শঙ্কর সান্যাল
পাটনা বৈঠকটি কংগ্রেস কিংবা বামপন্থীরা আহ্বান করেনি। এদের বিজেপি-বিরোধিতা প্রশ্নাতীত। যাঁরা ডেকেছিলেন এবং সর্বাধিক উৎসাহী ছিলেন, বিজেপি-বিরোধিতার প্রশ্নে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। আর শুরু থেকেই এমন একটি চিত্র তৈরি করা হল যাতে বিজেপি-বিরোধী শিবিরের মধ্যে গাঢ় অনৈক্যের ছবিটা ফুটে ওঠে। এই পিকচার আভি ভি বাকি হ্যায়
এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগের কাল। দুর্যোগ না বলে বরং দুর্দৈব বলাই ভাল। ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনে ভারতীয় জনতা পার্টি গত প্রায় এক দশক ধরে। না, রক্তস্নাত রাস্তায় তারা ক্ষমতায় আসেনি। বরং বেশ নিরুপদ্রবেই ভারতীয়দের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পরপর দু-বার তারা ক্ষমতায় এসেছে। গণতন্ত্রে বিভিন্নবিধ বিপরীতমুখী সমীকরণ, স্রোত এবং অঙ্ক থাকে। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে বিজেপি সেই সমস্ত অন্তর্লীন শক্তিকে সংহত করে বিরোধীদের পর্যদুস্ত করতে পেরেছিল। ২০১৪ সালে গোটা ভারত এক অবদমিত আকাঙ্খা থেকে ইউপিএ সরকারকে সরিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় এনেছিল। কিন্তু তারপরের পাঁচ বছর বিজেপির যাবতীয় কর্মকাণ্ড ছিল আক্ষরিক অর্থেই জনবিরোধী, ভারতের সংবিধানের মূল সুরটির পরিপন্থী এবং গণতন্ত্রবিরোধী। কিন্তু বিজেপি তার প্রথম পাঁচ বছরের রাজত্বকালে যে কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে করতে পেরেছিল— সেটা হল বিরোধীদের ক্রমশক্তিহীন করে দেওয়া। বিশেষ করে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপির সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসকে কার্যত গুরুত্বহীন করে দেওয়া। বামপন্থীরা বিভিন্ন কারণেই শক্তিহীন। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে, কেবল কেরলে ক্ষমতায়। লোকসভা এবং রাজ্যসভাতেও উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে মজার ব্যাপারটি হল যে কোনও রাজনৈতিক দলের যত বড় সংগঠন থাকুক না কেন, তারা যত আন্দোলন সংগ্রামই করুক না কেন, তা ইভিএমে প্রতিফলিত না হলে তাদের কোনও গুরুত্ব নেই। তাহলে এই সময়কালের মধ্যে দুটি সর্বভারতীয় শক্তি কংগ্রেস এবং বামপন্থীদের গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ায় সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে গেল ভারতীয় জনতা পার্টি। কংগ্রেস পঞ্জাবের মতো রাজ্যে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় সেই সুবিধা আরও কিছু বেড়েছে। অবশ্য এর মধ্যেই কর্নাটকে কংগ্রেস আবার ক্ষমতা দখল করায় পরিস্থিতিতে খানিকটা বদল এসেছে। ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজস্থান, ছত্তিশগড় এবং মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। এই তিনটি রাজ্যেই ভোটে জিতে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল। মধ্যপ্রদেশে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়। এবারও ওই তিন রাজ্যের ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এইরকম এক জটিল দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে সম্প্রতি পাটনায় বসেছিল বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বৈঠক। কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি এবং সিপিআই(এম) বাদ দিলে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের খাতায় বাকি কারও পিছনেই জাতীয় দলের তকমা নেই। সবাই আঞ্চলিক দল। যারা বৈঠকে যোগ দিয়েছিল, তাদের মধ্যে আম আদমি পার্টি এবং তৃণমূল সরাসরি নাগপুরের ঝাণ্ডেওয়ালা ভবনের ডিস্ট্যান্ট লার্নিংয়ের ছাত্র। এই দুটি দলই আপাতভাবে বিজেপি-বিরোধিতায় উচ্চকণ্ঠ। বিজেপিও বিভিন্ন চাপ, মূলত গোয়েন্দা এজেন্সির চাপ তৈরি করে এদের কব্জায় রাখার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে আবার এই দুটি দলকেই বিজেপি ব্যবহার করে কংগ্রেস এবং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বাফার ফোর্স হিসাবে। যেখানে বিজেপির ক্ষমতায় আসার দূরতম সুযোগও নেই, সেখানে