উন্মেষ মিত্র
ছাত্র, পরিবেশকর্মী
শুষ্ক ঘাসজমি এই পাখিদের আবাসস্থল। কিন্তু লজ্জাজনকভাবে স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রম করা দেশের প্রশাসনিক অভিধানে ঘাসজমি (grassland)-কে চিহ্নিত করা হয় বন্ধ্যাজমি (wasteland) হিসাবে। তাই দেশের সকল ‘উন্নয়নমূলক’ কর্মকাণ্ডে প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকে এই ঘাসজমি। আর উন্নয়নের রঙিন মোড়কের তলায় হাঁসফাঁস করতে থাকে ঘাসজমির বাসিন্দা ভারতীয় নেকড়ে, ক্যারাকাল, লেসার ফ্লোরিক্যান বা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড
স্বাধীনতার পর জোর আলোচনা শুরু হয়েছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের জাতীয় প্রতীক নির্বাচন নিয়ে। দেশের ১৭টি জাতীয় প্রতীকের মধ্যে অন্যতম জাতীয় পাখির নির্বাচনে ময়ূরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল চার ফুট উচ্চতার একটি পাখি। জাতীয় পাখি হিসাবে স্বনামধন্য পক্ষীবিজ্ঞানী সালিম আলির প্রথম পছন্দ ছিল এই পাখিটিই, কিন্তু বাধ সাধল নাম। ইংরেজি ভাষায় ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড’ নামে পরিচিত হওয়ার কারণে, দেশের সম্মানহানির আশঙ্কায় তালিকা থেকে নামটি কাটা গিয়েছিল গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের, যা রাজস্থানে গোডাবান এবং মহারাষ্ট্রে মালডোক নামে পরিচিত।
গত ১৭ অক্টোবর রাজস্থানের জয়সলমির জেলার দেগ রায় মাতা গোচরভূমিতে পরিবেশপ্রেমী, পেশায় উটপালক সুমের সিং ভাটি উদ্ধার করেন একটি গোডাবানের মৃতদেহ। এবছর ২৩ মার্চ জয়সলমির জেলার পোকরানের নিকটবর্তী খেতোলাই গ্রামে স্থানীয় পরিবেশপ্রেমী রাধেশ্যাম পেমানী উদ্ধার করেন আরেকটি মৃতদেহ। দুক্ষেত্রেই মৃত দেহাবশেষের ওপরে অবস্থান করছে হাইটেনশন বৈদ্যুতিক তার। এই খবর এবং ছবি ছড়িয়ে পড়তেই প্রমাদ গুনেছেন সারা বিশ্বের পরিবেশকর্মী, পক্ষীবিজ্ঞানীরা। কারণ ২০২১ সালে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি (BNHS)-র রিপোর্ট অনুসারে সারা পৃথিবীতে এই পাখির সংখ্যা ১২০টিরও কম! আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘের (IUCN) লাল তালিকাভুক্ত এই পাখিটি হয়ত স্বাধীন ভারতের প্রথম পাখি হিসাবে হারিয়ে যেতে চলেছে বিলুপ্তির করাল গহ্বরে।
গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের ক্রম অবলুপ্তির সব থেকে বড় কারণ হিসাবে দায়ী করা যেতে পারে শিকারকে। ব্রিটিশ অফিসার কর্নেল রবার্ট ম্যান্সফিল্ডের আত্মজীবনীমূলক রচনা থেকে জানা যায় ১৮০৮ থেকে ১৮৩৩ সালের মধ্যে মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরে চাকরি সূত্রে থাকার সময় তিনি নিজে ৯৬১টি গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড শিকার করেন। আশা করব এই তথ্য থেকে রাজা-বাদশাহ, ব্রিটিশ অফিসার, ‘বীর’ শিকারিদের হত্যালীলার পরিমাণ পাঠক সহজেই আন্দাজ করতে পারবেন। ১৯৬৯ সালে আরএস ধর্মকুমারসিনজি প্রথমবার গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের সংখ্যা জানার জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সার্ভে করেন এবং দেখা যায় সর্বসাকুল্যে ১২৬০টি পাখি সারা দেশে বেঁচে আছে। ২০০১ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৬০০টি, ২০০৬ সালে পক্ষীবিজ্ঞানী আসাদ রহমানির রিপোর্ট অনুসারে সংখ্যাটা ছিল ৩০০ বা তার কম।
