অনুপ্রভা দাস মজুমদার
একটি পরিবারে যখন কেউ সমকামী অথবা রূপান্তরকামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন প্রথম যে প্রশ্নটি ওঠে তা হল বংশের কী হবে? অর্থাৎ নারীগর্ভকে ব্যবহার করে পুরুষের নামাঙ্কিত বংশলতিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে মূল পিতৃতান্ত্রিক ধাঁচাটি আছে তা আমাদের অস্তিত্বের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং সেই কারণেই এই গোটা সমাজব্যবস্থা থেকে আমরা ব্রাত্য। এবং রাষ্ট্রও যে পক্ষান্তরে এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকেই শক্ত করতে চায়
ঠিক কবে থেকে আমার অস্তিত্বের এই সঙ্কটের সুত্রপাত তা এখন আর স্পষ্ট করে মনে নেই। তবে যে বয়স থেকে একটি শিশু নিজের সম্পর্কে অনুভব করতে শুরু করে, সেই সময় থেকেই আমার আত্মপরিচয়ের বিপন্নতারও সূচনা।
আমি জন্মেছি একটি পুরুষ শরীর নিয়ে, কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে সত্তায় আমি একজন নারী। বোধে, অনুভবে, মননে, চেতনায়, প্রকাশে, সেই নারীসত্তা ভিন্ন আমি আমার অন্তরে বিন্দুমাত্রও অন্যরূপ অনুভব করিনি। অথচ জন্মাবধি আমার দৃশ্যমান শরীর দেখে আমার পরিবার এবং সমাজের আমার প্রতি প্রত্যাশা ছিল এক পুরুষোচিত ভাবের। কিন্তু আমার অন্তর সেই ‘পৌরুষ’-এর প্রদর্শনে ব্যর্থ কারণ নিজেকে ভিন্ন সে অন্য কিছুকে প্রকাশ করবে কেমন করে…!
শিশুকাল থেকেই আমার বন্ধুরা প্রায় সকলেই মেয়ে। তাদের সঙ্গেই ছিল আমার যাবতীয় ‘মেয়েলি’ খেলা। বড়দের কিনে দেওয়া গাড়ি, বল এসব খেলনা আমি ছুঁয়েও দেখতাম না, বরং মায়ের শাড়ি-গয়নায় নিজেকে সাজাতে ভালবাসতাম, ভালবাসতাম বৃহস্পতিবার ঠাম্মাদের সঙ্গে বসে আলতা পরতে, গামছা দিয়ে নকল খোঁপায় আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে ভাবতাম কবে দিদির মতো বড় চুল হবে…!
আমার প্রতি সকলের ব্যবহারে সহজ বুদ্ধিতেই বুঝেছিলাম যে আমি সকলের থেকে একেবারে আলাদা, তাই অস্বীকৃত এবং অগ্ৰহণীয়। আমার এই অস্তিত্বের সঙ্কটকে প্রকাশ করার মতো আমার না ছিল ভাষা, না ছিল কোনও মানুষ। ক্রমে একা থেকে আরও আরও একা হতে থাকি। এ তো রঙ্গমঞ্চে কয়েক ঘণ্টার অভিনয় নয়…! জন্মকাল থেকে দীর্ঘ আঠেরো বছর চারপাশের কন্ঠরোধ করা চাপে নিজেকে দুমড়ে-মুচড়ে, প্রাণপণে চাপা দিয়ে এক অন্য মানুষ হয়ে বাঁচা যে কী দুঃসহ…! তা নিজের জীবনে যে অনুভব না করছে, তাকে বোঝানো দুঃসাধ্য।
উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছি বলে এই অবস্থাকে কেউ যদি নিজের পছন্দমতো পোশাক পরতে না পারা বা নিজেকে সাজাতে না পারার বিলাসী দুঃখের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন তাহলে বুঝতে হবে তিনি এই নিষ্পেষণের কণামাত্রও অনুভব করতে পারেননি। একজন মানুষের স্ব-ভাবের প্রকাশ তার ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, মানুষ হিসেবে তার মধ্যেকার সমস্ত সুপ্ত সম্ভাবনার উন্মেষ এবং সেই প্রতিভার প্রস্ফুটনের সঙ্গে যুক্ত।
উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আমাদের পড়াশোনা একটি বয়েজ স্কুলে। স্কুলে কেবল আমরা দুজনই পরস্পরের বন্ধু ছিলাম। একেবারে অভিন্নহৃদয় বন্ধুত্ব যাকে বলে আর কী! আর কোনও বন্ধু ছিল না আমাদের। থাকা সম্ভবও নয়, কারণ আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বাকি সহপাঠীরাও ততদিনে বুঝে গিয়েছিল যে আমরা ওদের থেকে আলাদা। মফস্বলে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে এরকম একটি ব্যতিক্রমী জীবন নিয়ে বড় হয়ে ওঠা খুব সহজ ছিল না। ইন্টারনেট শব্দটা প্রথম শুনলাম ক্লাস এইট-নাইনে পড়ার সময়। তার আগে তথ্যভাণ্ডার বলতে বাড়িতে আসা দৈনিক সংবাদপত্র এবং পাড়ার লাইব্রেরি। আমাদের অল্পশিক্ষিত, রক্ষণশীল পরিবারে নিজেকে নিয়ে এবং নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ে কথা বলাও সম্ভব ছিল না। কারণ ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সকলের আচরণ বুঝিয়ে দিয়েছিল আমার স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশটাও (পড়ুন মেয়েলি) তাঁদের পক্ষে লজ্জার, অসম্মানের। নিজের অন্তরকে প্রাণপণে চেপেচুপে, ঢাকাঢুকি দিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। ছোটবেলায় কখনও মন খুলে হেসেছি বলে মনে পড়ে না। টিউশনে পড়া বুঝতে না পারলেও চুপ করে থাকতাম, পাছে আমার কথা বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে ওঠে। তারপর ক্রমে ইন্টারনেট এল, সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটল। ধীরে ধীরে জানতে পারলাম আমার অন্তর-প্রকৃতিটা কোনও অসুখের ফল নয়। বেশিরভাগ মানুষের মতো না হলেও, আমি অস্বাভাবিক নই। আমার নিজেকে হীন মনে করার কোনও কারণ নেই, কারণ আমি প্রকৃতিরই এক অন্যরকম সৃষ্টি। আমার মতো আরও অনেক মানুষ আছেন গোটা বিশ্ব জুড়ে। এই আত্মবিশ্বাস অর্জন করার পর আমার বাবা-মায়ের কাছে নিজের সম্পর্কে সবটা খুলে বলি এবং সঙ্গে এটাও জানাই আমার পক্ষে মিথ্যে কোনও জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। আমি যা, নিজের সম্পর্কে ঠিক সেই বার্তাই বাইরে গোটা জগৎকে দিতে চাই। তখন আমি সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি। বলাই বাহুল্য এই যাত্রাপথ সহজ ছিল না এবং এখনও সহজ নয়।
একজন সিস-জেন্ডার ব্যক্তি অর্থাৎ যিনি জন্মসুত্রে তাঁর সত্তার অনুরূপ শরীরটি পেয়েছেন এটা একটা প্রিভিলেজ। তাঁর অন্তরকে ধারণ করার জন্য যে উপযুক্ত আধার-শরীরের প্রয়োজন তাকে গড়তে গিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিতে হয় না। সইতে হয় না সেই পথের অসহনীয় যন্ত্রণা।
কিন্তু, এই লেখার উদ্দেশ্য শুধু দুঃখ বিলাপ নয়। বরং আমার এই সত্তা আমাকে যা যা উপহার দিয়েছে তার উদযাপন।