আপ এবং তৃণমূলের মতো দল ক্ষমতায় থাকুক, এটাই বিজেপি চায়। এই কৌশল কংগ্রেস এবং বামপন্থীদের গুরুত্বহীন করার কৌশল। এই দুটি পার্টিকে বিজেপি আরও একটি কাজে ব্যবহার করে। সেটি হল বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী ভোটে ভাগ বসিয়ে বিজেপির সুবিধা করে দেওয়ার কাজে। যেমন গোয়ায়, ত্রিপুরায় এবং মেঘালয়ে এই কৌশলের সফল প্রয়োগ করা গিয়েছে। তৃণমূল এবং আপকে কিন্তু বিজেপি-বিরোধিতায় উচ্চকিত থাকতেই হয়। এটা তাদের অস্তিত্বরক্ষার প্রয়োজনে করতে হয়। নয়তো তারা শিরোমণি অকালি দল এবং গোয়ার মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টির মতো অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। পাটনা বৈঠকের আহ্বায়ক বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও সন্দেহাতীত নন। তিনিও একাধিবার বিজেপির সমর্থনে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর দল জনতা দল ইউনাইটেড বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র গুরুত্বপূর্ণ শরিক ছিল। এটা প্রমাণিত সত্য যে নীতীশ কুমারের বিজেপিতে খুব একটা অরুচি নেই। কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা বাদ দিয়ে নিখাদ বিজেপি-বিরোধী অবস্থান রয়েছে তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় মুনাত্রা কাজাঘাম বা ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় জনতা দলের। আরও একটি দল জম্মু-কাশ্মিরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিজেপি-বিরোধিতায় কোনও খাদ নেই।
এবার সরাসরি আসা যাক পাটনা বৈঠক প্রসঙ্গে। বৈঠকটি আহ্বান করেছিলেন নীতীশ কুমার। আর বৈঠকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেখিয়ে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অরবিন্দ কেজরিওয়াল। রাহুল গান্ধি, মল্লিকার্জুন খড়্গে, সীতারাম ইয়েচুরি এবং ডি রাজা গিয়েছিলেন বিজেপি-বিরোধিতার এক আবশ্যিক বাধ্যবাধকতা থেকে। কিন্তু বৈঠকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল যে প্রসঙ্গটি বৈঠকে তুলে কংগ্রেসকে তুলোধোনা করতে শুরু করেছিলেন, সেটির আদৌ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ছিল না। দিল্লি সরকারের আমলাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে রাখতে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অস্বীকার করে বিজেপি যে অর্ডিন্যান্স জারি করেছে, কংগ্রেস তার বিরোধিতায় কেন সরব হয়নি? এই প্রশ্নটি তোলার উপযুক্ত স্থান কি পাটনার বৈঠক? দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে এই প্রসঙ্গটি নিয়ে কেজরিওয়াল সরাসরি রাহুল কিংবা সোনিয়া গান্ধির সঙ্গে পৃথকভাবেও আলোচনা করতে পারতেন। কিন্তু করলেন না। এই প্রসঙ্গটি নিয়ে বৈঠকের মধ্যে যে বিতণ্ডা হল, তা কি কাম্য ছিল? ছিল না। কিন্তু হল। বার্তা গেল বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রথম মেগা বৈঠকেই অনৈক্যের চিত্র ধরা পড়ল। যদি এদের হাতে দেশের শাসনভার যায়, তবে আগের সমস্ত জগাখিচুড়ি ফ্রন্টের মধ্যে যে অনৈক্যের চেহারা ছিল, তারই পুনরাবৃত্তি হবে। এতে সুবিধা কার হল? সহজ উত্তর— বিজেপির। অরবিন্দ কেজরিওয়াল একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং একটি জাতীয় দলের চেয়ারম্যান। তাঁর এই রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা নেই, কথাটি বালখিল্যের মতো শোনাবে ও মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রসঙ্গত, পাটনা বৈঠকে কংগ্রেসের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেই কেজরিওয়াল ক্ষান্ত দেননি। ওইদিনই দিল্লি ফিরে গিয়ে তাঁর দলের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করলেন। তাতে বলা হল, দিল্লির আমলা নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে কংগ্রেস যদি কোনও সিদ্ধান্ত না নেয় এবং অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতায় সরব না হয়, তাহলে বিরোধী বৈঠকের পরবর্তী কর্মসূচিতে যদি কংগ্রেস থাকে, তবে সেই বৈঠকে যোগ দিতে তিনি সিমলা যাবেন না। কফিনে পেরেক মারার আর কিছু বাকি থাকল কি?
