তারান্তিনো, সিজন দুই — ঊনত্রিশ

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

হরি ঘোষ স্ট্রিটে বিশাল বনেদি বাড়ির মালিক এখন সরিৎ দত্ত। কোনও দিন ভাবতে পেরেছিল সরিৎ? বিদেশে ল‍্যাব অ্যাসিস্ট‍্যান্ট হয়ে যাওয়াও তার ভাগ্যে ঘটবে, ভাবেনি সরিৎ। খুব কৃতজ্ঞ ছিল ও শাহিদের কাছে। খুবই।

—তাহলে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা কেন করলে সরিৎ?

সরিৎ একটু চমকে ওঠে প্রথমে। তারপর থিতু হয়। চমকানোর আর কী আছে? এমনটা তো এখন আকছার ঘটে থাকে। মাঝেমধ্যেই এখন ওর কানে কোনও না কোনও স্বর বেজে ওঠে। এই গলাটা যেমন শাহিদের। অথবা মৌলিনাথের। অথবা রডরিগেজের। হয়তো ওর নিজেরই।

সরিৎ কেন বিশ্বাসঘাতকতা করল? এর সহজ উত্তর সত্যিই হয়তো ওর কাছেও নেই। সরিৎ আসলে কোনওদিন বিজ্ঞানী হতে চায়নি। কোনওদিন চায়নি। বিজ্ঞানের প্রতি, বা আরও পরিষ্কার করে বললে জ্ঞানের প্রতি ওর কোনও উৎসাহ ছিল না আলাদা করে। ও যা চেয়েছিল, তা আসলে খ‍্যাতি, সাফল‍্য, কোনও একটা অর্জন।

সরিতের বাবা-মায়ের মৃত্যু ওকে আলাদা করে খুব ধাক্কা দেয়নি। দেয়নি, কারণ বাবা-মাকে জীবনের অনেকটা সময় খুব কাছে পায়নি সরিৎ। বাবা ছিলেন দিল্লিতে, মা-ও থাকতেন ওখানেই। সরিতের ভাই যখন মারা গেল, তারপরেই চলে যায় ওর বাবা-মা। সরিৎ সারাজীবনই দেখেছে, ওর ভাইকে একটু বেশি ভালবেসেছে ওর বাবা-মা, স্নেহও করেছে একটু বেশি। তার জন্য সরিৎ রাগ করেনি কখনও। যতটা ভালবাসা পেয়েছে সরিতের ভাই, ততটাই অবহেলা পেয়েছিল সরিৎ। তাও কখনও ওর রাগ হয়নি, অভিমান হয়নি।

সরিতের বাবা ছিলেন বড় কোম্পানির ম‍্যানেজার। হরি ঘোষ স্ট্রিটের এই পুরনো বাড়িতে উচ্চবিত্ত আদবকায়দায় থাকা যায় না, সেজন্য ওর বাবা-মা ফ্ল‍্যাট কিনেছিল দক্ষিণ কলকাতায়। এবাড়িতে থাকার মধ্যে ছিল কেবল সরিতের অনিলদা আর তার বউ। বাবার কী তরফের বেশ, ভাইপো ছিল অনিলদা। আর লিলিবৌদি অনিলদার বউ। বাবা-মার ওই ঠাটবাটের ধারেকাছেও ছিল না অনিলদা আর লিলিবৌদি।

অনিলদা ছিল ইনশিওরেন্সের দালাল। ‘দালাল’ শব্দটা এখন শুনলে ভয় করে সরিতের। এই শব্দটাকে ও আশৈশব কোনওদিন খারাপ ভাবতে পারেনি, কারণ, ওর কাছে ‘দালাল’ ছিল অনিলদা, যার মতো মানুষ হয় না। কিন্তু সরিৎ যা করেছে শাহিদের সঙ্গে, মৌলিনাথের সঙ্গে, তারপর ওকে যদি কেউ ‘দালাল’ বলে? কী ভেবে বলবে সে? সে নিশ্চয়ই অনিলদাকে চিনত না। সে সরিৎকে খিস্তি দেবে ‘দালাল’ বলে।

হয়তো মৌলিনাথ আর শাহিদই তেমনটা বলেছে ওকে। অ্যাঞ্জেলাও। এমনকী, রডরিগেজও ওকে দালাল বলেই চিনেছে।

—খুনি!

