অয়নেশ দাস
প্রবল শক্তি নিয়ে গলার ওপরে ক্রমশ চেপে বসছে প্রতিপক্ষের বজ্রকঠিন বাহুমূল। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে; কারণ শক্ত মেঝের ওপর হাঁপধরা বুকটুকুর সামান্য প্রসারণের জায়গাও এখন খতম। কর্নিয়া ভিজে আসছে বিন্দু বিন্দু ঘামে। যন্ত্রণা পেশী ছাড়িয়ে হাড়ের ভিতরে গিয়ে বিঁধছে। কানের ভিতর থেকে গরম রক্ত গাল বেয়ে মিশে যাচ্ছে হিমশীতল যন্ত্রণার সঙ্গে। আমাদের কজনার এই অভিজ্ঞতা আছে? শ্বাসরোধী অভিজ্ঞতা? কুস্তি বা বক্সিং-এর রিংয়ে যে অভিজ্ঞতা অহরহ, নিয়ত ঘটে চলে কুস্তিগীর বা মুষ্টিযোদ্ধার জীবনে, আমাদের জীবনে তো তা ঘটে না। রিঙের বাইরে নৃশংস, নিরাপদ অ্যাড্রিনালিনে স্নান করতে থাকি আমরা। এ আমাদের আদিম অভ্যেস। এ আমাদের আধুনিকতার উন্মাদনা। সভ্যতার মশালদীপ্ত গ্রিকরা এ অন্ধকারের মহাকাব্য লিখেছিল অনেক আগেই। খেলা তো শুধু খেলা নয়। খেলা হল যুদ্ধ। খেলোয়াড় হল যোদ্ধা। হিংসার মহাকাব্য লিখে চলবে যুদ্ধক্ষেত্র, সভ্যতার এই তো পুরুষকার। অলিখিত বান্দার নির্দেশে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয়ে যায় ট্রয়… ওয়াটার্লু… অলিম্পিকের চারকোনা রিং…।
যোদ্ধার শ্রম, খেলোয়াড়ের শ্রম মৃত্যু উপত্যকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বারংবার ফিরে আসে আমাদের উন্মাদ আনন্দ হয়ে। কখনও হয়তো প্রাণ আর ফিরে আসে না। তাতে কী যায় আসে! প্রতিপক্ষের লৌহ-বাহুবন্ধে শ্বাসরোধ হয়ে আসে অমিত শক্তিধর অ্যারিচিয়নের। ঘাম মিশে যায় যন্ত্রণার ধারাপাতে, রিঙের বাইরে উন্মত্ত জনতার ফাঁক গলে আসে না ভূমধ্যীয় আলো; অস্বচ্ছ শক্তিহীন দৃষ্টির বাইরে চলে যায় এলেফসিনার নীল জল। অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে কী দেখে অ্যারিচিয়ন? শেষ শক্তি জড়ো হয় অ্যারিচিয়নের দুই হাতে। দুই চোখ চিরতরে বোজার আগেই দুই হাতের মরণ কামড়ে ভেঙে চুর চুর হয়ে যায় প্রতিপক্ষের পায়ের হাড়। আকাশে উঁচিয়ে ওঠে প্রতিপক্ষের বুড়ো আঙুল। সাবমিশন। ততক্ষণে স্তব্ধ অ্যারিচিয়নের বুক। তাতে কী! মরণোত্তর বিজয়ীর পদকজয়ীর নাম লেখা হয় অ্যারিচিয়ন দ্য ফিগালেইয়ার নামে। প্রাচীন গ্রিসের আদিম অলিম্পিকে কুস্তির রিঙে বিজয়ীর মৃতদেহে নির্মিত হয় খেলার ময়দানে হিংসার আবহমান গৌরবগাথা।
সেই গাথাতেই কাঁথা বোনে সহস্র অন্যতর আখ্যান। অলিম্পিকের রিং। স্বপ্নের চতুষ্কোণ। রিঙের বাইরে, টিভির পর্দায় লক্ষ ক্ষুধিত চোখের সামনে মেঝেয় চেপটে বসেছে সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগটের মাথা। কঠিন হয়ে আসছে প্রতিপক্ষের বাহুমূল। প্রতি মুহূর্তে হু-হু করে কমে আসছে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা। অস্বচ্ছ দৃষ্টি কী খুঁজে বেড়ায় তখন? দুখী