পাঁচটি কবিতা
আমার রবিঠাকুর
আমার ঘরের পুবদিকে একটাই জানলা
টান মেরে খুলতেই
সকালের প্রথম সূর্য সটান লাফিয়ে ঢোকে
আলোয় ভরে যায় তক্তাপোশ মেঝে মাদুর
ওই জানলাই আমার রবিঠাকুর।
জানলার ফাঁক দিয়ে দেখি
দূরের পথে সার বেঁধে ওরা দিনের কাজে চলেছে
পাশে পাশে পায়ে পায়ে লক্ষ্মীমায়া কোপাই
তার জলে ভাসছে গান
সুরে সুরে একাকার মানুষের কলতান
নদী পথ মাঠ মেঘ রোদ্দুর
পুবের জানলা হয়ে তিনি— আমার রবিঠাকুর।
বাড়ানো হাত
বাড়ানো হা্ত
কেন যে তবু দীর্ঘতর একাকী বুঁদ ফুল,
বিকেলমেঘে সোনার বীণ—
জলের ধারে ক্রমেই যেন নৌকা হয়
আবছা আন মুখ,
গহীনে চোখ খুঁজে বেড়ায় কোথায় ছিল ভুল!
দেখা
কোনও মহালগ্ন তো ছিল না
তবু দেখা হয়েছিল
ঠিক তোমাতে-আমাতে নয়
ওপাশে তুমি
আর এইপাশে
ছোট্ট একভিড় মানুষের ফাঁকে
একটি পাগল স্থির আমারই মতন
তোমার ছিপছিপে টান-টান শরীর
সাদা শাড়ির পাপড়িতে
গানের মতো ফুটে ওঠার জন্যে উন্মুখ
তারপর সত্যিই গান
দিগন্তবিস্তারী তানে আদিঅন্তহীন
না, সঙ্গীত-টঙ্গীত নয়
মন্ত্রমুগ্ধ নারী যেন
বাঙ্ময় ধ্বনিত এক অস্থির আলোর বিরুৎ
তার স্নিগ্ধ ছায়ামূলের ঘ্রাণ পেতে
কবেকার কিশোরের বুকের গহনঝর্ণা
স্বচ্ছতোয়া নদী হয়ে বয়ে গেল
দূরে
অচিনপুরে
যেতে যেতে
পাগলকিশোর হেঁকে বলে গেল
আর ফিরবে না সে
ভেসে যাবে
আলোছায়া ঘ্রাণ নিতে শুধু ভেসে যাবে
একদিন
চিরদিন
নীলিমাবিলীন
নির্বাণ
তোর সেই চুরমার মুখ তো আমিই দেখেছিলাম
কাটা হাত, ছিন্ন পা
ছবিগুলি নিঃশব্দে সামনে এসে দাঁড়ায়
আর আমি ভিতর থেকে ভেঙে গুঁড়ো হতে থাকি
কোন্ গুহার অন্ধকারে ফেরার হলি তুই?
নাঃ, কোত্থাও কোনও বাজনা বাজেনি
নিস্পন্দ্য হাড়িকাঠ
নিথর মুখের সারি জমাটকঠিন
পাথরের সেই দেওয়াল
অনন্ত নৈঃশব্দ্যের বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে যেতেই
আকাশচোঁয়া কালো টপ টপ টপ টপ,,,
শরীরের ঝাঁকুনিতে মনকে ছুড়ে ফেলে
ফুলেল-নরম আগুন হাতে তুলে
ঋজু সৈনিক আমি টানটান তোর মুখোমুখি।
গল্প হতে চেয়েছিলি?
ছোটগল্প?
গল্প শেষ,
চিতার আগুন চাটে শান্তিজল,,,,
ধূর্ত শেয়ালের মতো রেলপাড়ের রাত চেয়ে দেখে
নিচের ইস্পাত ধরে সোল্লাসে ছুটছে মেলট্রেন
আতুর যাত্রীর স্বপ্নে সোনালি জঙ্ঘার মায়াটান
লবণাক্ত মূক রক্তে তুড়ি মেরে প্রতিদিন
ধেয়ে চলে দিলখুশ পর্যটক সহর্ষ জীবন
বোকার হদ্দ ঝর্ণাগুলো
সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়ার মানেই বোঝে না
ইস্পাতের কোল ঘেঁষে অনর্থক
বোবার কান্নার মতো আজও তারা বয়েই চলেছে
এই কি নির্বাণ তোর,
যাকে চেয়ে
এক ধ্বস্তপল সময় জেগে আছে ওইখানে?
পথের শেষে
লকডাউন, সোশাল ডিস্ট্যান্সিং-এর
এত সব বিধিনিষেধের মধ্যেও
কোথাও কোথাও প্রবল ভিড়—
‘আহা-উহু’ ‘স্প্লেন্ডিড’ ‘সুপার্ব’ ‘অ-সাম’
কনুইয়ের গোঁত্তা খেয়ে
ভিড় থেকে সরে এসে অক্সিজেন খুঁজি
বাতাস, স্বস্তি
আজকাল আমাদের ভাললাগার
বড্ড বাড়াবাড়ি
ভিড়ের মধ্যে সত্যি-মিথ্যে গুলিয়ে যায়
হয়ত তারা মিথ্যে নয়
তবু সহজ স্বচ্ছন্দও নয় আর
কেবলই আয়নায় মুখ দেখে
ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে বলে
উৎকট চড়া রঙে নিজেদের সাজায়
প্রবঞ্চক প্রতিযোগিতায়
প্রকাশের সত্যমুখ হারিয়ে যেতে থাকে
তোমাকে সেখানে আমি খুঁজে পাই না
বাইরে এসে খুঁজি
যেখানে সাদামাটা সকালের আলোয়
আজও মায়া ঝরে
গাছেরা নিবিড় করে
আলো জল বাতাসকে কাছে পায়
সেইখানে
দুপুরের মাঠে ঘাসফড়িঙের বাধাহীন ওড়াউড়ি
সেইখানে
রেলসাঁকোর নিঝুম ছায়া
কোপাইয়ের জলে স্বচ্ছন্দে ঘুমিয়ে পড়ে
সেইখানে
জলবাতাসের মতো বয়ে যেতে সাধ হয়
আলোর ঠিকানা লেখা নদীটির ধার ঘেঁসে
বাধাহীন বয়ে যাই
দূরে.. দূরে… দূরে….
যেখানে পথের শেষে জেগে আছে
নিভৃত দুয়ার এক—
সেইখানে।