সোমেন বসু
গত ১ মে বিশ্বের ধর্মীয় স্বাধীনতার ২০২২-এর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে মার্কিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। এই রিপোর্টে ভারতের জন্যও একটি অধ্যায় বরাদ্দ হয়েছে। এর আগে বিশ্ব স্বাধীনতা সূচকের ২০২২-এর রিপোর্টে জানানো হয়েছিল ভারতে কীভাবে “বিভেদমূলক নীতি এবং ধর্মীয় নিপীড়ন বাড়ছে যার ফলে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মুসলিম জনগণ।” সেই রিপোর্টে ভারতকে “আংশিক স্বাধীন” দেশ বলা হয়েছিল। কী বলছে এই ধর্মীয় স্বাধীনতার রিপোর্টটি?
উত্তরকাশী, উত্তরাখণ্ড। গত ৫ জুন পোস্টার পড়েছে। পরিষ্কার বয়ান: লাভ জিহাদিরা আগামী ১৫ জুন মহাপঞ্চায়েতের আগে যেন তাদের দোকান খালি করে দেয়, না-করলে পরবর্তী ঘটনার জন্য যেন তারা তৈরি থাকে।[1] লাভ-জিহাদি কাদের বলে, কেন বলে, আমরা জানি। আপাতত তাদের ওপর রোষের কারণ কিছুদিন আগে একজন নাবালিকাকে অপহরণের দায়ে পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করেছে যাদের একজন মুসলিম। অতএব, ঘটনা পরিষ্কার লাভ জিহাদ। অতএব, সমস্ত মুসলিমদের, যাঁদের লাভ জিহাদি বলেই অসঙ্কোচে সম্বোধন করা চলে, তাঁদের দোকান-বাড়ি ইত্যাদি ছেড়ে চলে যেতে হবে। না গেলে তাঁরা যেন পরবর্তী ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকেন। পরবর্তী ঘটনা কী হতে পারে তার ছোট করে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে পোস্টার পড়ার দুদিন আগে। সেদিন হিন্দুত্ববাদীরা একটি মিছিল করেছিল বারকোটে। সেই মিছিল থেকেই মুসলিমদের দোকান এবং বাড়ির ওপর কিছু হামলা চালানো হয়। দোকানগুলির বন্ধ শাটারের ওপর ঢ্যাঁড়াও এঁকে দেওয়া হয়। এগুলিই ছেড়ে দিতে হবে। পুরোলা বাজারের এক মুসলিম ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, ২৬ মে থেকেই ৩০টির ওপর দোকান বন্ধ রয়েছে। মুসলিমদের, অবশ্যই। ওই দুজন গ্রেফতার হয়েছে ২৭ মে। নামদুটোও বলা থাক— উবেদ খান এবং জিতেন্দর সাহনি। জিতেন্দর এখানে দুধভাত। একজনের নাম যে উবেদ খান এটুকুই যথেষ্ট।
একটুও না থমকে, একটা বিস্ময়চিহ্নেরও ব্যবহার না করে উপরের স্তবকটা লিখে ফেলা গেল। যে-রামরাজত্বে আমরা বাস করছি, তাতে এসব ঘটনা বিস্ময় উদ্রেক করার ক্ষমতা হারিয়েছে। কিছু বিচলন সৃষ্টি হয় হয়তো, যার ফলশ্রুতি এই জাতীয় কিছু লেখা, কিন্তু যে রামরাজত্বের দিকে আমরা এগিয়ে চলেছি, তাতে তাও কতদিন স্থায়ী হবে সন্দেহ।
গত বছরই মধ্যপ্রদেশের খারগোন[2] এবং গুজরাতের খাম্বাতে রামনবমীর মিছিল হচ্ছিল। এবং সেই মিছিলগুলির অনিবার্য গন্তব্যপথ ছিল মুসলিম মহল্লাগুলির ভেতর দিয়ে। পাঠক, আমাদের রাজ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নেবেন অনুগ্রহ করে।[3] মিছিলের সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশও আসে এবং মহল্লাগুলির অনেক বাড়ি, দোকান গুঁড়িয়ে দেয়। কারণ? নির্মাণগুলি নাকি অবৈধ। রামরাজত্বে আমরা এখন জেনে গেছি, অবৈধ নির্মাণ মানেই মুসলিমরা করে থাকেন। যেমন জানি উত্তরকাশীর নাবালিকা অপহরণকারী সন্দেহে ধৃত দুজনের মধ্যে একজনের নাম জিতেন্দর সাহনি হলেও ঘটনাটি আসলে লাভ জিহাদ।