মায়ের মুখ? হলুদ ছোপধরা গাঁ? বাবার যক্ষাক্লিষ্ট বুক? নাকি ভেজা কর্নিয়া ভাসিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায় দুরন্ত তেরঙা? চোখ জুড়ে যত অন্ধকার নামে, ততই কি আলোকিত পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে কালো দিগন্ত ভেঙে ভেসে ওঠে অলিম্পিক মেডেল? নাকি হিংসা? হিংস্রতা? নাকি ঘৃণা? নাকি নাছোড় লড়াই? নাছোড় অপ্রেসড কেউ অ্যারিচিয়নের মতো ভেঙে চুর-চুর করে দিতে চায় জীবনের যাবতীয় অপ্রেশন? ইতিহাস ক্ষমতাহীনের জন্য রেখে যায় রক্তাক্ত খেলার মাঠ, কুস্তির আখড়া, বক্সিং রিং। সেই মুহূর্তে কোথায় রাষ্ট্র? কোথায় তেরঙা? সে তো প্রতীক মাত্র! উপহাস মাত্র। শ্বাসরোধী অতিকায় সময়ের মুখোমুখি নিদারুণ একলা শরীর। ট্রেঞ্চে… রিংয়ে… অ্যাস্ট্র্রোটার্ফে এক মৃত্যু-শীতল অমরত্বের প্রত্যাশায়। অতীত-ছেঁড়া যন্ত্রণায় যাবতীয় হেরে যাওয়া জয়ে পালটে যেতে চায় মুখোমুখি চতুষ্কোণে। জাতিঘৃণার পাঞ্চে, পুরুষতন্ত্রের জ্যাবে কান ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসার আগেই কানে ফিসফিস করে যান মায়া অ্যাঞ্জেলু।
Out of the huts of history’s shame
I rise
Up from a past that’s rooted in pain
I rise
নিস্তব্ধ আলোকপুঞ্জের মতো মৃত অ্যারিচিয়নের অবিনশ্বর শ্রম গলে গলে খোদিত হয় সোনার পদক। অতীতভাঙা কান্না দিয়ে সেঁচে কাঞ্চনরঙা হয়ে সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগটের গলায় ঝোলে রক্তের অর্জন। অন্ধ জনতাকে উপহাস করে আলোময় অন্ধকার। একটি অলিম্পিক পদক। সে কি শুধুই ভিকট্রি স্ট্যান্ড? সে কি শুধুই জাতীয় সঙ্গীতের কোরাস? ১৯৬০-এর রোম অলিম্পকে বক্সিঙে সোনার পদক ছিনিয়ে নিয়েছিল এক কৃষ্ণাঙ্গ দেবতা। ক্যাসিয়াস ক্লে। বন্ধু ওয়েলমা রুডলফ বলেছিলেন— পদকটি ওর কাছে এতটাই মূল্যবান ছিল, ও সর্বক্ষণ, সর্বত্র পদকটি গলায় ঝুলিয়ে ঘুরত। ও ঘুমোতে যেত, ক্যাফেটেরিয়ায় কফি খেতে যেত— সর্বক্ষণ ওর গলায় ঝুলত অলিম্পিকের সোনার মেডেল। ষাটের দশকের কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকার কালো আকাশে সে মেডেল ছিল সোনার চাঁদ। ষাটের দশক প্রত্যক্ষ করেছিল সেই নিঃসঙ্গ কালো দেবতার উত্থান। ‘’তোমরা যে আমাকে বক্সিং রিঙে ফাইট করতে দেখছ; সে তো শুধুই এ জন্য নয়, যে আমি প্রতিপক্ষকে হারাতে পারি। আমি সাফল্যকে এইজন্যই ছুঁতে চাই, কারণ একমাত্র তখনই আমি আমার নিজের কথাটা মানুষকে শোনাতে পারব।’’ সে তো এক নিঃসঙ্গ, ঘৃণিত কালোমানুষের একলা বিজয়! একলার অর্জন! পিতৃপুরুষের কয়েকশো বছরের ঘৃণিত অস্থি-মজ্জা-ছাই আশরীর জড়িয়ে এক নাছোড় অন্তর্ভেদী উত্থান!
Bringing the gifts that my ancestors gave,
I am the dream and the hope of the slave.