অরবিন্দ কেজরিওয়াল পাশুপত নিক্ষেপ করে দিয়েছেন। সম্ভবত তাঁর তূণীরে আর কোনও বাণ নেই। এবার পালা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁর রঙ্গটি পুরনো। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগেও তিনি এই রঙ্গের অবতারণা করেছিলেন। এবারও সেই ইঙ্গিত তিনি দিয়ে রেখেছেন। বলেছেন, যে রাজনৈতিক দল যেখানে শক্তিশালী সেখানে তারাই বিজেপির বিরুদ্ধে প্রার্থী দিক। মমতা পোড়খাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি খুব ভাল করেই জানেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণ কাজ করে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বামপন্থীরা তাদের সমর্থন করতে পারবেন না। আবার পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থীদের জোট থাকলেও কেরলে কিন্তু তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুযুধান। উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের নির্বাচনী জোট হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। রাজস্থান এবং পাঞ্জাবে কী হবে? আপের সঙ্গে কংগ্রেসের সমঝোতা কি আদৌ সম্ভব? এগুলি সবই মমতা জানেন। কিন্তু তবুও পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছেন। উদ্দেশ্য তো একটা আছেই। প্রশ্ন হল সেটি ঠিক কী? বিজেপি-বিরোধী কোনও জোট গড়ে ওঠার আগেই এক আজগুবি তত্ত্ব আমদানি করে অঙ্কুরে তাকে বিনাশ করা নয় তো? আজগুবি তত্ত্ব কেন বলা হচ্ছে? কেননা এর সঙ্গে ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা মেলে না।
পাটনা বৈঠকটি কংগ্রেস কিংবা বামপন্থীরা আহ্বান করেনি। এঁদের বিজেপি-বিরোধিতা প্রশ্নাতীত। যাঁরা ডেকেছিলেন এবং সর্বাধিক উৎসাহী ছিলেন, বিজেপি-বিরোধিতার প্রশ্নে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। আর শুরু থেকেই এমন একটি চিত্র তৈরি করা হল যাতে বিজেপি-বিরোধী শিবিরের মধ্যে গাঢ় অনৈক্যের ছবিটা ফুটে ওঠে। এই পিকচার আভি ভি বাকি হ্যায়। সিমলায় বৈঠক যদিচ হয়, তাহলে এই চিত্রটিকেই আরও স্পষ্ট এবং আরও দৃশ্যমান করার আপ্রাণ চেষ্টা হবে। কেজরিওয়াল নিজেই তাঁর আরএসএস-যোগের কথা স্বীকার করেছেন। আর মমতা? এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন একদা তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহকর্মী মুকুল রায়। দিল্লিতে বিজেপিতে যোগ দিয়ে সাংবাদিকদের স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, আরএসএস পিছনে না থাকলে তৃণমূল দলটি গঠিতই হত না। মমতা জনসভায় মোদির বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ আক্রমণ শানালেও মোহন ভাগবতকে আপেল পাঠাতে ভোলেন না। খেলা হবে-র খেলটা এখানেই।
প্রশ্ন উঠেই যাচ্ছে। পাটনা বৈঠক আসলে কোনও বুবি ট্র্যাপ নয় তো? এই বৈঠকে উপস্থিত থাকলেও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না কংগ্রেস ও বাম নেতারা। ভারতে ভোট হয় পারসেপশনের ওপরে ভিত্তি করে। একবার যদি এই পারসেপশন তৈরি হয়ে যায় যে বিরোধীরা ছন্নছাড়া, তাহলেই বিজেপির কেল্লা ফতে। এটা মনে রাখতে হবে বিজেপি-বিরোধী প্রাজ্ঞ নেতাদের।
*মতামত ব্যক্তিগত
লোহিয়াপন্থী দলগুলির ব্যাপক জনাধার আছে যার ভিত্তি হল ব্রাহ্মণ্যবাদী হেজেমনি। জরুরি অবস্থা বিরোধী গণজাগরণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জয়প্রকাশ। দূর্নীতি আদি শাসনের সমস্যা তো আছেই। কিন্তুু লোহিয়াপন্থীদের ক্রেডেনশিয়াল নিয়ে প্রশ্ন করার আগে ভাবুন।
ব্রাহ্মণবাদ বিরোধী