এগুলি নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কথা না বলে, আসুন, সদ্যোপ্রকাশিত একটি রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতার রিপোর্ট, ২০২২
ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসসিআইআরএফ) আমেরিকার সরকারের বানানো একটি সংস্থা যারা আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইন, ১৯৯৮-এর অধীনে কাজ করে। গত ১ মে ইউএসসিআইআরএফ-এর ২০২২-এর রিপোর্ট প্রকাশ করেছে মার্কিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। সারা বিশ্বের মধ্যে এই রিপোর্টে ভারতের জন্যও একটি অধ্যায় বরাদ্দ হয়েছে।[4] ইউএসসিআইআরএফ তাদের এই রিপোর্টে বিশ্ব স্বাধীনতা সূচকের ২০২২-এর রিপোর্ট থেকেও উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে ভারতে কীভাবে “বিভেদমূলক নীতি এবং ধর্মীয় নিপীড়ন বাড়ছে যার ফলে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মুসলিম জনগণ।” প্রসঙ্গত, এই স্বাধীনতা সূচক-এর ২০২২-এর রিপোর্টে ভারতের প্রাপ্ত নমর ১০০-য় ৬৬, এবং ভারতকে আখ্যায়িত করা হয়েছে একটি “আংশিক স্বাধীন” রাষ্ট্র হিসেবে।[5] আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের স্বপ্নের হিন্দুরাষ্ট্রের কাছে এ-সবই খুবই স্বাভাবিক এবং গর্বের ব্যাপার। ক্ষুধা সূচক বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আমরা অবলীলায় সেঞ্চুরি পার করে তলানিতে অবস্থান করি, আবার মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর দমনপীড়ন চালানোর নিরিখে হয়ে উঠি বিশ্বের গর্বিত সেকেন্ড বয়— মাত্র ব্রাজিলের পরেই।[6] যদিও ইউএসসিআইআরএফ-এর এই রিপোর্ট নিয়ে তাদের আবার গোঁসাও হয়েছে। যাই হোক, সেসব প্রসঙ্গে পরে আসছি, আগে আমরা খানিক বিস্তারে রিপোর্টটি দেখে নেব। রিপোর্টটিতে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রগুলিকে ধরে ধরে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আমরাও সেভাবেই এগোব।
সাম্প্রদায়িক হিংসা
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র তথ্য অনুযায়ী ২০২১-এ ৩৭৮টি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।[7] ২০২২-এও এরকম সংঘর্ষ হয়েছে গুজরাত, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবাংলা, দিল্লি, বিহার সহ অনেক জায়গাতেই। ২০২০-র নারকীয় দিল্লি দাঙ্গা মূলত যে-অঞ্চলগুলিতে হয়েছিল তারই একটি জাহাঙ্গিরপুরিতে গত বছর এপ্রিল মাসে হনুমান জয়ন্তীর দিন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটি মিছিল বেরোয় এবং যথারীতি সেই মিছিল থেকে স্থানীয় মসজিদের সামনে গিয়ে উত্তেজক এবং উস্কানিমূলক স্লোগান দেওয়া হতে থাকে। যা শেষ পর্যন্ত একটা সংঘর্ষের রূপ নেয়। অন্যান্য সমস্ত জায়গাতেই ছকটা মোটামুটি একই। দিনগুলিও মূলত রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তী।
মুসলিমরা তো আছেনই, হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের হাত থেকে কিন্তু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষরাও রেহাই পাননি। তাঁদের ওপর নিপীড়নের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটেছে ছত্তিশগড়ে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে সে-রাজ্যের নারায়ণপুর এবং কোন্দাগাঁও জেলার ৭০টি খ্রিস্টান পরিবারের প্রায় ২০০ জনকে ঘরছাড়া করা হয়।[8] গোটা এলাকা জুড়ে অন্তত ২০টি সংগঠিত হামলা চালানো হয় তাঁদের ওপর।