I rise
I rise
কিন্তু সোনার মেডেলের দ্যুতি এত ব্যপ্ত নয় যে তা আস্ত একটা জীবনকে ঢেকে রাখতে পারে। লুইভিলের ক্যাসিয়াস অলিম্পিকের নায়ক হয়েছিল বটে, কিন্তু বাস্তব তার আসল সামাজিক অবস্থানটিকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে নগ্ন করে দিতে সময় নেয়নি। রিঙের বাইরে তুমি তো শেষ পর্যন্ত একজন ‘ডার্টি নিগার’ ছাড়া আর কিছু নও, ক্যাসিয়াস! রিঙের ভেতরেও তুমি নিগার ছিলে, রিঙের বাইরেও তাই। তুমি কী করে ভুলে গিয়েছিলে; সভ্যতাকে ছেড়েই দাও, এমনকি ‘কিং অফ দ্য জাঙ্গল’— টারজানও একজন বিশুদ্ধ শ্বেতকায়! লুইভিলের দর্পিত কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিল লুইভিলের এক পাবে। যদিও সদ্য অলিম্পিক বিজয়ীর গলায় তখনও ঝুলছিল সোনার মেডেল; পাব কর্তৃপক্ষ কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিল— এখানে নিগ্রোদের খাবার সার্ভ করা হয় না। ফেলে আসা জীবন থেকে আমেরিকান সমাজের এই চেহারা কি জানা ছিল না ক্যাসিয়াসের? ছিল; শুধু এই ধারণা ছিল না যে একটা সোনার মেডেল ঘৃণার সামনে কিছুই না। সেইদিনই লুইভিলের কৃষ্ণাঙ্গ নায়ক ওহায়ো নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল নিজের প্রিয়তম সোনার মেডেল। আরেকটা জিনিস সে ভাসিয়ে দিয়েছিল ওহায়োর জলে; নিজের জন্মগত নাম— ক্যাসিয়াস ক্লে। Cassius Clay is a slave name. I didn’t choose it and I don’t want it. I am Muhammad Ali, a free name। জন্মাবধি অপমানকে প্রত্যাখ্যান করে এক নতুন নামে দুর্বার উত্থান ঘটেছিল এক অদম্য ইতিহাসের। ১৯৬৪-র ওয়র্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপে বাজির পাশা উলটে দিয়ে সোনি লিস্টনকে ছিটকে দেওয়ার ঠিক পরের দিনেই পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছিল সেই নতুন নাম— মহম্মদ আলি। অ্যারিচিয়ন রিঙের বাইরে জীবিত বেরোতে পারেনি; মহম্মদ আলি যেন রিঙের বাইরে আরও বেশি করে বেঁচে উঠেছিল।
You may write me down in history
With your bitter, twisted lies,
You may trod me in the very dirt
But still, like dust, I’ll rise.
সেখানে কার দেশ? কোথায় রাষ্ট্র? কোথায় বা স্টারস অ্যান্ড স্ট্রাইপ্স! সোচ্চার উচ্চারণ— আমি মহম্মদ আলি। আমিই আমেরিকা। কিন্তু দেশ আর রাষ্ট্রে যে ফারাক আছে বিস্তর! রাষ্ট্রের তরফ থেকে যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধে সৈন্য হিসেবে যাওয়ার শমন এল, তখন আলি পক্ষ নিতে ভুল করেনি।
I ain’t got no quarrel with the Viet Cong… no Viet Cong ever called me nigger.
১৯৬৭ সালের ১৮ জুন, মহম্মদ আলি ইউএস আর্মিতে যোগদানের ড্রাফট প্রত্যাখ্যান করেছিল। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলির মন পরিবর্তনের জন্য আরও দুই খ্যাতনামা কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়কে পাঠানো হয়েছিল। ফুটবল তারকা জিম ব্রাউন আর প্রবাদপ্রতিম বাস্কেটবলার লিউ অ্যাল্কিন্ডর যিনি পরে করিম আব্দুল-জব্বার নামে পরিচিত হয়েছিলেন। সর্ব্বোচ্চ শিখরে থাকা কেরিয়ারের কতখানি ক্ষতি হতে পারে জানিয়েও টলানো যায়নি আলিকে। সপাট বক্তব্য এসেছিল—
Why should they ask me to put on a uniform and go 10,000 miles from home and drop bombs and bullets on Brown people in Vietnam while so-called Negro people in Louisville are treated like dogs and denied simple human rights? No I’m not going 10,000 miles from home to help murder and burn another poor nation simply to continue the domination of white slave masters of the darker people the world over. This is the day when such evils must come to an end. I have been warned that to take such a stand would cost me millions of dollars. But I have said it once and I will say it again. The real enemy of my people is here. I will not disgrace my religion, my people or myself by becoming a tool to enslave those who are fighting for their own justice, freedom and equality. If I thought the war was going to bring freedom and equality to 22 million of my people they wouldn’t have to draft me, I’d join tomorrow. I have nothing to lose by standing up for my beliefs. So I’ll go to jail, so what? We’ve been in jail for 400 years.
