তিস্তা চক্রবর্তী
বিপাশাদি,
এখানে এখন মেপল পাতায়-পাতায় মোড়ানো সোনালি সড়ক। তোমার ওখানে হলদে রাধাচূড়া। অচেনা বসন্ত পেরোচ্ছি ভীষণ মনকেমনের ঝিল বুকে নিয়ে। বিকেলবেলাগুলো ভানুদার তেলেভাজার গন্ধ বয়ে আনে আজও। সঙ্গে জেঠির সেই কালোজিরে আর শুকনোলঙ্কা দিয়ে ভাজা মুড়ি। তুমি এখনও ওরকমই ঝাল খাও? জেঠুকে কী ভয় পেতাম! দেখলেই মনে হত এই বুঝি কেসি নাগ দিয়ে বসিয়ে দেবে দশখানা অঙ্ক কষতে। লুকিয়ে লুকিয়ে চিলেকোঠার ঘরে আচমকা খুঁজে পাওয়া ‘লোলিটা’ আর বাবার পকেট ঝেড়ে আনা ক্যাপস্টানে নিষিদ্ধ টান ভাগাভাগি… এখন মহার্ঘ্য মার্লবরোতেও সে আমেজ আর কই? তা এখনও মাঝেমাঝে ফুকফুক টানো, নাকি বয়সের ভারে গিন্নি হয়েছ খুব? আচ্ছা, কবিতা লেখো এখনও? ওই পাগলটা আজও লেখে… পড়ো হয়তো। শুধু উত্তর দাও না আগের মতো কবিতায়। গতকাল রাতে একখানা লিখেছে। দাঁড়াও, পড়াই তোমায়…
তারপর তুমি রোজকার মতো
আমার বাসি কপালে
ঠোঁট রাখলে।
ক্যামেরা থেকে অনেক দূরে
এসব সহজ ছায়াছবি—
আমি অ্যালার্ম বন্ধ করে
আরেকটু শুয়ে থাকি…
অতীত চুমুর কাছে
বিপাশাদি, ‘অরণি’ মানে জানো তো… ধূপ। আজও ছাই হয়ে পুড়ছে ছেলেটা একবুক অন্ধকার খাদ জমিয়ে রেখে। অনেকবার বলেছি তোমায় ভুলে যেতে, সম্ভব নয় জেনেও বলেছি। হেসে প্রতিবারই বলেছে, ‘অ’ মানে ‘না’। চিনার পার্কের ওই ছাইরঙা সিমেন্টের বেঞ্চটা ছাড়া আমাদের স্বপ্নে আর কিছুই বেঁচে নেই। একদিন এসে বসব দুজনেই আগের মতো। মাঝখানের জায়গাটা ফাঁকাই থাকবে। যদি পারো তাহলে… আসবে?
আসি আজ। কর্মব্যস্ত প্রহরের চাবুক। অবসরের অপেক্ষায় আছি দুজনেই। কাঁধে মাথা রাখতে দেবে তো?
খুব ভালবেসে,
অত্রি
বিছানা জুড়ে আজ মনখারাপ মেলে বসেছেন বিপাশা। বাইরে বারান্দায় বসে ঝিল্লি আর বুবকা নিমন্ত্রিতদের লিস্ট ফাইনাল করতে ব্যস্ত। টেবিলের ওপর স্তূপাকারে রাখা শ্রাদ্ধের কার্ড। পিউ সেগুলো একটা একটা করে খামে ভরছে।
আজ শুক্রবার। সোমবার রাতে একটা বড়সড় কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে বিপাশার স্বামী শাম্ব চলে গেছেন।
যেকোনও মৃত্যুর পর শোকের আবহ আঁশটে একটা গন্ধের মতো বাড়ির হাওয়ায় লেগে থাকে দিন কয়েক। তারপর আবার রুম ফ্রেশনারের সৌরভে, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা পরিচিত ফোড়নে, পছন্দের তেল-সাবান-পারফিউমে বা ঠাকুরঘরের ধূপ-চন্দনে সব আগের মতো হয়ে যায় দিব্যি। এই বাড়িতে এখন সেই আঁশটে গন্ধটা লেগে রয়েছে খুব। বিপাশার গা গুলিয়ে ওঠে।
এই শোক তার ব্যক্তিগত নয়।
সারাটা জীবন একটা নেশাচ্ছন্ন গলা, একগাল নরম দাড়ি আর তারছেঁড়া শব্দের মতোই গভীর অথচ নিস্পৃহ দুটো চোখ বিপাশাকে অন্য কোনও অনুভূতির কাছাকাছি আসতে দেয়নি। জমিয়ে রেখেছে সে সব। প্রতিটা শব্দ। স্পর্শ। স্বপ্নের মতো। সামান্য অগোছালো সময় সব হিসেব বদলে দিয়ে চলে যায় নির্মম হাতে। একগলা বিষাদ আগলে থাকাই কি জীবন?
