অনির্বাণ চন্দ
(স্থায়ী সূচনা সে এক)
শেষমেশ সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলল দশানন।
দশানন গায়েন পেশায় কৃষক (ভাগচাষি, তার বেশি নয়। নিজের জমি এক ছটাকও নেই তার। তবে, ওদের মতো কার-ই বা আছে?), জাতে মাতাল, নেশায় মুখোশধারী। না, মানে রাজনৈতিক নেতা নয়। রামলীলা, চড়ক, গাজন— এইসব সময়ে যেসব লোকদের হঠাৎই মনে পড়ে, হঠাৎই কদর বেড়ে যায়, সেইরকম একজন। মুখোশ পরে অভিনয় করে ওরা। মঞ্চেই। কারও জীবন নিয়ে নয়।
কদিন ধরেই মধুরার শরীরটা একেবারে ভাল যাচ্ছে না। মধুরা, মানে, দশাননের বউ আর কী। কোত্থেকে যেন অনেক রোগ এসে জুটেছে বউটার। রোগ, রোগ আর রোগ। এসব ভাবতে বসলেই আজকাল কেমন যেন দমবন্ধ লাগে দশাননের। মনে-মনে বলে, “ধুর শ্লা!”
এককালে মধুরা ছিল সত্যিই মধুরা। সত্যি-সত্যিই হেব্বি সুন্দরী ছিল। আর ছিল সুন্দর গলার গান। শেখেনি কখনও যদিও, কিন্তু ওই আর কী, শুনে-শুনেই শেখা। দশাননের সঙ্গে মধুরার দেখা এক বিয়েবাড়িতে। পাশের গাঁয়ে। প্রথম দেখাতেই খুব পীরিত উথলে ওঠে। তারপর দুজনে দুজনায় মজেই একবার গাজনের মেলা থেকে ওরা পালিয়ে গেল হর-পার্বতী সেজে। বাড়ির অমতে পালিয়ে বিয়ে।
তারপর, প্রেমিকা হয়ে গেল বউ। বচ্ছর পাঁচেকেই তিনটে ছেলে— ইন্দ্রজিৎ, অক্ষয় আর বিরাট। তারা প্রায় পিঠোপিঠি।
সে প্রায় এক যুগ আগের কথা।
এর পরেই বউ হয়ে গেল রুগী। মেয়েটার বুক-পিঠ এক হয়ে গিয়ে এখন প্রায় একপ্রকার ভাই-বোনের সম্পর্ক তাদের।
তবে তা বলে কেউ বলতে পারবে না যে দশানন বউয়ের সেবা-যত্ন করে না। কিন্তু বয়স (পড়ুন, যৌবন) চলে যাচ্ছে, আর, ধুর-শালা-কী-যে-রোগের-ডিপো-এত-খরচ-কোত্থেকে-পয়সা-পাব, এইসব চিন্তায় জেরবার হয়ে আজকাল একটু বেশিই মদ খেয়ে ফেলে দশানন, এটুকুই। মধুরা আজকাল মুখরা হয়ে গিয়েছে। আবার কখনও একটু বেশিই শান্ত।
তো, এইসব আদি-অকৃত্রিম সমস্যার মধ্যে অক্টোবরের এক সন্ধ্যায় একটা আধপোড়া বিড়ি মুখে লুঙ্গির খুঁটটা বাঁধতে বাঁধতে অনেকক্ষণ ভেবে-টেবে দেখল দশানন। নাঃ, যেতেই হবে। পয়সাটা বেশ ভালই বলছে পার্টি। তিন-চার দিনের মামলা, আসা-যাওয়া দুই-দুই চার দিন এক্সট্রা। মোদ্দা কথা, এক হপ্তার ঝক্কি। মধুরাকে বাড়িতেই রেখে যেতে হবে। রুগী মানুষ, বিছানা ছেড়ে উঠতে যে পারে না ও।
ঠিক আছে, বুড়ি জ্যাঠাইমা আছে তো, ভাবে দশানন। ও ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।
যেতে হবে অনেকদূর। তিনটে ছেলেকেই নিয়ে যাবে সঙ্গে। একজনের আয়ের তিনগুণ আয় হতে পারে! বড় দাঁও মারার চান্স, এটা হাতছাড়া করলে যে অভাব বেড়েই চলে…
(অন্তরা বা মধ্যিখানের কথা)
বাপ আর তিন ব্যাটা মিলে ট্রেনে চেপেছে কাল রাতে। স্লিপার ক্লাস। এ-ট্রেনেই তাদের বাকি যাত্রাপালার গ্রুপটা আছে, এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।
তাদের গন্তব্য অমৃতসর। সেখানের কে এক পয়সাওলা বাঙালি বাবুর খেয়াল হয়েছে, বিজয়া দশমীতে একটা বাঙালি রাবণ বধ পালা করতে হবে। মানে, দশেরার বাঙালি ভার্সন আর কী। ওখানের নন-বেঙ্গলিগুলোকে দেখিয়ে দিতে হবে, হাম বাঙালি কিসিসে কম নেহি! তো ডাক পড়েছে এক বাঙালি গ্রুপের, যারা রাবণ বধ পালা করবে।
সে যে যা দেখাতে চায় দেখাক, ভাবে দশানন। আমার পয়সা নিয়ে কথা। কোনও শালা তো এক নয়া পয়সা ঠেকাতে আসে না দরকারের সময়। এ যাত্রায় প্রত্যেকে পাবে দশ হাজার টাকা করে! এ কি ফেলনা?