কেড়ে নেওয়া হয়েছিল হেভিওয়েট বেল্ট, খেতাব। নেমে এসেছিল নির্বাসন। তাতে কী? মহম্মদ আলির ওডিসি ছড়িয়ে পড়েছিল ক্যাম্পাসে, ক্যাম্পাসে… সমস্ত যুদ্ধবিরোধী প্রস্তাবনায়… রেস ও গণতন্ত্রের যাবতীয় প্রতর্কে…।
আমি তো আর অবিচুয়ারি লিখছি না; তবে মহম্মদ আলিকে নিয়ে এত কথা লিখছি কেন জানেন? ইতিহাসের কী অদ্ভুত সমাপতন! সামাজিক অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক অপমানিত কৃষ্ণাঙ্গের ওহায়োর জলে পদক ভাসিয়ে দেওয়ার মধ্যে যে আগুনে ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল, আজ দীর্ঘ ৬৩ বছর ভারতের মাটিতে সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগটরা যখন কষ্টার্জিত, স্বপ্নার্জিত নিজের চেয়েও প্রিয়তম পদকগুলি একইরকম ক্ষোভে, যন্ত্রণায় গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে চাইছে তখন ইতিহাস আমাদের আরেকবার ১৯৬০-এর ওহায়োর তীরে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ যেমন এক অন্ধকার দিক, তেমনি আশার দিক কি নেই? আমরা তো দিন গুনতেই পারি ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে সাক্ষী, বিনেশ, বজরং-এর ভবিষ্যতের মহম্মদ আলিতে উত্থানের আশায়। সোনার মেডেল ঢাকতে পারেনি ক্যাসিয়াসের কৃষ্ণাঙ্গ আত্মপরিচয়। স্টেট অ্যাপারেটাস, ক্ষমতার লোলুপ থাবার থেকে সোনার মেডেল ঢাকতে পারেনি হরিয়ানার সোনার মেয়েদের অসুরক্ষিত নারী শরীর। এই তো সময় রিঙের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে আসার। আলি যদি পেরে থাকে, আমাদের সোনার মেয়েরা, তোমরাও পারবে। যে করিম আব্দুল-জব্বার আলির মন পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রেরিত হয়েছিল, সেই জব্বার-ই আলির স্মৃতিচারণায় লিখেছিল— “While I admired the athlete of action, it was the man of principle who was truly my role model.” ভারতবর্ষের নিপীড়িত জনতার রোল মডেল কারা হয়ে উঠবে সেটা ইতিহাস-ই বলবে। তবু বুক বাঁধতে চায়। গোটা ভারতবর্ষ বুক বাঁধতে চায়। যেমন মহম্মদ আলির মধ্যে দিয়ে বর্ণান্ধতার বিরুদ্ধে, অন্যায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে বুক বেঁধেছিল আমেরিকার জনতা, যেমন জো লুই-এর মধ্য দিয়ে হিটলারি শ্বেত আরিয়ান প্রভুত্বের বিরুদ্ধে বুক বেঁধেছিল আপামর নিপীড়িত বিশ্ব।
এই পুরো লেখাটায় একজন আমার পিছু কিছুতেই ছাড়ছেন না। মায়া অ্যাঞ্জেলু। ১৯৩০-এর ‘ব্রাউন বম্বার’-কে নিয়ে উচ্ছসিত ছিলেন মায়া— “the one invincible Negro, the one who stood up to the white man and beat him down with his fists. He in a sense carried so many of our hopes, and maybe even our dreams of vengeance.” জো লুই। মায়ার নয়নের মণি। কালো মানুষের ড্রিম অফ ভেনজেয়ান্স। ১৯৩৬ এবং ১৯৩৮ সালে দুটি ভুবনবিখ্যাত লড়াই-এর সাক্ষী থেকেছিল পৃথিবী। কৃষ্ণাঙ্গ জো লুই বনাম জার্মান শ্বেতকায় ম্যাক্স শ্মেলিং। আরিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হিসেবে