—মা, তোমার সঙ্গে একটু আলোচনা ছিল কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে।
বুবকা বিছানার দিকে তাকিয়ে খানিক বিরক্ত গলাতেই বলে বিপাশাকে। আবার সেই সাতকাহন মেলে বসেছে মা! জন্মের পর থেকেই মা-কে এইসব ছবি-চিঠি-ডাইরি যক্ষের ধনের মতো আগলাতে দেখেছে তারা দুই ভাইবোন। অত্রিমামার কথা মামামামীদের মুখ থেকে কিছুটা জানতে পারলেও এই আরেকজনের কথা জিজ্ঞেস করলেই বরাবর গম্ভীর হয়ে পাশ কাটিয়ে গেছে সবাই। বাবার সঙ্গে মায়ের দূরত্ব দেখেই বড় হয়েছে বুবকা আর ঝিল্লি। সম্ভবত এই লোকটার জন্যই সেই অভেদ্য দেওয়াল। বাবা-মায়ের মধ্যে চূড়ান্ত অমিল ছিল শুরু থেকেই। তবু এই লোকটাকে বুবকা মানতে পারে না। এই লোকটার শব্দ ছুঁয়ে মা রাতের পর রাত ভুলে যেত আলো নেভানো হয়নি বারান্দার, ভুলে যেত ঠাকুমাকে প্রেশারের ওষুধ খাওয়ানো বাকি, ভুলে যেত ব্যাঙ্কের পাসবই রয়ে গেছে তোষকের নিচে… আরও কত কী যে ভুলে যেত মা, শুধু এই লোকটাকে ভালবেসে। অত্রিমামার বন্ধু ছিল এই লোকটা। এটুকুই জানে সে। ভাল লাগে না তার একদম। মা কেন অন্য একটা লোককে ভালবাসবে!
—বল কী বলবি… পিউ একটু চা করে নিয়ে আয় তো। আর হ্যাঁ, আদা দিস খানিক, গলাটা খুসখুস করছে কেমন যেন।
একটা ঘিয়ে রঙের কমলা পাড় কোটকি শাড়ি আর খোলা চুলে মাকে আগের মতোই সুন্দর ভরাট দেখাচ্ছে। প্রসাধন নেই, অথচ খুব রুচিশীল গয়না, সুগন্ধি, রিস্টওয়াচ বলছে এই বিচ্ছেদের জন্য মা এতটুকু ক্লান্ত নয়। খুব যত্নে গুছিয়ে রাখছে তার রাজ্যপাট আলমারির লকারে। ঝিল্লি জানে ওখানে কখনও কোনও টাকাপয়সা রাখেনি বিপাশা। শুধু কিছু হলদে হয়ে যাওয়া সময় বাঁচিয়ে রেখেছে, অতি সন্তর্পণে।
—দেখো আত্মীয়স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী সব মিলিয়ে প্রায় শ-তিনেক লোক। কাজের দিন কী মেনু হবে তাও ক্যাটারারকে বলে দিয়েছি। কিন্তু পুরোহিতমশাই যে তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছেন। মানে নিয়মকানুনের ব্যাপারে আর কী, তুমি তো বলতে গেলে প্রায় কিছুই মানছ না… এটা নিয়ে নিজেদের লোকজনেরা অলরেডি অনেক কথা বলছে, কানাঘুষোয় শুনছি সবই। কটা দিন কি তুমি পারতে না একটু মানিয়ে নিতে?
বিপাশা হাসলেন। বললেন—
—তুমি করছ তো সব নিয়ম পালন। আমার কোনওদিনই এইসব আচারবিচারে তেমন বিশ্বাস নেই, জানো তো তোমরা। জোর করছ কেন তবে? আমি এসবের মধ্যে নেই। তোমরা যেমন ভাল বোঝো করো।
—য়ু আর জাস্ট ইনকরিজিবল য়ু নো… মানুষটা তোমার হাজব্যান্ড ছিল। ভালবাসতে না পারো তো শো অফ করো অন্তত। অ্যাটলিস্ট স্পেয়ার আস ফ্রম আটার ফেসলস!
—এতটা আধুনিক যে হতে পারিনি বুবকা। ভালবাসার শো অফ করাটা রপ্ত করতে পারিনি বলেই জীবনভর অপেক্ষা করেছি। তোমাদের নিয়মপালনের পালা মিটলে বরং দুজনেই সময় নিয়ে এসো আমার কাছে। কিছু সিদ্ধান্ত তোমাদের জানানোর আছে আমার।
পিউ চা আর পাঁপড় ভেজে এনেছে এর মধ্যেই। তৃপ্তির চুমুক দিয়ে হালকা করে গান চালিয়ে দিলেন বিপাশা। জোয়ান বায়েজ। গানটা বারবার সেই সন্ধেগুলোতে নিয়ে যায় এক পলকে…
We both know what memories can bring,
They bring diamonds and rust…”
দুই.
