শৈলেন সরকার
গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক
কুস্তিগিরদের লড়াইয়ের প্রতি সৌরভ, পিটি উষা বা অন্য অন্য খেলার খেলোয়াড়দের বা এমনকি সাধারণ মানুষ বা পাবলিকের আগ্রহহীনতা নিশ্চয়ই অবাক করেনি কাউকে। সৌরভ অবশ্যই মহম্মদ আলি বা আর্জেন্টাইন ফুটবলার লারেসা কি মার্কিন বেসবলার ডেলগ্যাডো বা পল ব্রাইটনার বা পাউলো রোসি নন।
শহুরে বাঙালির একেবারে আহ্লাদিত হওয়ার মতো খবর। সৌরভ মানে বাঙালির আইকন সৌরভ গাঙ্গুলির নিরাপত্তা আরও বাড়ল। ‘ওয়াই’ ক্যাটাগরি থেকে একেবারে ‘জেড’ ক্যাটাগরি। ব্যবস্থাপনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু এই ক’দিনে উনি বিশেষ কী এমন কাজ করলেন যে রাতারাতি তাঁর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হল বা বাঙালির আইকনের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য নিরাপত্তা বাড়ানো হল। হ্যাঁ হয় তো এমন, পাড়ার ওয়ার্ড কমিশনারও নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য যে ভাবেই হোক পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নেন। সংবাদসূত্রে জানা যাচ্ছে তার বাড়ির নিরাপত্তাও ২৪ ঘন্টার জন্য বাড়ানো হচ্ছে। আর ‘মহারাজ’ না কি প্রিন্স অব ক্যালকাটা নিজেই নাকি এই উচ্চতর পর্যায়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চেয়েছিলেন। ‘জেড’ ক্যাটাগরি নিরাপত্তার কারণে সৌরভের সঙ্গে সবসময় দু’জন বিশেষ নিরাপত্তা আধিকারিক থাকবেন। সৌরভের বাড়ি এবং তিনি যেখানে যাবেন সেখানেই এই দুই নিরাপত্তা আধিকারিক সঙ্গে যাবেন। সবসময় একটি বিশেষ গাড়ি থাকবে তাঁর সঙ্গে। ২১ মে থেকে এই বাড়তি নিরাপত্তা পাবেন সৌরভ। রাজ্য সরকারের থেকেই ‘জেড’ ক্যাটাগরি নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
আসলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মহারাজ’ সৌরভকে খুবই স্নেহ(?) করেন। গত বছর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসাবে তাঁর মেয়াদ শেষ হয়। তারপর সচিব জয় শাহকে পদে রাখা হলেও সৌরভকে আর দায়িত্বে রাখা হয়নি। সেই নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাহলে কী এমন বৈপ্লবিক কাজ করলেন সৌরভ এই ক’দিনে? গত মাস দুয়েকের মধ্যে তাঁর কাজ বলতে আইপিএল ক্রিকেটে দিল্লি ক্যাপিট্যালস দলের ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট হয়েছেন আর আর শেষ দু’ম্যাচ বাকি থাকতেই টুর্নামেন্ট থেকে নিজের টিমটি বিদায় নিয়েছে। আর, আর কিছু? হ্যাঁ, সম্প্রতি কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতির বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগিরদের প্রতি অশালীন আচরণের কারণে আন্দোলনরত কুস্তিগিরদের নিয়ে জিজ্ঞেস করায় উনি বললেন, আমি ঠিক জানি না কী হয়েছে তবে ওঁদের আন্দোলন ওঁদেরকেই লড়তে হবে। এমনকি সম্প্রতি আইপিএল-এর ম্যাচে পাছে ওঁরা মাঠে ঢুকে প্রতিবাদ প্রদর্শন করেন, তাই কুস্তিগির বজরং পুনিয়াদের মাঠে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
