শৌভিক চক্রবর্তী
বহুদিন পর নীল জার্সির দামাল এগারোটা ছেলে দুর্দমনীয় পরাক্রম বজায় রেখে খেলছে। ওই ব্রেন্ডন, ওই লিস্টন, ওই সন্দেশ, ওই গুরপ্রীত, ওই সামাদ, ওই ছাংতে— ১৮ বছরের টানা যুদ্ধে লড়ে যাওয়া ওই ক্যাপ্টেন আজও মাঠে নামলে তার হৃদয়-অলিন্দ উজাড় করে দিতে চায় তার দেশকে। এই সুনীল নিজেই এক সাগর, নিজেই এক দুঃসাহসিক অভিযান
উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিদের ধরনটাই আলাদা। ক্রমাগত নিজের স্বাভাবিক সত্তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার বিশেষ আকাঙ্খা তাড়া করে যায়। সুনীল ছেত্রি সেই বিশেষ উচ্চাভিলাষীদের একজন। যাকে আমরা আমাদের সঙ্গেই বেড়ে উঠতে দেখেছি। আমাদের সঙ্গে যখন কেসি নাগ যুদ্ধ করেছেন, সুনীল তখন জুনিয়র অ্যাকাডেমিতে অস্ত্রাগার তৈরি করছেন। আসলে, একটা সময় যখন নিজের আপন খেয়ালে অতিক্রান্ত হয় তখন আশেপাশে কী ঘটছে তার দিকে বড় একটা খেয়াল থাকে না। চিরকাল চোখের সামনে পড়ে থাকা দ্রব্যের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ যেমন জন্ম নেয় না, আমাদের মনোভাবটা সুনীল ছেত্রির প্রতি কতকটা তাই। তাকে মনে পড়ে বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে হারের গল্প লিখতে গিয়ে, আইএসএলের সময় অথবা হঠাৎ এএফসি কাপের সময়। আসলে সুনীলের প্রতি আমাদের কখনও সহমর্মিতা তৈরিই হয়নি। ভারতীয় ফুটবলের আইকন হিসেবে যে সম্মানটা সুনীলের প্রাপ্য ছিল, আমরা অর্থাৎ ভারতীয় বলে ভোটার কার্ডে যাদের নাম নথিভুক্ত রয়েছে— তারা দিনশেষে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছি, ভারতীয় ফুটবলের সলিল সমাধি দেখে।
খুব বেশি কায়দাধারী হয়ে না জন্মানো সুনীল, দৃপ্ত চিত্তে কী করে মধুর সুরের মুর্ছনার মতো হেড দেয়, আজও এর রহস্য ঠিক ভেদ হল না। এতটাই একাগ্রতা, এতটাই পারফেকশন! বৃষ্টিমুখর যুবভারতীতে বাঁ পায়ের প্লেসমেন্টেও— সুনীলের হেডের মোহ থেকে বেরিয়ে আসা যেমন খুব দুরূহ ব্যাপার তেমনই একটা ক্রস থেকে চকিতে প্লেস করে গোলে রাখা সুনীল মোহবিষ্ট করে দেয়। সব ভুলে হঠাৎ জোরে বলতে ইচ্ছে করে, আমাদের একটা সুনীল আছে।
নস্ট্যালজিক হয়ে, মনকে পিছিয়ে কয়েক যোজন দূর নিয়ে গেলে, পূর্বজরা বলেন লেখায় তার ছাপ পড়ে। সহমত হই। কারণ ভারতবর্ষের তূণীরে থাকা সুনীল ছেত্রি নামক এই বাণের, উত্থান থেকে গ্যালারিতে হাতজোড় করে দেশের ফুটবল দেখতে আসার অনুরোধের মতো বন্ধুর যাত্রাপথ— সবকিছুর সাক্ষী আমরা, এই দশকে বড় হওয়া এই ছেলেমেয়েরা। যারা বব হাউটনের কোচিংয়ে সাফ কাপ জিততে দেখেছে বাইচুংয়ের নেতৃত্বে। যারা এনপি প্রদীপ, ক্লিফোর্ড মিরান্ডা, স্টিভেন ডায়াস, সুরকুমার সিং, মহেশ গাউলি, রবিন সিংয়ের মতো খেলোয়াড়দের দেখে দেখেই বড় হওয়ার পথে সমস্ত কাঁটা সরিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছে, আজ এই এত বছর পরেও তাদের রেখে যাওয়া ধ্বজের একমাত্র রক্ষক, বাহক ও ধারকের নাম সুনীল ছেত্রি। এই বছর ১২ জুন যার দেশের হয়ে ফুটবল কেরিয়ারের ১৮তম বছর পূর্ণ হল। অথচ এখনও তার বিকল্প নেই, এতগুলো বছর পেরিয়েও সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ৫ ম্যাচে ৫ গোল! সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়।
বহুদিন পর নীল জার্সির দামাল এগারোটা ছেলে দুর্দমনীয় পরাক্রম বজায় রেখে খেলছে। ওই ব্রেন্ডন, ওই লিস্টন, ওই সন্দেশ, ওই গুরপ্রীত, ওই সামাদ, ওই ছাংতে— ১৮ বছরের টানা যুদ্ধে লড়ে যাওয়া ওই ক্যাপ্টেন আজও মাঠে নামলে তার হৃদয়-অলিন্দ উজাড় করে দিতে চায় তার দেশকে। ওই পজিশনিং, ওই কন্ট্রোল, বক্সের ভিতর নিজেকে আনমার্ক করার এক অবিশ্বাস্য প্রবণতা, লব পাসে ফার্স্ট টাচ— সুনীলকে একটি শব্দে ব্যাখ্যা করার মতো শব্দ ভারতবর্ষের ভাণ্ডারে রিক্ত। আজ ভাবতে অবাক লাগে, এই সুনীল মোহনবাগানের জার্সি গায়ে পেনাল্টি মিস করেছিল। আবার এই সুনীল ইস্টবেঙ্গল জার্সিতে কত সাবলীল গোলের নাম। এই সুনীল নিজেই এক সাগর, নিজেই এক দুঃসাহসিক অভিযান।