রাত ফুরোলেই মেসোর ঘাটকাজ। কাল রাত থেকেই আত্মীয়স্বজনের আসা শুরু হয়ে গেছে। সঙ্গে বেড়েছে পিউয়ের ব্যস্ততা। মাসিকে যে একটু সময় দেবে সেই ফুরসত মেলাই দুষ্কর হচ্ছে। তার মধ্যে মানুষটাকে নিয়ে যত হাড়জ্বালানো কথাবার্তা লোকজনের…
—এই ছোড়দি, বড়মামিকে দেখেছ! বাব্বা, কে বলবে বলো দুদিন আগেই বর মারা গেছে? একেবারে টিপটপ। এরকম দেখিনি বাপু! এই তো গতবছর আমার শাশুড়িমা মারা গেলেন, সাজগোজ খাওয়াদাওয়া এসব নিয়ে ভাবার মতো মনই থাকত না তখন, আর এ তো নিজের স্বামী! অদ্ভুত নির্লজ্জ মহিলা কিন্তু…
পিউ খুব গম্ভীর মুখে চায়ের ট্রে-টা সশব্দে সামনে নামিয়ে রেখে চলে যায়। তাতেও ফিসফাস…
—এই একটা অজাতকুজাতের মেয়েকে সবকিছুর চাবি ধরিয়ে রেখেছে। মুখুজ্জেবাড়ির কৌলিন্য বলতে আর কিস্যু রইল না…
পিউ এসব বহু বছর ধরে শুনে শুনে অভ্যস্ত। ঠিক যেমন মাসি এতগুলো বছর ধরে অক্লান্ত দোষারোপ সহ্য করেও দিব্যি হাসিমুখে থাকে তেমনই। বুবকাদাটা একদম মেসোর মতো হয়েছে হাবেভাবে। সবাই শুয়ে পড়েছে খেয়েদেয়ে। মাসি দুপুরের পর থেকে কিছুই খায়নি। কফি আর অমলেট খুব ভালবাসে মাসি। পিউ রান্নাঘরের দরজা লক করে অমলেট বানায় বিপাশার জন্য। প্লেটে বেড়ে ঢাকা দিয়ে পা টিপেটিপে তার ঘরে গিয়ে দেখে সেই ডায়েরিটা…
—মাসি…
ঘরের আলো জ্বেলে দরজা বন্ধ করে পিউ। প্লেট এনে বিপাশার সামনে ধরে।
—খাও।
বিপাশা পিউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বলে— খুব সাহস হয়েছে দেখছি তোর। আধখানা তুই খা তবে। সাহসিকতার পুরস্কার।
পিউ অমলেট ভেঙে মুখে দিয়ে বলে— তুমি খাও। কাল তো চাইলেও বানিয়ে দিতে পারব না। বুঝতেই পারছ, তোমার সব বাঘা বাঘা ননদ-জায়েরা এসে যাবে। আমি সেখানে এন্ট্রি পাব বলে বোধ করি না।
বিপাশা কফিমাগ তুলে নিয়ে বলে— এই ছেমড়ি ,কাল মোমো খাব। চিকেন ফ্রায়েড মোমো। তুই আর আমি। বুঝলি?
পিউ মুচকি হেসে ঘাড় নেড়ে বলে, তথাস্তু।
বিপাশা এমনিতেই অর্ধেক দিন নিরামিষ খেয়ে কাটান। অথচ এই কটা দিন কোনও না কোনওভাবে আমিষ খাবেনই এই পণ করেছেন। এটাই প্রায়শ্চিত্ত তাঁর। যেদিন নিয়ম ভাঙার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, সেদিন তিনি পারেননি। একবুক অভিমান নিয়ে ফিরে গিয়েছিল অরণি। মাত্র তিন বছরের ছোট ছিল বিপাশার চেয়ে। অত্রির প্রিয় বন্ধু। অরণি বসুরায়। সেবার পুজোর ছুটিতে হোস্টেল থেকে অত্রি ফিরল তাকে সঙ্গে নিয়ে। বিপাশা নারকেলনাড়ুর শিশি আর কবিতার খাতা বগলদাবা করে সোজা অত্রির ঘরে। সেখানেই দেখা। কী দারুণ সব গান গাইছিল, পিঙ্ক ফ্লয়েড… বিটলস…! বড় বড় দুটো চোখ, ভেতর অব্দি যেন সব পড়ে ফ্যালে… একমাথা এলোমেলো চুল, ঝিম ধরে আসে কথা বললে। বিপাশা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছিল ভাললাগায়। কবিতাও লেখে এ ছেলে! অনর্গল আউড়ে যায় সুনীল-শক্তি-সন্দীপন…
ওহে বিপাশা, তুমি মরেছ পুরোপুরি!
আরও একজন পড়ে ফেলছিল বিপাশাকে। জলের মতো। অত্রি। তিনদিন থেকে নিজের বাড়ি চলে গিয়েছিল সেই স্বপ্নের মতো যুবক। বিপাশা জানত না। নেশায় বুঁদ হয়ে সেদিনও ছুটে গেছিল। অত্রি কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বলেছিল,
—বিপাশাদি, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
—মানে?