আমি প্রান্তিক বলেই হয়তো আমার চোখে পড়েছে যে পুরুষ এবং নারী দুজনেই কীভাবে পিতৃতন্ত্রের নিগড়ে নিষ্পেষিত হন। আমার বাবা ছিলেন বাড়ির জ্যেষ্ঠপুত্র। পারিবারিক নিয়মমতে বিবাহ-কর্তব্যের প্রথম দায়াধিকারী। তাঁর বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে, কোমর বেঁধে, ভাল করে ঝেঁড়েবেছে, দেখেশুনে সদ্য আঠারো পেরোনো ফর্সা টুকটুকে এক গ্ৰামের মেয়েকে তাঁদের বড় ছেলের সঙ্গে সাড়ম্বরে বিবাহ দিয়ে নিজেদের আহ্লাদ পূরণ করলেন। তারপর শুরু হল বংশের প্রদীপ আনার তোড়জোড়।
বিয়ের এক বছরের মাথায় আমি আর আমার সাড়ে তিন বছরের মাথায় ভাই এল। বিবাহ-কল্পনার সুখস্বপ্নটি যখন বুদবুদসম ফাটল তখন তিন-তিনটে প্রাণের আর্থিক দায়ভারসহ সমস্ত চাহিদা, দাবি, আবদারের কেন্দ্রবিন্দুতে আমার বাবা আবিষ্কার করলেন নিজেকে। অভাব-অনটনে, দুশ্চিন্তায় সারাক্ষণ মেজাজ সপ্তমে চড়ে থাকত। তাই দেখে আমরা ভয়ে এমনই সিঁটিয়ে থাকতাম যে কখনও কাছে ঘেঁষতে সাহস হয়নি। আর আমি বরাবরই মধ্য-মেধার। কোনওদিনই পরীক্ষার ফল বিশেষ ভাল করতাম না। অঙ্কের কথা আর না বলাই ভাল। সেই মার্কশিট বাবাকে দেখাতে গিয়ে তো প্রতিবার হৃৎপিণ্ডটিও হাতে খুলে আসার জোগাড়। কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ-ভাদ্র মিলেমিশে একাকার। ঘোর বজ্র-বিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতসমেত দুমাদ্দুম তাল পড়ার শব্দ শুনতে পেতেন প্রতিবেশীরা।
আমাদের প্রতি বাবার মনোভাব একেবারে আমাদের দেশের চিরাচরিত পিতা-পুত্রের সম্পর্কের গতানুগতিক ব্যাকরণ মেনে চলত। স্ব-পরিচয় সম্পর্কে তাঁকে জ্ঞাত করানোর আগে অবধি তিনি যে প্রথমবার পিতা হওয়ার সময় পুত্ররূপে কন্যা লাভ করেছেন একথা তাঁর বোধেই আসেনি কখনও। তাঁর ধারণামতে তিনি দুই পুত্রসন্তানের জনক। তাই ভাবতেন আমাদের ইহজগতে এনে তিনি ইতিমধ্যেই তাঁর পরমকর্তব্যটি পালন করে ফেলেছেন। সংসারের প্রতি তাঁর দায় শুধুমাত্র সামর্থ্য অনুযায়ী রোজগার করে স্ত্রীর হাতে সংসার খরচটুকু তুলে দেওয়া। এরপর সবটুকু দায়িত্ব তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের। তাঁর প্রত্যাশা ছিল সাধ্বী স্ত্রী যৎসামান্য টাকায় সন্তানদের পড়াশোনার যাবতীয় খরচসমেত গোটা সংসারটা জাদুবলে চালিয়ে নেবেন ও পরমকল্যাণীয় সন্তানদের খুঁদকুড়ো খেয়ে হলেও অসামান্য প্রতিভায় স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিদ্যা, বুদ্ধি ও অন্যান্য কীর্তিতে যশস্বী হয়ে পিতৃগৌরব বৃদ্ধি করে যাওয়াই জীবনের একমাত্র পুরুষার্থ।