দু রাত্তিরের জার্নি, খাবার বলতে সঙ্গে আনা মুড়ি, শুঁটো হয়ে যাওয়া চানাচুর আর কিছু ভেজা ছোলা। ছেলেগুলো তা-ই কী পরম তৃপ্তিতে গিলছে! দেখে আচমকা দশাননের চোখ হাল্কা ভিজে আসে। আহা রে, ওরা তো কোনওদিন ঘরের বাইরে বের হতেই পারেনি!
দশেরার এই ধ্যাস্টামি শেষ হলে তিনটে ছেলেকেই পেট পুরে পাঞ্জাবি রুটি-তড়কা খাওয়াতে হবে, ট্রেনের দুলুনির মধ্যেই মনে মনে ঠিক করে রাখে দশানন।
আর, মধুরার জন্য কী নিয়ে যাওয়া যায়?…
(সঞ্চারীতে সমাপ্তির আগে)
আজ দশেরা। ১৯ অক্টোবর, ২০১৮।
কাল রাত্তিরে একটা আজব টাইপের স্বপ্ন দেখেছে সে। এই রাম-রাবণ নিয়েই।
মেঘ করেছিল আকাশে, খুব। মেঘের আড়াল থেকে ভেসে আসছে একটা সুতীব্র আর্তনাদ। কে? কে কাঁদে? মেঘনাদ নাকি?
বেশ কিছু যুবতীর হাসি শোনা যাচ্ছে। এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে হাসির মতো হাসি। সঙ্গে একটা ছেলের প্যানপ্যানে গলার আওয়াজ। পাঁচালির সুরে বকে যাচ্ছে একটাই বাক্য—
—সীতা ধ্যান, সীতা জ্ঞান, সীতা চিন্তামণি
এক খসখসে নারীকণ্ঠে শোনা যায়—
—এ ম্যা গো! কেঁদে কেঁদে এ মালটা মোলো যা! আরে বউ গেলে তবেই তো নতুন বউ পাবি রে পাগলা!
—শক্তিশেলটা পেয়েছিস তো? আজ শালা মাছের তেলেই ভাজব মাছ! পাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে।
মধুরাকে দেখতে পায়। আরেঃ! রুগী নেই সে, বরং বেশ লাগছে তাকে। অনেকটা আগের মতোই… কিন্তু, এ কী! একটা বিরাট বিকট হনুমান মধুরার হাত ধরে টানছে কেন? মধুরা চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু অসীম শক্তিধর সে হনুমান টেনে-হিঁচড়ে মধুরাকে একটা ঝোপের আড়ালে টেনে নিয়ে যায়…
এমন সময় ঝপ করে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে দশানন। গায়ে বেশ বিনবিনে ঘাম। মাথাটা কেমন যেন দপদপ করছে।
নাঃ, বেজায় পেটগরম হয়েছে রে ভাই। এক গেলাস জলে একটা ইনোর প্যাকেট গুলে খেয়ে নেয় দশানন সক্কাল-সক্কাল।
আজ সকাল থেকেই বেশ একটা সাজ-সাজ ভাব সবার মধ্যে। জোড়া ফাটক বলে একটা লেভেল ক্রসিং আছে কাছেপিঠেই কোথায় যেন, সেখানেই হবে রাবণ-বধ। সাজগোজের পালা শুরু হয়েছে।
দশানন সাজছে রাবণ।
কাল সারারাত মশার কামড়ে আর এই আজব স্বপ্নের চোটে ঘুমই হয়নি। যাক গে, এমনিতেই রাবণের চোখে কালি থাকলে কাজল লাগবে কম। মেক-আপ দাদাকে একটা হাঁক দেয় দশানন।
(আভোগ, সত্যসমাপ্তি)
কিছুক্ষণ আগেই ঘটে গেছে বিপদটা।
একগাদা লোক জমা হয়েছিল তাদের যাত্রাটা দেখতে। এ সময়ে কোনও ট্রেন আসে না, তাই জোড়া ফাটকের রেললাইন জুড়েই বসেছিল তারা।
যাত্রাপালা শুরু হয়। খুব লড়ছে দশানন, মানে রাবণ। রাম সেজেছে যে ছেলেটা, সম্পর্কে মধুরার মাসতুতো ভাই হয়। এমনিতে পাত্তাই দেয় না জামাইবাবুকে। আজ উলটে এ শালা কলকেই পাচ্ছে না দশাননের সামনে। না অভিনয়ে, না লড়াইয়ে। কিন্তু ইতিহাসে তো এ কথা লেখা নেই। তাই খেলনা রামের হাতে শেষমেশ অক্কা পায় রাবণরূপী দশানন। স্টেজের মাঝখানে ধপাস করে পড়ে মরে যায়। আড়চোখে তার দিকে দেখে একটা বিদ্রূপের হাসি হেসে রামটা বিরাট সেই রাবণের পুতুলের বুকে একটা জ্বলন্ত মশাল ছুঁড়ে দেয়। পুতুলটা পুড়তে শুরু হয় আগুনে। ঘনঘন বাজি ফাটতে থাকে।