১৯৭২ সালের বন্যজীব সংরক্ষণ আইনের দ্বারা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডকে বাঘ, সিংহ বা হাতির মতো সর্বাধিক সুরক্ষা দেওয়া হয় এবং এই পাখির সংরক্ষণের জন্য চারটি অভয়ারণ্য বানানোর ঘোষণা করা হয়, মহারাষ্ট্রে নানজ বাস্টার্ড স্যাংচুয়ারি, মধ্যপ্রদেশে কারেরা বাস্টার্ড স্যাংচুয়ারি এবং গুজরাটে গগা বাস্টার্ড স্যাংচুয়ারি এবং কচ্চ বাস্টার্ড স্যাংচুয়ারি। আর এই সংরক্ষণের প্রচেষ্টাই গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের কফিনে পুঁতে দিয়েছিল আরেকটি পেরেক। ভারতীয় প্রশাসনের ‘ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার’ নীতিতে এইসব অভয়ারণ্য অঞ্চলে শুরু হয় কঠোর নিয়মকানুন, আর এই নিয়মের বেড়াজালে অতিষ্ঠ হতে থাকেন সাধারণ গ্রামবাসীরা। অভয়ারণ্যের চক্করে চাষের জমি হারিয়েছিলেন অনেকে, নিজেদের গ্রামে চলাচলেও শুরু হয়েছিল নানান প্রতিবন্ধকতা। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছিল মিথ্যে প্রচার, এই পাখি থাকলে বন্ধ হয়ে যাবে গ্রামের সব ‘উন্নয়ন’, ভিটে-মাটি ছাড়া হতে হবে সবাইকে। কিছু সময়ের মধ্যেই এলাকার সাধারণ মানুষের চক্ষুশূল হয়ে উঠল নির্বিবাদী এই পাখিটি। শুরু হল চোরাগোপ্তা শিকার, বিষ দিয়ে মেরে দেওয়ার চেষ্টা। আর এর ফলাফল হিসাবে বলা যায় বর্তমানে কারেরা বাস্টার্ড স্যাংচুয়ারি এবং গগা বাস্টার্ড স্যাংচুয়ারি থেকে চিরতরে অবলুপ্তি, নানজ বাস্টার্ড স্যাংচুয়ারিতে ১-২টি এবং কচ্চ বাস্টার্ড স্যাংচুয়ারিতে ৪টি (৪টিই স্ত্রী পাখি) গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড অবশিষ্ট রয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে ভারত এবং পাকিস্তানের শুষ্ক ঘাসজমি এই পাখিদের আবাসস্থল। প্রায় চার ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এবং ১৫-১৬ কিলোগ্রাম ওজনের এই পাখিটির বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন দিগন্তবিস্তৃত ঘাসজমি। কিন্তু লজ্জাজনকভাবে স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রম করা দেশের প্রশাসনিক অভিধানে ঘাসজমি (grassland)-কে চিহ্নিত করা হয় বন্ধ্যাজমি (wasteland) হিসাবে। তাই দেশের সকল ‘উন্নয়নমূলক’ কর্মকাণ্ডে প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকে এই ঘাসজমি। আর উন্নয়নের রঙিন মোড়কের তলায় হাঁসফাঁস করতে থাকে ঘাসজমির বাসিন্দা ভারতীয় নেকড়ে, ক্যারাকাল, লেসার ফ্লোরিক্যান বা গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড। আবার গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন উন্নয়নের বুলডোজারের সঙ্গে সঙ্গে এই ঘাসজমির পশুপাখিকে লড়াই করতে হয় বনদপ্তরের অন্ধত্বের সঙ্গেও। ‘বনসৃজন প্রকল্পের’ নামে ভারতের ঘাসজমিতে অবৈজ্ঞানিক এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিদেশি বৃক্ষ রোপণ করা হয়। পেঙ্গুইন যেমন সুন্দরবনে থাকতে পারবে না, সেরকমভাবেই ঘাসজমির পশু এবং পাখিরা জঙ্গলে বসবাস করতে পারে না। লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলে এইসব প্রাণীরা অভিযোজনের মাধ্যমে ঘাসজমিতে বসবাসের উপযোগী হয়েছে। এই অভিযোজনের কারণেই গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের পায়ে আঙুলের সংখ্যা ৩টি, যেখানে বেশিরভাগ পাখির পায়ে আঙুলের সংখ্যা থাকে ৪টি। এর ফলে এরা গাছে বসতে পারে না কিন্তু ঘাসজমিতে অতি দ্রুতগতিতে হেঁটে বেড়াতে পারে। ‘সব রোগেই বোরোলিনের’ মতো সব জমিতেই সুদূর আফ্রিকার গাছ Acacia tortilis রোপণ করার ফলে আরও সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড এবং ঘাসজমির অনান্য পশু-পাখিদের আবাসস্থল।
এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র জয়সলমির জেলাতেই গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড বংশবিস্তার করছে। এই পাখিটি সাধারণত বছরে মাত্র একটি ডিম প্রসব করে, কিন্তু পশ্চিম রাজস্থানে এই বছর প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে সবুজ শস্য শ্যামলা হয়ে যাওয়ার ফলে পক্ষীবিজ্ঞানী এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষকদের চোখে আশার আলো দেখিয়ে ৪-৫টি গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ড এবছর দুটি করে ডিম প্রসব করেছে। এবার আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে একটি পাখির মৃত্যুতে এত হইচই করার কী আছে? হইচই করার কারণ হল পাখিটির মৃত্যু হয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে! আর গত চার বছরে জয়সলমিরে এই নিয়ে ৮টি গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের মৃত্যু হল এই একই কারণে।
