ধরিত্রী দিবসের আহ্বান…

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 



গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

এই পৃথিবী এক আশ্চর্য বাসস্থান। গোটা ব্রহ্মাণ্ডে এমন অপরূপ, প্রাণময় বাসভূমির কোনও জুড়ি নেই। ধরিত্রীর অস্তিত্বের সঙ্গেই আমাদের অস্তিত্ব নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। এই সম্পর্কের বন্ধনকে ছিন্ন করা মানে নিজেদেরই বিপন্ন করা

 

দাবদাহের কারণে সারারাত প্রায় নিদ্রাহীন থেকে ভোরের দিকে চোখদুটো গভীরভাবে বুজে এসেছিল। এমন সময়ে দূরাগত মাইকের শব্দে চোখ থেকে ঘুমের পর্দা সরিয়ে জেগে উঠি। ঘড়ির দিকে তাকাতেই মালুম হল বেলা বেড়েছে। মাইকের কথকতা এখন স্পষ্ট।

আজ ২২ এপ্রিল। আজ ধরিত্রী দিবস— আমাদের বাসভূমিকে রক্ষা করার শপথ গ্রহণের দিন। এক বিপন্নতার হাহাকার নিরন্তর ধ্বনিত হচ্ছে আমাদের বাসভূমিকে ঘিরে। ঘরে বিপদ এসে হানা দিলে যেমন আমরা আবাসিকরা বিপন্ন হই, তেমনই হাল আজ আমাদের। এই বিপদ এল কোথা থেকে? এই সহজসরল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখব, বারংবার আঙুল উঠছে আমাদের দিকেই। আমরাই আমাদের কৃতকর্মের সূত্রে বিপন্ন করেছি ধরিত্রীর নিয়মসূত্রগুলোকে। যে শৃঙ্খলা ধরিত্রীর সকল আবাসিকের পক্ষে পালনীয় অনুসরণীয়, সেই শৃঙ্খলাকে নস্যাৎ করে আমরা নিজেদের শ্রেষ্ঠতম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি নানান কৌশলে আর তার ফলেই বিপন্নতার হাহাকার আজ সর্বত্র ধ্বনিত হচ্ছে। এই হাহাকার দীর্ঘায়িত হওয়ার অর্থই হল আমাদের চিরবিদায়ের ক্ষণকে ত্বরান্বিত করা। যেহেতু মানুষের কৃতকর্মের ফলেই বাসভূমি ধরিত্রীর এমন শ্রীহীন রিক্ততা, সেহেতু মানুষকেই আজ আগুয়ান হতে হবে ক্ষয়ক্ষতি মেরামতের জন্য যাতে আমাদের অনন্য বাসভূমি পুনরায় তার গৌরবের আসন ফিরে পায়। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য এ কোন বাসভূমি রেখে যাচ্ছি আমরা? ধরিত্রী দিবস সেই শপথের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। বলে– একটু সচেতন হও, বিশ্ব-মানবকরা! ২২ এপ্রিল, ধরিত্রী দিবস, বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের আবাসিক মানুষের কাছে এই সচেতনতার বার্তাই পৌঁছে দিতে চায়।…

বক্তার তথ্যনিষ্ঠ, আবেগময় ভাষণের তারিফ করে কাগজ আর কলম নিয়ে বসে পড়ি ধরিত্রীকথা শোনাবার জন্য।

 