হ্যাঁ, ওঁদের আন্দোলন ওঁদেরকেই লড়তে হবে, কী চমৎকার কথা। মানে কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ নিয়ে তাঁর বা তাঁর মতো সেলিব্রিটিদের কোনও মাথাব্যাথা নেই। তাহলে কুস্তিগিররা কি স্পোর্টসম্যান নন? বা সৌরভ? মানে তিনি কি নিজেকে স্পোর্টসম্যানদের দলভুক্ত করতে রাজি নন? তিনি ক্রিকেটার। প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক, ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সদ্য ক্ষমতা হারানো চেয়ারম্যান। কিন্তু ক্রিকেটাররা কি স্পোর্টসম্যান নন? না, তারা অবশ্যই স্পোর্টসম্যান, কিন্তু তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি প্রমুখেরা তিনি ভিন্ন গ্রহের মানুষ। বিশেষ কোয়ালিটির মানুষ। ক্রিকেটার ছিলেন তো বটেই এ ছাড়া তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্রীড়া পরিচালক সংস্থার চেয়ারম্যান। তার ওপর তিনি – না, ছিলেন বলা যাবে না, আছেনও, একেবারে আপামর মধ্যবিত্ত বাঙালির নয়নের মণি, প্রিন্স অফ ক্যালকাটা, মহারাজা।
কিন্তু গত বিধানসভা নির্বাচনের আগের মাস কয়েকের কথা ভাবুন। এই অমিত শাহ দেখা করছেন সৌরভের সঙ্গে আবার পরের দিনই হয়তো মমতার সঙ্গে নবান্নে। বাঙালি কাঁপছে তখন। মহারাজ তাহলে কোথায়? বিজেপি না কি তৃণমূলে? বাম আমলে তিনি আবার সিপিএম মন্ত্রী প্রগতিশীল অশোক ভট্টাচার্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন। ছবি তুলেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ইদানীং একটি কাপড় কাচা সাবানের পাউডারের বিজ্ঞাপনে বলতে শোনা যাচ্ছে, আগে ব্যবহার করুন পরে পছন্দ করুন। বলছেন সৌরভ বা তাঁর মতো মানুষরাই। বিনা পয়সায় বলছেন না অবশ্য, বলছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার বিনিময়ে। তাঁরা টাকা নেন। তাঁরা টাকা নেন বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি থেকে। তাঁরা মানুষের শরীরের পক্ষে অচল খাবারকে ‘একবার খেয়ে দেখুন’ বলে একেবারে ঘরে ঘরে ঢুঁ মারেন। ঠিক যেমনভাবে আমাদের দেশের তিন পদ্মশ্রী-প্রাপ্ত রুপোলি পর্দার নায়ক দেশবাসীকে ক্ষতিকর পানমশলা খাওয়ার বিজ্ঞাপনী আবেদন জানান। তেমনই মধ্যবিত্ত মানুষজন ‘ও সৌরভ’ বলে বিগলিত চিত্তে তাঁকে স্পর্শ করার জন্য দৌড়োন।
ভাল কথা, মহিলা কুস্তিগিরদের শ্লীলতাহানির কারণে প্রতিবাদে অনশন করছেন কারা? না, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া বা বিনেশ ফোগটরা। তাঁরা রক্ত জল করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নানা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দেশের জন্য পদক জিতেছেন। সম্মান বাড়িয়েছেন দেশের। ভাল কথা, কুস্তিগিররা যে মহাশয়ের বিরুদ্ধে সরব, তাঁর কিন্তু একটি আলাদা পরিচয় আছে। তিনি ব্রিজভূষণ শরণ সিং শুধু যে কুস্তি সংস্থার সভাপতি