—না মানে তিন বছরের ছোট ছেলের সঙ্গে… জেঠি জানতে পারলে বুঝতেই পারছ…
বিপাশার থমথমে মুখ দেখে বদমাশটা খুব হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার বন্ধুটিকে একটু বেশিই মনে ধরেছে বুঝতে পারছি। বেশ বেশ আমায় তবে ঘটকবিদায় দিও ভাল করে…
বিপাশা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। অত্রি তাকে বড্ড ভালবাসে। আর কেউ না থাকুক, ও থাকবেই বিপাশার পাশে, সবসময়।
একটা কবিতার খাতা অরণি রেখে গিয়েছিল অত্রির কাছে। বিপাশার জন্য। একদম শেষে লেখা ছিল,
অনেক পুড়েছে সময়
মিথ্যে আগুন ঠোঁটে নিয়ে
বাকি যা আছে, এটুকুই—
জলের মতন দেখি তুমি
অ-সুখেই সই, তবু…
নিও।
সেই অ-সুখ গ্রহণের মতোই রয়ে গেল দুজনের মধ্যে। মাঝরাতের হঠাৎ বেজে ওঠা কালো ডায়ালের সেই পুরনো ল্যান্ডফোন, ছুটির দুপুরে অত্রির চিলেকোঠায় নিরাপদ নির্ভার চুমু, ভরসন্ধের এলোচুলে মুখ ডুবিয়ে কানেকানে বলে ওঠা,
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালেবাসি—
এই ওষ্ঠে আর কোনও মিথ্যে কি মানায়?
বিপাশা নদীর মতই ভেসে যেত এই উদ্দাম স্রোতে। ঘড়ির কাঁটা যেমন হঠাৎই একদিন থমকে যায়, বিপাশার সুখের চাবিকাঠি তেমনই একদিন অ-সুখের কাঁটায় এসে থমকে গেল। অরণির তখন সবেমাত্র থার্ড ইয়ার চলছে। বিয়ের বয়স?… নাহ্, একেবারেই না। খুব অসহায় লেগেছিল প্রথমবার সেই ছেলেকে। বিপাশাও জোর করতে পারেনি।
চিনার পার্কের ধূসর বেঞ্চ জুড়ে তারপরই দীর্ঘ শীত নেমে আসে।
শাম্বরা আসলে এভাবেই জিতে যান। অথচ আর কয়েকটা বছর অপেক্ষা করা খুব কঠিন হয়তো ছিল না। তবু পারেনি বিপাশা আটকে দিতে সেই চাকার গতি। অত্রি খুব আহত হয়েছিল। পালিয়ে যেতে চেয়েছিল এইসব কিছু থেকে।
পাশ করার পর সে চলে গেল আমেরিকা। চিঠি দিত। প্রথমে ঘনঘন। তারপর… অসময়ে আসা বৃষ্টির মতো। ততদিনে বুবকা এসে গেছে প্রাকৃতিক নিয়মে। একটা আদ্যোপান্ত কেজো মানুষ, একটা আচারবিচারসর্বস্ব পরিবার আর প্রাত্যহিক ক্লান্তিকর সম্ভোগ…
বিপাশা দ্রুত ফুরোচ্ছিলেন। খুব দ্রুত।
আকাশ ক্রমশ ফরসা হয়ে আসছে। পিউ কখন তার পাশেই গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। চাদরটা ওর গায়ে টেনেটুনে ঠিক করে দিলেন বিপাশা। সারাদিন বড্ড খাটুনি যায় মেয়েটার।
তিন.
বিপাশাদি,
তোমার মেইল ঠিক সময়েই খবরটা পৌঁছে দিয়েছিল, আমিই একটু সময় নিলাম লিখতে। আসলে এই মুহূর্তে ঠিক যা যা লেখে মানুষ সেগুলোর একটাও আমার তোমাকে লিখতে ইচ্ছে করছিল না। তোমাকে এই পৃথিবীতে আমি শুধুমাত্র একজনের সঙ্গেই ভাগ করেছিলাম। আজও তোমার সামাজিক পরিচয়, এই সোনার খাঁচা, বৈধব্য… এসব কিচ্ছু দেখতে পাই না আমি। তোমাকে সেই দিনটার পর আর কখনওই দেখতে ইচ্ছে করেনি আমার। আমি এখনও আমার ওই চিলেকোঠার ঘরে আসা নদীকে দু চোখে ধরে রেখেছি, যাতে আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা ডুব দিতে আসত। সেই যে সে ডুবল, আর মাথা তুলে দাঁড়াল না। নাহ্, চেষ্টা সেও বহু করেছে মুখ বদলে বদলে… কিন্তু নদীতে যে একবার নেয়েছে, তার কি আর সাজানো সুইমিং পুল ভাল লাগে বলো?