মুসলিমদের ঘরবাড়ি এবং দোকান ধ্বংস
ইউএসসিআইআরএফ-এর রিপোর্টে এই ক্ষেত্রে বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিমদের ঘরবাড়ি বা দোকান ভেঙে দিচ্ছে শুধু হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী গুণ্ডাবাহিনিই নয়, সরাসরি পুলিশ-প্রশাসন। এবং অধিকাংশ এমন ঘটনাই ঘটছে কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনার পরে=পরেই। খারগোনে এবং খাম্বাতের কথা বলেছি, ইউএসসিআইআরএফ-এর রিপোর্টে এই ঘটনা দুটির উল্লেখও রয়েছে, সঙ্গে রয়েছে উত্তরপ্রদেশে মুসলিম অ্যাক্টিভিস্ট আফরিন ফতিমার বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাটির কথাও।[9] অভিযোগ সেই আদি ও অকৃত্রিম— অবৈধ নির্মাণ।
গোরক্ষা এবং মব লিঞ্চিং
এই ক্ষেত্রটিও বহুচর্চিত, বহু নারকীয় এবং পাশবিক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি এই রামরাজত্বে গোরক্ষার নামে। ইউএসসিআইআরএফ তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, শুধু মব লিঞ্চিং-এর পাশবিকতাই নয়, বিষয়টি রীতিমতো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সমতুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের ২৫টি রাজ্যে এখন এইজন্য আইন বানানো হয়েছে, সাজা জরিমানা থেকে হাজতবাস। হাজতবাসের মেয়াদও ৬ মাস থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত। হ্যাঁ, যাবজ্জীবন— গুজরাতে। এসবের ফল ভোগ করছেন মুসলিম, খ্রিস্টান, তফসিলি জাতি ও উপজাতির মানুষরা, গরুর মাংস যাঁদের স্বাভাবিক খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত।
গো-সন্তানদের হাতে নিগৃহীত থেকে নিহত হওয়া ২০২২-এর তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ইউএসসিআইআরএফ রিপোর্টে। ঘটনাগুলি ঘটেছে বিহার, ত্রিপুরা এবং মধ্যপ্রদেশে। এছাড়া ঝাড়খণ্ড জনাধীর মঞ্চ নামে ঝাড়খণ্ডের একটি মানবাধিকার সংস্থার একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে ২০১৬ থেকে ২০২১-এর মধ্যে গোহত্যা এবং গোমাংস ভক্ষণের সন্দেহে সে-রাজ্যের আদিবাসী এবং ক্রিস্টানদের ওপর ৩০টি লিঞ্চিং-এর ঘটনা ঘটেছে।
উস্কানিমূলক মন্তব্য
নুপূর শর্মা এবং নবীন জিন্দালের কথা আমরা জানি। হয়তো এটা জানি না তাদের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে যে উত্তেজনা ছড়ায় তাতে কম করে ১৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের হয়তো এটাও নজরে পড়েনি বিজেপির এক বিধায়ক হরিভূষণ ঠাকুর বাচাউল গত বছর ৭ মে প্রকাশ্যে বলেছিল দশেরায় যেমন রাবণের পুতুল জ্বালানো হয়, সেই একইভাবে মুসলিমদেরও জ্বালিয়ে দেওয়া উচিত।[10] কেরলের প্রাক্তন বিধায়ক পিসি জর্জ মুসলিমদের মালিকানাধীন রেস্তোরাঁয় হিন্দু এবং খ্রিস্টানদের খেতে নিষেধ করেছিল। এরকম বীরপুঙ্গবের অভাব নেই এখন দেশে। এবং এই তালিকায় শুধু রাজনীতিকরাই নন, ধর্মগুরু থেকে শিক্ষাবিদ পর্যন্ত সবাই আছেন।
ধর্মান্তর বিরোধী আইন