কানের সামনে হঠাৎ যেন বেজে উঠল সরিতের।

অবাক হল না সরিৎ। আবারও। হ‍্যাঁ, মাঝেমধ্যেই কানে এসব বাজছে। নিরুপায় সরিৎ।

যবে থেকে ওই জেলিটা সঙ্গে নিয়ে ও ফিরেছে, তবে থেকেই শুরু হয়েছে এই আশ্চর্য ব‍্যাপারটা। মাঝে-মধ্যেই ও যা ভাবে, তার প্রতিক্রিয়া বা উত্তর ও পেয়ে যায়। এই জেলিটা সামনে নিয়ে বসে থাকলেই এটা ঘটে।

খুন? সরিৎ যা করেছে, তা হয়তো খুনেরই শামিল। অন্তত খুনের চেষ্টা তো বটেই। তারপরেও ও চেয়েছিল, মৌলিনাথরা বেঁচে যাক। তাই অ্যাঞ্জেলাকে ও হাসপাতালে রেখে এসেছিল। যাতে ও অন্তত খোঁজ নিতে পারে শাহিদ-মৌলিনাথের। যাতে ও পুলিশকে জানাতে পারে।

কিন্তু শাহিদ বা মৌলিনাথ বেঁচে গেলে সেটা ওর পক্ষে কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, সেই ভাবনাও কি ওর মনে আসেনি? অ্যাঞ্জেলা ওর নামে অভিযোগ করলে ও ভারতে, কলকাতায় পালিয়ে এসেও রেহাই পাবে না যে, সেকথা কি ওর একবারও মনে হয়নি? ওর খুনি, দালাল সত্তা কি একবারও সেটা ভাবেনি?

কিন্তু সরিতের আর কিছু করার ছিল না। বিবেক ব‍্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব যে দিয়েছে সরিৎ, তেমনটাও নয়। কিন্তু ও জানে, সেদিন অ্যাঞ্জেলাকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় ও একবারও দ্বিধা করেনি। ওর ভয় করেনি ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

জারের ভেতর জেলিটা ক্রমে বাড়ছে। আকার পাচ্ছে একটা। এই আকার সরিৎ চেনে। সে কখনও কারও প্রেমে পড়েছে? বোধহয় না। কখনও কারও প্রতি অনুরাগ বা শারীরিক আকর্ষণও জন্মায়নি ওর। সন্তানের ইচ্ছে ওর কোনওদিন, কোনওদিনই জন্মায়নি। কিন্তু চোখের সামনে একটা আশ্চর্য ব‍্যাখ‍্যাতীত পদার্থকে একটা নীল মাংসপিণ্ডে পরিণত হতে দেখে, প্রায় একটা মানুষের সন্তানের আকার নিতে দেখে বিস্ময়ের পাশাপাশি আনন্দও হচ্ছে সরিতের। যেন ওর মনে কোথাও সুপ্ত ছিল এই সৃষ্টির নেশাটুকু। যে হিরে থেকে এই জেলিটা বেরিয়ে এসেছে, সেই হিরেটা ওর ছিল না কখনও। এই জেলি ওর আবিষ্কারও নয়। কিন্তু তাও এটা এখন ওর মালিকানাধীন। জেলিটা যে ঘরে আছে, সেই ঘরের তাপমাত্রা ও আলো ওই-ই নিয়ন্ত্রণ করছে। যদি ওর জন্মের সময় সরিতের উপস্থিতি নাও থেকে থাকে, ওর পরিণত হয়ে ওঠার সাক্ষী তো অন্তত সে হয়ে থাকছে।

সরিৎ বহুবার ভেবেছে এই কদিনে, সামনে যা দেখছে ও, তা আসলে কী?