প্রথম ধরিত্রী দিবস

এ-কথা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৭০ সালের মার্কিন মুলুকের তাপদগ্ধ এপ্রিল মাসে। তখন পৃথিবীতে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য বিধিনিয়মের কোনও বালাই ছিল না। কলকারখানার উত্তুঙ্গ চিমনি থেকে কালো ধোঁয়া অবাধে অনিয়ন্ত্রিতভাবে মিশে যাচ্ছিল বাতাসে, লক্ষ লক্ষ টন কঠিন ও তরল রাসায়নিক বর্জ্য অপরিশ্রুত অবস্থায় এসে জমা হচ্ছিল নদী ও সাগরে। এমন ঘটনা যে আমাদেরই ক্ষতি করবে সে-বিষয়ে বিন্দুমাত্র হুঁশ ছিল না। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এমনটাই স্বাভাবিক, বৈধ ছিল। নালিশ জানাতে আদালতের দ্বারস্থ হবে? সে উপায়ও নেই। আদালতের হাতে প্রয়োজনীয় আইনি বিধিনিয়মের সংস্থানই ছিল না যাতে করে সে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে— না ছিল এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন অ্যাক্ট, না ছিল ক্লিন এয়ার বা ক্লিন ওয়াটার অ্যাক্ট। আদালতের তখন নিধিরাম সর্দারের অবস্থা— ঢাল, তরোয়াল ছাড়া সে দূষণকারী সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে কী করে? অথচ কিছু মানুষ বুঝতে পারছিলেন পরিবেশকে রক্ষা না করলে সমূহ বিপদ। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সরব হলেন মার্কিন সেনেটর গেলর্ড নেলসন। তিনিই প্রথম ধরিত্রী দিবস উদযাপনের কথা ঘোষণা করলেন যাতে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি একটি জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। কারণ, পৃথিবী তো একটাই। নেলসন সাহেব বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজটা সম্পন্ন করলেন। নড়েচড়ে বসল মার্কিন কংগ্রেস। এতদিন যে পরিবেশ-ভাবনা উপেক্ষার বিষয় হয়ে আড়ালে পড়েছিল, রাতারাতি তা-ই যেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঠাঁই করে নিল প্রথম ধরিত্রী দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে। সোনার কাঠির জিয়নস্পর্শে যেমন রূপকথার রাজকন্যা চোখ মেলে চায়, ঠিক তেমনই ধরিত্রী দিবসের আহ্বান আমেরিকার নাগরিক সমাজকে জাগিয়ে দিল। ২২ এপ্রিল ১৯৭৩— ২০ মিলিয়ন মার্কিন অধিবাসী পরিবেশমানের যথেচ্ছ অবনমনের বিরুদ্ধে সরব হয়ে পথে নামলেন। ইতিহাসের পাতায় সংযোজিত হল আরও একটি নতুন অধ্যায়। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান এক নতুন পরিবেশবাদী দর্শনের জন্ম দিল। নতুন চেতনার আলোয় উদ্দীপিত হল বিশ্ববাসী। প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে নয়, প্রকৃতির তন্ত্র বা অনুশাসন অনুসারে নিজেদের জীবন ও বিকাশকে পরিচালনা করাই হল এই দর্শনের সারকথা। ‘এসো, প্রকৃতির সাথে বাঁচি, প্রকৃতির মাঝে বাঁচি, প্রকৃতির মতো বাঁচি’— প্রকৃত-পরিবেশবাদী দর্শনের এই মূলকথাগুলি কিন্তু মোটেই নতুন নয়। প্রাচ্যের প্রচলিত দর্শনের মধ্যেই এমন সহাবস্থানের কথা বারংবার বলা হয়েছে। আরণ্যক পরিবেশেই মানুষের প্রথম পদচারণা। সেই অরণ্যে, ‘যে ওষধি-বনস্পতির মধ্যে প্রকৃতির প্রাণের ক্রিয়া দিনে-রাত্রে ও ঋতুতে ঋতুতে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে এবং প্রাণের লীলা নানা অপরূপ ভঙ্গিতে ধ্বনিতে ও রূপবৈচিত্র্যে নিরন্তর নূতন নূতন ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে, তারই মাঝখানে ধ্যানপরায়ণ চিত্ত নিয়ে যাঁরা ছিলেন তাঁরা নিজের চারদিকেই একটি আনন্দময় রহস্যকে সুস্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলেন।’ বিশ্বব্যাপী সঞ্চরমান বিপুল প্রাণের বৈভবকে তাঁরা নিবিড়ভাবে নিজেদের মধ্যে অনুভব করতে পারতেন। কিন্তু চিরদিন তো সমান থাকে না। প্রকৃতির নিবিড় যাপনকে অস্বীকার করে ‘আপন মানুষী সত্তার ঔদ্ধত্যে’ মানুষ যেদিন নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার উদগ্রতায় মেতে উঠল, গোল বাঁধল সেদিন থেকেই। প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে এই যে দূরে, আরও দূরে সরে যাওয়া তা আধুনিক মানুষের জীবনকে ক্রমশই বিবর্ণ, প্রাণহীন করে তুলছে। প্রকৃতির স্পর্শ ছাড়া যে মানুষের জীবন অপূর্ণ, প্রকৃতির নিঃস্বতা যে আমাদের নিরন্তর বিপন্ন করছে— তা নতুন করে উপলব্ধি করার জন্যই ধরিত্রী দিবসের আয়োজন।