আমি ডুমুরের ফুল সেজে থাকলেও সে কিন্তু তোমার প্রতিটি খবর রাখে। কটা কবিতার খাতা জমালে শুনি এযাবৎ? হিসেবমতো ঠিক বয়সেই অবসর মিলেছে তোমার। আমরাও খুব বেশি পিছিয়ে নেই বুঝলে। এইবেলা পার্কের বেঞ্চখানা ফের দখল করো দেখি। দুটো বুড়ো দিন গুনছে পৃথিবীর দুই প্রান্ত থেকে… তোমার দখল নিতে। এবার আর কিছুতেই পালাতে দেব না।
রিলকে পড়িয়েছিলাম তোমায়, মনে আছে? A Walk? লাইনগুলো আজ খুব মনে পড়ছে জানো…
My eyes already touch the sunny hill.
Going far ahead of the road I have begun.
So we are grasped by what we cannot grasp;
It has inner light, even from a distance—
আমি ওই আলোটুকু নিয়েই এই বরফের দেশে আজও দুটো চোখ জ্বালিয়ে রাখি। অন্ধ হওয়ার আগে ছুঁতে চাই তোমাদের। থেকো ততদিন… প্লিজ।
ওই চিলেকোঠার দিব্যি দিয়ে,
তোমার অত্রি।
ব্যালকনির রেলিঙে ভর রেখে সামনের একফালি সবুজে আস্থা খুঁজে নিচ্ছে বিপাশা। একগাল নরম দাড়ি, ঠোঁটের কোণে জ্বলে ওঠা সিগারেট, পার্ক এভিনিউ-এর গন্ধ। ঠিক ডানদিকে গিটার হাতে স্বচ্ছ কাচের মতো ঝকঝকে চোখের অত্রি… বিপাশার ফেরার সময় হয়েছে সেখানে। গুছিয়ে নিতে হবে তার আগে অনেক কিছু।
বুবকা আর ঝিল্লি মৎস্যমুখ মিটলেই যে যার জায়গায় চলে যাবে। বুবকা খুব করে বলছে এদিকের পাট গুটিয়ে তার সঙ্গে গিয়ে থাকতে। তার বউয়ের বাচ্চাকাচ্চা হবে, এখন বিপাশা গিয়ে থাকলে নাকি সুবিধাই হয়। ঝিল্লি বরাবরই একটু একা থাকতে ভালবাসে। বিয়ে-থা করারও তেমন একটা ইচ্ছে তার নেই। অবশ্য সেসব নিয়ে বিপাশার নিজেরও খুব একটা মাথাব্যথা নেই। যে যার নিজের জীবনে ভাল থাকাটাই জরুরি। বাকি রইল পিউ। ওর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
—বুবকা… ঝিল্লি… পিউ… তোমরা ফ্রি থাকলে একটু আমার ঘরে এসো। কিছু জরুরি কথা আছে।
চুলদাড়ি কামানো বুবকার দিকে তাকালে বিপাশার অবিকল শাম্বর মতোই লাগে। ওরকমই গোঁয়ার, রুক্ষ। ভাবনাচিন্তার মধ্যে একটা শ্যাওলা জমে থাকে সংস্কারের।
—বলো কী বলবে… আমি আর ঝিল্লি একটু ফিউচার প্ল্যানিং করছিলাম এই বাড়িটার ব্যাপারে।
বুবকার গলায় একটা চাপা বিরক্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ঝিল্লি ফোনে কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকে ইশারায় বলল সে শুনছে সবই। একটা দরকারি কল, তাই ছাড়তে পারছে না। পিউ দরজার কাছে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বুবকার কোনওদিনই তাকে যে তেমন পছন্দ নয় সেটা পিউ অনেক ছোট থেকেই বোঝে।
বিপাশা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেন,
—কী ব্যাপারে এত পরিকল্পনা চলছে দুই ভাইবোনের, জানতে পারি?”
—কীসের আবার? এই বাড়ির কী ব্যবস্থা হবে, তুমি কী করবে… তাছাড়া আমাদের বাকি যা যা প্রপার্টি আছে সেগুলো…
—থাক থাক, আমি একটু বলি?