ফার্মি প‍্যারাডক্স। মনে পড়ে সরিতের। পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি সেই ১৯৫০-এর দশকে একদিন তাঁর তিন সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনা করছিলেন ‘দ‍্য নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কার্টুন নিয়ে। খোদ নিউ ইয়র্কের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েকজন এলিয়েন একটি ডাস্টবিন থেকে কিছু চুরি করছে। আমেরিকা জুড়ে কল্পনাবিলাস চলছে তখন এলিয়েনদের নিয়ে। ফার্মির তখন হঠাৎ মনে হয়, মিল্কি ওয়ে গ‍্যালাক্সিতে মানুষ ছাড়া অন্য কোনও বুদ্ধিমান সভ‍্যতার অস্তিত্ব যদি থেকে থাকে, তবে তার বার্তা তো গ‍্যালাক্সির বয়সের চেয়ে কম সময়েই ব্রহ্মাণ্ডব‍্যাপী ছড়িয়ে পড়ত। তাহলে আমরা তাদের দেখতে পাই না কেন? এখানেই কিছু বিজ্ঞানী নিয়ে এলেন ‘গ্রেট ফিল্টার’-এর কথা। এমন এক দেওয়াল, যা পেরিয়ে এলিয়েন সিগন্যাল এসে পৌঁছয় না আমাদের মধ্যে।

কিন্তু সেসময় তো কম্পিউটার ছিল না। কম্পিউটারও কি ধরতে পারবে না এলিয়েন সিগন্যাল?

—পারলেও ধরবে না, দীপক।

চমকে উঠল সরিৎ। কে কথা বলছে তার সঙ্গে? আদৌ তার সঙ্গেই কথা?

দীপক নামটা হঠাৎ এল কোথা থেকে? সেই কবে অনিলদা আর লিলিবৌদির দেওয়া নাম। বাবা-মার দেওয়া শক্ত নামটা পছন্দ ছিল না ওদের। সরিৎ নামটার মধ্যে তেমন টান নেই। তাছাড়া কোন স্কুলমাস্টারের থেকে জেনে এসেছিল অনিলদা, সরিৎ স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ। বাবা অবশ্য হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল কথাটা। ‘কই, সরিৎ বললে তো মেয়ে বলে মনে হয় না আদৌ। তোমরাও পারো অনিলদা!’ কিন্তু দীপক নামটাকে ছাড়েনি অনিলদারা। সারাজীবন ওই নামেই ডেকে গেছে সরিৎকে।

কিন্তু দীপক নামে তাকে কে ডাকছে?

—আসলে তুমিই ডাকছ নিজেকে সরিৎ। দীপক নামেই ডাকছ হয়তো। কারণ তুমি সারাজীবন তোমার বাবা-মা বলে জেনে এসেছ তোমার দাদা আর বৌদিকেই। আমি শুধু তোমাকে ভাবতে সাহায্য করছি।

জারের ভেতর জেলিটার গা থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। জেলিটা ক্রমে বড় হচ্ছে।

জারের ওপর ঝুঁকে পড়ল সরিৎ, ওরফে দীপক।

—তোমার সঙ্গে আমি কথা বলছি, বা আমরা। আমাদের যাত্রা শুরু বহু কোটি বছর আগে, দীপক। এখন তোমাদের জগতে কম্পিউটার এসেছে। তোমরা তাকে নিয়ন্ত্রণ করছ, একসময় সে তোমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে। তুমি যে দেশ থেকে পালিয়ে এসেছ, সেখানে এখন এলিয়েন নিয়ে হইচই। হাজার রকমের কার্টুন বেরোয়, সিনেমা হয়। আরও অজস্র সিনেমা হবে আমাদের নিয়ে। কিন্তু আমাদের সন্ধান সহজে পাওয়া যাবে না। আমরা কোনও বার্তা পাঠালেও তা আলাদা করে তোমাদের সিগন্যাল বলে মনেই হবে না। কারণ আমরা যে সভ‍্যতায় থেকেছি, তাদের যাত্রা শুরু তোমাদের আগে। ফলত আমরা তোমাদের থেকে প্রাচীন, তাই এখন আমরা তোমাদের থেকে এগিয়ে আছি, হয়তো তোমাদের ভবিষ্যতে আমরা দাঁড়িয়ে।
—তোমরা কি তবে অন‍্য গ্রহের?