 

আহ্বান, এল আহ্বান…

‘পৃথিবী আমাদের বাসভূমি, তাই এর সামগ্রিক স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখার জন্য আমাদের প্রয়াসী হতে হবে।’ প্রথমবার ধরিত্রী দিবস উদযাপনের ঠিক এক দশক পরে ১৯৮০ সালের ২২ এপ্রিল গেলর্ড নেলসন তাঁর স্বপ্ন-প্রয়াসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে আরও বলেছিলেন—

ধরিত্রী দিবস পালনের আহ্বান নিছক একটি দিবস হিসেবে দিনটিকে পালনের আহ্বান ছিল না। আমার মূল উদ্দেশ্যই ছিল পরিবেশমানের অবনমম ও নাগরিক সুরক্ষার বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আমার মনে হয়েছিল সরকারের সহযোগিতা ও সদিচ্ছা ছাড়া কোনওভাবেই পরিবেশের অবক্ষয়কে ঠেকানো সম্ভব নয়। ধরিত্রী দিবস পালনের আহ্বান মার্কিন রাজনীতির একটা বড় বাঁক। কেননা এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মার্কিন নাগরিক পথে নেমে প্রতিবাদ করেছে, উচ্চকিত কণ্ঠে দাবি জানিয়েছে উন্নয়ন আর উৎপাদন বৃদ্ধির নামে প্রকৃতির অবাধ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের। এটা একটা বড় প্রাপ্তি। ধরিত্রীর শিক্ষা আশ্চর্য সহাবস্থানের শিক্ষা। এই মহতী শিক্ষা বিস্মৃত হয়ে সবকিছু করায়ত্ত করার চেষ্টার মধ্যে এক ধরনের নীচতা প্রকাশ পায়। এমনটা চলতে থাকলে একদিন পৃথিবীর বুকে আক্ষেপ করার মতো কাউকেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। উন্নয়নের বল্গাহীন ঘোড়াকে লাগাম পরানোর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। ধরিত্রী দিবসের আহ্বান সেই কাজটাই খুব পরিশীলিত অথচ বলিষ্ঠ, দ্ব্যর্থহীনভাবে করতে পেরেছিল। আগামী পৃথিবী এই সামান্য কাজের জন্যই গেলর্ড নেলসনকে মনে রাখবে।

গেলর্ড নেলসনের আহ্বান যে নিছক আবেগপ্রসূত ছিল না তার প্রমাণ বিগত পাঁচ দশকেরও বেশি সময় (১৯৭০-২০২৩) ধরে এই ভাবনার প্রচার, প্রসার ও পরিপুষ্টিসাধন। ধরিত্রী দিবস উদযাপনের কর্মকাণ্ড আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক পরিসীমা ছাপিয়ে পৃথিবীর ১৯০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। নেলসন সাহেব চেয়েছিলেন নিজেদের আবাসভূমি সম্পর্কে জনজাগৃতি। শাসকবর্গের নজরদারিকে গুটিকয়েক চেনা ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে এনে নতুন বিষয়ভাবনার প্রতি নিবিষ্ট করতে, অবক্ষয়িত পরিবেশ পরিমণ্ডলকে সুস্থিত অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হলে চাই বিপুল অর্থের বিনিয়োগ যা সরকারি তহবিলের সাহায্য ছাড়া কখনওই সম্ভব নয়। বাস্তুতন্ত্রের নিয়মানুগ শৃঙ্খলাকে উপলব্ধি করতে না পারলে যে সমূহ বিপদ সেই সত্যটাকে বুঝতে হবে আমাদের। বুঝতে হবে প্রকৃতিতে কোনও কিছুই আকস্মিক নয়, তা দীর্ঘ কার্যকারণের ফল। আমাদের প্রত্যেকের জৈবনিক অস্তিত্ব এই শৃঙ্খলার সঙ্গে বিজড়িত। এই সম্পর্কের সখ্যতাকে অস্বীকার করা মানেই হল নিজের অস্তিত্বের প্রসঙ্গটিকে বিপন্ন করা। ধরিত্রী দিবস এই অনুশাসনের প্রতিই আমাদের জাগরুক, শ্রদ্ধাবান করে।

 

