শুভ্র মৈত্র
মালদা-মুর্শিদাবাদ দুই জেলাতেই শাসক দল ভোটে জেতার ব্যাপারে কনফিডেন্ট। সবটাই হাওয়ায় নয়। প্রথম কারণ অবশ্যই মহিলা ভোটারদের মধ্যে— হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে— মমতা ব্যানার্জির এখনও প্রায় অটুট জনপ্রিয়তা। আর একটা বড় কারণ জনসংযোগ। এছাড়া ‘জিতলেও তো তৃণমূলেই’— বিপক্ষ সম্পর্কে এমন অনায়াস বিশেষণও আছে যার দায় এড়াতে পারে না বিরোধীরা। আর সবার ওপরে আছে পুলিশ-প্রশাসন
লোকসভা বা বিধানসভা ভোটের সাথে পঞ্চায়েত ভোটের মূলগত পার্থক্যটা কারও অজানা নয়। এখানে প্রার্থীকে অনেক কাছ থেকে দেখা যায়, মুখের ভাঁজ, কপালের তিল, জামার কলারে কালো দাগ—–সব চোখে পড়ে। তার খানিক সুবিধা যেমন আছে অসুবিধা আছে আরও বেশী। ‘কাছের মানুষ কাজের মানুষ’ যতই গালভারী স্লোগান হোক, কে না জানে প্রার্থী খানিক ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকতে চান, এমনকি ভোট বাজারেও। হাত মেলাতে পারেন বা শিশুকে কোলেও তুলে নিতে পারেন, কিন্তু তা নিজের মর্জিমাফিক। পঞ্চায়েত ভোটে তেমন আড়ালের সুযোগ কম। এখানে বানিয়ে বানিয়ে গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ নেই। বস্তুত মাইকের ব্যবহারই বা কোথায়? পায়ে হেঁটে এখানে সরাসরি সংযোগ, গায়ের গন্ধ পেতে হয় ভোটারের।
কেমন সে গন্ধ? নিশ্চয়ই ডুয়ার্স থেকে সুন্দরবন, অযোধ্যা পাহাড় থেকে কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত একইরকম বিভঙ্গে সাজানো থাকে না সে প্রসাধন। ভাষা-সংস্কৃতি-আবহাওয়া-অভ্যাস বারবার জানান দিয়েছে সে বৈচিত্র্যের কথা। (শাসক তার সুবিধের জন্য যতই এক সূত্রে গাঁথার চেষ্টা করুক না কেন, সর্বগ্রাসী সিপিএম বা অধুনা তৃণমূলকে এই বিভিন্নতাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার মাশুল গুনতে হয় বারবার!)
উত্তর ও দক্ষিণের মোটা দাগে ভাগ করার প্রক্রিয়ায় মধ্যবঙ্গ যেমন। মালদা-মুর্শিদাবাদে এসে হোঁচট খেতে হয় পরিচিত রাজনৈতিক ডিসকোর্সগুলিকে। পরিচিত সংখ্যালঘু শব্দটাই কেমন ঘেঁটে ঘ। এখানে সংখ্যালঘু মুসলমানরাই যে সংখ্যাগুরু! তাহলে? সংখ্যালঘুর বিপন্নতা? সে তো আরও অলীক! কিন্তু সংখ্যার বিচারে ‘গুরু’ হয়েই যে মিটে যায় না সব সমস্যা তা বোঝার জন্য কোনও বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।
দীর্ঘদিন ধরে মালদা-মুর্শিদাবাদ ছিল কংগ্রেসের গড়। এমনকি বাম জমানাতেও সেই রীতির ব্যত্যয় হয়নি। এখন সেখানে ঘাসফুলের এমন প্রবল পরাক্রম খুঁজতে গেলে পেছনে হাঁটতেই হবে। বামফ্রন্ট সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য ভূমিসংস্কার, যা বছরের পর বছর ধরে ভোটের ডিভিডেন্ড দিয়ে গেছে বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা, দিনাজপুর, কোচবিহারে। তুলনায় মালদায় সেই জমি-আন্দোলন খুবই কম। আমবাগান প্রধান এই ভৌগোলিক অঞ্চলে জমির মালিক কম, সামন্তপ্রভুর প্রতি অনুগত থাকা মানুষের সংখ্যা বেশি। এই পরিস্থিতি গণি খানের মতো নেতার অবিসংবাদী হয়ে ওঠার জন্য আদর্শ। কাজেই পঞ্চায়েত বা কখনও কখনও বিধানসভাতে সিঁদ কাটলেও বামফ্রন্ট গণির ভোটে তেমন ভাগ বসাতে পারেনি। সেক্ষেত্রে যুক্তির থেকেও আবেগ কাজ করেছে অনেক বেশি, অন্তত গণির জীবনের শেষ কুড়ি বছর। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও তিনিই বৈতরণী পার করেছেন তাঁর আত্মীয়স্বজনকে। কে না জানে শিক্ষার হারে তলানিতে থাকা জেলায় মিথের শক্তি বেশি হয়, বাস্তবের থেকে।
পাশাপাশি মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস ছিল অপেক্ষাকৃত সংগঠিত। গণির পরের প্রজন্মের নেতা অধীর চৌধুরী জেলার একটা বড় অংশে বুথভিত্তিক সংগঠন গড়ে বামফ্রন্টের ওষুধেই ঘায়েল করতে চেয়েছিলেন শাসক দলকে। নিজের লোকসভা কেন্দ্র এবং তার বাইরে জেলার বড় অংশে অবিসংবাদী জনপ্রিয়তা তাঁর অর্জিত। এমনকি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে জেলায় এনে সাংসদ করাতেও অধীরের ছায়াই প্রলম্বিত হয়েছে।
এটা খুব আশ্চর্যের নয়, ক্ষমতায় আসার পর প্রথম প্রথম তৃণমূল সারা রাজ্যে সাফল্য পেলেও এই দুই জেলায় তেমন দাঁত ফোটাতে পারেনি। অবশ্য ২০১১-টা এই হিসেবে আনা উচিত নয়, তখন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ছিল তৃণমূলের। ২০১৬-র ধাক্কাটা ছিল মর্মান্তিক। কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে তৃণমূল দুই জেলাতেই প্রায় নিশ্চিহ্ন। কিন্তু সেই ভোটের পরেই শুরু হয় শাসকের দখল প্রক্রিয়া। ‘উন্নয়নে’ সামিল হতে একের পর পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ এমনকি বিধায়ক দখল প্রক্রিয়া শুরু হল এই মধ্যবঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রীর এই একতরফা দখলযজ্ঞে সেদিন এই দুই জেলায় প্রধান সৈনিক ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। আর সেই স্রোতেই এল ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোট। শাসকের দ্বিমুখী অস্ত্র— প্রসাদ ও শাস্তির সামনে খড়কুটোর মতো উড়ে গেল বিরোধী কংগ্রেসের যাবতীয় প্রতিরোধ। পঞ্চায়েতে পরাজয় তো ঘটলই সঙ্গে সঙ্গে বিধায়করাও দল ছেড়ে ‘উন্নয়নে’ সামিল হলেন প্রায় সবাই।
পঞ্চায়েতের এই একচেটিয়া দখলদারি যে এমনকি পঞ্চায়েতের প্রসাদ পাওয়া মানুষও ভাল মনে নেয়নি তা বোঝা গেল ২০১৯-এর লোকসভা ভোটেই। আপ্রাণ চেষ্টাতেও হারানো গেল না অধীর চৌধুরীকে, মালদায় খাতাই খুলতে পারল না তৃণমূল।
কিন্তু লোকসভা ভোট আর বিধানসভা এক নয়। ইতিমধ্যেই প্রায় আশীর্বাদের মতো এনআরসি-র ঢাকে কাঠি পড়েছে। বিপুল সংখ্যক মুসলমান-মনে ভয় ঢোকানো গেছে কেন্দ্রের শাসক দলের পক্ষ থেকে। এ সুযোগে তাদের বরাভয় দেওয়ার জন্য উপযুক্ত তারাই যাদের হাতে প্রশাসন-পুলিশ আছে। ফলে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট খানিক মাঠের বাইরে থেকেই দেখল তৃণমূল-বিজেপির ডুয়েল। আর উজাড় করে মালদা-মুর্শিদাবাদ ভোট দিল রাজ্যের শাসক দলকে। ২০১১ আর ২০১৬-র অতৃপ্তি সুদে আসলে মিটিয়ে নিল শাসক দল। মুখ্যমন্ত্রীর আমের সঙ্গে আমসত্ব খাওয়ার সাধ মিটল।