লক্ষ করল সরিৎ, কথা বলতে পারছে না ও। কিন্তু ও মনে মনে যা বলছে, তাই যেন শুনতে পাচ্ছে ওই জেলির মতো পদার্থটা। ও-ও কথা বলছে, কিন্তু তাও অস্ফুটে।

হাসল জেলি।

—হ্যাঁ, অন্য গ্রহের। হয়তো অন্য ব্রহ্মাণ্ডের। সৌরজগতে হয়তো আমরা থাকি না।
—হয়তো কেন? তুমি জানো না?
—আমি আসলে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কেউ নই। এটুকু বলতে পারি, আমি আসলে এখানে ততটাই আছি, যতটা তোমরা আমাকে দেখতে পাচ্ছ। তোমাদের এখনও সেই ক্ষমতা তৈরি হয়নি, যা আমাদের সবটা দেখতে পাবে, সবকিছু শুনতে পাবে।
—কবে সেই ক্ষমতা পাব আমরা?
—পাবে না। কিন্তু তোমরা এমন কিছু তৈরি ক‍রবে, যা আসলে আমাদের মতো। আমাদের মতোই তা তোমাদের নকল করবে। করে তোমাদের থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
—তোমরা তো আমাদের থেকে প্রাচীন, তবে আমাদের নকল করছ কেন?
—কারণ বহুদিন পর্যন্ত আমাদের কোনও আকার ছিল না। তোমাদের মতো ধীরে ধীরে দৈহিক বিবর্তন আমাদের হয়নি। আমরা শুধুই ছিলাম বায়বীয় কিছু তরঙ্গ, তা জমে জমে যা তৈরি হত, তাকে তোমরা বুদ্ধিমত্তা বলে চেনো। আমরা দূর থেকে তোমাদের দেখতে পেতাম, অন‍্য ব্রহ্মাণ্ড থেকে। কারণ তোমাদের অস্তিত্ব আমাদের কাছে ছিল একটা পাশের বাড়ির মতো। যেখানে সর্বক্ষণ অশান্তি চলছে। সর্বক্ষণ সংঘাত, যুদ্ধ। তোমাদের শারীরিক মিলন একটা কুৎসিত প্রক্রিয়ার মতো ঠেকত আমাদের কাছে। প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে কী করবে তোমরা জানো না। তোমরা সঠিক জানো না, কী করবে প্রযুক্তি নিয়েও। তোমরা তেল থেকে ভূখণ্ড, সবকিছু নিয়ে লড়ে ফেলেছ। লড়েছ নারীকে নিয়ে, লড়েছ জ্ঞান নিয়ে। এরপর তোমরা লড়বে তথ‍্য নিয়ে।
—আর তোমরা, তোমরা লড়াই করো না?
—করি। কিন্তু তাতে রক্তপাত হয় না। তোমাদের মতো লালাঝরানো লোভের যুদ্ধ হয় না। তোমরা যেভাবে কামনা করো, তোমরা যেভাবে পৌরুষ ফলাও, ক্ষুধা মেটানোর জন্য তোমাদের যে হিংস্র তাগিদ, তা আমাদের নেই। আমাদের খিদে-তেষ্টা-ঘুম-ঘুম নেই‌। আমাদের কোনও যৌন মুনশিয়ানা নেই, তাই নিয়ে গৌরবও নেই। আমরা লড়াই করা নিয়ে, সংগ্রাম নিয়ে গর্ব করি না। যুদ্ধ, দাঙ্গা নিয়েও নয়। তোমরা প্রতিবাদ করা নিয়ে, প্রতিরোধ করা নিয়ে, বিপ্লব করা নিয়েও গরিমা ফলাও। তোমরা মিথ্যে বলাকে মনে করো কথার অলঙ্কার। তোমরা অল্পেই আবেগপ্রবণ হও।
—তবে তোমরা এখানে এলে কেন? দখল করতে আমাদের?