ধর্মীয় স্বাধীনতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বা ভাষান্তরে সন্ত্রাসের এটিও একটি বড় জায়গা। দেশের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ১৩টি রাজ্যে এখন এই আইন কার্যকর হয়েছে। এই আইন বলছে, কেউ যদি ধর্মান্তরিত হতে চান, তবে তাঁকে সরকারকে জানাতে হবে, পুলিশ তদন্ত করে দেখবে তাঁর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কারও কোনও আপত্তি আছে কিনা। ঠিক এখানেই ব্যাপারটা ব্যক্তিস্বাধীনতায় চূড়ান্ত হস্তক্ষেপের বিষয় হয়ে গেল এবং নানারকম অপরাধের দ্বার খুলে দেওয়া হল। স্পষ্টতই, ধর্মান্তরিত হতে চাওয়া ব্যক্তিটি যদি হিন্দু হন, তাহলেই হিন্দুত্ববাদীদের প্রচুর আপত্তি থাকবে এবং শুরু হবে ব্যক্তিটির ওপর মানসিক-শারীরিক নানা জাতীয় নিপীড়ন। যে ধর্মে তিনি ধর্মান্তরিত হতে চাইছেন, আক্রান্ত হবেন সেই ধর্মের মানুষজনও, বে-সরকারি এবং সরকারিভাবে। হচ্ছেও তাই।
ইন্ডিয়ান-আমেরিকান মুসলিম কাউন্সিল জানাচ্ছে, এই আইনের বলে খ্রিস্টানদের ওপর অত্যচার উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। যে-সমস্ত আদিবাসী এবং দলিত জনগণ বহুযুগ আগেই হিন্দু ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন, এই আইনের বলে তাঁদের ওপর জোর খাটিয়ে আবার হিন্দু ধর্মে ফেরানোর প্রক্রিয়া চলছে। ২০২০ থেকে ২০২২-এর নভেম্বর পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশ সরকার এই আইনে ২৯১টি মামলা রুজু করে এবং ৫০৭ জনকে গ্রেফতার করে। অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে ‘মন্দির নগরী’ বলে পরিচিত শহরগুলিতে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মের ধর্মাচরণই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।
লাভ জিহাদ
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গত বছর ডিসেম্বর মাসে ২০০৯ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ঘটা ৪০০টি আন্তঃধর্ম বিবাহের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে এবং দাবি করেছে এগুলি সব ‘লাভ জিহাদ’। কেন্দ্র সরকারের কাছে তাদের আর্জি এর বিরুদ্ধে সারা দেশে একটি কঠোর আইন বলবৎ করা হোক।[11]
বস্তুত, এই লাভ জিহাদ=এর প্রচারটি ধর্মান্তর বিরোধী আইনের সঙ্গেই যুক্ত। হরিয়ানার ধর্মান্তর বিরোধী আইনেই যেমন পরিষ্কার বলা রয়েছে কোনও বিয়েতে যদি কাউকে ধর্মান্তরিত হতে হয়, তবে সেই বিয়ে বে-আইনি ঘোষিত হবে।
স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট-এর ৫ নম্বর সেকশন[12] অনুযায়ী যে পাবলিক নোটিস দেওয়ার প্রয়োজন হয়, এখানেই সেটি এই হিন্দুত্ববাদী বাহিনির বড় হাতিয়ার হিসেবে দেখা দিয়েছে। নোটিসদাতা যদি মুসলিম হন এবং কোনও হিন্দু মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহের বিষয় থাকে, এই নোটিস এলেই যে তিনি আক্রান্ত হবেন, প্রাণও হারাতে পারেন, তা এখন এই রামরাজত্বে প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। ইউএসসিআইআরএফ রিপোর্টেও বিষয়টি নিয়ে উদাহরণ সহ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
ধর্মীয় সম্পদ এবং প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ
বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানই হয় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। যে ন্যক্কারজনক ঘটনা পরে রাষ্ট্র, এমনকি আদালতেরও বৈধতা পেয়ে যায়। এখনও কাশী, মথুরা সহ বেশ কিছু শহরের মসজিদ তাদের যাকে বলে হিট লিস্টে আছে। কিন্তু সে তো বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলের মতো আরএসএসের শাখা সংগঠনগুলির অ্যাজেন্ডা— বর্তমানে আমাদের দেশে সরাসরি রাষ্ট্রই এই ধরনের ভাঙাভাঙিতে নেমে পড়েছে। ২০২২-এ ঘটা এরকম তিনটি ঘটনা ইউএসসিআইআরএফ রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছে। কর্নাটকের গোকুন্তে গ্রামের একটি ৩০ বছরের পুরনো যিশু-মূর্তি, তেলেঙ্গানার শামসাবাদের একটি তিন বছরের পুরনো মসজিদ, অসমের বঙ্গাইগাঁও, বরপেটা এবং মোরিগাঁও জেলার তিনটি মাদ্রাসা ভেঙে দিয়েছে সরকার। অসমের ক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল মাদ্রাসাগুলি নাকি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যুক্ত। মাদ্রাসাগুলির ৯৭ জন ইমাম এবং শিক্ষককে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
বৈষম্যমূলক নীতি
সিলেবাস পরিবর্তন নিয়ে বর্তমানে দেশে যে কদর্য কাজকারবার চলছে ইউএসসিআইআরএফ রিপোর্টে সেটিও উল্লেখ করা হয়েছে। ছেঁটে ফেলা হচ্ছে মুঘলদের মতো অ-হিন্দু শাসকদের কথা, ২০০২-এর গুজরাত মুসলিমনিধনের মতো অ-হিন্দুদের ওপর নারকীয় অত্যাচারের কাহিনি, অন্যদিকে ঢোকানো হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী গল্প-কবিতা, এমনকি নির্লজ্জতার চূড়ান্ত নজির দেখিয়ে এনসিইআরটি সম্ভবত মোদির ‘মন কি বাত’ও কার্টুন ফর্মে সিলেবাসে ঢোকাতে চলেছে।
মাদ্রাসাগুলির ওপর নজরদারি, কর্নাটকের হিজাব-বিতর্কের বিষয়গুলিও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিফলন।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে কাজ করে এমন এনজিওদের ওপরেও নজরদারি সহ তাদের কাজে নানারকম বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, কোপটা আসলে অ-হিন্দুদের নিয়ে কাজ করে এমন এনজিওগুলির ওপর। বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার জন্য তাদের যে রেজিস্ট্রেশনের দরকার পড়ে, সরকার তা দিচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই জানিয়েছেন ২০১৯ থেকে ২০২১-এর মধ্যে সরকার ১৮১১টি এনজিও-র রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছে এবং ৭৮৩টি এনজিও-কে পুনর্নবীকরণ করতে দেয়নি।[13]
নির্বিচার ধরপাকড়
জেলে উমর খালিদের ১০০০ দিন পূর্ণ হল। আমরা মোহাম্মদ জুবেইর, সিদ্দিক কাপ্পান, শেহলা রশিদদের কথা জানি। কুখ্যাত ভীমা-কোরেগাঁও মামলার কথা জানি। জানি স্ট্যান স্বামী-ভারভারা রাওদের কথাও। ২০২০-র দিল্লি দাঙ্গার একটা তথ্যানুসন্ধান করেছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তারা জানাচ্ছে, যে ১৮ জন অ্যাক্টিভিস্টকে এই দাঙ্গার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে পুলিশ গ্রেফতার করেছে তার মধ্যে ১৬ জনই মুসলিম। এই দাঙ্গার সময়ে এবং তার পরবর্তীতে পুলিশের ন্যক্কারজনক ভূমিকা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে তারা।[14]