ভারত সরকার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে পুনর্নবীকরণ যোগ্য শক্তির মাধ্যমে দেশের ৫০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর। এই লক্ষ্যে প্রথম দুটি নাম হল সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎ। রাজস্থানের জয়সলমির, বিকানের, বাড়মেরের মতো জেলাগুলিতে গত ৫ বছর ধরে বেসরকারি এবং সরকারি সংস্থার উদ্যোগে মাইলের পর মাইল এলাকা জুড়ে স্থাপিত হচ্ছে হাওয়াকল, জমি ঢেকে যাচ্ছে সৌরপ্লেটে। এ-পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল, জলবায়ু পরিবর্তন রোখার জন্য কয়লা বা জ্বালানি তেলের পরিবর্তে সৌরবিদ্যুৎ বা বায়ুবিদ্যুৎ যে ভবিষ্যৎ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য হাই ভোল্টেজ তার মাকড়সার জালের মত গ্রাস করেছে এই অঞ্চলের আকাশকে। এই জাল এতটাই ভয়াবহ যে ওয়াইল্ডলাইফ ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ার একটি গবেষণা অনুসারে প্রতি মাসে ১৮,০০০ পাখি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে এই অঞ্চলে!
সমাধান? সমাধান একটাই, বিদ্যুৎবাহী তারগুলিকে ভূগর্ভস্থ করা। অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার এবং পরিবেশপ্রেমী এমকে রণজিৎসিন এই বিদ্যুৎবাহী তারগুলিকে ভূগর্ভস্থ করার দাবি জানিয়ে ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টে পিটিশন ফাইল করেন। ১৯ এপ্রিল, ২০২১ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট রায় দান করেন, অবিলম্বে সমস্ত বিদ্যুৎবাহী তার ভূগর্ভস্থ করতে হবে এবং এই কাজে নজরদারি করার জন্য তিন সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এই রায়দানের পর আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবৈধভাবে কাজের গতি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। যার ফলাফল ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দেগ রায় মাতা গোচরভূমিতে একটি গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু এবং ঠিক একই গোচরভূমিতে ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর আরেকটি গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের একইভাবে মৃত্যু।
গত ১৪ অক্টোবর ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (WWF)-এর লিভিং প্ল্যানেট রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই রিপোর্ট অনুসারে গত ৫০ বছরে ৬৯ শতাংশ বন্যপ্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে! আর এই ভয়াবহ মৃত্যুমিছিলে আগামী শিকার হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান(!) প্রাণী মানুষ। বিশ্বব্যাপী এই সংহারযজ্ঞ বন্ধ করতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা। পরিবেশ বিষয়ে বর্তমান রাজনৈতিক অনিচ্ছাকে সদিচ্ছাতে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা একমাত্র সাধারণ মানুষের হাতেই রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং গতানুগতিক চিন্তাধারা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা। নাহলে আগামীর পৃথিবীতে গ্রেট ইন্ডিয়ান বাস্টার্ডের সঙ্গে বিলুপ্তির গহ্বরে তলিয়ে যেতে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না।