তা নন, তিনি আবার মোদি-শাহর দল বিজেপি-র বিরাট মাপের নেতা। একেবারে আইনসভার সদস্য, পার্লামেন্ট মেম্বার। সুতরাং— । সুতরাং বিজেপি-র আর এক পার্লামেন্ট মেম্বার পি টি ঊষা এলেন। তিনিও আরেক স্পোর্টস আইকন। ৪০০ মিটার দৌড়ে অলিম্পিকে চতুর্থ হওয়া ঊষা কুস্তিগিরদের এই বিক্ষোভে দেশের সুনাম যে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বোঝাতে এলেন। অর্থাৎ বিজেপি-র দেওয়া রাজ্যসভার সদস্যতার সম্মান পাওয়ার বিনিময়ে কিছু করার চেষ্টা করতে চাইলেন। প্রতিবাদী আন্দোলনরত কুস্তিগিরদের বোঝাতে এলেন যে তাঁদের এ ধরনের ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি মানায় না। অবিলম্বে তাঁরা সরকারের ওপর ভরসা রেখে ফের মাঠে বা বাড়িতে ফিরে যান। এই পিটি ঊষা বা সৌরভরাই বলে থাকেন, ‘আগে ব্যবহার করুন, পরে পছন্দ করুন’। একবার বিজেপি দলে ভিড়লেই আপনি পরিষ্কার। একেবারে ঝকঝকে। এঁরাই বাঁচাতে আসেন স্বৈরাচারী সরকারকে, দরকারে চুপ করে থাকেন। আর সরকারও চায় এঁদের ব্যবহার করতে। কেননা সরকার এঁদের একটি ক্ষমতা নিয়ে একেবারে নিঃসংশয়, সরকার জানে এঁরা নেশাগ্রস্ত করে রাখতে পারে দেশের সাধারণ মানুষকে। সরকারের বিপজ্জনক সময় পার করাতে এঁদের ভূমিকা অপরিসীম। দরকারে ভোট চাইতে পারেন, এমনকি পারেন ভোটে দাঁড়াতেও। এঁরা নিজেদের এই জনমোহিনী ভূমিকার জন্য পুরস্কার পাবেন নানাভাবে। পি টি ঊষা বা শচিনের মতো মেম্বার হতে পারেন রাজ্যসভার, আবার রীতিমতো ব্যবসায়িক ভিত্তিতে লাভের জন্য স্কুল তৈরি করার আবদার করতে পারেন, যে স্কুলে আমার আপনার ঘরের কোনও কেউই পড়ার সুযোগ পাবে না, তবু সরকার বিনে পয়সায় বা একেবারে জলের দরে জমি দিতে গড়িমসি করলে আপনি আমিই চীৎকার করব, হ্যাঁ দেশের হয়ে ঘাম ঝড়াল যারা— ।
এদিকে ভারতের হয়ে পদক অর্জন করা কুস্তিগিরদের কথা পুলিশ শুনছে না। এফআইআর নিচ্ছে না। এত সাংঘাতিক অভিযোগ থাকা সত্বেও, এত পদকজয়ী কুস্তিগির দিনের পর দিন অনশন করতে থাকা সত্ত্বেও পুলিশ বা সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? সৌরভ-শচিনদের ছেড়ে দিন, দেশের মানুষই বা কুস্তিগিরদের পক্ষে সরব হচ্ছে না কেন? তারা তো আইপিএল-এর মাঠে বা টিভি বা মোবাইলের পর্দায় চোখ রেখে নেশায় ভরপুর। প্রশ্নটা খুবই মৌলিক। ক’ পয়সা দেয় কুস্তি? আর ক্রিকেট দেয় কত? এই একটা প্রশ্নেই পাবলিক কাত। আইপিএল ঘিরে অফিসিয়াল ব্যবসা ছেড়ে দিন স্রেফ বেসরকারি বা সরকারি নানা কায়দার জুয়া থেকে বাজারে কত কোটি কোটি টাকা ওড়ে ভাবুন! ভাল কথা, এই প্রতিবাদী কুস্তিগিররা অনশনে দিনের পর দিন না বসলে এদের নাম কে জানত বলুন তো? তা এঁরা যতই পদক জিতুন দেশের হয়ে, কিন্তু ক্রিকেটের বেলা আমরা কী দেখি? হাতে গোনা যে কটা দেশই বা খেলুক না এই খেলাটা, ভারতীয় ক্রিকেট দলে নিয়মিত প্লেয়ারদের কথা ছেড়েই দিন, গত তিন বছরে একটিও ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়নি এমনি জনা দশেক প্লেয়ারের নাম পর্যন্ত যেকোনও বাচ্চা বলে দিতে পারবে। বাজারের মাহাত্ম্য এটাই।