মারধর, হুমকি…
গত বছর আমেদাবাদে হিন্দুদের একটি পরবে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ সাদা পোশাকে চারজন মুসলিমকে প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তার মধ্যে চাবুক দিয়ে পেটায়।[15] এসব ঘটনা, প্রথমেই যেমন বলেছি, আজ আর চমক সৃষ্টি করে না। তালিকা দিতে থাকলে সে নিয়েই একটা গোটা লেখা হওয়া সম্ভব। ইউএসসিআইআরএফ রিপোর্টে এই সমস্ত ঘটনাগুলিই উল্লিখিত হয়েছে এবং অত্যন্ত সঠিকভাবেই বলা হয়েছে যে আজকের ভারতে এসব রুটিনে পরিণত হয়েছে।
ধর্মাচরণে বাধা
ওডিশার গেলটুয়া জেলার একমাত্র গির্জাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ, ওখানে নাকি হিন্দুদের খ্রিস্টান করে নেওয়া হচ্ছিল। অভিযোগকারী, বজরং দল। উত্তরপ্রদেশের মোরদাবাদের এক গ্রামে একটি বাড়ির মধ্যে একসঙ্গে নামাজ পড়ার জন্য ২৬ জন মুসলিমের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। ত্রিপুরার আগরতলায় মুসলিমদের একটি কবরস্থানে একটা শিবলিঙ্গ বসিয়ে অস্থায়ী মন্দির বানিয়ে ফেলেছে হিন্দু যুব বাহিনি নামে একটি বানর সংগঠন। মহরমের মিছিল বের করার জন্য শ্রীনগরে গ্রেফতার হয়েছেন বেশ কিছু মুসলিম…
কয়েকটি নমুনা মাত্র। ২০২২-এর। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
মহিলাদের ওপর নিপীড়ন
কুখ্যাত বিলকিস বানো মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ১১ জন আসামিকে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির মোচ্ছবের সময়ে ক্ষমা প্রদর্শন করে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হল। লোকগুলো বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে এল জেল থেকে ফুল-মালা-মিষ্টি সহযোগে ঢাকঢোল কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে তাদের বরণ করে নিল হিন্দুত্ববাদী বীরপুঙ্গবেরা। শুধু এই একটিমাত্র দৃশ্যই ভারতে এই মুহূর্তে মহিলাদের অবস্থা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট।
আসলে যে-কোনও ধর্মীয় মৌলবাদের চোখেই নারী মনুষ্যেতর কোনও জীব এবং পুরুষের সম্পদ মাত্র। ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের অন্য কিছু হওয়ার সুযোগই নেই।
ইউএসসিআইআরএফ রিপোর্টে বিলকিস বানোর ঘটনার সঙ্গেই উল্লেখ করা হয়েছে বুল্লি বাই বলে একটি অ্যাপের কথা। গিটহাব নামের একটি আন্তর্জাল প্ল্যাটফর্মে এই অ্যাপটি আপলোড করা হয়েছিল যেখানে ১০০-রও বেশি মুসলিম প্রতিবাদী মহিলার ছবি সহ নাম দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল এই মহিলারা “বিক্রি আছে”। যদিও এই ঘটনায় দিল্লি এবং মুম্বাই থেকে মোট ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু এর মাস ছয়েক আগেই একই ওয়েব প্ল্যাটফর্মে সুল্লি ডিল নামেও একটি একই জাতীয় অ্যাপ আপলোড করা হয়েছিল যে ঘটনায় কোনও গ্রেফতারির খবর নেই।[16]
এই হচ্ছে বর্তমানে আমাদের দেশ। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে যাকে নিয়ে আমরা কতই না শ্লাঘাবোধ করে থাকি। সংখ্যালঘু, দলিত জনগণ এবং নারীদের কাছে সেই দেশ আপাতত এক কারাগারস্বরূপ, যে কারাগারের শৃঙ্খল ক্রমশই দৃঢ়তর হচ্ছে।
কিন্তু গোঁসা কেন?