শ্মেলিং-কে প্রমোট করেছিল হিটলার নিজে। প্রথম বাউটে লুই পরাজিত হয়। আনন্দে আত্মহারা যে শুধু গোয়েবলসের মিডিয়া হয়েছিল তাই নয়, এমনকি আমেরিকার নিউ অরলিন্স পাকায়ুনের একটি কলাম ঘোষণা করেছিল— “I guess this proves who really is the master race.” কিন্তু কিছু মানুষ থাকে যারা ইতিহাস পালটে দিতে পারে। ১৯৩৮-এর লড়াইটা যেন গোটা পৃথিবীর দুই অংশের লড়াইতে পরিণত হয়েছিল। একদিকে হিটলার, জিম ক্রো সাউথ; অন্যদিকে গণতন্ত্রকামী বাকি দুনিয়া। হিটলার যেমন এই লড়াইয়ের রেডিও ধারাবিবরণী জার্মান জনতার জন্য বাধ্যতামূলক করেছিল, তেমনি আমেরিকান কম্যুনিস্ট পার্টি হারলেম থেকে বার্মিংহাম পর্যন্ত সমস্ত জনসমাবেশে এই ধারাবিবরণী প্রচার করছিল। প্রথম রাউন্ডেই লুই যখন শ্মেলিং-কে নক-আউট করে দেয়, হিটলার সঙ্গে সঙ্গে জার্মানির সমস্ত রেডিও লাইন বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তবুও নক আউটের শব্দ শুনে ফেলে সারা জার্মানি। সে শুধু নক-আউটের শব্দ ছিল না, সে ছিল ফ্যাসিস্ট ক্ষমতার পতনের আগাম সঙ্কেত। এর পরও দীর্ঘ ১২ বছর ধরে পঁচিশটি লড়াইতে জো লুই হেভিওয়েট খেতাব ধরে রেখেছিল। এবং তার বেশিরভাগই শ্বেতাঙ্গ বক্সারদের তুলোধোনা করে।
গ্যাস চেম্বার বললে আমরা অনেকেই শুধুমাত্র হিটলারের জার্মানির কথাই বুঝি। গ্যাস চেম্বার নামটিতে যে হরর আষ্টেপৃষ্টে এঁটে আছে, সে হররের বাস্তব হলোকস্টের বাইরেও ছড়িয়েছিল। ১৯২৪ সাল থেকে আমেরিকার সাদার্ন স্টেটগুলিতে ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের ব্যবস্থা পালটে ফেলা হয়েছিল। ফাঁসিকাঠের বদলে ব্যবহার শুরু হয়েছিল বিষাক্ত গ্যাসের। বদ্ধ গ্যাস-চেম্বারের মধ্যে একটি মাইক্রোফোন রাখা থাকত, যাতে করে বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষকরা শাস্তিপ্রাপ্তের মৃত্যুর ঠিক মুহূর্তে অর্থাৎ ওই মাহেন্দ্রক্ষণে শেষ অভিব্যক্তি কী হয় রেকর্ড করে রাখতে পারেন।
তিরিশের দশকের কোনও এক সময় (সম্ভবত ১৯৩৬-এ) মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ছিল এক হতভাগ্য তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ। তার জন্য প্রস্তুত ছিল গ্যাস চেম্বার। নিখুঁতভাবে সারা হয়ে গিয়েছিল পদ্ধতিগত যাবতীয় খুঁটিনাটি। তরুণটিকে মৃত্যু বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। খুব সাধারণ একটি ট্রিক। এক দীর্ঘ প্রশ্বাসে যতটা সম্ভব বেশি মারণগ্যাস বুকের মধ্যে টেনে নাও। মৃত্যু হবে দ্রুত ও নির্ঝঞ্ঝাট। সদ্যযুবক তরুণটিকে চেম্বারে ঢুকিয়ে চেয়ারের সঙ্গে চেন দিয়ে বাঁধা হয়ে গিয়েছিল।