সুনীল যখন হেডে গোল করছে, বা করে বলা উচিত কারণ এটা তার একপ্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে— তখন দেখতে হয় তার বডি পজিশন। মাথার সঙ্গে বুকের তফাতের ডিগ্রি, কোণ। বল যখন প্রায় মাথার কাছাকাছি অর্থাৎ স্কোরিং পজিশন, এমতাবস্থায়, বলের দিকে চোখ না সরিয়ে লাফিয়ে বডি পজিশনকে ৯০ ডিগ্রিতে কনভার্ট করা। এটা বিশ্বে একজনই প্রায় নিখুঁত করেন, যার নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। কিন্তু তাহলে সুনীল কেন? কারণ, সুনীলের হাইট রোনাল্ডোর তুলনায় কম, প্রায় মেসির সমানই বলা যায়। এই কম দৈর্ঘ্য নিয়ে একের পর এক গোল, বিধিলিখন বললে এই শিল্পকলার অপমান হয়।
বাইচুংয়ের পর সুনীল। মাঝে রবিন সিং প্রদীপের ন্যায় আলো ছড়ালেও তা বেশি সময়ে কার্যকর হয়নি। সুনীলের পর? অনেক ট্যালেন্ট, অনেক নাম, অনেক আশার প্রদীপ। কিন্তু আর একটা সুনীল হবে কি? যে প্রখর সূর্যের তাপের কাছে, পাগল ঝড়ের চোখের কাছে, বৃষ্টিভেজা মাঠের কাছে নিজেকে নুইয়ে দিতে শেখেনি। ভারতের হয়ে ৯৩ গোল করে যে নিজেকে ছাপিয়ে চলেছে উত্তরোত্তর। মাঠের প্রতিটা ঘাসে লিখে চলেছে গল্পগুলো। প্রতিটা ঘামের বিন্দুকে সাক্ষী রাখছে অদম্য জেদের, মানসিকতার। এহেন যোদ্ধা আর কবে পাবে ভারত?
ঠিক এখানেই সুনীল চমকে দিয়েছে আমাদের। যার প্রকৃতার্থে তেমন কিছু যায় আসে না, প্রাপ্য সম্মান-টম্মান নিয়ে ততটা ভাবান্বিতও সে নয়। সে শুধু গোল চেনে। বাড়ানো লব পাসগুলো থেকে গোলের লক্ষ্যে মাথা ছোঁয়ানোর একটা সুযোগ খোঁজে। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে তো বটেই, ভারতীয় দলেও যখন শুরু থেকে খেলেছে তখন থেকেই সুযোগসন্ধানী। কিছু ক্ষেত্রে বাইচুংয়ের থেকেও বেশি। সুনীল তার গোটা কেরিয়ারে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দাবি করতে পারে তার নাছোড়বান্দা মনোভাবের কারণে। ভারত কোয়ালিফায়ারের গণ্ডি বহুবছর পার করেনি, বারবার হেরে যায় আর রম্যরচনায় ভরে যায় মুখপুস্তকের দেওয়াল, তবু সুনীল স্বপ্ন দেখে। আসলে, উচ্চাভিলাষীরা কখনও স্বপ্ন দেখা ছাড়ে না। ওতেই বাঁচা, ওতেই দিন যাপন করা। পৃথিবীতে এসে একখানি দাগ রেখে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা বড় কঠিন। সুনীল সেই স্বপ্ন দেখে, সার্থকও করে। সেই সার্থকতার ছাপ থেকে যায় ক্রমবর্ধমান গোলসংখ্যায়।
সুনীলের সঙ্গে স্বপ্ন দেখি আমরাও। যেমন করে চাতকের ঠোঁটে কখনও এসে পড়ে জলের বিন্দু, সেইভাবে আমরাও স্বপ্ন দেখি। একটা একটা করে সেইসব অধরা স্বপ্ন সুনীল পূরণ করে চলেছেন। এএফসি কাপে যোগ্যতা, সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন চ্যাম্পিয়নশিপ জয়— একদিন বিশ্বকাপের আসরে তেরঙ্গা উড়বে। আমরা আসলে স্বপ্নপিপাসু। ভারতবর্ষের মতো ব্যক্তিপুজোর দেশে বহু হারিয়ে যাওয়া তারার মতো সুনীলও হারিয়ে যেতে পারত। যেমন দেশের হয়ে ভাল পারফর্ম করা দীপক মণ্ডল, সন্দীপ নন্দীরা হারিয়ে গেছে। সুনীল এখানেই অনন্য, ভুল দেশে ভুল সময়ে জন্মে যাওয়া এক জিনিয়াস। গোল করতে যেমন তার ভুল হয় না, তেমনই পজিশনিংয়ে সেরা, কখনও নিচে নেমে ডিফেন্সের সাহায্যেও তাকে দেখা গেছে। টিমম্যান হিসেবে এখানেই সুনীল এতটা প্রাসঙ্গিক, যে টিমগেম শব্দটা ভারতে এগজিস্টই করে না। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্স— এর পরের কথা ভবিষ্যত লিখবে তার পাণ্ডুলিপিতে।
হি ইজ দ্য ক্যাপ্টেন, বর্ন ক্যাপ্টেন। সুনীল আসলে সাগরের ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা দীপ্যমান সূর্য। যাকে কখনও ডুবতে দেবে না একখণ্ড ভারতবর্ষ।