আবার একটা পঞ্চায়েত ভোট এল। এখানে বলে রাখা যাক, গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে শাসক দলের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির ছবি শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে যত আলোড়িত করেছে, গ্রামবাংলায় তেমনটা করেনি। এমনকি পঞ্চায়েতে দুর্নীতির ছবি দেখেও তেমন বিচলিত নয় গ্রামের মানুষ। সে এখন মেনে নিয়েছে, নেতারা তো খাবেই, আমি পাচ্ছি কিনা।
হ্যাঁ, চিরাচরিতভাবে পঞ্চায়েত ভোট হয় মূলত দুটি ইস্যুতেই হয়। এক, বিভিন্ন সুযোগসুবিধা যা পঞ্চায়েত থেকে দেওয়া হয়, আর দুই, নিরাপত্তাবোধ। অর্থাৎ, আমাকে পুলিশে ধরলে কে ছাড়াবে? সেক্ষেত্রে পঞ্চায়েতে স্বাভাবিকভাবেই অ্যাডভান্টেজ শাসক দল।
তাহলে কি ২০২৩-এর পঞ্চায়েত ভোটেও সেই ধারাই থাকবে? মুর্শিদাবাদের ৭৮টি জেলা পরিষদ আসন আর মালদার ৪২টি আসন কি শাসক দলের কাছে নিছক কেকওয়াক? কিন্তু বিষয়টি বুঝি সহজ পাটিগণিত নয়।
চুরি এবং স্বজনপোষনের ধারাবাহিক কুৎসিত প্রদর্শনী হয়তো গ্রামবাংলাকে তেমন আলোড়িত করতে পারেনি, কিন্তু পঞ্চায়েতগুলিতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য প্রকল্পের বিপুল অর্থের সঞ্চালনা সমীকরণটা অনেক ক্ষেত্রেই জটিল করে তুলেছে। ‘উন্নয়ন করতে চাওয়া’র উচ্চাশা জারিত হয়েছে একাধিক মানুষের মনে। অবশ্যম্ভাবী ফল শাসক দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা যাক, আই-প্যাক বা রাজ্য নেতৃত্ব শত চেষ্টা করেও এই দুই জেলার কোথাও তৃণমূল কংগ্রেসকে একটি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের পরে দেখা গেল নির্বাচিত শাসক দলের বিধায়ক-নেতারা অধিকাংশই প্রাক্তন কংগ্রেস বা বাম নেতা। পুরনো তৃণমূলকর্মীরা দুই জেলাতেই কোণঠাসা। এখানে বিভিন্ন নেতার আলাদা গোষ্ঠী, বিরোধী দলের চেয়ে যাদের বেশি লড়াই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সঙ্গে। রাজ্য নেতৃত্ব নিজেও তা জানে আর মদত দিয়ে যায় এই দ্বন্দ্বে। জেলায় কান পাতলেই শোনা যায় ‘কত টাকার বিনিময়ে ভোটের টিকিট বিক্রি হয়েছে’ বা ‘কত টাকার বিনিময়ে পঞ্চায়েত বা পুরসভায় প্রধান পদ পাওয়া গেছে’। ফলে বঞ্চিতদের মধ্যে ক্ষোভ থাকছে, এবং ভোটবাজারে তাদের কেউ নির্দল বা জোটপ্রার্থী। আশা, জয়ের পরেই ভিড়ে যাবে শাসকের সঙ্গে। প্রথম কারণ যদি হয় অর্থের ভাগ (উন্নয়নের জন্য ব্যকুলতা!), অপর কারণটি অবশ্যই বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা জিতে গেলে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা।
