আগামী সংখ্যায় সমাপ্য…
সে তার সময় পার হয়ে চলে যায় নদীটি পেরিয়ে…
অতীতের ছায়া এসে পড়ে।
যা-সব কখনও ঘটেনি, যা-সব ঘটার ছিল না কোনওদিন
সে-সব ঘটতে থাকে দিনের আলোয় আর রাতের আঁধারে
যারা আর নাই, যারা চলে গেছে বিপুল অতীতে চড়ে
ঝমঝম রেলগাড়ি সুড়ঙ্গ পেরিয়ে ওইপারে
তারা, সেইখানে উপস্থিত হয়ে মোচ্ছব বসায়
ঘুগনির দোকান দেয়, ভাঙ খায়
বেলুন ফাটায় গিয়ে বন্দুক ছুঁড়ে
চড়কের টঙে বসে সিগরেট ধরায়!
যেন তারা কোথাও যায়নি কোনওদিন
যেন এইখানে বটতলে ব্যাপক হুল্লোড়ে মেতে
মন্দির-চাতালে ঘাসে তাস পিটেছিল এতদিন।
সেরকম,
স্বাভাবিক স্বরে এসে পা দোলায়, গল্প করে পুরানো দিনের
ভবিষ্যতে যাদের সঙ্গে দেখা হবে বলে কথা ছিল
তারাও দু-চারজন এসে পড়ে গল্পের আসরে
যে দু-পক্ষের কখনওই দেখা হয়নি পৃথিবীতে এসে,
যারা সব সময়ের এপার-ওপার তারা
হাসিমুখে গল্প করে মাদুরের একপাশে বসে।
ওঘরে কার যেন হাত ফস্কে পড়ে গিয়ে
ঝনঝন শব্দ ওঠে বাসনের,
চমকে উঠি, দেখি—
ঘরের সামনে এক অন্য কুলি-পথ…
খুব ছোটবেলাকার বন্ধু এক
লাঠি হাতে সাইকেল-টায়ার পিটিয়ে ছুটছে আখড়ার দিকে
সেই রাস্তার পাশে ছাইগাদা,
সারা মহল্লার তোলা উনানের ছাই,
ঘুঁটা আর কয়লা পোড়া ছাই স্তূপ হয়ে আছে সারাদিন
গ্রীষ্ম-দুপুর উড়ছে ভিরুলের দিকে
মন্দিরবাড়ির দিকে পাক মেরে উড়ে যাচ্ছে ছাই
আবছা সেই দৃশ্যের ভিতর মনে পড়ে তার মুখ,
ছাইমাখা আবছা ধুসর!
সে খুব ছোটবেলায় তিনদিনের ধুমজ্বরে মারা গিয়েছিল..
সকালে কিশলয়পাঠ খুলে তার মৃত্যু পড়ি নিরাসক্ত মনে
তখনও আমার মন মৃত্যুসংবাদের মতো উপযুক্ত নয় বলে
আমি খুব বিষণ্ণ হই না
…সে ছুটছে টায়ার চালিয়ে।
উপরে টেলিগ্রাফের তারে মরা চাঁদাঘুড়ি
লাট খাচ্ছে দখিনা হাওয়ায়।
আমি তার পিছুপিছু প্রাণপণ ছুটতে গিয়ে বুঝি
বয়স হয়ে যাচ্ছে আমারও
ভারি হয়ে আসছে পা
সন্ধ্যা নামার আগে ডুমবাতি জ্বলে উঠছে পোলের মাথায়—
তার হলুদ আলোর নিচে মনে পড়ে
কোথায় রয়েছে যেন আমারও অন্য এক ঘর
সেখানে অন্য লোক, অন্য অন্য ঘরের মানুষ
রক্ত-সম্পর্কের মতো সব মুখ!
তবু তাদের কারও মুখ মনে পড়ছে না কিছুতেই।
…
আজীবন ঘুম থেকে জেগে উঠে ভাবি—
এই বুঝি আসল জীবন!
