ত্র্যহস্পর্শেই প্রহসন, তবু চিন্তায় থাকবে তৃণমূল-বিজেপি

শঙ্কর সান্যাল

 


সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের বেশ কয়েকটি বিশেষত্ব চোখে পড়েছে, যা বস্তুতপক্ষে এ রাজ্যে অভূতপূর্ব। প্রথমত রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, দ্বিতীয়ত রাজ্যপালের ভূমিকা, তৃতীয়ত রাজ্য প্রশাসন এবং পুলিশের ভূমিকা এবং চতুর্থত রাজ্যের গ্রামীণ জনগণের ভূমিকা। এই প্রতিটি পক্ষের ভূমিকাকে ঘিরেই ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়ত নির্বাচনের যাবতীয় ঘটনাবলি আবর্তিত হয়েছে। এখানে ইচ্ছা করেই রাজ্যের শাসকদলের ভূমিকা উল্লেখ করা হল না। কেননা তা পুনরুক্তি হবে এবং তাদের একই ভূমিকা ২০১৩ এবং ২০১৮ সালেও লক্ষ করা গিয়েছে

 

এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না।

প্রত্যাশিতই ছিল। পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে আক্ষরিক অর্থেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল তৃণমূল। কিন্তু নজিরবিহীন নির্দেশে কলকাতা হাইকোর্ট বলেছে, এখনই কোনও প্রার্থীকে জয়ী বলে ঘোষণা করা যাবে না। সেই মোতাবেক রাজ্য নির্বাচন কমিশনও বিজ্ঞপ্তি জারি করে দিয়েছে। অর্থাৎ যে বিপুল কৃৎকৌশল অবলম্বন করে তৃণমূল গ্রামবাংলার দখলদারি পেয়েছে, তা আপাতত বিশাল প্রশ্নচিহ্নের মুখে।

বাংলার রাজনীতি সম্পর্কে নিতান্তই অজ্ঞ কোনও ব্যক্তিও জানতেন তৃণমূলই পঞ্চায়ত নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়েই আসবে। কয়লার কালি, গরুর আর্তনাদ, চাকরিপ্রার্থীদের অসহায় পথজীবন, মহার্ঘ্যভাতার দাবিতে সরকারি কর্মীদের সোচ্চার লড়াই, চুরির অভিযোগে জেলবন্দি নেতা-যুবনেতা-মন্ত্রী-বিধায়ক-উপাচার্য-আমলা, আবাসের উবে যাওয়া স্বপ্ন, একশোদিনের কাজের মজুরি মাদারির খেলায় বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া, পাথর খাদান আর বালিঘাট থেকে ত্রাণের ত্রিপল থেকে মিড ডে মিলের চাল— এক আশ্চর্য বাণিজ্যময় রাজনীতি, চৌর্যবৃত্তির এমন নিরুপম প্রাতিষ্ঠানিকতা উপহার দেওয়া তৃণমূল যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুলভাবেই ফিরে আসবে, এ নিয়ে কারও কোনও দ্বিমত ছিল না। কেননা ওরা বীর/ওরা আকাশে জাগায় ঝড়/ওদের কাহিনি মানুষের খুনে/গুলি-বন্দুক-বোমার আগুনে/ভারি রোমাঞ্চকর। নির্বাচনপর্বে গ্রামবাংলা যেন যুদ্ধদীর্ণ বধ্যভূমি। ঝরে গিয়েছে অর্ধশত প্রাণ। এই মৃত্যুমিছিল যে শেষ হয়ে গেল এমন কথা বলা নিতান্তই মূর্খামি। আরও কত রক্তস্নান? যাঁরা চলে গেলেন, তাঁরা কেউ কখনও ল্যাম্বারঘিনি কিংবা মার্সিডিজ চড়েননি। তাঁরা কখনও আমাশয় নিরাময় করতে ইওরোপে উড়ে যাননি। খাওয়ার ঘর থেকে শোওয়ার ঘরে যেতে চলমান সিঁড়িতে পা রাখেননি। এঁদের মধ্যে কে কোন দলের রাজনীতি করতেন, সেটা তাঁদের পরিচয় নয়। তাঁদের একমাত্র পরিচয় তাঁরা প্রত্যেকেই নুন আনতে পান্তা ফুরনো ফাটা লুঙ্গি পরা ফুটো চালের বাসিন্দা। মায়ের কোল খালি করে মাটিতে অর্ধশত মানুষের রক্তস্নাত চিরশয়ান। বেশিরভাগই সংখ্যালঘু, স্বল্পসংখ্যক নিম্নবর্ণের হিন্দু।