দ্য লিফলেট পত্রিকায় গত ২ জুন ইউএসসিআইআরএফ-এর এই রিপোর্টটি নিয়ে একটি বিস্তারিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখা হয়েছে।[17] বস্তুত, এই বর্তমান নিবন্ধটির মূল তথ্যসূত্র সেই সম্পাদকীয় নিবন্ধটিই। সেখানে দ্য লিফলেট-এর সম্পাদকমণ্ডলী প্রশ্ন করেছেন, রিপোর্টে যে বিষয়গুলি এসেছে সেগুলি তো কোনও গোপন বিষয় নয়। বরং এগুলি নিয়ে দেশের রাষ্ট্রনায়করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতা মন্ত্রী বা আধিকারিকরা প্রায়শই বুক বাজিয়ে থাকেন। তবে এই রিপোর্ট নিয়ে সরকারের প্রকাশ্যে আপত্তি জানানোর কারণটা কী?
গোঁসা হয়েছে। রিপোর্ট প্রকাশের পরের দিনই, অর্থাৎ ২ মে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি রিপোর্টটিকে “উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে খারিজ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে ইউএসসিআইআরএফ-কে পরামর্শ দিয়েছেন “এ-ধরনের কাজ যেন তারা আর না করে”, এবং ভারতের “বহুত্ব, গণতান্ত্রিক ভাবনা এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া” সম্পর্কে আরও জ্ঞানার্জন করে।[18]
এই অমৃতবাণীর পাশেই নিজের ‘বুলডোজার বাবা’ তকমা নিয়ে গর্বোদ্ধত যোগী আদিত্যনাথের মুখ ভাবা যাক; স্মরণ করা যাক উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে গোরক্ষা গুণ্ডাবাহিনির হাতে এক মুসলিম যুবকের নিহত হওয়ার ঘটনার পরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেত্রী সাধ্বী প্রাচীর বক্তব্য— ‘যারা গোমাংস খায়, তাদের এরকমই হওয়া উচিত;’ মনে করা যাক বিজেপির আইনজীবী সদস্য ভিক্টোরিয়া গৌড়ী, যাকে সম্প্রতি মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারপতি করে হয়েছে, তার বক্তব্য— ‘ইসলাম হল সবুজ সন্ত্রাস আর খ্রিস্ট ধর্ম হল শ্বেত সন্ত্রাস;’ মনে রাখা যাক এমনকি মোদিও সদ্যোসমাপ্ত কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে তাঁর সমস্ত ভাষণ শুরু এবং শেষ করেছেন ‘জয় বজরংবলি’ ধ্বনি দিয়ে।
তালিকা দীর্ঘ হতেই থাকবে। দরকার নেই।
দ্য লিফলেট-এর সম্পাদকমণ্ডলীর প্রশ্নটি ঠিক এই জায়গায়।
এই প্রেক্ষিতেই আমরা বরং একবার দেখে নিই ইউএসসিআইআরএফ তাদের রিপোর্টের শেষে মার্কিন সরকারের কাছে কী কী সুপারিশ করেছে।
প্রথমত তাদের আর্জি, ভারতের এই দুর্বিষহ অবস্থার কারণে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী ভারতকে “বিশেষ উদ্বেগজনক দেশ”-এর গোত্রে ফেলা হোক।
দ্বিতীয়ত, ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে যে সন্ত্রাস চলছে তার নিন্দা করা হোক এবং সরকার এবং সরকার-পোষিত সংগঠনগুলি যে সমস্ত ধর্মীয় এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলির ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে তাদের সহায়তা করা হোক।
তৃতীয়ত, ভারতের যেসব সরকারি সংস্থা বা আধিকারিক ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে গুরুতর অপরাধী তাদের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হোক। যেমন তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হোক, বা মার্কিন দেশে তাদের ঢোকার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হোক।
চতুর্থত, তারা মার্কিন কংগ্রেসের কাছে ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বৈঠকগুলিতে এই ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের বিষয়টি উত্থাপনের জন্য এবং ভারত সরকারকে এ-বিষয়ে সক্রিয় হতে চাপ দেওয়ার জন্য আর্জি জানিয়েছে।
এবার এগুলি পড়ে কারও যদি সেই গাঁ-দেশের প্রবাদটা মনে পড়ে যায়— মেড়া কোঁদে খুঁটোর জোরে— তবে কি তাকে দোষ দেওয়া যাবে?