বিপাশা হাত তুলে থামিয়ে দিলেন ছেলের বৈষয়িক চিন্তার এই তুমুল গতিকে। ঝিল্লি বুঝতে পারছে মা অসন্তুষ্ট হয়েছে দাদার ওপর।
—আমি উকিলকাকুকে বলে দিয়েছি উইল বানানোর জন্য। ছেলেমেয়েদের আমার সিদ্ধান্ত জানানোটা দায়িত্ব, তাই তোমাদের এখানে ডেকে আনা। আমি এই বাড়ি এবং এবং অন্যান্য যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির তিনটে সমান অংশ করতে বলেছি… আমার, তোমার আর ঝিল্লির। আমার মৃত্যুর পর আমার অংশ পিউ পাবে। আশা করি এই সিদ্ধান্তে তোমাদের কারও কোনও আপত্তি নেই। অবশ্য আপত্তি থাকলেও আমার সিদ্ধান্তে তার জন্য কোনও রদবদল ঘটবে না। আর বাকি রইল আমার কী হবে এই প্রসঙ্গ। তোমরা দুজনেই জানো যে আমি কোনওদিনই তোমাদের বাবার ওপর নির্ভরশীল ছিলাম না। সারাজীবন শিক্ষকতা করার সুবাদে প্রতিমাসের শেষে সরকারের তরফ থেকে কিছু অর্থ আমার অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। তাতে পিউ আর আমার দিব্যি চলে যাবে। তোমরা এটা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আর বুবকা, এই শহরটা ছেড়ে আমি অন্য কোথাও থাকতে যাব না। তাই তোমার ওখানে গিয়ে পাকাপাকিভাবে থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। নিজেদের সংসার, নিজেরা মিলেমিশে ভালভাবে থাকো। অতিথি একদিন-দুদিন থাকলে তার খাতির থাকে, তার বেশি হলেই গলার কাছে কাঁটার মতো খচখচ করে, নেমে গেলেই তখন মনে হয় শান্তি। তাছাড়া পিউকে একা রেখে আমি অন্য কোথাও গিয়ে স্বস্তি পাব না।
ঝিল্লি এতক্ষণ একমনে বিপাশাকে দেখছিল। এতদিন এই গারদে ভদ্রমহিলা শ্বাসরুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন। এবার হয়তো নিজের জীবনটা খানিক ফিরে পাবেন। নাহ্, মায়ের কোনও সিদ্ধান্তেই তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। বিপাশার পাশে গিয়ে বসে ঝিল্লি। জড়িয়ে ধরে বলে—
—এবার যেমন ইচ্ছে বাঁচো। আর কোনও দায় নেই তোমার। আমি তোমার সব সিদ্ধান্তেই পাশে আছি।
বিপাশা ঝিল্লির কানে ফিসফিস করে বললেন— ছেলেটা কে রে? খুব ফোন আসছে আজকাল। অ্যাদ্দিন পর তবে তোর মনে কেউ একটু টোকা দিতে পারল! নট ব্যাড মিস ঝিলম মুখার্জি। আলাপ করিয়ে দিস কিন্তু পরে।
ঝিল্লি হেসে ফেলে বলল— মা তুমি না সত্যি! ওর নাম স্টিভ। রিসেন্টলি আমাদের নতুন অফিসে জয়েন করেছে, সেম ডিপার্টমেন্ট। মা… উই আর প্ল্যানিং টু গো ফর আ লিভ ইন রিলেশনশিপ।
—গো ফর ইট… যদি সত্যিই ভালবেসে থাকো। আমার দিক থেকে কোনও বিধিনিষেধ যে নেই তা তো জানোই।
বিপাশা চোখে প্রশ্ন নিয়ে এবার ছেলের দিকে তাকালেন।
—আমার জাস্ট কিচ্ছু বলার নেই মা। সারাজীবন তুমি তোমার সো-কলড পাতানো ভাই অত্রি আর ওই ন্যাকাবোকা প্রেমিকের কবিতা বুকে নিয়ে থেকেছ, আর এখন ঝিল্লিকেও এসব নোংরামিতে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছ। ব্রেভো! বাবা যে কী খুশি হচ্ছে ওপর থেকে এসব দেখে! মুখার্জিবাড়ির আদল পাল্টে দিতে উঠেপড়ে লেগেছ তোমরা… গ্রেট, ক্যারি অন!
তীব্র শ্লেষ উগড়ে দিয়ে বুবকা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে।
ঘরটা এখন ভীষণ শান্ত। পিউ এতক্ষণে মুখ খোলে,
—আমার এসব কিছুই চাই না। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনের পর বিএড করে নেব। একটা না একটা স্কুলে ঠিক প্লেসমেন্ট হয়েই যাবে আশা করি।
—বেশ, নিস না। এমনিতেও আমি না মরলে তো কিছু পাচ্ছিস না। আর মরার পর তুই আমার সম্পত্তি আগলে রাখবি না দানছত্র করবি সেটা তোর ব্যাপার। আপাতত আমার একটা কাজ কর দেখি।
বিপাশার ঠোঁটে একটা রহস্যের হাসি। পিউ এই হাসি চেনে খুব। কাছে এসে কোমরে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে বলে, কী চাই শুনি?
বিপাশা বেশ ধরা পড়ে যাওয়ার মতো লজ্জালজ্জা মুখ করে হেসে বলেন—
—খুব ইচ্ছে করছে… একটা এনে দে না, প্লিজ।
—মাসি! তুমি সত্যিই ধন্য! একটা মানে কিন্তু একটাই, মনে থাকে যেন… দাঁড়াও এনে দিচ্ছি।
—লাইটারটা মনে করে আনিস কিন্তু।
অনেকদিন পর সেই পরিচিত গন্ধটা জড়িয়ে ঘুমোবে আজ বিপাশা। নিশ্চিন্তে।
চার.