বিসিসিআই-এর মানে বোর্ড অফ ক্রিকেট কন্ট্রোলের নেতা কে? না জয় শাহ। জয় শাহ কে? না রাজাধিরাজ অমিত শাহের সুপুত্র। বিগত পাঁচ বছরে ভদ্রলোকের সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬০০০ গুণ। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়ছেন, ১৬০০০ গুণ। কীভাবে বৃদ্ধি পায় এত? না, এঁরা অতিমানব তো তাই। এঁদের কাছাকাছি থেকে সৌরাভরাও অতিমানব। সারাক্ষণ লাখ লাখ নয় একেবারে কোট কোটি টাকার হাতছানি। তাই কোনও ক্রিকেটারের দায় পড়েনি কুস্তিগিরদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর। এই প্রসঙ্গে আমরা বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্সার মহম্মদ আলির কথা জানি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার ভূমিকার সমালোচনা করে যিনি আমেরিকান সেনাদলে যোগ দেননি, যে কারণে জেলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। মনে পড়ছে সেদিনের ফুটবলার ওজিলের কথা। জার্মান দলের তুর্কি জার্মান প্লেয়ার জাতিবিদ্বেষের অভিযোগ তুলে দলের নিয়মিত সদস্য হয়েও অবসর নেন খেলা থেকে। ছেড়ে দেন খেলা। মনে রাখতে হবে ফুটবলে অর্থের পরিমান ক্রিকেটের চেয়ে অনেক অনেক গুণ। ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ জয় করেছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু আর্জেন্টিনার প্লেয়ার ওমর লারোসা দেখলেন স্বৈরতন্ত্রী সামরিক জুন্টা সরকার তাদের এই জয় রাজনৈতিক ফয়দার কাজে লাগাতে চাইছে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণা করলেন, তিনি খেলেছেন আর্জেন্টিনার জার্সি ও আর্জেন্টিনার জনগনের জন্য। সরকারি কোনও সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিলেন না। এই লাসেলা প্রতিবাদ করলেন সামরিক সরকারের করা বন্দিহত্যার। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে আর্জেন্টিনার সামরিক জুন্টা সরকার ৫০০০ মানুষকে রাজনৈতিক কারণে বন্দী করেছিল, তাঁদের মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র ১৫০ জন। ২০০৪ সালে মার্কিন বেসবল প্লেয়ার কার্লোস ডেলগ্যাডো ঠিক করেন আমেরিকার আফঘানিস্তান ও ইরাক আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানাতে তিনি আর ‘গড ব্লেস আমেরিকা’ গানের সময় উঠে দাঁড়াবেন না। আসছি জার্মান ফুটবলার পল ব্রাইটনারের কথায়। ১৯৭৪ সালে তিনি বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করেন। সেই তিনিই পরের বছর বিশ্বকাপ খেলবেন না বলে জানান। কারণ? না এক সুইডিশ-আর্জেন্টাইন নারী ড্যাগমার হ্যামলিন রাজনৈতিক কারণে উধাও হয়ে যান এবং তাঁকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে সরকারের কোনও আগ্রহই দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি। জার্মান ফুটবলার সেপ মেয়ের ও ইতালির পাওলো রোসিও এই কারণে অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে স্বাক্ষর করেছিলেন।
