শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার
১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ কালপর্বে পশ্চিমবঙ্গে সামগ্রিক শিক্ষা পরিস্থিতি যে অতল গহ্বরে পৌঁছেছিল তাকে গণতন্ত্রীকরণের আদর্শগত কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে একটা শৃঙ্খলার অবস্থায় সাফল্যের সঙ্গেই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছিল। নীতি ও আদর্শগত যে পথ গ্রহণ করা হয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত ও বৈজ্ঞানিক। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই সেই নীতির খোলনলচে পাল্টে দিয়ে যে সর্বনাশের পথে পা বাড়িয়েছিল, আজকে তা এক পরিপূর্ণ নৈরাজ্যে পরিণত হয়েছে
পিং-পং কথাটা এখন আর চালু নয়। তবু টেবিল টেনিস বললে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতিকে দৃশ্যমান করা সম্ভব হবে না। গত পরশু রাজ্যের শিক্ষাদপ্তর বিশেষ আয়ুক্তের স্বাক্ষরে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রাজ্যপাল উপাচার্য ‘নিয়োগ’ করেছেন, তার কর্মসচিবদের চিঠি পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়েছে ‘বেআইনি’ উপাচার্যদের বেতন ও ভাতা বন্ধ করে দিতে। এর পরপরই রাজ্যপালের তরফে ওই কর্মসচিবদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের ওই চিঠির বিরুদ্ধে আদালতে যেতে। কর্মসচিবেরা পড়েছেন মহাফাঁপড়ে। কোন পথে যাবেন? যাঁরা নতুন উপাচার্যদের অত্যুৎসাহে কাজে যোগ দেওয়াকে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করেছেন আগে, তাঁদের কেউ কেউ রাজ্য শিক্ষা দপ্তরের চিঠি পেয়ে পত্রপাঠ উদ্যোগ নিয়েছিলেন নতুন উপাচার্যদের ‘বয়কট’ করার। প্রস্তুতিপর্ব শুরু করতে না করতেই আবার এ থেকেও পিছিয়ে এসেছেন। আক্ষরিক অর্থেই এঁদের অবস্থা এখন, শ্যাম রাখি না কূল রাখি। গত ১২ বছরে পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্কৃতি আমূল পাল্টে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন আইনের কোথাও মন্ত্রী, রাজ্য শিক্ষা দপ্তর বা শিক্ষা সচিবদের কোনও সংজ্ঞায়িত ভূমিকা না থাকলেও এখন জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবই বিকাশ ভবন-নির্ভর। কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত কর্মসমিতি কোর্ট বা বৌদ্ধিক পর্ষদ নেই। এক দশক গড়িয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালন বিধি তৈরি হয়নি। কোনও নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই। অথচ কর্মসমিতি কোর্ট ছাত্র সংসদ সবই চলছে। একদিকে মনোনীত কর্মসমিতি ও কোর্ট, অন্যদিকে ছাত্রজীবন ফুরোনো ছাত্রনেতাদের অনির্দিষ্ট মেয়াদের ছাত্র সংসদ এবং অবশ্যই সমর্থন ভিত্তি যাচাই ব্যতিরেকেই আত্মপ্রকাশ করা কর্মচারী নেতা— এমন একটি অক্ষশক্তির দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দৈনন্দিন কাজকর্ম। কথায় কথায় গাড়ি ছুটছে বিকাশ ভবন। হিসেবনিকেশ, শলাপরামর্শ— বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সমস্ত কাজের মূল কেন্দ্র এখন বিকাশ ভবন। ২০১১ সালের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকাশ ভবনের প্রসঙ্গ উচ্চারিত হত হয়ত বছরে একবার বা দুবার। এখন উপাচার্যরাই সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করেন বিকাশ ভবনে অলিন্দে। সচিবদের আপ্ত সহায়কের সামনে অপেক্ষারত অবস্থায় তাঁদের দেখতে পাওয়া যায় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কখন কী কিনবে, কার কাছ থেকে কিনবে, কাকে কোন কাজের বরাদ্দ দেওয়া হবে, তার সবটাই হয়েছে বিকাশ ভবনের অঙ্গুলিনির্দেশে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল ভেঙে কখনও বসানো হয়েছে পরিবেশবান্ধব জেনারেটর। কখনও কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে বসানো হয়েছে বায়োমেট্রিক হাজিরা ব্যবস্থা। যদিও বছরের পর বছর চলে গেলেও চালু আর হয়নি সেই ব্যবস্থা। অদ্ভুত নতুন নিয়ম করেছে সরকার। সরকারি বিভাগকে কাজের বরাত দিলে টেন্ডার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে না। অথচ কাজের সময় কোনও সরকারি বিভাগই নিজে কাজ করে না। নিজেদের তালিকাভুক্ত নানা বাইরের এজেন্সিকে কাজ হস্তান্তর করে দেয়। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় না ঢুকেই এভাবে যারা কাজ পেয়ে যায়, তারা কারা? কেনইবা এমন এক অদ্ভুত নিয়ম? যিনি উত্তর দিতে পারবেন এর সবটুকু, তিনি এখন গরাদের ভেতরে। মোদ্দা কথা, এটাই রাজ্যের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার নতুন কর্মসংস্কৃতি।