অতীতের ভাবনাপথে…

একটা দিবস উদযাপনের মধ্যেই নিহিত থাকে অনেক অনেক পরিকল্পনা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ১৯৭০ সালে যখন প্রথম এই দিনটিকে পালনের আহ্বান জানানো হল তখন তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল পরিবেশের যথেচ্ছ অপব্যবহার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আইনের বিধিনিয়ম প্রচলন করা। এই প্রত্যাশাকে জোরদার করতে গণচেতনার জাগরণের প্রয়োজন ছিল। প্রথম এই দিবসটি পালনের এক দশকের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একগুচ্ছ পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক আইন প্রণয়ন ও প্রচলন করা হল। ধরিত্রী দিবসের ভাবনা বিশ্বের মানুষজনের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করার ফলে প্রতিবছর একটি বিশেষ ভাবনা বা থিমকে সামনে রেখে দিবসটিকে উদযাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বলা বাহুল্য এই ভাবনাগুলির মাধ্যমে উদ্যোক্তা সংগঠন বর্তমান পৃথিবীর পরিবেশ সমস্যার প্রতি বৈশ্বিক নাগরিক সমাজকে সচেতন করতে চায়। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বিগত বছরগুলির থিম বা প্রধান বিষয়ভাবনার দিকে:

২০০৭: Be kind to the earth— starting from saving resources.
২০০৮: Trees please.
২০০৯: How do you get around.
২০১০: Reduce.
২০১১: Clear the air.
২০১২: Mobilize the Earth.
২০১৩: The face of the climate change.
২০১৪: Green Cities.
২০১৫: Water wonderful world
এবং Clean Earth, Green Earth.

তালিকাভুক্ত ভাবনাগুলির দিকে তাকালে বর্তমান বিশ্বের পরিবেশ সমস্যার গভীরতার বিষয়টিকে খুব সহজেই উপলব্ধি করা সম্ভব। আইনের অনুশাসনে পরিবেশের অবক্ষয়কে বেঁধে ফেলার সার্থক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে যে সম্পূর্ণ বাগে আনা যায়নি এই দীর্ঘায়িত তালিকা তারই প্রমাণ। মানুষের প্রবৃত্তির উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কখনওই সম্ভব নয়। তাই কখনও আবেদন করা হয়েছে আরও আরও সবুজায়নের প্রতি, কখনও ভোগস্পৃহা কমানোর কথা বলা হয়েছে, কখনও বা বলা হয়েছে পরিস্রুত বাতাসের কথা। বারংবার নানান ভাবনার কথা বলে চেষ্টা করা হচ্ছে এই ক্ষয়াটে পৃথিবীর বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মলাটটাকে রঙিন, বর্ণিল করে তুলতে। সাম্প্রতিক বছরগুলির বিষয়ভাবনার প্রতি একবার নজর দেওয়া যাক।

২০১৬: Trees for the Earth.
২০১৭: Environmental and Climate Literacy.
২০১৮: End Plastic Pollution.
২০১৯: Protect our Species.
২০২০: Climate Action.
২০২১: Restore our Earth.

সবুজ গাছে দেশকে ভরিয়ে তোলার আহ্বান জানানোটা খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে। গাছ থাকলে কমবে পৃথিবীর আঁচ—বাড়বে পাখপাখালি, বনের পশুরা পাবে খাদ্য, আশ্রয়ের নিরাপত্তা— কমবে খরা-বন্যার দাপট— প্রাণময় হয়ে উঠবে ধরিত্রী। এর চেয়ে উপযোগী ধরিত্রী দিবসের প্রার্থনা আর কী-ই বা হতে পারে। বিগত দুবছর, অর্থাৎ ২০২২ এবং ২০২৩-এ একই বিষয়ভাবনা বা থিমকে সামনে রেখে ধরিত্রী বাঁচাও আন্দোলনে সামিল হওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছে। গতবারের মতো এবারও ‘ইনভেস্ট ইন আওয়ার প্ল্যানেট’ এই স্লোগানটিকে সামনে রাখা হয়েছে। এখানে ইনভেস্ট শব্দটির গূঢ়ার্থ কেবল আর্থিক বিনিয়োগ নয়, বিশ্বের প্রতিটি নাগরিকের কাছে তাদের শ্রম, ভালবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে এই অনন্য বাসভূমিকের রক্ষা করার জন্য। এ-কথা অস্বীকার করার তো কোনও উপায় নেই যে মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের ফলেই আমাদের ধরিত্রীর আজ এমন বিপদাপন্ন পরিস্থিতি। উদগ্র ভোগতৃষার তাড়নায় আমরা আমাদের বাসভূমির আনাচকানাচ তছনছ করে ফেলেছি। যে প্রাকৃতিক তন্ত্রগুলি আমাদের নিরাপদ রেখেছে এতকাল সেই তন্ত্রগুলি আজ সম্পূর্ণভাবে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। তাদের প্রাকৃত শৃঙ্খলাকে পুনঃসংস্থাপিত না করতে পারলেও কিছুটা মেরামত করা তো সম্ভব। এই কাজটাও যে খুব সহজ তা নয়। আর এজন্যই চাই সেবাপরায়ণ বিনম্র মানসিকতা। এই একাগ্রচিত্ততাই বিনিয়োগ করতে হবে আমাদের প্রিয় আবাসভূমির শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য, প্রাণময়তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আর্থ ডে উদযাপন সংস্থার সভানেত্রী ক্যাথলিন রজার্স তাঁর অভিভাষণে সমগ্র বিশ্ববাসীকে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন:

