স্টেশনমাস্টারের কলম
আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে, ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর বাইশ বছরের এক কলেজপড়ুয়া যুবক চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) প্লাইমাউথ বন্দর থেকে এইচএমএস বিগল জাহাজে দক্ষিণ আমেরিকার উদ্দেশ্যে ভেসে পড়লেন। যুবকটির উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ আমেরিকার জীববৈচিত্রময় দ্বীপগুলিতে ভূতত্ত্বিক গবেষণা ও জীবজগতের অনুপুঙ্খ অন্বেষণ যা তাঁকে একজন অভিজ্ঞ প্রকৃতিবিদ হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। পাঁচ বছর পর বিগল যখন দেশে ফিরল, সাতাশ বছরের ডারউইন এই দীর্ঘ ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে সংগ্রহ করেছেন ৫৪৩৬টি উদ্ভিদ ও প্রাণীর নমুনা, সঙ্গে সেই নমুনাগুলির বিষয়ে ৩৬৮ পাতার বিবরণী, এছাড়াও ছিল ৭৭০ পাতার ডায়েরি যাতে লিপিবদ্ধ আছে তাঁর যাত্রার খুঁটিনাটি বিবরণ, পর্যবেক্ষণ ও নানা বিষয়ে মতামত, যাকে কেন্দ্র করেই ১৮৫৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত হবে তাঁর সেই মহাগ্রন্থ— The Origin of Species by Means of Natural Selection। আজ আমরা সকলেই(?) জানি, ‘দ্য ওরিজিন অফ স্পিসিস…’ হল এমন এক গ্রন্থ বা গবেষণাপত্র যা এই পৃথিবীতে জীবজগতের উদ্ভব সম্বন্ধে মানুষের ধ্যানধারণা চিরকালের মতো বদলে দিয়েছিল। এতদিন অবধি এই দুনিয়ায় জীবজগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধে মানুষের ধ্যানধারণা একতরফা শাসন করত ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব। যেমন বাইবেলে বর্ণিত ছিল যে ঈশ্বর প্রায় ছ হাজার বছর আগে ছ দিন সময় নিয়ে সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদদের সৃষ্টি করেছেন এবং সব শেষে অর্থাৎ ছয় নম্বর দিনে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ সৃষ্টি— মানুষকে। এর আগে কিছুদিন যাবৎ, জীবনের বিবর্তনের কথা কিছু কিছু প্রকৃতিবিদ কানাঘুষো উত্থাপন করছিলেন বটে, কিন্তু ডারউইনের দীর্ঘ পরিশ্রমী সমীক্ষা-লব্ধ তত্ত্ব প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করে দিল যে মানুষ সহ এই গোটা জীবজগৎ মোটেই ঈশ্বরের সৃষ্ট নয়, বরং অতি সরল প্রাণের চিহ্ন সময়ের বিস্তীর্ণ পাল্লায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিবর্তিত হতে হতে বর্তমানের পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, এমনকি এই দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রাচীন বহু জীব বিলুপ্তও হয়ে গেছে, এবং যারা রক্ষা পেয়েছে তাদের অস্তিত্বরক্ষা ও বিবতর্নের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক নির্বাচন। অর্থাৎ জীবজগতের বয়স মাত্র ছ হাজার বছর নয় মোটেই, জীবনের ইতিহাস আরও আরও বহু হাজার বছরের পুরনো, আর সবচেয়ে বড় কথা এই প্রাচীন ইতিহাসের নির্মাণে ঈশ্বর তথা কোনও দৈবশক্তির কোনও ভূমিকা নেই। এইভাবেই ডারউইনের বিবর্তনবাদ ঈশ্বরবিশ্বাসের মর্মমূলে তথা ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বের কফিনে প্রথম ও শেষবারের মতো অমোঘ পেরেকটি পুঁতে দেয়, যা প্রথমে স্বয়ং ডারউইনের পক্ষেই বিশ্বাস করা কঠিন হয়েছিল, কারণ বিগল-যাত্রার শুরুতে তিনি নিজে ছিলেন চালু সৃষ্টিতত্ত্বে বিশ্বাসী একজন মানুষ। বিজ্ঞানের সৌন্দর্য এখানেই যে তার পদ্ধতিতন্ত্র অনুসরণ করে সঠিকভাবে কাজ করে যেতে পারলে যে ফললাভ হয় তা স্বয়ং বিজ্ঞানসাধকের মানসিক ঝোঁক বা নিহিত পক্ষপাতের দ্বারাও প্রভাবিত হয় না। বিবর্তনবাদের ক্ষেত্রেও হয়নি, বরং তা খোদ বৈজ্ঞানিককেই বদলে ফেলেছিল।
কিন্তু এসব কথা তো আমরা, যারা স্কুল-কলেজে বিবর্তনবাদের সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি, তারা সকলেই জানি। আজ হঠাৎ ডারউইন-জন্মের ২১৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে আচমকা এই ইতিহাসের অবতারণা কেন? বলা বাহুল্য, এই প্রশ্নটি ওঠামাত্র ওয়াকিবহাল পাঠক উত্তর দিতে পারবেন। কারণ অতি সম্প্রতি আমাদের দেশে জাতীয় শিক্ষাপাঠক্রম থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ছেঁটে ফেলা হয়েছে, যার প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। এই সিদ্ধান্ত একাধারে হাস্যকর ও ধ্বংসাত্মক। নতুন প্রজন্মের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বিবর্তনবাদ না পড়ে জীবনবিজ্ঞান শিখবে, যা যোগ-বিয়োগ না শিখে গণিত শেখার মতোই অবান্তর। পাশাপাশি, এই অর্ধপক্ব বিদ্যা এমন এক অস্পষ্ট-মেধা, অবিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্মের জোগান দেবে, যাদের মস্তিষ্কে একইসঙ্গে কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার চাষ খুব সুচারুভাবে করা যায়। এ কথা জানা দরকার, আজ এই একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে ধর্মশাসিত বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মঘেঁষা যে-কটি দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল রাষ্ট্র আছে, তাদের প্রত্যেকটির চার্লস ডারউইন ও তাঁর বিবর্তনতত্ত্বের প্রতি জৈবিক ক্রোধ রয়েছে। আজ ভারতবর্ষের নামও সেইসব পেছনের-দিকে-এগিয়ে-চলা দেশগুলির সঙ্গে জুড়ে গেল।
যদিও শিক্ষা দফতরের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়েছে, শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে অতিরিক্ত পড়ার চাপ কমানোর তাগিদেই এই পদক্ষেপ। কিন্তু পড়ার চাপ কমানোর তাগিদে পাঠক্রম থেকে অন্যতম প্রধান বিষয়টিকেই বাদ দিয়ে দেওয়া আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ পরবর্তীকালে আমাদের দেশে যে শিক্ষাক্ষেত্রে যে ঢালাও গৈরিকীকরণ ও বিজ্ঞানকে জলাঞ্জলি দিয়ে লাগাতার অবিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়েছে, তাতে বিবর্তনবাদকে ছেঁটে ফেলার ঘটনাটিকে মোটেই এত নির্বিষ ও বিচ্ছিন্ন বলে মনে হচ্ছে না। বস্তুত, আমাদের দেশে সার্বিকভাবে যে প্রগতিশীল চিন্তাবিরোধী এক সরণ শুরু হয়েছে, বিবর্তনবাদের বিসর্জনকেও আমরা সেই প্রেক্ষিতেই দেখব। আর এই বাস্তব সঙ্কটকে পাঠকের সামনে সামগ্রিকতায় তুলে ধরার, তাঁকে সমস্ত জানানোর ও ক্রুদ্ধ করার তাগিদেই চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর মে মাসের প্রচ্ছদ-ভাবনার নির্বাচন। আক্রান্ত ডারউইন— ধর্মান্ধতার কবলে বিবর্তনবাদ। লিখেছেন আশীষ লাহিড়ী, অশোক মুখোপাধ্যায়, মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপন ভট্টাচার্য, সুমন কল্যাণ মৌলিক, জয়ন্ত দাস ও সুব্রত রায়। আশা করব, বিবর্তনবাদকে জাতীয় পাঠক্রমে ফিরিয়ে আনার তাগিদ পাঠকের মধ্যেও সঞ্চারিত হবে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকের সুরক্ষার প্রশ্নে আমাদের দেশ যখন প্রতিবছর সূচক-সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নিচের দিকে নামছে, ব্রাসেলস-এ ‘ডিফারেন্স ডে অনারারি টাইটেল ফর ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন’ সম্মানে ভূষিত হলেন সাংবাদিক রবীশ কুমার। তাঁর পুরষ্কার গ্রহণের বক্তৃতাটিকে অতি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আমরা অনুবাদ করে প্রকাশ করেছি এই সংখ্যার বিশেষ নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকার বিভাগে।
স্মরণ করা হয়েছে সদ্যোপ্রয়াত ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহকে। তাঁর স্মরণে তিনটি মূল্যবান লেখা লিখেছেন কণিষ্ক চৌধুরী, তাপস দাস এবং ধনঞ্জয় সাহা। শতবর্ষ পেরোচ্ছেন মৃণাল সেন। ভারতীয় নতুন ধারার ছবির নিরিখে তাঁর অবদান ও স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের কাজ সবে শুরু হয়েছে। এই মূল্যবান মুহূর্তটিকে ধরে রাখতে আমরা প্রকাশ করছি মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র-বিশ্ব নিয়ে দুটি লেখা, একটি নতুন, একটি পুনঃপ্রকাশ। লিখেছেন শুভদীপ ঘোষ ও মধুময় পাল।
এছাড়া অন্যান্য নিয়মিত বিভাগ তো রইলই।
পরিশেষে, এই পত্রিকা সম্বন্ধে দুটো কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এই সংখ্যা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সপ্তম বর্ষে পা রাখল ‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’। পাঠকদের নিয়মিত প্রশ্রয় ছাড়া এই পথচলা সম্ভব হত না। এই যাত্রা দীর্ঘতর করা সম্ভব হবে না যদি আমরা নিজেদের অবিরাম প্রশ্ন করতে না পারি। নিয়মমাফিক পত্রিকা প্রকাশ করে চলা অনুচিত হবে যদি না আমরা বিষয়বস্তুকে সময়োপযোগী, প্রাসঙ্গিক ও সূচীমুখ করে তুলতে পারি। তাই আত্মতুষ্টির কোনও জায়গা নেই, বরং, প্রিয় পাঠক, আত্মসমালোচনার পথে আপনাদের সুচিন্তিত মতামত একান্ত কাম্য৷ সঙ্গে থাকুন। অলমিতি।
সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
দেবব্রত শ্যামরায়