জগদীশ ধনকরের আগে শিক্ষা দপ্তর যাই বলেছে তাতেই মান্যতা দিতেন রাজ্যপালেরা। বিবাদ শুরু ধনকরের সময় থেকে। রাজ্যপালের সঙ্গে মতভিন্নতার জেরে আইন ভেঙে ২৫ জন উপাচার্যকে নিয়োগ করেছিল সরাসরি রাজ্য সরকার। সেই নিয়ে দীর্ঘ মামলা চলেছে। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল ভেঙে কোনও কারণ ছাড়াই কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এই মামলায়। নতুন রাজ্যপাল সরকারের মুখ বাঁচাতে আদালতের রায় বেরোনোর আগেই মধ্যস্থতা করে ২৪ জন উপাচার্যকে পদত্যাগ করিয়েছেন। করিয়েই তাদের হাতে অস্থায়ী দায়িত্ব দিয়েছেন। তখন আহ্লাদে আটখানা ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী। যৌথ সাংবাদিক বৈঠক করে নতুন পর্বের সূচনা হয়েছে জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে রাজ্যপালের বাংলা ভাষার পাঠ নেওয়া শেষ। কিন্তু রাজ্য সরকার নিয়মের সংশোধন করে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরুই করতে পারল না। বসতে দিলে শুতে চায়, সেই প্রাচীন কথাটির মতো, উচ্চশিক্ষা দপ্তর আবদার করল ইতিমধ্যে আদালতের রায়ে বেআইনি ঘোষিত ২৪ জনকেই আবার অস্থায়ী হিসেবে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হোক আরও লম্বা সময়কালের জন্যে। রাজ্যপাল বললেন তথাস্তু, তবে যে উপাচার্যরা তাঁকে সাপ্তাহিক কাজের খতিয়ান পাঠিয়েছে শুধু তাঁরাই বর্ধিত মেয়াদের ক্ষমতা পাবেন। বাকিগুলির ক্ষেত্রে কী হবে? রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে প্রবীণ অধ্যাপকদের তালিকা আনিয়ে প্রবীণতমদের উপাচার্যের ক্ষমতা ব্যবহারের দায়িত্ব দিয়েছেন। নিয়োগ করেননি। সরকার বলছে, তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে উপাচার্য এ কাজ করতে পারেন না। রাজ্যপাল উত্তরে বলছেন, পরামর্শ করা কথাটার অর্থ একমত হওয়া নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এক অভূতপূর্ব অচলাবস্থার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের ধারা এতটাই উপাচার্যনির্ভর যে সেই পদ ফাঁকা থাকলে বা উপাচার্য না থাকা অবস্থায় কাউকে দায়িত্ব দেওয়া না হলে পরীক্ষা ও ভর্তি সহ সামগ্রিক শিক্ষার পরিবেশ স্তব্ধ হয়ে যাবে। রাজ্যপাল কেন্দ্রের পছন্দের মানুষ হিসেবে সবসময়ই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষেই কাজ করেন, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা রাজনীতির কথা, আইনের কথা নয়। আইনের চোখে রাজ্যপাল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। তাঁকে রাজ্য সরকার থেকে আলাদা করে দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে রাজ্যপালই সেতু। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে রাজ্যপালের পরিচয়ে তিনি সরকারের প্রতিনিধি। আবার রাজ্য সরকারের কাছে আচার্য হিসেবে তাঁর পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান হিসেবে। সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয় রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করে আচার্যের মাধ্যমে। আবার রাজ্য সরকারও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযোগ রাখে রাজ্যপাল বা আচার্যের মাধ্যমেই। এভাবেই চলে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থা। রাজ্য সরকারের আর্থিক অনুদান নিয়ে আলাপ আলোচনা বা নথিপত্র দিতে বা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অর্থ বিভাগীয় আধিকারিকেরাই আগে কালেভদ্রে বিকাশ ভবনে যেতেন। সরকার, মন্ত্রী বা সচিব কখনওই সরাসরি উপাচার্যের সঙ্গে সম্পর্ক রাখত না দাপ্তরিকভাবে।