আমার বাবা-ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার প্রায় কোনও আত্মিক সম্পর্ক নেই। চিরকালই আক্রমণাত্মক ভূমিকা ছাড়া অন্য কিছুতে তাঁকে দেখিনি। আমার মা তখনকার দিনে বছর উনিশ হতে না হতেই বিবাহের কারাগারে রুদ্ধ। একদিন বাড়ির পুরনো কিছু কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে বাবার যুবক বয়সের একটি কবিতার খাতা খুঁজে পেলাম। বেশ ছন্দ মেলানো কবিতা। জুটমিলে যন্ত্রপাতি ঠিক করতে পটু, রসকষহীন মানুষটি কোনও একদিন কবিতা লিখত। তারপর কোথাও সে হারিয়ে গেল আর ‘সংসার চালাতে হয়’ নামক এক যন্ত্র তার জায়গা নিল। আমার মাকেও আমি বহুদিন বহুভাবে সংসার সামলানোর জন্য নিজেকে ফুরিয়ে দেওয়া থেকে বিরত করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছি। যখন আমি টাকাপয়সায় স্বাবলম্বী হয়ে বাড়ি ছাড়লাম তখন আমি শুধু আমার পুরনো ঠিকানা ছাড়তে বাড়ির বাইরে বের হইনি, আসলে ওই দমবন্ধকর বোধগুলো থেকেও অব্যাহতি নিয়েছি।
আজ যখন শুনি “মেয়েরা মেয়েদের শত্রু” বা “ছেলেদের অধিকার হরণ করছে মেয়েরা” তখন বুঝি যে পিতৃতন্ত্র দুপক্ষকেই আবারও দুপক্ষের বিরুদ্ধে চালনা করছে। যখন দেখি হাসপাতালে শুধু নারী আর পুরুষ ওয়ার্ড আর আমাদের জন্য কোনও স্বাস্থ্য-পরিষেবাই নেই, তখন বুঝি এই অস্তিত্বহীনতাই মূল সঙ্কট। ভাঙলে ভাঙতে হবে এইটাকে।
যৌনতার দিক থেকে রাষ্ট্রের নজরে সবেমাত্র আমরা অপরাধী তকমা থেকে মুক্তি পেয়েছি বটে, কিন্তু শুধুমাত্র জেল-হাজতের শাস্তি থেকে মুক্তি দিয়েই রাষ্ট্র তার দায় সেরেছে। এই রাষ্ট্রেরই ক্ষুদ্রতম একক হল পরিবার। একটি পরিবারে যখন কেউ সমকামী অথবা রূপান্তরকামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন প্রথম যে প্রশ্নটি ওঠে তা হল বংশের কী হবে? অর্থাৎ নারীগর্ভকে ব্যবহার করে পুরুষের নামাঙ্কিত বংশলতিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে মূল পিতৃতান্ত্রিক ধাঁচাটি আছে তা আমাদের অস্তিত্বের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং সেই কারণেই এই গোটা সমাজব্যবস্থা থেকে আমরা ব্রাত্য। এবং রাষ্ট্রও যে পক্ষান্তরে এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকেই শক্ত করতে চায়— এর প্রমাণ মেলে যখন বর্তমান সরকার আমাদের পাঁচ হাজার বছরেরও পুরনো সভ্যতার ঠিকাদার হয়ে এই কথা বলে যে এই ধরনের বিবাহ আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি-বহির্ভূত।
আমি ভারত সরকারের তরফে যুব দূত হিসেবে দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে কথা বলতে যাচ্ছি। আমি বলব এই বাইনারির কথা, বলব আমার লিভড এক্সিপেরিয়েন্সের কথা, শোনাব মায়ের কথা, শোনাব হারিয়ে যাওয়া বাবার কবিতার কথা। শোনাব হাসপাতালে তাঁর ওয়ার্ড কী হবে বুঝতে না পেরে অপেক্ষায় মৃত হয়ে যাওয়া আমার ট্রান্সজেন্ডার বোনের কথা, বলব রজস্বলা আমার ট্রান্সজেন্ডার ভাইয়ের কথা! এই বাক্সগুলোর কথা, এই বাক্সগুলোকে ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে পরিণত করার কথা। বলব ভাঙার খেলা কীভাবে গড়ে তোলার বিন্দু হয়ে ওঠে!
এই কথাগুলো বারবার বলতে থাকলে, একদিন আপনাদের সকলের সঙ্গে নিশ্চয়ই আমার দেখা হবে ‘অন্য গানের ভোরে’….
জীবনের দুঃখকষ্টগুলিকে সহজ ও সাবলীল ভাবে গ্রহণ করেছেন। খুব ভাল লেখা।