২০২৪ সালে আমরা আবার সমবেত হব এই ধরিত্রীর পুনঃসংগঠনে। এই কাজে সমস্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় পরিচালকবৃন্দ তথা সরকার এবং বৃহত্তর নাগরিক সমাজের প্রতিটি মানুষ সমানভাবে দায়বদ্ধ থাকবেন যাতে আমরা ঘনায়মান জলবায়ু সঙ্কটের অন্ধকার ছায়াকে কাটিয়ে এক সবুজ, সমৃদ্ধশালী এবং সমতাপূর্ণ ভাবী পৃথিবীর প্রতিষ্ঠা করতে পারি পৃথিবীর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আজকের এই আহ্বান একটা স্ফুলিঙ্গ হয়ে অসংখ্য আলোকভাবনায় উদ্দীপ্ত করুক আমাদের। এ এক লড়াই, এক মহাসংগ্রাম। এই যুদ্ধে আমরা আজ হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামিল হব যাতে করে পৃথিবীর ভাবী নাগরিকরা এক সুস্থিত সবুজ পৃথিবীতে বুকভরা শ্বাস নিয়ে সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকতে পারে। আসুন, এই কর্মকাণ্ডে আপনার সুচেতনা, সুভাবনা, সুকর্মপ্রয়াস বিনিয়োগ করুন।

এই পৃথিবী এক আশ্চর্য বাসস্থান। গোটা ব্রহ্মাণ্ডে এমন অপরূপ, প্রাণময় বাসভূমির কোনও জুড়ি নেই। ধরিত্রীর অস্তিত্বের সঙ্গেই আমাদের অস্তিত্ব নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। এই সম্পর্কের বন্ধনকে ছিন্ন করাই মানে নিজেদের বিপন্ন করা। তাই ধরিত্রী দিবসের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। আমাদের বাসস্থান নির্মল, পরিচ্ছন্ন, পরিপূর্ণ থাকলে আমরাও যে তার প্রসাদ পাব। মায়ের আঁচল ভরা থাকলে সংসারে সুখ আর সমৃদ্ধি উপচে পড়ে। নিজেদের আখের গোছাতে গিয়ে আমরা মায়ের আঁচল শূন্য করে ফেলেছি। এবার যে তাকে পূর্ণ করার ডাক এসেছে। সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে আমরা কি পারি?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4881 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. এমন গভীর জ্ঞান এবং মূল্যবান তথ্য এত সহজ ও যত্ন করে বোঝানোর কঠিন কাজটা সফল করার জন্য লেখককে কুর্নিশ।

  2. দারুন লেখা আজকের এই ধরিত্রী দিবসে। মানুষ সচেতন হোক, শুভবুদ্ধির উদয় হোক, পৃথিবী বাঁচুক, আমরাও বাঁচি।

  3. আজকের এই বিশেষ দিনটিতে লেখাটা পড়ে ফেললাম। যদিও গত বছরেই এই লেখাটি প্ল্যাটফর্মের পাতায় প্রকাশিত হয়েছে তথাপি একবছর পরেও এর প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র কমেনি বরং আরও বেড়েছে। আর কবে আমাদের সচেতনতা সৃষ্টি হবে ?

আপনার মতামত...