—Herr God, Herr Lucifer
Beware
Beware.
Out of the ash
I rise with my red hair
And I eat men like air.
এই যে লেডি ল্যাজারাস, আর কতক্ষণ ঘুমোবেন শুনি? চোখ খুলে দেখো… আমি। হ্যাঁ, আমিই। দেখো কী ভীষণ শূন্যতা নিয়ে জেগে আমার হাহাকার… খেয়ে ফ্যালো আমায়… কতদিন, কত কতদিন ঘুমাইনি… কোল পেতে দাও আরেকবার। মাথা রাখি…
ভোররাতের দিকে ঘুমটা ভেঙে গেল বিপাশার। এভাবে ডাকল কেন? বুকটা বড্ড খালি-খালি লাগছে হঠাৎই। কী করবে এখন সে? অত্রিকে জিজ্ঞাসা করবে কি…? ও নিশ্চয়ই কিছু বলতে পারবে।
আহ, লিখতে গিয়ে আজ এত হাত কাঁপছে কেন তার!
অত্রি,
এখানে সকাল হব-হব করছে। তোর ওখানে বিকেল ফুরিয়ে এল প্রায়। অরণির জানালায় এখন আলো না অন্ধকার জানি না, শুধু জানি সেটা পেরিয়ে আসতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। ভাবলাম আর কেউ কিছু না জানুক তুই নিশ্চয়ই…
জানিস, অনেকদিন পর কেউ কানে কানে ডাকল আগের মতোই। বলল, ভাল আছ, ভালবাসা? উত্তর দিতে পারিনি। তোর চিলেকোঠার ঘরটা ছাড়া ‘ভালবাসা’-কে কোথায় বা আশ্রয় দিই বল? লেডি ল্যাজারাস… নামটা মনে আছে আমার। সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে প্রথম আলাপ করিয়ে দেওয়ার সময় তোর চোখটা ভিজে উঠেছিল কী এক অদ্ভুত শোকে! নিজেকেও এতগুলো বছর সেই ফিনিক্সের মতোই মনে হয়েছে। ছাই হতে হতে, বারবার মরে যেতে যেতেও আবার ঠিক সোজা হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়েছে জীবন। হাজারো যন্ত্রণার ওপরে রেখেছি অপেক্ষার অধিকারকে।
অরণির খবর পাইনি অনেকদিন। কোন ঠিকানায় খুঁজব তাও জানি না। শুধু জানি অপেক্ষার দ্বিতীয় প্রহরের জন্য আমি তৈরি। সময়মতো চলে আসিস দুজনেই, কেমন?
ইতি,
তোর বিপাশাদি
না থাক। এই উদ্বেগ, এই প্রতীক্ষা তার মধ্যেই থেকে যাক বরং। এসব খুব গোপন অসুখ। সংক্রামিত না হওয়াই ভাল। মুছে ফেলতে একটা মুহূর্তই যথেষ্ট।
একটা একটা করে শব্দ নিভে যাচ্ছে। ঠিক সেভাবেই, যেভাবে জ্বলে উঠেছিল হঠাৎ।
বাইরে বেশ হইচই শুরু হয়ে গেছে। আজ মৎস্যমুখ। শোকের আবহ কেটে গিয়ে বেশ একটা গমগমে ভাব বাড়ির আবহাওয়ায়। পিউ এসে স্নান সেরে নিতে বলল বিপাশাকে ঝটপট। পুরোহিতমশাই এসে গেছেন। বুবকা খুব নিষ্ঠার সঙ্গে নিয়মমাফিক যা যা দরকার সব করে চলেছে। সবকিছু খুব স্বাভাবিক ছন্দেই আছে।
বিপাশা স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। ঠিক কতটা সাজ এই সময় উপযুক্ত হবে এটা একটা চিন্তার বিষয় বটে।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে শাম্বর একটা ছবি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। নিটোল সংসারে যেমন হয় আর কী।
—তুমি এখনও তৈরি হওনি মাসি? গেস্ট আসতে শুরু করে দিয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে ড্রইংরুমে এসো। জানি এসব তুমি ভালবাসো না, তবু ওই লোকদেখানো আদিখ্যেতা ভেবেই এসো। অকারণে তোমার নামে আজেবাজে কথা শুনতে একদম ভাল লাগে না আমার।
বড্ড সংসারী গোছের হয়েছে পিউ। বিপাশার বেশ হাসি পেল ওর হাবভাব দেখে। শাড়ির কুঁচি ধরতে ধরতে ওর গম্ভীর মুখটা দেখে বিপাশা বললেন, আজ বিকেলে নন্দন যাব। হিটলারকে বলে দিস।
পিউ ততোধিক গম্ভীর গলায় বলল, বুঝেছি… অশান্তি না বাধিয়ে ছাড়বে না তুমি। যা খুশি করো। দুদিন পর গেলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত কে জানে।
বিপাশা ফিক করে হেসে বলেন, ঠাকুমা আমার! এত চড়া ধূপের গন্ধে গা গুলোচ্ছে খুব। জানিস তো আমার এসব সহ্য হয় না। প্লিজ, সরিয়ে নিয়ে যা।
পিউ ধূপদানি সরিয়ে একটা বাটিতে কিছু জুঁইফুল এনে রেখে দিয়ে যায় বিপাশার ঘরে। ধীরে ধীরে ঘরটা মৃত্যুগন্ধ পেরিয়ে আসছে। নাক টেনে আঘ্রাণ নিলেন বিপাশা। জীবনের।
পাঁচ.