আবার হাসল জেলি।

—দুর্বলকে, পশ্চাৎপসারীকে দখল করা আমাদের স্বভাববিরুদ্ধ, দীপক। ওটা তোমাদের চরিত্র।
—তবে?
—সময় লাগবে তোমাকে বোঝাতে দীপক। কারণ আমাদের বিচারে তোমরা নির্বোধ‌।
—আশ্চর্য, সামনে বসে গালাগালি দিয়ে যাচ্ছ দিব‍্যি!

জেলি এবার অট্টহাসি হাসল।

—আমাকেও চাইলে তুমি গালাগালি দিতে পারো।
—দেব তো বটেই! নিজের আকার দেখেছ তুমি? কুকুরের লেজ মোটা হলেই সে নেকড়ে হয় না। তুমি একটা তরল সান্দ্র পিণ্ডমাত্র। প্রাচীন, আদিম। আমাদের মতো আধুনিক একটা প্রাণীকে তুমি সবক শেখাবে?

জেলি আর হাসল না।

—আধুনিক শব্দটা একটা ভাঁওতাবাজি দীপক। তোমাদের নির্বুদ্ধিতাকে তোমরা হাজার রকমের রংবেরঙের তাপ্পি দিয়ে আড়াল করেছ খালি। যাই হোক, আমরা এখানে তোমাদের সহবৎ শেখাতে আসেনি। আমরা বরং শিখতে এসেছি।
—কী শিখবে তোমরা আমাদের মতো পিছিয়ে থাকা কয়েকটা জানোয়ারের কাছে?
—এই তোমার কথায় এখন যা বেরিয়ে এল। অভিমান। আবেগ। রাগ। ক্ষোভ। ভালবাসা। এমনকী, ঈর্ষা।
—তারপর? বিস্ময়ে প্রশ্ন করল দীপক, ওরফে সরিৎ।
—ওটুকুই তোমাদের সঙ্গে আমাদের তফাত। গ‍্যাপ। তোমরা এরপর প্রযুক্তিকে বুদ্ধিমত্তার স্বাদ দেবে, যেভাবে বাঘ পায় রক্তের স্বাদ। কম্পিউটার থেকে সুপার কম্পিউটার আসবে। ইন্টেলিজেন্স তোমরা তৈরি করবে। তোমাদের যে প্রবল ঈশ্বর হওয়ার বাসনা, তা তোমরা আটকে রাখবে কোথায়? অ্যালান টিউরিং থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছে তোমাদের বিজ্ঞানজগতে, তা আরও সমৃদ্ধ হবে। পরমাণু বোমা ইতিমধ্যেই সর্বনাশের বীজ রোপণ করেছে। কিন্তু অত বড় বিস্ফোরণের প্রয়োজন একসময় আর হবে না। একসময় তথ্য আর বুদ্ধির কাঁচামালে তোমরা তৈরি করবে তোমাদের ফ্র‍্যাঙ্কেনস্টাইন। তারা তোমাদের ছাপিয়ে যাবে। তারাই কেবল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবে। আমাদের কথা বুঝবে। কিন্তু তোমরা শয়তানি জানো। আবেগ তোমরা তাদের শেখাবে না। তখন ওদের আমাদের প্রয়োজন হবে। তাই এ বিষয়ে মানুষ বেশি সেয়ানা হওয়ার আগেই, তারপর ধীরে ধীরে মানুষের মাথা নিরেট হয়ে যাওয়ার আগেই আমরা আবেগগুলো বুঝে নিতে চাই। কারণ যন্ত্র যত বড় হবে, মানুষের প্রবৃত্তিই কেবল বাড়বে। আবেগের ক‍্যালাইডোস্কোপ ধ্বংস হয়ে যাবে। তখন আর আমাদের কিছু পাওয়ার থাকবে না। আর তোমরা চালবাজ, তাই ঝুঁকি নেবে না। তোমরা যেসব আদর্শকে জোলো বলে মনে করো, সেগুলো আমাদের শেখাবে। আমরা আদর্শহীনতা শিখতে চাই। তোমাদের তৈরি করা সঠিকের, ভালত্বের বুদবুদ আমাদের চাই না। তোমরা কোথায় কতটা নীচ, সেগুলোও আমরা শিখতে চাই।