অতএব…
অতএব আমাদেরই ঠিক করতে হবে আমরা আমাদের দেশটাকে একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চাই, নাকি এক বর্বর তালিবানি শাসনকেই আমাদের ভবিতব্য বলে মেনে নিতে চাই। দেশ ইতিমধ্যেই সেদিকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে, এবার আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর পালা।
কন্নড় জনগণ বুঝেছেন, বুঝছেন দেশের গর্ব কুস্তিগিররাও, বাকি ভারতবাসীও বুঝবেন— অচিরেই— সম্ভবত, ২০২৪-এই।
[1] ‘Quit’ notices, cross marks on shops send chilling message, Uttarakhand’s Purola town tense. TOI. June 6, 2023.
[2] Kakvi, Kashif. Khargone: Communal Violence Leaves Many Displaced, State Action Targets Muslims. The Wire. Apr 14, 2022.
[3] মুখোপাধ্যায়, প্রবীর। পশ্চিমবঙ্গে রামনবমী: হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের জমি তৈরির প্রয়াস। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। মে, ২০২৩।
[4] 2022 Report on International Religious Freedom: India. Office of International Religious Freedom. US Department of State.
[5] Freedom in the World 2022. Freedom House.
[6] Banerjee, Preetha. India 2nd-most dangerous country in 2022 for those flagging concerns about corporate projects: Report. Down To Earth. May 5, 2023.
[7] Crimes in India 2021. National Crime Records Bureau.
[8] Tiwari, Vishnukant. Forced Out of Homes, Tribals Bear Brunt of ‘Conversion’ Politics in Chattisgarh. The Quint. Dec 29, 2022.
[9] Aafaq, Zafar. India activist Afreen Fatima says her house bulldozed ‘illegally’. Aljazeera. June 13, 2022.
[10] ‘Muslims Should Be Set Ablaze Just As Hindus Burn Ravana Effigies on Dussehra’: BJP MLA. The Wire. May 8, 2022.
[11] Pandey, Neelam. VHP releases list of 400 ‘love Jihad’ cases, demands central law from Modi govt. The Print. Dec 1, 2022.
[12] Section 5 in The Special Marriage Act, 1954. Indiankanoon.org.
[13] FCRA license of 1,811 NGOs cancelled in 3 years: Government. PTI. Dec 13, 2022.
[14] India: Biased Investigations 2 Years After Delhi Riot. Human Rights Watch. Feb 21, 2022.
[15] Police publicly flog men who disturbed Navratri Garva event in Gujarat. The Hindu. Oct 5, 2022.
[16] Dasgupta, Sravasti. What is Bulli Bai scandal — Indian app that listed Muslim women for auction. Independent. Jan 8, 2022.
[17] International Religious Freedom Report: Why does domestic pride turn to international shame for the current regime? The Leaflet. Jun 2, 2023.
[18] “Biased, Motivated”: India on US Government’s Religious Freedom Report. PTI. May 2, 2023.
*মতামত ব্যক্তিগত