বিছানায় ঘুম ভেঙে শ্বাস ছাড়ি, ভাবি
খুব বাঁচা বেঁচে গেছি, ভাগ্যিস সত্যি নয় কিছু
ভাগ্যিস ঘুমের ভিতরে…
ভাবতে ভাবতে ফের চোখ বুজে শুই, দেখি
জেগে উঠি ফের সেই ঘুমের ওপারে
অন্য এক মানুষের অন্য পরিচয়ে
অন্য ঘর, অন্য বন্ধু নিয়ে হেঁটে যাই
সেখানে অলীক রং, স্বচ্ছ কাচের মতো ফুল
বাগানের ভিতরে সেই বিষণ্ণ দৈত্যের বাড়ি খোলা পড়ে আছে
সেখানে দেয়াল জলের মতো, টোকা দিলে দুলে ওঠে
বাতাস অল্প নীল, দরজার বাইরে বয়ে যায়
কে কোন সম্পর্ক নিয়ে হেঁটে আসে অনিশ্চিত পথে?
পিতা, মাতা, সন্তান, বন্ধুজন মুহূর্তে পালটে যায় রূপ!
সকালে বার হয়ে দেখি—
আকাশ অন্ধকার, ঝুলে আছে সন্ধ্যার দিকে
সূর্য অস্ত যায়, সময়ের হিসাব খুব ঘোরালো এখানে
ঘড়ির ডায়ালে লেখা বারোটি মাসের নাম
আজ সংক্রান্তি কাল পয়লার মাঝে এক ধুসর অঞ্চল পড়ে আছে
জয়ন্ত হঠাৎই বলে ওঠে–
আলোকবর্ষ এক দূরত্বের মাপ? নাকি সময়ের?
ভাবি, একবার ওপারে জেগে উঠে
স্যারকে ফোন করে ডাকি…
অমনি কিছুদূরে হেসে ওঠে কেউ!
তার কণ্ঠস্বর বহুযুগ চেনা, অথচ শরীরহীন
এপারে ওসব খুব স্বাভাবিক, হালচাল ভীষণ স্বাধীন…
এইবার ওপারে যাবার দিন এল
—ফের জেগে উঠি।
ভাবি, তবে দুদিকেই জেগে ওঠা যায় নিয়মিত!
দুদিকেই সংসার রয়েছে মানুষের?
শুধু তার নিয়ন্ত্রণ অন্যকারো হাতে…
…
টানা, দীর্ঘ, টানেলের মত স্বপ্নের ভিতর
ছুটে যাওয়া হল এতদিন
ঘুম ভাঙবার পরে শৈশবের মতো এক
অবিকল ভয় ও স্বস্তির অন্ধকার জগতে নেমেছে
যখন বিকালবেলা বাবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি
যতদূর রাস্তা চিনি তার চেয়ে আরও দূর চলে গিয়ে
ফেরার সময় দেখি সন্ধ্যা নেমে গেছে
কালো পুকুরের জলে ঘাই মারছে কার্তিক-গণেশ!
কালপুরুষের ধনু ঝুলে আছে পশ্চিম আকাশে ওই উত্তরে জিজ্ঞাসা মণ্ডল
সাইকেল ঠেলে নিয়ে ফিরে আসছি খালি পায়ে
যেখানে নতুন-মহল এক শ্মশানের নাম!
লালবাঈ খুন হয়েছিল এইখানে!
তার ধ্বংস-মহলজুড়ে শ্মশানের প্রেতাত্মারা ওড়ে
তীব্র ধূপের গন্ধ উড়ে আসে সন্ধ্যা-হাওয়ায়
হাঁটতে হাঁটতে ১৯৮৬ সালের চটি ছিঁড়ে যায় এইখানে এসে…
এ পথের শেষে জানি খুঁজে পাব শৈশবের ঘর!