এখন এনআরসি জুজু অনেকটাই কেটেছে, আর বিরোধী আসনে থাকার স্বাভাবিক অ্যাডভান্টেজ নিয়ে কংগ্রেস প্রায় অজাতশত্রু। এতদিনের কংগ্রেস সমর্থকদের মনে ফেলে আসা ঘরের প্রতি টান তো থাকেই। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের সমর্থনের ধারাই হল ক্ষমতাধর থেকে ক্ষমতাহীনের দিকে যাওয়া (নেতাদের ঠিক বিপরীত)। এসবের যৌথ ফলেই বুঝি সাগরদীঘি উপনির্বাচনের ফলে অন্যরকম আভাস। সাগরদীঘিতে পরাজয়, নাকি বিজয়ী কংগ্রেসি প্রার্থীকে নিজেদের দলে নিয়ে নেওয়া— কোনটা শাসক দলের কাছে বেশি ভারী হবে তা সময় বলবে। কারণ, মুর্শিদাবাদ হোক বা মালদা— অশিক্ষিত, ধুলোবালিতে মিশে থাকা মানুষের কাছে ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’ বা ‘রামধনু জোট’-এর চেয়েও ‘গদ্দার’ অনেক পরিচিত, অনেক ঘৃণিত শব্দ।
এত বিপরীত সমীকরণের পরেও এই দুই জেলাতেই শাসক দল ভোটে জেতার ব্যাপারে কনফিডেন্ট। সবটাই হাওয়ায় নয়। প্রথম কারণ অবশ্যই মহিলা ভোটারদের মধ্যে— হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে— মমতা ব্যানার্জির এখনও প্রায় অটুট জনপ্রিয়তা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যেখানে অক্সিজেন জুগিয়েছে। আর একটা বড় কারণ জনসংযোগ। না, বিপুল অর্থ আর নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে নবজোয়ার ছাড়াও রোজকার স্বাভাবিক সংযোগ, সেখানে দল সম্পর্কে কোনও মোহ থাকে না। অর্থাৎ অনায়াসে নেতার কাছে দলের নিন্দা করা যায়। এছাড়া ‘জিতলেও তো তৃণমূলেই’— বিপক্ষ সম্পর্কে এমন অনায়াস বিশেষণও আছে যার দায় এড়াতে পারে না বিরোধীরা। সবার ওপরে আছে পুলিশ-প্রশাসন। তাদের শাসক দলের পক্ষে দাঁড়ানোর যে উদাহরণ সারা রাজ্য দেখেছে মধ্যবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। বিরোধীদের কথায় অনুব্রত মণ্ডলের মতো দু-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে সব জেলাতেই দলের ভার মূলত ন্যস্ত জেলাশাসক বা পুলিশ সুপারের ওপর। মুখ্যমন্ত্রীর ভরসা নাকি তাঁদের ওপরেই বেশি। সেটা জেলা নেতাদের এখনও লজ্জার কারণ হয়ে ওঠেনি।
দৃশ্যত উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে এই কয় বছরে। গাঁয়ের রাস্তা পাকা হয়েছে, আলো বসেছে কোনায় কোনায়। রাস্তা পাকা হওয়াতেই দাবি উঠেছে ড্রেনের। কয়দিন আগেও গ্রাম যা ভাবতে পারত না। নতুন মন্দির হয়েছে, মসজিদ হয়েছে আরও চকচকে। উপভোগ করছেন প্রার্থীরা। এদিকে অলক্ষ্যে আমের এই দুই জেলাতেই বাগান সাফ হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের ছোঁয়াতেই সেই জমিতে প্লট এখন ইন-থিং। তাছাড়া আম নিয়ে আদিখ্যেতা তো অনেক হল, আজ পর্যন্ত এই বিপুল উৎপাদন জেলার অর্থনীতির কোনও উন্নতি করতে পারল কই? তাই এই পঞ্চায়েত ভোটের পরেও রাজ্যের সবচেয়ে বেশি শ্রমিক এই দুই জেলা থেকেই আবার ভিনরাজ্যের ট্রেনে উঠবে কাজের আশায়।
*মতামত ব্যক্তিগত