চেম্বারের মধ্যে তখন ছিল অসহ্য নিস্তব্ধতা। বৈজ্ঞানিকরা কান পেতে ছিলেন ইয়ারফোনে। চেয়ারের তলায় রাখা ছিল হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের পাত্র। প্রোটোকল মেনে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত লিভারের মাধ্যমে চেয়ারের সিটের গায়ে লাগানো কন্টেনার খুলে গেল। ইয়ারফোনে ভেসে এল পটাশিয়াম সায়ানাইড পেলেটগুলির অ্যাসিডের পাত্রে পতনের হাল্কা শব্দ… একটু প্রাণান্ত ছটফটানি আর তারপর ছিটকে আসা তিনটে জড়ানো শব্দের আর্তনাদ— সেভ মি জো লুই। সেভ মি জো লুই। সেভ মি জো লুই। তারপর সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা। না, গভীর প্রশ্বাসের কোনও আওয়াজ পাওয়া যায়নি। সাদাটে ধূসর হাইড্রোসায়ানাইড অ্যাসিডের ধোঁয়ায় চেম্বার ভরে যাচ্ছিল। রাষ্ট্র তো জানত তাতে কোনও শব্দ হয় না। ফলে শব্দহীন ইয়ারফোনের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল।[1]
ওই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণটির থেকে কত দূরে আছি আমরা? কত দূরে ছিল আখলাক, মনীষা? কতদূরে ছিলেন স্ট্যান স্বামী? কতদূরেই বা আছে উমর খলিদ? রাষ্ট্র কেন গ্যাস চেম্বার তৈরি করে? রাষ্ট্র কি কখনও নিজেই গ্যাস চেম্বার হয়ে ওঠে? গ্যাস চেম্বারে যদি বা না আমাদের শরীরটা ঢুকে থাকে, চেতনা কি ঢুকে যায়নি? মৃত্যু বিশেষজ্ঞরা কি আমাদের চেতনার কানে কানে বলে দিয়ে যায়নি— প্রশ্বাস গভীর করো… ভেতরে টেনে নাও মারণ গ্যাস?
কেউ পরামর্শ মেনে নিচ্ছি। কেউ এক অসহ্য পঙ্গুত্ব নিয়ে রাষ্ট্র ও পুঁজির ফ্যাসিস্ট গ্যাস চেম্বারে দম বন্ধ করে আপ্রাণ চেষ্টা করছি নিজেদের চেতনার শেষ নিঃশ্বাসটিকে প্রাণপণে আটকে রাখবার। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে চাইছি একটা মহম্মদ আলি; প্রবলভাবে চাইছি একটা জো লুই। মাথার ওপরে নীল আকাশ ঢেকে আসছে হাইড্রোসায়ানাইড অ্যাসিডের প্রবল কুয়াশায়। তাই একটা কৃষক আন্দোলন, একটা কুস্তিগিরদের আন্দোলন থেকে শুষে নিতে চাইছি একটুখানি সপ্রাণ বাঁচার আশ্বাস। খানিকটা অক্সিজেন। গ্যাস চেম্বারে বাঁধা পড়েও এখনও বাঁচতে ইচ্ছে করে, যখন দেখি ওদের মুখ। বিনেশ, সাক্ষী, বজরং…। বুঝতে পারি এখনও জ্ঞান হারায়নি আমাদের সবটা… এখনও খোলা যেতে পারে ওই ওপারের বন্ধ জানলাটা। মেরুদণ্ডহীন সরীসৃপের মতো হেন্ড্রিক হফগেনরা আজ বাজার আলো করে আছে সর্বত্র। খেলার দুনিয়াটাও তার বাইরে না। যখন শয়তানের কাছে আত্মা বন্ধক দিয়ে আছে সফল তালিকার অধিকাংশই, তখন বিনেশ, সাক্ষী— তোমরাই হয়ে উঠতে পারো আমাদের মহম্মদ আলি। আমাদের ভারতবর্ষ। তোমরা চেঁচিয়ে, চিৎকার করে বলো— আমরাই ভারতবর্ষ। জানোই তো মৃত্যুর মুহূর্তে অ্যারিচিয়নের শেষ কামড় দেওয়ার ক্ষমতাও আমাদের নেই। তবুও আমাদের সার্বিক চেতনার সমাগত মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত এক অসম্ভব বাঁচার তাড়নায় অন্তত ছটফট করে, শেষ শক্তিটুকু দিয়ে আমরা প্রাণান্ত আর্তনাদটুকু করতে পারি— সেভ আস সাক্ষী, সেভ আস বিনেশ! আমাদের বাঁচাও; ভারতবর্ষকে বাঁচাও। এই দমবন্ধ গ্যাস চেম্বারে একটু বাঁচার অক্সিজেন দাও।
*বারবার ব্যবহৃত হয়েছে মায়া অ্যাঞ্জেলুর অসামান্য Still I Rise কবিতাটি।
[1] এর তিরিশ বছর পর মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তাঁর ‘হোয়াই উই কান্ট ওয়েট’ বইতে এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছিলেন।