কণিষ্ক চৌধুরী
শরিয়ত ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যের বাইরেও একটি গতিশীল ভাবনা ভারতীয় সমাজে বরাবরই থেকে গেছে। প্রাচীন ভারতে আন্বিক্ষীকি, স্বভাববাদ, লোকায়ত, বিতণ্ডাবাদ, অনেকান্তবাদ, উদ্দালক-আয়নীর ভাবনার মধ্যে যার প্রথম প্রকাশ ঘটে, পরে চার্বাক, আকবর, আবুল ফজল এবং মোবাদ শাহের রচনার মধ্যে দিয়ে তা বিকশিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় রামমোহন-বিদ্যাসাগর-অক্ষয় দত্তের মধ্যে দিয়ে। অলৌকিকতা ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে মানবতাবাদী, ইহজাগতিকতাবাদী এই ধারাটির সন্ধান তাই সবকালেই অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে
রামমোহনের তুহফাৎ-উল-মুওয়াহিদিন-এর বক্তব্য নিঃসন্দেহে সেই সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকা ভাবনা। এই ভাবনার আবির্ভাব যে বৌদ্ধিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত তা প্রায় পুরোপুরিই প্রাচ্যদেশীয়। তুহফাৎ থেকে রামমোহন-চিন্তার প্রধান যে দুটি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায় তা যেমন যুক্তিনির্ভর, তেমনই শাস্ত্রনিরপেক্ষ। এই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ইউরোপীয় ডিইস্ট (Deist)-দের বেশ খানিকটা সাদৃশ্য আছে। অনেকে Deism-এর বাংলা অনুবাদ করেন: যুক্তিসঞ্জাত ঈশ্বরবাদ। ডিইস্টদের মতে, একেবারে সৃজনের আদিলগ্নে ঈশ্বর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে এক মোক্ষম ঠেলা দিয়ে সরে পড়েছেন। তারপর থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিজের নিয়মেই চলছে। ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের আর প্রয়োজন পড়ছে না।[1] রামমোহনের অবস্থানটিও অনেকটা এইরকমই। তিনি সৃষ্টি ও স্রষ্টার ভূমিকা সহ ইহজগৎকে বুঝতে চান কার্যকারণ সম্পর্ক ও যুক্তির মধ্যে দিয়ে। তাই তিনি অলৌকিকতা সহ অর্থহীন ও কুৎসিত আচার-অনুষ্ঠানকে বাতিল করে দেন। আর ঈশ্বর ও উপাসকদের মধ্যেকার মধ্যস্থতাকারী পুরোহিত/মোল্লা ইত্যাদিদের অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। যুক্তিবাদ তাঁর চিরসঙ্গী। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলি সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ মোহমুক্ত। তিনি কোনও ধর্ম অনুসরণ করেননি, বা তৈরি করেননি, বা প্রচার করেননি। ধর্ম তাঁর কাছে একান্তই ইহজাগতিক স্বার্থ সাধনের উপায় মাত্র।
দুই.
