সুমন কল্যাণ মৌলিক
প্রাবন্ধিক, শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী
মেধাতালিকায় থাকা মুসলমান নামগুলিকে পরিকল্পিত আক্রমণ এক বৃহত্তর আক্রমণের অংশ। এই বিদ্বেষের সংস্কৃতিকে হারাতে প্রয়োজন এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধা। প্রগতিশীল সংস্কৃতির মোড়কে যে গণবিচ্ছিন্ন, আপসকামী, শ্রেণিরাজনীতিহীন, উন্নাসিক কলাকৈবল্যবাদের চর্চা আমরা করে এসেছি তাকে বিসর্জন দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতির নতুন ভাষ্য নির্মাণ না করতে পারলে বিদ্বেষের রাজনীতির কাছে আমাদের পরাজয় নিশ্চিত
এখন ফল প্রকাশের মরশুম। মাধ্যমিক হোক বা উচ্চমাধ্যমিক মায় দিল্লি বোর্ডের পরীক্ষা— প্রকাশিত হচ্ছে মেধাতালিকা, কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের গল্প। সেই গল্পের মধ্যে মিশে থাকে প্রতিকূলতাকে জয় করার নানান ছোটখাটো কাহিনি। মিডিয়ার দৌলতে আমাদের ড্রইংরুম পর্যন্ত পৌঁছে যায় সেই খবর। সাধারণভাবে কৃতীদের আলাপন হয় চেনা গঁতে বাঁধা। হঠাৎ করে কোনও ছকভাঙা উত্তর আমাদের চমকিত করে, ব্যস এই পর্যন্ত। কিন্তু আজকাল সোশাল মিডিয়ায় সেই মেধাতালিকায় যদি কোন মুসলমানের নাম থাকে তাহলে ছবিটা মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যেতে সময় লাগে না। অভিনন্দন, বড় হও, মানুষ হও, আগামী জীবনে সাফল্য কামনা করি মার্কা সুশীল সুবচনীর বদলে জায়গা করে নেয় নিরবচ্ছিন্ন ঘৃণার লাভাস্রোত। বলবার অপেক্ষা রাখে না যে এইসব মন্তব্য যারা করছেন, ধর্মপরিচয়ে তারা হিন্দু, প্রোফাইল ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী শিক্ষিত। মোটের উপর তাদের ঘৃণাভাষণ একরকম। একজন লিখেছেন এত ভাল রেজাল্ট করে কী হবে, হবে তো সেই সন্ত্রাসী। একজনের চিন্তা যত মেধাবী, তত কুশলী বোমা বাঁধার কারিগর হওয়ার সম্ভাবনা। একটা বড় অংশের মতে মুসলমান শিক্ষার্থীদের এই ধরনের ভাল রেজাল্ট অসম্ভব, সংখ্যালঘু ভোট নিশ্চিত করতে এইসব করানো হচ্ছে। উদাহরণের তালিকা দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই, আসলে এটাই পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশের ছবি।
একটা কারণে অবশ্য সোশাল মিডিয়ার ধন্যবাদ প্রাপ্য। উদারবাদী, যুক্তিবাদী, আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি মধ্যবিত্তের যে ছবি আমরা বছরের পর বছর নির্মাণ করেছি তা যে কতটা ফাঁপা, শূন্যগর্ভ তা প্রমাণ করে দিল এই বিদ্বেষের নীল বর্ণমালা।
ঘৃণার সংস্কৃতির এই উদগ্র প্রকাশ আমাদের গালেও এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। আমরা অর্থে যারা বিশ্বাস করি এইসব ধর্মের প্রতি ঘৃণা, জাতপাতের রাজনীতি আসলে গোবলয়ের সংস্কৃতি, আমরা জারা হাটকে। আমরা যারা বছরে দু-একবার নিয়ম করে উচ্চারণ করি বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি/বুঝে নিক দুর্বৃত্ত, যারা বাপ-ঠাকুরদার আমল থেকে ঘাড়ে পাউডার দিয়ে, আনকোরা পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে পাড়ার ক্লাবে ‘রসুন’ উৎসব (রবীন্দ্র-সুকান্ত-নজরুল) পালন করে ভাবি বেশ একটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পালন করা হল— এ চপেটাঘাত আমাদের সবার জন্য।
আমরা বড় মুখ করে আমাদের নিয়ে একটা সাংস্কৃতিক কাঠামো তৈরি করেছি। সত্যজিৎ-মৃণাল সেনের সিনেমার অলৌকিক কোনও দৃশ্য নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক করা, শঙ্খ ঘোষের কোনও স্বপ্নতাড়িত কবিতা নিয়ে কফি হাউসে চায়ের কাপে তুফান তোলা, বার্তোলুচি বা গোদার-এর কোনও সিনেমার জন্য রাত জেগে লাইন দেওয়াকে আমরা যতই আমাদের সংস্কৃতির অভিজ্ঞান ভাবি না কেন তা আসলে গুটিকয়েক মানুষের সংস্কৃতি। আমবাঙালির তাতে কিছুই এসে যায়নি। শ্রেণিবোধহীন, ইতিহাস-অচেতন আমরা তা দেখলেও তার গুরুত্ব উপলব্ধি করিনি। না হলে আমরা দেখতাম ‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান কারণ ইহা সত্য’ সাইনবোর্ডের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে পাড়ার মোড়ে মোড়ে তৈরি হওয়া শনিমন্দির। বিজ্ঞান জাঠাকে কয়েক যোজন পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে ‘ভোলে বাবা পার করে গা’-র যৌবনদীপ্ত মিছিল।
পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি চরিত্রগত ভাবে প্রগতিশীল ও বামমনস্ক— এটা বস্তুত একটা মিথ। গণসংস্কৃতির উপর বাম সংস্কৃতির প্রভাব কখনও নির্ধারক ছিল না। তেভাগা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, ভিয়েতনামের পক্ষে মিছিল, নকশালবাড়ির ঐতিহাসিক লড়াই, দীর্ঘকালীন সংসদীয় বামশাসন রাজনৈতিক পাটিগণিতে বামমার্গিতাকে শক্তিশালী করলেও, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তা কখনও প্রগতিশীল জীবনবোধকে শক্তিশালী করেনি। বরং ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে প্রতিক্রিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে মেনে নেওয়া হয়েছে। বিপত্তারিণীর লাল তাগা আর লড়াইয়ের লাল পতাকা অবৈরিতামূলক সম্পর্ক বলে আমরা মেনে নিয়েছি।
আমরা যতই সহাবস্থানের কথা বলি না কেন, দ্বন্দ্ব তত্ত্ব মেনে প্রতিক্রিয়ার পাল্লা ভারি হয়েছে। লখিন্দরের বাসরঘরে অনায়াসে প্রবেশ করেছে কালনাগিনী। আপাতত শান্তিকল্যাণের চাদর সরিয়ে কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ফণা মাথা তুলেছে সুযোগ পেলেই, গণেশের দুধ খাওয়ানো হোক বা রামমন্দিরের জন্য ইট বয়ে নিয়ে যাওয়া। আমরা যতই অস্বীকার করি না কেন, জমি প্রস্তুত ছিলই, ঘৃণার রাজনীতির বীজ বপণ ছিল সময়ের অপেক্ষা।
এই প্রেক্ষাপটে সংঘ পরিবারের মুসলমানদের ‘অপর’ বানানোর প্রকল্পের শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে এ রাজ্যে বেশি সময় লাগেনি, বিশেষ করে পরিবর্তনের জমানায় বিদ্বেষের সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। একথা বোধহয় কেউ অস্বীকার করবে না যে বরাবরই এ রাজ্যেও সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর সংস্কৃতি কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে পৃথক ধারায় বহমান ছিল। যদিও এখনকার মতো তা যুযুধান দু পক্ষ ছিল না। আমাদের যাপিত সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস, উৎসব ছিল ধর্মীয় পরিচিতিনির্ভর। মূলধারার বাংলা সাহিত্য, নাটক, সিনেমা বা গানে মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল নামমাত্র। ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন মহানগর হোক বা শহর-আধাশহর, হিন্দুবাড়ি বা আবাসনে গত পঁচিশ বছরে মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয় না।
বিজেপিকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় আসা ঠেকানোর আনন্দে আমরা নিজেদের পিঠ চাপড়েছি, কিন্তু তাতে মোহন ভাগবতদের এরাজ্যে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের কার্যক্রম চালাতে অসুবিধা হয়নি। তৃণমূল সরকারের প্রতিযোগিতামূলক ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্গাপূজা, ইফতার, পুরোহিত-ইমাম ভাতা, গঙ্গার ঘাটে আরতি, করদাতাদের পয়সায় মন্দির। এই পরিমণ্ডলে বিদ্বেষের অনুশীলন আরও জোরদার হয়েছে রামনবমীর আক্রমণাত্মক মিছিলে। একটু নজর করলে দেখা যায় হনুমানের চিরাচরিত ছবির বদলে এ রাজ্যের বেশিরভাগ গাড়ির পেছনে এখন রোষকষায়িত হনুমানের মুখ। আর এই আগ্রাসী হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে কোনও সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিতে না পারার কারণে সংখ্যালঘুরাও এক মৌলবাদী সংস্কৃতির চোরাগলিতে হারিয়ে যাচ্ছেন।
ইন্টারনেট ও সোশাল মিডিয়া শাসিত এই সময়ে আইটি সেলের পরিকল্পিত আগ্রাসনের ফল দেশের অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ফলেছে। কাশ্মির ফাইলস বা কেরালা স্টোরির অনেক আগে থেকেই বলিউডি সিনেমায় খলনায়ক মানেই সীমান্তপারের মুসলমান সন্ত্রাসী বা তাদের এদেশীয় এজেন্ট। এই সর্বভারতীয় মডেলের বাইরেও বাংলাদেশ ও এ-রাজ্যে হিন্দুরা বিপন্ন— এই ধরনের হাজার হাজার গল্প প্রতিদিন ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সোশাল মিডিয়ায় পেশাদারি দক্ষতায়। অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক মিলের প্রশ্নটা যাতে আজকের হিন্দু বাঙালিদের প্রভাবিত করতে না পারে তার জন্য বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে মুসলমানি সংস্কৃতি প্রতিপন্ন করার লাগাতার প্রয়াস জারি রয়েছে। সত্যি কথা বলতে গেলে সংঘ-পরিকল্পিত ও নির্দেশিত সাংস্কৃতিক আচরণ আজ মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালিদের একটা বড় অংশ গুরুবাক্য বলে মেনে নিয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হল শুধু সংখ্যালঘুদের গালিগালাজ করে এই ঘৃণার রাজনীতির শেষ হবে না। মনুসংহিতার আদর্শপুষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি তফসিলি জাতি ও উপজাতির মানুষদেরও ছেড়ে কথা বলবে না। গোবলয়ের হিংস্র জাতপাতের রাজনীতির মতো না হলেও পরিশীলিত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র ও উচ্চবর্ণের দাপট এরাজ্যের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোয় কম নয়। এসসি-এসটিদের সোনার চাঁদ, সোনার টুকরো বা কোটার মাল বলতে অভ্যস্ত আমরা। রণজিৎ গুহের নিম্নবর্গের ইতিহাসের প্রশংসা ও সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের পদবি দেখে তার ভালমন্দ নির্ধারণ এক নিঃশ্বাসে করতে পারি আমরা। এবছর উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম স্থানাধিকারীর পদবি দেখে চায়ের দোকানে মধ্যবিত্ত বাঙালিবাবুর প্রতিক্রিয়া: দেখেছ আজকাল ‘কাস্ট’রা কতটা উন্নতি করেছে! তাই আক্রমণের লক্ষ্য হিসাবে নতুন টার্গেট খুঁজে নিতে সময় লাগবে না।
একুশের নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় হলেও এরাজ্যে সংঘের শাখা বৃদ্ধি করতে সমস্যা হয়নি। এই অবিমিশ্র ঘৃণার কারণে আজ রাজ্যের বহু জায়গায় সামান্য প্ররোচনা পেলেই দাঙ্গাপরিস্থিতি শুরু হতে পারে। একটা সময়ে আমরা বুক বাজিয়ে বলতাম শ্রমিকশ্রেণি যেহেতু অগ্রবর্তী বাহিনি তাই তাদের দিয়ে দাঙ্গা করানো সম্ভব নয়। আমরা গর্বিত ছিলাম এ রাজ্যের সমন্বয়ী সংস্কৃতি নিয়ে। আজ সেসব অতীত। সাম্প্রতিক সময়ে এরাজ্যের যে সমস্ত জায়গায় দাঙ্গাপরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেমন আসানসোল, সালকিয়া, নৈহাটি, ভাটপাড়া, জগদ্দল, চন্দননগর, রিষড়া— সবই কিন্তু শ্রমিক অধ্যুষিত ও মিশ্র সংস্কৃতির। এরাজ্যের যে সমস্ত ছোট ছোট সংগঠন এই সমস্ত সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে কাজ করছেন তাদের প্রতিবেদনগুলি থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। মেধাতালিকায় থাকা মুসলমান নামগুলিকে পরিকল্পিত আক্রমণ এক বৃহত্তর আক্রমণের অংশ। এই বিদ্বেষের সংস্কৃতিকে সংসদীয় নির্বাচনী পাটিগণিতে হারানো সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন এক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধা। প্রগতিশীল সংস্কৃতির মোড়কে যে গণবিচ্ছিন্ন, আপসকামী, শ্রেণিরাজনীতিহীন, উন্নাসিক কলাকৈবল্যবাদের চর্চা আমরা করে এসেছি তাকে বিসর্জন দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতির নতুন ভাষ্য নির্মাণ না করতে পারলে বিদ্বেষের রাজনীতির কাছে আমাদের পরাজয় নিশ্চিত।
*মতামত ব্যক্তিগত
কাজী নজ্রুল ইসলাম প্রচুর ‘হিন্দু’ ও ধার্মিক গান লিখেছেন, যা নিয়ে আমরা গর্ব করি। অনেক গান আমাদের মুখে-মুখে ঘোরে। নজরুল অনেক ‘মুসলমানী’ গানও লিখেছেন। আমরা কটা জানি বা মনে রাখি? এই হিপক্রেসীর কারণ হিন্দুদের সবায়ের ওপরে থাকার মনোভাব। খ্রিস্টানরা বোধহয় তার থেকে বাদ – কারণ আমরা তাদের সবাইকে সাদা চামড়ার মনে করি।