চারদিকের উন্মত্ত ‘জয় শ্রীরাম’ জয়ধ্বনির চক্করে সহসা আগন্তুক ট্রেনের হুইসলটা কেউই শুনতে পায়নি। আচম্বিতে রাবণরূপী দশানন দেখে, একরাশ লোকের শরীরগুলো ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে ট্রেনটা পালিয়ে গেল নিমেষের মধ্যে। পরিত্রাহি চিৎকার করতে-করতে কিছু লোক দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে এদিক-ওদিক ছোটে। কে কার পায়ে চাপা পড়ে, কেউ জানে না। জনতার কোনও নাম হয় না, মুখ হয় না।
শত আওয়াজের মধ্যেও দশানন দুঃস্বপ্নের মত শুনতে পায়, অক্ষয় আর বিরাটের ভয়ার্ত চিৎকার— বাবা! বাবা! বাঁচাও…!
ছুটে স্টেজ থেকে নেমে আসতে যায় দশানন। চিৎকার করে বলতে চায়— ভয় পাস না! আমি আসছি!
কিন্তু দশানন কিছুই করতে পারে না। এক লোকসমুদ্রের জোয়ার তাকে ঠেলে সরিয়ে দেয় ছেলেদুটো থেকে…
ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে-যেতেও দশানন প্রাণপণে মনে করতে থাকে, ইন্দ্রকে কোথায় যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল সে… কোথায়… কিছুতেই মনে করতে পারে না সে…
এর মাঝে জ্বলন্ত রাবণের পুতুলটা ধড়াম করে ভেঙে পড়ে যায়। পুড়তে থাকে ধিকিধিকি করে।
(দৃশ্যকল্প, কিছুক্ষণ পরে)
চারিদিকে শুধু ধোঁয়া। একটু-একটু মড়া পোড়ার গন্ধও ভেসে আসছে যেন। বেশ কিছু দমকলের গাড়ি এসে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলো মৌমাছির মতো ভনভন করছে চারদিকে। যথারীতি এসে গেছে মোবাইল মিডিয়া এবং স্থানীয় নেতারা। নিয়মমাফিক ক্ষতিপূরণ হিসেব হয়ে চলেছে মুখে-মুখে।
হঠাৎই আধপোড়া রাবণের পুতুলটার কিছুটা নড়ে ওঠে। আগুন নেভেনি এখনও সে চিতার। তলায় কেউ চাপা পড়ে আছে বোধহয়, এই ভেবে দমকলের লোকগুলো দৌড়ে এগিয়ে যায় উদ্ধারের চেষ্টায়।
ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা আরো গভীর ধ্বংসস্তূপ থেকে কে যেন বেরিয়ে আসছে। একটা লোক। কে ও? কারও স্বামী? পিতা। কে জানে, হয়তো তাই হবে। এখন সে স্বয়ং ধ্বংসস্তূপ যেন। শোকে না বিপাকে স্তব্ধ, এ আবছায়ায় ঠিক বোঝা যায় না।
একরাশ মানুষের ভগ্নাংশ, ছাই-মাটি-আগুন, এসবের মাঝখান দিয়ে টলোমলো পায়ে হেঁটে বের হয়ে আসে দশানন। তার বুকে জড়ানো আছে ইন্দ্রজিৎ। কে জানে, বেঁচে আছে বোধহয় বড় ছেলেটা। তাকে বুকে করে জড়িয়ে থাকে দশানন। অসীম স্নেহে। সব-খোয়ানোর পরে বাকি থাকা স্নেহে। হারিয়ে পাওয়ার স্নেহে।
এগিয়ে আসতে গিয়ে হঠাৎ দশানন কিসে যেন হোঁচট খায়। কে একটা যেন ছিন্নভিন্ন। এ যে তার সেই শালা! রামচন্দ্র। আর নেই? কে জানে, হয়তো বেঁচেই আছে? দশানন আর ফিরে তাকায় না। সময় খুব কম। খুব ধীরপায়ে হেঁটে-হেঁটে দৃশ্যটা থেকে সরে যায় তারা দুজনে। ছেলে বুকে করে বাবা। বিশল্যকরণী কোথায় পাওয়া যাবে…?
মিডিয়ার ক্যামেরা হাজার চেষ্টা করেও বুঝে উঠতে পারে না, হাজার বছর পর এবার দশানন বাঁচাতে পেরেছে তার ইন্দ্রজিৎকে!