তুহফাৎ রচনার ক্ষেত্রে রামমোহনের উপর একটি প্রত্যক্ষ ও অপরটি পরোক্ষ প্রভাবের কথা বলা যায়। প্রথম ও প্রত্যক্ষ প্রভাবটি অবশ্যই তাঁর আরবি ও ফার্সি ভাষা শিক্ষা। দ্বিতীয় ও পরোক্ষ প্রভাব হিসেবে ভারতীয় ধর্মসহিষ্ণুতার ঐতিহ্যের ধারা ও বিশেষ করে ‘দবিস্তান-ই-মজহিব’ গ্রন্থটির নাম করতে হবে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে তখনও বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলিতে আরবি/ফার্সি শিক্ষার প্রচলন ছিল। সেই অনুসারেই রামমোহনকে ১৭৮০-র কাছাকাছি কোনও একটা সময়ে বিদ্যাশিক্ষার জন্য পাটনায় পাঠানো হয়। তিনি সেখানে আরবি/ফার্সি শিক্ষা করেন। কোরান পাঠের পাশাপাশি সুফি সাধকদের রচনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এ-সময়েই। আরবি ভাষাতেই তিনি ইউক্লিড ও অ্যারিস্টটলের লেখা পাঠ করেন। একদিকে যেমন একেশ্বরবাদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস গড়ে উঠতে থাকে, তেমনি অন্যদিকে যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনাও তাঁর চিন্তায় স্থায়ী আসন লাভ করে। তিনি পার্সি কবি হাফিজ ও জালালুদ্দিন রুমির রীতিমতো ভক্ত হয়ে ওঠেন। তাঁদের কবিতার প্রভাব তাঁর জীবনে একটা বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিল। তিনি মানুষের প্রতি প্রেম ও ঐশিক প্রেম উভয়ের থেকে নিজেকে কোনওদিন বিচ্ছিন্ন করেননি। তুহফাৎ-এর মধ্যে তাই দেখা যাবে এই প্রেমের উপস্থিতি, দেখা যাবে একেশ্বরবাদের জয়গান। একই সঙ্গে ইহজাগতিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ। এখানেই রামমোহন-চিন্তার অনন্যতা। এটাই তাঁর মৌলিক চিন্তার প্রকাশ।
তিনি মনে করতেন স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ দান। এই স্বাধীন নিচারবুদ্ধিকেই তিনি প্রয়োগ করলেন তুহফাৎ-এ। বইটি গভীরভাবে পাঠ করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ইসলামিক সাহিত্য পাঠ তাঁকে কীভাবে প্রেরণা দিয়েছিল। তিনি ইসলামিক ধর্মসাহিত্য ও ইতিহাস পাঠ করে যে সম্পদ সংগ্রহ করলেন তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েই সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোকে বর্জন করলেন। তিনি দেখলেন যে ইসলামের ইতিহাসে কেবল গোঁড়া গজ্জালি ও ধর্মান্ধ যুক্তিহীন ধর্মনেতারাই নেই, পাশাপাশি রয়েছে ‘মুতকল্লিম’রাও। রয়েছে যুক্তিবাদী মুতাজিলা সম্প্রদায়, যাদের অবস্থান কট্টরপন্থী শাস্ত্রবাদীদের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। মুতাজিলা সম্প্রদায়ের পণ্ডিতরা বলতেন, কোরান অনাদি ও নিত্য হতে পারে না, এই গ্রন্থ ঈশ্বরের বাণী হলেও তা সৃষ্ট বস্তু। একে যদি অনাদি ও নিত্য বলা হয়, তাহলে অনাদি, অনন্ত, নিত্য পরমেশ্বরের অতিরিক্ত আরেকটি অনাদি ও নিত্য বস্তু স্বীকার করতে হয় এবং তার দ্বারা ইসলামের মূল তত্ত্ব একেশ্বরবাদই খণ্ডিত হয়। মুতাজিলাগণ ঈশ্বরের গুণ স্বীকার করতেন না। মৃত্যুর পর শারীরিক কিয়ামতে বা স্বর্গে ঈশ্বরের চাক্ষুষ দর্শনলাভের সম্ভাব্যতায় এঁদের বিশ্বাস ছিল না। এছাড়াও মানুষের পাপ-পুণ্য, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ধারণের দায়িত্ব মানুষের নিজের বলে তাঁরা মনে করতেন। এভাবেই তাঁরা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ক্রিয়াশীলতাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। রামমোহন রায়ের তুহফাৎ-এ এ-ভাবনার প্রতিফলন যে সুস্পষ্ট তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