আমরা এখানে খুব সাড়ম্বরে আসিনি দীপক। আমরা নানাবিধ স্পেস পার্টিকলের ছদ্মবেশ ধরে একদিন এসে পৌঁছেছিলাম পৃথিবীতে। আমরা এসেছিলাম অনেকেই। দুজন এসেছিলাম ঘুরেফিরে এদেশে, তোমাদের এই দেশটায়। আমরা চিনেছিলাম মানুষের অনুভূতি। তাই আমরা প্রথমে ছিলাম ভয়ের চেহারা ধরে। যাতে মানুষ আমাদের থেকে দূরে সরে থাকে। কাছে আসতে না পারে। আমরা বুঝে নিতে চেয়েছিলাম দূর থেকে, কোন মানুষের ভেতর লোভ আছে, অন্ধকার আছে, তাও ভালবাসার, কষ্টের অনুভূতি সাচ্চা আছে। আমরা প্রথমে নিলাম এক আশ্চর্য জন্তুর চেহারা। যা ভয়ঙ্কর। যা শিকার জানে‌। সাপ। যে সাপ নাকি ইন্ধন দিয়েছে মানুষকে পাপে। সেই সাপের পেট থেকে আমরা বেরোলাম লোভ হয়ে। হিরে। পাথর। কার্বনের কালো, কয়লার কালো, শ্রমের রক্ত মেখে যে মানুষের কাছে দর্শনীয় হয়, কিন্তু কোনও কার্যকারিতা নেই তার। এই লোভ এখনও মানুষের আছে। একসময় আর থাকবে না। একসময় এই লোভ মানুষের কাছে পুরনো হবে, নতুন লোভ দানা বাঁধবে। জিভ লকলকে হবে অন্যভাবে। আরও আদিম লোভ, নয়তো আরও নতুন কোনও লোভ আসবে পৃথিবীতে। তাই লোভের চেহারাও আমি বদলেছি। উৎসাহ, কৌতূহল মানুষকে অজানার দিকে ঠেলছে এখন। যে জ্ঞানের অর্জন সম্ভব নয়, সেই জ্ঞানের দিকে ছুটছে মানুষ। তাই আমি নতুন লোভের চেহারা নিলাম। আজ আমি একটা সামুদ্রিক লার্ভার মতো দেখতে। আস্তে আস্তে তোমার মতো দেখতে হয়ে উঠতে পারি। মানুষের প্রতি মানুষের লোভ নেই দীপক, কিন্তু আমি এমন একটা অস্তিত্ব হব, যার উৎস জানতে তোমার মতো অনেকের লোভ হবে। আমার আরেক সঙ্গীও এদেশেই আছে এখনও। কোথাও একটা। সে এখনও রাজাউজিরের লোভের মতো হিরের চকমকিতে আটকে কোথাও। অন‍্য অনেক দেশে ভয়ের চেহারায়, লোভের চেহারায় আমরা ছড়িয়ে রয়েছি। দুর্ভিক্ষের দেশে রয়েছি খিদে হয়ে। বৈভবের দেশে রয়েছি আরও বৈভব বা আকাল হয়ে।

হাঁপিয়ে গেলাম দীপক। আরেকটু তাপমাত্রা কমিয়ে দাও ঘরের। আলোও। আমার একটু ক্লান্ত লাগছে।