বুবকা আর ঝিল্লি একটু আগেই রওনা দিল যে যার শহরের উদ্দেশে। যাওয়ার সময়ে বিপাশা বুবকার মাথায় হাত রাখতেই এতদিনের মধ্যে প্রথমবার ডুকরে কেঁদে উঠল বিপাশাকে জড়িয়ে ধরে। প্রথমবার বাবা হবে। কত বড় হয়ে গেল ছেলেটা…
—চিন্তা করিস না। অসুবিধে হলে জানাস আমায়। ঠিক পৌঁছে যাব। মা এখনও তেমন বুড়ি হয়নি যে এটুকু পারবে না। ঝুমুরের যত্ন নিস। ওর মন ভাল রাখার চেষ্টা করবি সবসময়। আর মাথা গরম করবি না কথায়-কথায়, বুঝলি?
আজ বাড়িটা খুব শান্ত। যে শালিকগুলো সকালসকাল জানালায় এসে খুব শোরগোল করে তারাও আজ কেন জানি বেশ চুপচাপ। অনেকটা বেলা করেই বিছানা ছাড়লেন বিপাশা। পিউ আজ অনেকদিন পর ইউনিভার্সিটি যাবে বলে তৈরি হচ্ছে। এই কদিনে ওর পড়াশোনার বেশ ক্ষতি হয়ে গেল। বিপাশা কিচেনে গিয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে মিউজিক সিস্টেম অন করলেন। ডিলান গাইছেন,
Hey! Mr. Tambourine man, play a song for me
I’m not sleepy and there is no place I’m going to…
একটা লম্বা ঘুমঘোর থেকে যেন জেগে উঠেছেন তিনি। নতুন করে আরেকবার সব গুছিয়ে নেওয়ার পালা। কিন্তু সত্যিই জানা নেই ঠিক কোথা থেকে কীভাবে শুরু করবেন।
এই সময় অত্রি হয়তো একটা বড় পেগ বানিয়ে ডুবে আছে নিজস্ব দুঃখের আড়ালে, ওর আদরের রাজা পায়ের কাছে ভিজে নাক ঠেকিয়ে ঝিমোচ্ছে রোজকার মতো। গিটারের তারে সময়ের ধুলো জমেছে। মাঝেমাঝে আঙুল রাখলেও স্ট্রামিং ভুল হয়ে যায় আজকাল। প্রফেসর অত্রি সেন তার সেই ঝকঝকে চোখজোড়া আর খুঁজে পায় না আয়নার সামনে দাঁড়ালে।
পৃথিবীর আরেকপ্রান্তে অরণির একঘেয়ে রুটিনে কবিতা পথ হারাচ্ছে নিয়মিত। ওর মেয়েটাও এতদিনে নিশ্চয়ই কলেজে… পায়ে একটা ব্যথা হত খুব। আরও বেড়েছে কিনা কে জানে? অন্যের যত্ন নিতে বরাবরই এগিয়ে দিত নিজেকে, পেতে অভ্যস্ত ছিল না কখনওই। এখন হয়তো কাগজেকলমে আর লেখে না। যন্ত্র সবকিছু মুছে ফেলে অনেক সহজে। যদি ভুল করে সত্যিই ফের কখনও দেখা হয়ে যায় তাহলে কি কথা ফুরিয়ে যাবে অনভ্যাসে?
নাহ্, শেষটা নতুন করে লেখাই ভাল। ডিসেম্বরের শুরু। উত্তরে হাওয়ায় শিরশিরে ভাব। পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে বিপাশা বেরিয়ে পড়লেন। একা। একটা হলুদ ট্যাক্সি।
—ভাই, চিনার পার্ক যাবে তো…?
শহর জুড়ে যত সবুজ সব আজ চিনার পার্কের ওই ছাইরঙা বেঞ্চের পায়ের কাছে জড়ো হয়েছে। শীতের শুরুতে পরিযায়ী পাখিদের আসার খবর পাওয়া যায় আকাশেবাতাসে। তাদের ধূসর ডানার অবাধ্য উড়ান অচেনা রূপকথা বয়ে নিয়ে আসে বিপাশার জন্য। সেখানে রূপোলি চুলের দুই রাজপুত্র ক্লান্ত অপেক্ষায়।
যুদ্ধটা আসলে জেতা হয়নি কারওই…