তুহফাৎ-এর উৎস সন্ধান করতে গিয়ে জাহিদা জাইদি তিনটি মূল প্রভাবের কথা বলেছেন— ক. কোরানের প্রভাব; খ. ঐস্লামিক চিন্তাধারার অন্তর্গত অতীত ও বর্তমানের অন্ধ আনুগত্যবিরোধী ও যুক্তিবাদী আন্দোলন সমূহের প্রভাব; গ. সুফি ভাবধারার মর্মোপলব্ধি ও আত্তীকরণ, বিশেষত সুফি ও মানবতাবাদী ফার্সি কবিতার মহান কবিরা এই ভাবধারাকে যে রূপ দান করেছেন তার।[2] কোরানের প্রভাবগুলিকে জাইদি যেভাবে ভাগ করেছেন সেগুলি এইরকম: অ. তৌহিদ বা একেশ্বরবাদ; আ. মানুষের সম্ভাবনাময় সৃষ্টিশীলতার গুরুত্ব; ই. প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও হৃদয় দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে এই অপরূপ বিশ্বকে বোঝার চেষ্টার মাধ্যমে পরমেশ্বরের উপলব্ধি সম্ভব— এই বিশ্বাস; ঈ. পৌত্তলিকতা ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর অন্যান্য আরাধনা পদ্ধতির নিন্দা।[3]
রামমোহনের ভাবনার উপর ইসলামের যথেষ্ট প্রভাব থাকলেও, তিনি তুহফাৎ-এ মোল্লাতন্ত্রের সমালোচনা করতে কার্পণ্য করেননি। দ্বিধা করেননি সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিকে মিথ্যা বলে চিহ্নিত করতে। যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ ও সহিষ্ণুতা যেহেতু তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে ছিল, তাই তাঁর পক্ষে প্রচলিত ধর্মগুলিকে নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হয়েছে। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, ইসলাম বা খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে কোনওদিন তিনি কোনও মোহ রাখেননি। কারণ এইসব ধর্মগুলি নানা কুসংস্কার, অন্ধত্ব, গোঁড়ামি ও কুপ্রথাকে প্রশ্রয় দেয়। উদার মানবতাবাদী রামমোহন তাই এদের বিপরীত পথেই হেঁটেছিলেন।
তিন.
তুহফাতের ওপর দ্বিতীয় ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছিল মোবাদ শা-র রচিত ‘দবিস্তান-ই-মজহিব’ নামক গ্রন্থটির। ফার্সি ভাষায় রচিত এই গ্রন্থটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, দবিস্তান-এর আলোচ্য বিষয় ও উপস্থাপনার রূপ। দ্বিতীয়ত, গ্রন্থটি রচনার সময়কাল। দবিস্তানের অনেকগুলি হাতে লেখা নকল পাওয়া যায়। সেখান থেকেই জানা যায় লেখকের নাম ও আংশিক পরিচয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকের হাতে লেখা একটি নকলে লেখকের পুরো নাম দেওয়া হয়েছে— মীর জুলফিকার আলী আল-হুসেইনি ওরফে মোবাদ শাহ। তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যু ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে। তিনি তাঁর জীবৎকালে শাহজাহানকে দিল্লির দিল্লির সম্রাট হিসেবে পেয়েছিলেন। হোশিয়ার নামে জনৈক ব্যক্তি ছিলেন তাঁর পিতৃতুল্য অভিভাবক। শৈশবে হোশিয়ার তাঁকে নিয়ে যান বালকনাথ তপস্বীর কাছে। তখন তাঁরা সম্ভবত পাটনায় থাকতেন। পাঁচ বছর পর হোশিয়ার তাঁকে পাটনা থেকে আগ্রায় নিয়ে আসেন। এই সময়েই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে চতুর্বর্গ গোঁসাই নামের এক যোগীর সঙ্গে। এছাড়াও কাশ্মির সহ বিভিন্ন স্থান তিনি ভ্রমণ করেন। এই ভ্রমণকালে পরিচয় হয় বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিত মানুষদের সঙ্গে। যাঁদের কাছ থেকে মোবাদ শাহ বিভিন্ন ধর্মের মূল ভাবনাগুলি শিক্ষা করেন এবং তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। রচনাটি শেষ হয় আনুমানিক ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে ওডিশার শ্রীকাকুল নামক একটি স্থানে।[4]
মোবাদ শাহ লিখিত ‘দবিস্তান-ই-মজহিব’ গ্রন্থটি সর্বমোট ১২টি তালিম বা অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রতিটি অধ্যায় ও তার বিষয়বস্তুগুলিকে নজর করলে দেখা যাবে সমকালে প্রচলিত প্রায় সব কয়টি বিশ্বধর্ম সম্পর্কে এখানে আলোচনা রয়েছে। তালিকাটির উল্লেখ প্রয়োজন।
১. পার্সি ধর্মীয় ধারা সমূহ। এখানে পার্সি ধর্মের ১৩টি শাখার উল্লেখ রয়েছে।
২. দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে স্মার্ত, বেদান্ত, সাংখ্য, যোগী, শাক্ত, বৈষ্ণব, চার্বাক, তার্কিক বৌদ্ধ, জৈন ধর্ম সহ নানা ছোট ছোট ধর্ম সম্প্রদায়ের উল্লেখ।
৩. তিব্বতি বৌদ্ধ ধর্ম এবং
৪. ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে মোবাদ জেনেছিলেন শর্মাদ কাসানির কাছ থেকে, যিনি জন্মসূত্রে ইহুদি হলেও নিজেকে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে পরিচিত হতে চাইতেন না।