সৌরভের কথা শুনে মন খারাপ করার মানে হয় না কোনও। সারা জীবন তিনি হয় মোদি-অমিত শাহ বা বুদ্ধদেব কি মমতাকে নিয়ে ভারসাম্যের খেলা খেলে গেছেন। কুস্তিগিরদের লড়াইয়ের প্রতি সৌরভ, পিটি উষা বা অন্য অন্য খেলার খেলোয়াড়দের বা এমনকি সাধারণ মানুষ বা পাবলিকের আগ্রহহীনতা নিশ্চয়ই অবাক করেনি কাউকে। সৌরভ অবশ্যই মহম্মদ আলি বা আর্জেন্টাইন ফুটবলার লারেসা কি মার্কিন বেসবলার ডেলগ্যাডো বা পল ব্রাইটনার বা পাউলো রোসি নন। সৌরভের সময়ে আমরা অস্ট্রেলিয়ান প্লেয়ার স্টিভ ওয়াকে টিটাগড় কুষ্ঠরোগীদের মধ্যে কাজ করতে দেখেছি। আর সৌরভকে আমরা দেখেছি সমাজের এলিট শ্রেণির জন্য ব্যবসায়িক ভিত্তিতে স্কুল খোলার আবদার নিয়ে বুদ্ধদেব-মমতার কাছ থেকে জমির জন্য দরবার করতে। বা মোদি-অমিত শাহকে খুশি রাখতে তাঁর মেয়ের এনআরসি –র বিরুদ্ধে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা বিবৃতি মুছে দিতে বাধ্য করাতে। এই সৌরভকেই আমরা যখন টিভিতে বলতে শুনি ‘আগে ব্যবহার করুন, পরে পছন্দ করুন’— তখনও কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু দেখি না, কেননা সৌরভরা শহুরে পাবলিককে চেনে, সৌরভরা জানেন পাবলিক মানে ঠিক উল্টোটাই অর্থাৎ, ‘আগে পছন্দ করুন, পরে ব্যবহার করুন’, নিজেদেরকে পাবলিকের পছন্দসই করার যাবতীয় কৌশল কিন্তু সৌরভ-শচিনদের জানা। শচিন তেণ্ডুলকারের ২০২১ সালের সেই কৃষক আন্দোলনের সময়কার কৃষক আন্দোলন-বিরোধী ভূমিকা মনে আছে আমাদের? শুরু থেকে একেবারে চুপ থেকে যেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমর্থনের ঝড় উঠল অমনি তিনি জেগে উঠলেন। জেগে উঠেই মার্কিনি গায়িকা রিহানা বা সুইডিশ অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেটা থুনবার্গের বিরুদ্ধে কামান দাগা শুরু করলেন আর ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে সচেতন হতে অনুরোধ করলেন, বিদেশি চক্রান্তকারী শত্রুদের বিরুদ্ধে আহবান জানালেন এক হতে। অর্থাৎ আমাদের সেলিব্রিটিরা রাষ্ট্রশক্তির বা সরকারে থাকা শক্তিশালী দলের তাঁবেদারি করা ছাড়া অন্য কিছুই পারেন না। তাঁদের মহত্ব শুধুমাত্র খেলার মাঠেই সীমাবদ্ধ, মাঠের বাইরে তাঁদের বেশিরভাগই স্বার্থান্ধ সুবিধাভোগী সাধারণ মানুষ, সহনাগরিক এমনকি সহ-খেলোয়াড়দের প্রতি তাঁদের কোনওরকম দায়বদ্ধতা নেই। এঁরা কোনওমতেই আমাদের নায়ক হওয়ার যোগ্য নন।
যথার্থ। নিরাভরণ সত্য। এই কথাগুলো আমরা বাংলাদেশে বসে বলতে পারি না; জাতিবিদ্বেষী অভিযোগ ওঠে। সেই ১৯৯৭ সাল থেকে ক্রিকেট নিয়ে লেখালিখির কারণে সৌরভ-শচীনকে ভালো করেই চেনা আছে। গতকাল বাংলাদেশেরও এক ক্রিকেট ‘আইকন’ যে কীনা এখন সংসদ সদস্য, তিনি এক হিন্দু জমিদারের দান করা পুকুর সংস্কার করছেন এনজিওর টাকায়। নাম বদলে দিলের এস এম সুলতান দীঘি! এরা সব এক ক্ষুরে কামানো মাথা।
লেখককে টুপি-খোলা অভিনন্দন।