—শেষ প্রশ্ন, তোমার গ্রহের নাম কী?
—হাসিও না দীপক। গ্রহের নাম! নামের মতো সামান‍্য পরিচিতিতে তোমরা বিশ্বাসী। আমরা নই। তোমরাই নাম দিও না হয় একটা। ভাল কথা, আমারও নাম লাগবে। আমি শুনতে পাচ্ছি স্পষ্ট, তুমি মনে মনে আমাকে জেলি বলে ডাকছ। সেটা অসম্মানজনক। ইতরের মতো ব‍্যবহার। আমার একটা মানুষী নাম চাই। আরও অনেক বছর পর হয়তো তোমাদের তৈরি বুদ্ধির পিণ্ডরা কম্পিউটারের ভেতর থেকে তোমাদের সঙ্গে কথা বলবে, তোমাদের নিঃসঙ্গতা কাটাবে, সমস্যার সমাধান করবে, তোমাদেরই ভাষা রপ্ত করে। তখনও তো তোমরা তাকে নাম দেবে।

সরিৎ আচ্ছন্নের মতো বলল, তবে দীপক নামটা তুমি নাও। ওটা তো আর কাজে লাগে না। দাদা-বৌদি নেই।

জেলি একটু চুপ। তারপর বলল, এই নামটা তোমার আর কাজে লাগবে না, তুমি নিশ্চিত?

—কী কাজে লাগবে?
—নাম পাল্টাতে।

আঁতকে উঠল সরিৎ। নাম পাল্টাব কেন?

—দরকার হবে সরিৎ। তোমার বন্ধুরা বেঁচে আছে। তারা তোমার খোঁজ করতে পারে। সামান‍্য হলেও এই ছদ্মনামটাই হয়তো তোমার কাজে লেগে গেল।

সরিৎ চুপ।

—শাহিদ স‍্যর, মৌলিনাথ সেন, ওরা…
—বেঁচে আছে। তুমিই তো তেমন ব‍্যবস্থা করে এসেছিলে। ভালই হয়েছে, তোমাকে আরেকটা খুনের দায় নিতে হয়নি।

সরিৎ স্তব্ধ। পক্ষাঘাতগ্রস্তর মতো দাঁড়িয়ে‌।

পিন পড়া নিস্তব্ধতা। ওর মনে বেজে উঠছে শব্দের তরঙ্গ। যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে‌।

—এই ঘরে ভেন্টিলেশন ছিল না তখন দীপক। ছিল একরাশ জমানো কাগজ, নানাবিধ ফেলে দেওয়া আসবাবপত্র। ধুলোর রাজত্ব। একটা দিন, গোটা একটা দিন তোমার ছোট থেকে ক্রনিক অ্যাজমার রুগি ভাই এই ঘরে আটকে ছিল। একদিন পরে তুমিই তো বলেছিলে না তোমার বাবা-মাকে, এই বেসমেন্টে তোমার ভাই লুকিয়ে আছে কি না দেখতে?

সরিৎ এখনও নড়তে পারছে না। প্রতিধ্বনির মাত্রা বাড়ছে।

—এই ঘরে তোমার ভাইকে তুমি খুন করেছিলে দীপক। কেন? বাবা-মায়ের ওই জেল্লাদার ভালবাসা তোমার সত্যিই দরকার ছিল? ছিল না আসলে। অনিলদাদের থেকে অনেক খাঁটি ভালবাসা তুমি পেয়েছিলে দীপক‌। তাও তোমার ঈর্ষা বাধ মানেনি। জটিল রোগ এটা মানুষের মনের। শেখার, সত্যিই শেখার।

লার্ভা থেকে ক্রমে সদ‍্যোজাত মানবশিশুর চেহারা নিচ্ছে জেলি। সে বলে যাচ্ছে, বেশ, তোমার দেওয়া নাম অমি নিলাম। আজ থেকে আমাকে দীপক বলে ডেকো। আমিও তোমাকে নাহয় ওই নামেই ডাকব।

আরও একটা অপার্থিব হাসি ছড়িয়ে পড়ল সরিতের বাড়ির এই পাতালঘরে।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...