ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে। চলে যান ইংল্যান্ডে। পরবর্তী একুশ বছর সেখানেই কাটান। প্রথমে ম্যানচেস্টার ও পরে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭০-৭১=এ তাঁর জীবনে আবার একটি বাঁক আসে। এই সময়ে তিনি ভারতে আসেন গান্ধিকে নিয়ে গবেষণা করার লক্ষ্যে। দিল্লিতে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় কয়েকজন মাওবাদী বিপ্লবীর। এই সংযোগ তাঁকে গান্ধির উপর গবেষণা থেকে সরিয়ে কৃষক বিদ্রোহের চর্চায় প্রাণিত করে। এখানে বলে নেওয়া দরকার ১৯৭০-এর দশকে নকশালপন্থী কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের উপর যে বয়াবহ রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন চলেছিল, রণজিৎ গুহ তার তীব্র প্রতিবাদ করে ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। ২৩ জানুয়ারি ১৯৭১-এ ফ্রন্টিয়ার-এ প্রকাশিত হয় তাঁর ‘On Torture and Culture’ প্রবন্ধটি। এ ধরনের সৎসাহস খুব কম বুদ্ধিজীবীই তখন দেখাতে পেরেছিলেন।
১৯৭১-এ সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে তিনি শুরু করলেন ঔপনিবেশিক ভারতে কৃষক আন্দোলন ও কৃষক রাজনীতির উপর নিবিড় চর্চা। দশ বছর পরে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য ছাড়াই শেষ করলেন তাঁর বিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ Elementary Aspects of Peasant Insurgency in Colonial India (১৯৮৩)। এখানে তিনি বিদ্রোহী চৈতন্যজাত কর্মকাণ্ডের কাঠামোয় নিম্নবর্গের প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক ভাবনার সাধারণ লক্ষণগুলিকে চিহ্নিত করলেন। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার এটি একটি ভিত্তিপ্রস্তর। কারণ এখানেই ইতিহাসের সাম্রাজ্যবাদী ও অভিজাত (এলিট) ব্যাখ্যার বিপরীতে তলা থেকে সমাজ ও ইতিহাসকে দেখা শুরু হল। বস্তুতপক্ষে সাব-অল্টার্ন তত্ত্বের পেকে ওঠার পর্বটি ছিল ১৯৭৯-৮০-র মধ্যে। দেশি-বিদেশি নানাজনের মধ্যে এই চিন্তার প্রসার সুসংবদ্ধভাবে নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চার রথকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এর প্রকাশ ঘটে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ-এর প্রথম খণ্ডের প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। প্রথম ছটি খণ্ড রণজিৎ গুহ নিজে সম্পাদনা করেন। পরবর্তী খণ্ডগুলির সম্পাদনার দায়িত্ব ছেড়ে দেন অন্যদের হাতে।
চার.
১৯৮০-তে রণজিৎ গুহ সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে ক্যানবেরাতে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। ১৯৮৮-তে এখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৯-এ পেশাদার ইতিহাসচর্চার জগৎ থেকে পাকাপাকিভাবে বিদায় নিলেন। শুরু হল ভাষাতত্ত্ব আর দর্শন পাঠ। দর্শন মানে শুধু ইউরোপীয় নয়, অবশ্যই ভারতীয় দর্শন। এইরকমই একটা সময়ে তিনি বন্ধুদের জানিয়ে দেন আর ইংরেজিতে লিখবেন না, সবই লিখবেন বাংলায়। এর ফলে জন্ম নিল একের পর এক অসাধারণ বাংলা বই। যেমন ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রপাত’ (২০১০), ‘দয়া— রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা’ (২০১০), ‘তিন আমির কথা’ (২০১১) ইত্যাদি।
চলে গেলেন ২৮ এপ্রিল ২০২৩। রেখে গেলেন বিরাট সম্ভার। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর পথ ছিল সোজা। মার্কসবাদকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলেই মনে করতেন। তাই তাঁর প্রত্যয় ছিল মানবতায়, সমতায় ও পরিবর্তনে। তাঁকে হাজারো সালাম।
[1] রচনা সংগ্রহ ১। ২০১৯: ২২-২৩।
আরে বাহ , বহুদিন আবার রণজিৎ গুহ !
হীরক সেনগুপ্ত