৫. তার্সা বা খ্রিস্ট ধর্ম।
৬. মহম্মদীয়া, সুন্নি, শিয়া, আকবরীয়, ইসমাইলি, আলি ইল্লাহান।
৭. সাদাকিয়া।
৮. বাহাদিয়া (মধ্য এশিয়ার ধর্ম, বাহেদ মামুদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত)।
৯. রোশানিয়া।
১০. দীন ইলাহি।
১১. প্রজ্ঞা ধর্ম (হেলেনীয় ঐতিহ্য)।
১২. সুফি ধর্ম।
দবিস্তান-এ আলোচিত ধর্মবিশ্বাসগুলির তালিকাটি দেওয়া হল এই কারণেই যে, সে-সময়ে বহু বিচিত্র ধর্মগুলি পাশাপাশি অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারত, নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী ধর্ম-অনুষ্ঠান করতে পারত— এটা দেখানো। সহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানের কারণেই এতগুলি ধর্মমতের সন্ধান মোবাদ শাহ পেয়েছিলেন। এটা মূলত মুঘল শাসনের সহিষ্ণুতা ও প্রায় সেকুলারবাদী নীতি (অবশ্যই সেকুলার শব্দের আধুনিক সংজ্ঞার সদৃশ হওয়া তখন সম্ভব ছিল না) এর জন্য দায়ী। এরই পাশাপাশি সমাজে সে-সময়কার সমন্বয়বাদী আন্দোলনের একটি প্রভাবও ছিল। ফলে প্রাচীন যুগ এবং আদি মধ্যযুগের ব্রাহ্মণ্যবাদ অবশ্যই কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এই সমন্বয়বাদী সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বড় প্রমাণ দবিস্তান-এ উল্লেখিত ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির অস্তিত্বের কথা।
এখানে আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজন। মোবাদ শাহ তাঁর গ্রন্থে ধর্মগুলি সম্বন্ধে যেমন যেমন তথ্য পেয়েছেন, তেমন তেমন বর্ণনা করেছেন। এখানে তিনি নিজের কোনও মত প্রকাশ না করেই শুধুমাত্র বিবরণ দিয়েছেন। কোনও ধর্মের প্রতি সমর্থন বা বিরাগ দেখাননি। এই দিক থেকে দেখলে মোবাদ শহ-র এই কাজটি একটি সমাজতাত্ত্বিক কাজ। কাজটির দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য— ক. ক্ষেত্রসমীক্ষার মধ্যে দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা; এবং খ. মূল্যনিরপেক্ষভাবে বা পক্ষপাতশূন্যভাবে বর্ণনা দেওয়া।
দবিস্তান-এর মর্মবস্তু সম্বন্ধে এত কথা বলার কারণ এটা দেখানো যে পরবর্তী মধ্যযুগ থেকে প্রবাহিত সমন্বয়ী ও উদারতাবাদী চিন্তাধারাটির স্রোত অষ্টাদশ শতাব্দীতেও বেশ জীবন্ত ছিল। মোবাদ শাহের পিতৃতুল্য অভিভাবক হোশিয়ার ছিলেন আজুর কাইওয়ানের শিষ্য। আজুর কাইওয়ান ছিলেন একেশ্বরবাদী। তিনি ইরান থেকে এসে পাটনায় বসবাস করতেন। এখানেই ১৬০৬-৭ সালে মারা যান। মোবাদ শাহ হোশিয়ারের মধ্যে দিয়ে আজুর কাইওয়ানের ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হন। তিনি তাঁর দবিস্তানে কাইওয়ানকে ‘সর্ববিদ্যাবিশারদ’, ‘মহান দার্শনিক’ বলে চিহ্নিত করেছেন। কাইওয়ান নিজে একেশ্বরবাদী হলেও শিষ্যদের শেখাতেন সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে, কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায় নিকৃষ্ট নয়, ঈশ্বর সর্বব্যাপী। ধর্মান্তরকরণের তিনি বিরোধী ছিলেন। এই ভাবনা দ্বারা মোবাদ শাহ পরিচালিত হন। কাইওয়ানের শিষ্যদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। ফলে পাটনায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগেও মোবাদ শাহের ‘দবিস্তান’ গ্রন্থটির হাতে লেখা নকল কাইওয়ানের শিষ্যদের কাছে পাওয়া যেত। ফার্সি ভাষায় শিক্ষিত রামমোহনের হাতে এই গ্রন্থ না পড়ার তাই কোনও কারণ ছিল না। বা এই গ্রন্থের মূল ভাবনার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটার সম্ভাবনাও যথেষ্ট ছিল। কারণ এই সময়ে পাটনা ছিল কাইওয়ানপন্থীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তুহফাতের মধ্যে একেশ্বরবাদের প্রভাব নানা ধর্মের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রবণতা দেখিয়ে দেয় রামমোহন ‘দবিস্তান’ দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে বেশ ভালরকমই প্রভাবিত হয়েছিলেন।
চার.