তবে রাজ্যপালের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন বাম আমলেও উঠেছে। কখনও উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে প্রতিক্রিয়ার মাত্রা অনভিপ্রেত পর্যায়েও পৌঁছেছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্টের পাঠানো নামের প্যানেল থেকে প্রথম নামকেই উপাচার্য হিসেবে মনোনীত করতে হবে বলে কোনও বিধিগত বাধ্যতা ছিল না। কিন্তু সেটা নিয়ে অশান্তি হয়েছে। রাজ্যপাল মনোনীত রাজ্য সরকারের অপছন্দের উপাচার্যরা কাজে যোগ দিতে এলে গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। পরে যদিও সেই উপাচার্য সরকারি দলের শিক্ষাকর্মী ও অধ্যাপকদের ঘনিষ্ঠ সুহৃদে পরিণত হয়েছেন। সবার ক্ষেত্রে অবশ্য তেমনটা হয়নি। এমনতর পরিস্থিতি এড়াতে এর পর থেকে একটিমাত্র নামের প্যানেল কোর্ট থেকে যাওয়ার প্রথা চালু হয়। সমাধান হিসেবে এটাকেও খুব উন্নত বা শ্রেয়তর বলার অবকাশ সম্ভবত নেই। এই দুর্বলতাগুলি বা এমন আরও অন্য দুর্বলতা সত্ত্বেও ২০১১ সালের আগে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্র বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অভ্যন্তরীণ পরিবেশে একটা সুস্থিতি ছিল। এমন নৈরাজ্যময় অন্ধকারের গর্ভে কখনওই পড়েনি। বরং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ কালপর্বে পশ্চিমবঙ্গে গণটোকাটুকি সহ সামগ্রিক শিক্ষা পরিস্থিতি যে অতল গহ্বরে পৌঁছেছিল তাকে গণতন্ত্রীকরণের আদর্শগত কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে একটা শৃঙ্খলার অবস্থায় সাফল্যের সঙ্গেই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়েছিল। নীতি ও আদর্শগত যে পথ গ্রহণ করা হয়েছিল তা ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত ও বৈজ্ঞানিক। এই নীতি সত্ত্বেও যে ভুলভ্রান্তি বা সমস্যার উদয় হয়েছে তা হয়েছে মূলত ঘোষিত নীতি থেকে সাময়িক বিচ্যুতির জন্যেই। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই সময়ের কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত সেই নীতিকে খোলনলচে পাল্টে দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নজরদারির গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সম্পূর্ণ উচ্ছেদ ঘটিয়ে যে সর্বনাশের পথে পা বাড়িয়েছিল, আজকের সময়ে এসে তা এক পরিপূর্ণ নৈরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে এখন রাজ্য উত্তপ্ত। রাজ্যপুলিশ-কেন্দ্রীয় বাহিনি-আক্রমণ-প্রতিরোধ নিয়ে সংবাদমাধ্যম সরগরম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অচলাবস্থা নিয়ে সান্ধ্য চিৎকারের আসর বসানোর সময় নেই মূলধারার সংবাদমাধ্যমের। আদালত দেড়দিন টানা শুনানির সময় নিয়েছে সাতটি জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনি মোতায়েনের নির্দেশ ও রাজ্য কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিতে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা শোনার সময় এখনও হয়নি। কিন্তু কার কখন সময় হবে সে অপেক্ষা না করেই এক চূড়ান্ত অচলাবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। রাজ্যপাল ও রাজ্যের পিং-পং খেলার মাঠ হয়ে উঠেছে সমগ্র উচ্চশিক্ষাক্ষেত্র। জেদাজেদির এই রাজনৈতিক টানাপোড়েন কবে শেষ হবে কেউ জানে না। ইতিমধ্যেই যাদবপুর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সোচ্চার হয়েছে রাজ্য সরকারের অভূতপূর্ব নির্দেশনামা নিয়ে। নিজেরাই বেআইনি ঘোষণা করে কার বেতন ভাতা বন্ধ হবে তার জানান দিচ্ছে। অথচ আদালতের রায়ে বেআইনি ঘোষিত উপাচার্যদের বেতন ভাতা বা তাদের কর্মকালে নেওয়া নানা অনিয়মিত সিদ্ধান্তবলীর কী হবে সে নিয়ে মুখে কুলুপ। এ যেন সাধু যুধিষ্ঠিরের কড়চা সিনেমার মাতাল সাধুর সংলাপ, যুধিষ্ঠির, তুই আর মাল খাস নে। তোকে ঝাপসা দেখাচ্ছে।
রাজ্যের শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে এসে এই মত্ত হাতিদের বিরত করার দায়িত্ব নিতে হবে। পবিত্র সরকার, অমল কুমার মুখোপাধ্যায়, সুবিমল সেনের মতো অধ্যাপকরা এগিয়ে এসে রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী দুজনের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করে ওদের হুঁশ ফেরানো প্রয়োজন। নয়তো রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়বে।
*মতামত ব্যক্তিগত
সঠিক বিশ্লেষণ ।
সব ঠিক আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পবিত্র সরকারের মত একজন অপবিত্র জোচ্চোর মানুষকে ডাকা হচ্ছে হুঁশ ফেরানোর জন্যে, মানতে পারলাম না।