প্রতিবার হারিয়ে যাবার আগে অন্ধকারে এভাবেই ঘর ফিরে পাই
সেই মেঠোরাস্তা আজ তোমাকে দেখাব বলে
অন্ধকারে হাত ধরে নেমে পড়ি পথে,
তখন মধ্যযাম,
বন্ধ হোটেলের উনানে কাঠের আগুন জ্বলছে ধিকি
তারপাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ডাইনি গুপিখেপি!
গুপিখেপি মরে গেছে ১৯৮৬-র মাঘে!
তিরকে উঠে দেখি সেই দুলে ওঠা বাসকের বন
কাটানধারের রাস্তা, চেনা কচুবন
যেন ৮৭ সালের পথে বছর তেরোর শৈশব
লাফ দিয়ে পার হই কুনোব্যাং গিলে ফেলা ঢোঁড়া
এই পথে বহুবার ফিরে পাওয়া ঘর—
তবু পুরনো সংশয় নিয়ে কিছুদুর হেঁটে এসে দেখি—
এবারেও রাস্তা শেষ!
যেখানে পুকুর ছিল সেখানে প্রাচীর!
বিপুল কিনারে তার থুত্থুরে অন্ধ পেঁচা বসে আছে পাহারার মতো
ওইপার আমার অজানা!
এক হাঁটু অন্ধকারে মাথানত ভাবি—
ফিরে যাব? কোনদিকে?
তুমি সংশয়-বিধুর চেয়ে থাকো,
চোখে অভিমান, আর পথ হারানোর বেদনা লুকাও
আমি হাত ধরে বোঝানোর চেষ্টা করি—
সত্যিই! একদিন পথ ছিল এইখানে,
আমি নিজে কতবার হেঁটে ফিরে গেছি!
তুমি বিশ্বাস করেছ?
মৃদু হেসে সান্ত্বনা দেবার মতো হাত নেড়ে স্বপ্ন ভেঙে দাও…
…
সেই ভাঙা কাচ পড়ে আছে লাইনের ধারে…
এই পথে একদিন লৌহগাড়ি চলাচল ছিল
তার জানলায় ছিল রঙিন চুড়ির হাত স্মৃতির মতন
এখন ভবিষ্যকাল, শ্রীচরণকমলেষু কুসুমাস্তীর্ণ এই ছায়াঘনপথে
বাড়ি ফিরবার ছলে শেষ বার জেগে উঠলাম
এপার-ওপার এই বহুবার জেগে ওঠা হল
এখন বিস্মৃত-ভুমি
ভুলে গেছি কোন পারে জেগে উঠে ফিরে পাব জন্মের ঘর
কোন পারে আত্মীয়স্বজন আর কোন পারে হারানিধি ঘাট!
কিছু পথ পায়ে হাঁটা কিছু পথ ডানা মুড়ে রাখা
যে পথে যেমন রীতি, এক পথ ঘরে ফিরবার—
ওন্দাগ্রাম স্টেশনের হলুদ সোঁদাল আর পিয়ারডোবার মোলবন
মধ্যিখেনে জন্মকাল
চৌকানের লুপ্ত জলাধার লুপ্ত পৃথিবীর ইতিহাস
বহুকাল পূর্বের ভুলে যাওয়া মেঠাভাষা তুলে কে যেন ডাকছে বহুদূরে
তার প্লুতস্বর ভেঙে ভেঙে ছড়িয়েছে ডাঙা ও ডহরে
সেই ডাকে সাড়া দিতে উড়ে যেতে হবে কিছুদূর..
অন্য পথ— হারিয়েছে পায়ের তলায়
সেখানেও হেঁটে ফিরছে অন্য কেউ
অন্য অন্য স্বপ্নের ভিতর
এ জন্মের শেষে একদিন ফিরে পাবে বলে তার ঘর…
এক অসামান্য স্মৃতিমেদুরতা ঘেরা এ এক আশ্চর্য নির্মাণ। কবিকে কুর্নিশ।