রামমোহন শৈশব-কৈশোরকালে নিজ পরিবারের মধ্যে বৈষ্ণব-শাক্ত সংঘাতের বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। এই সংঘাত তাঁকে পৌত্তলিক ধর্মগুলি সম্বন্ধে মোহশূন্য করে তোলে। ছাত্রাবস্থায় ইসলামের সঙ্গে সংযোগ তাঁর সামনে একেশ্বরবাদের দিগন্ত খুলে দেয়। একেশ্বরবাদের প্রতি আকর্ষিত হলেও ইসলামকে তিনি সমালোচনামূলক দৃষ্টিতেই লিখেছিলেন। কারণ তিনি মুতাজিলাদের মতোই কোরানকে ঈশ্বরের বাণী হিসেবে গ্রহণ করেননি বা মহম্মদের অলৌকিক ক্ষমতায় তাঁর মোটেই বিশ্বাস ছিল না। এ সত্ত্বেও তুহফাতের ওপর যে ইসলামের যথেষ্ট প্রভাব ছিল তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
তবে মানবতাবাদ ও উদার সহিষ্ণু চিন্তা সহ সমন্বয়বাদী ধারণার প্রভাব তুহফাতে বিরাটভাবে পড়েছিল— তা সন্দেহাতীত। এখানেই ‘দবিস্তান-ই-মজহিব’-এর প্রসঙ্গ উঠে আসতে বাধ্য। শরিয়ত ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যের বাইরেও এমন একটি গতিশীল ভাবনা ভারতীয় সমাজে যে বরাবরই থেকে গেছে, দবিস্তান-ই তার বড় প্রমাণ। এই দুটি গ্রন্থের মধ্যে আরও সংযোগসূত্র হল যুক্তিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ— যা উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিফলিত হয়েছে। রামমোহনকে তাই ‘তুহফাৎ’ রচনার জন্য ইউরোপের কাছে হাত পাততে হয়নি, কারণ তা দেশীয় সজীব ধারার মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে। প্রাচীন ভারতে আন্বিক্ষীকি, স্বভাববাদ, লোকায়ত, বিতণ্ডাবাদ, অনেকান্তবাদ, উদ্দালক-আয়নীর ভাবনার মধ্যে যার প্রথম প্রকাশ ঘটে, পরে চার্বাক, আকবর, আবুল ফজল এবং মোবাদ শাহের রচনার মধ্যে দিয়ে তা বিকশিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় রামমোহন-বিদ্যাসাগর-অক্ষয় দত্তের মধ্যে দিয়ে। অলৌকিকতা ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে মানবতাবাদী, ইহজাগতিকতাবাদী এই ধারাটির সন্ধান তাই সবকালেই অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছে। কখনও হয়তো ক্ষীণ হয়ে পড়েছে, কিন্তু ধারাটি পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। শুকিয়ে যায় না।
[1] লাহিড়ী, আশীষ। ২০০৯ : ৪১।
[2] জাইদি। ২০১৯ : ১০১।
[3] পূর্বোক্ত।
[4] রায়। ২০১৯ : ১১০, ১১২।