ইথিওপিয়ার স্বৈরশাসক ইদি আমিন নাকি নরমাংস খেতেন। কত কী যে খায় লোকে নাহি তার কিনারা। কিন্তু তাই বলে গোটাকয়েক ব্যালটপেপার খেয়ে ফেলা! আমরা মহাদেব মাটি নামের তৃণমূল প্রার্থীকে সেটাও খেতে দেখলাম। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ছাপমারা ব্যালট কোঁৎ করে গিলে ফেলে না-মুমকিন জিতকে মুমকিন করে ফেলার ভেলকি একমাত্র তৃণমূলই জানে। এহেন মাটিমশাই পঞ্চায়েতে ঢুকে আরও কত কী যে খেয়ে ফেলবেন, তা কে জানে! কেবল মাটিমশাই-ই নন, আরও যাঁরা গুলি, হুমকি, বোমার আগুন জনগণকে এতদিন ধরে খাইয়েছেন, তাঁরাও এবার আবাসের বাড়ি, গোটা গোটা প্রকল্প, একশোদিনের জবকার্ড চিবিয়ে খাবেন। তবে ব্যালট খেয়েও শেষরক্ষা করতে পারেননি অশোকনগরের মহাদেব মাটি। আবার ভোট হবে ওই বুথে। নিদান কমিশনের। আসলে সবটাই ব্যবসা। এই বাংলায় রাজনীতিকে গত একদশকে ব্যবসায় বদলে দিয়েছে তৃণমূল। ভৌত নয়, গোটাটাই রাসায়নিক বদল। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন বদলা নয়, বদল চাই। সেই বদলটা যে ঠিক কী তা বুঝতে বাঙালির দশক কাবার।

সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের বেশ কয়েকটি বিশেষত্ব চোখে পড়েছে, যা বস্তুতপক্ষে এ রাজ্যে অভূতপূর্ব। প্রথমত রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, দ্বিতীয়ত রাজ্যপালের ভূমিকা, তৃতীয়ত রাজ্য প্রশাসন এবং পুলিশের ভূমিকা এবং চতুর্থত রাজ্যের গ্রামীণ জনগণের ভূমিকা। এই প্রতিটি পক্ষের ভূমিকাকে ঘিরেই ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়ত নির্বাচনের যাবতীয় ঘটনাবলি আবর্তিত হয়েছে। এখানে ইচ্ছা করেই রাজ্যের শাসকদলের ভূমিকা উল্লেখ করা হল না। কেননা তা পুনরুক্তি হবে এবং তাদের একই ভূমিকা ২০১৩ এবং ২০১৮ সালেও লক্ষ করা গিয়েছে। অর্থাৎ ভোটে জেতার জন্য বল্গাহীন সন্ত্রাস এবং শাসক হওয়ার সুবাদে পুলিশ এবং প্রশাসনকে রাজনৈতিকভাবে যথেচ্ছ ব্যবহার।

পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগেই পূর্বতন নির্বাচন কমিশনারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। পঞ্চায়েত ভোটের সময় হয়ে গেলেও অভিভাবকহীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ভোট পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না। আইন অনুযায়ী রাজ্যপাল নিয়োগ করন নির্বাচন কমিশনার। এই নিয়োগপর্বে রাজভবন বনাম নবান্ন একটা সংঘাত-সংঘাত নাটক অনুষ্ঠিত হয়। জনগণ বেশ উপভোগও করেন। এরপরেই রাজ্যের পাঠানো তিন প্রাক্তন আইএএস অফিসারের নামের তালিকা থেকে রাজ্যপাল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব রাজীব সিনহাকে বেছে নেন। বেছে তো নিলেন, কিন্তু ব্যক্তিটির ইতিহাস-ভূগোল কি তার আগে নেড়েচেড়ে দেখলেন? হয় দেখেননি, নয় দেখে শুনে জেনে বুঝে নিয়োগ করেছেন, খেলা জমিয়ে দেওয়ার জন্য। দ্বিতীয়টাই সম্ভবত ঠিক। রাজীব সিনহা তৈরিই ছিলেন। দায়িত্ব নিয়েই একঘণ্টা কালও বিলম্ব না করে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে দিলেন। এই নির্বাচনের যারা কুশীলব, সেই রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে একবারও আলোচনা করলেন না। নির্ঘণ্ট ঘোষণার আগে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকা যে একটি চালু প্রথা, এটি রাজীব সিনহা জানতেন তো? নাকি তাঁর মনিবানির মতোই এসবের ধার ধারেন না! এর পরে শুরু হল কেন্দ্রীয় বাহিনি নিয়ে নাটক। আলোচনা এবং পর্যালোচনায় ক্লিশে হয়ে বিষয়টি নিয়ে আর কোনও অবতারণা অপ্রয়োজনীয়। রাজীব সিনহা নামক ব্যক্তিটির মেরুদণ্ডের তারল্য নিয়ে বঙ্গবাসীর অন্তত কোনও সংশয় নেই। না হলে তিনি ধুলো ঝাড়ার মতো সকল দায় ঝেড়ে ফেলে কী করে বলতে পারলেন যে কে কখন গুলি চালাবে কে বলতে পারে! আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে নাকি নির্বাচন কমিশনের দায় নেই। দায়টা জেলা প্রশাসনের। অথচ নির্বাচনপর্বে প্রশাসনের কর্তৃত্ব থাকে কমিশনের হাতেই। মাঝেমাঝে ন্যাকা হয়ে যাওয়াটা রাজীব সিনহার মুদ্রাদোষ কিনা আমরা জানি না।

কেরলের বিখ্যাত কথাকলি নৃত্যের পরতে পরতে নাটকের গভীর উদ্ভাস। মুখোশের আড়ালে থাকে নর্তকের মুখ। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও কেরলবাসী। গোটা নির্বাচনপর্ব এবং তৎপরেও কী অপরূপ নাট্যময় নৃত্যশৈলী তিনি বাঙালিকে উপহার দিয়ে চলেছেন! তাঁর এই নৃত্যকল্পের নাট্যরূপ যে নাগপুরিয়া ঘরানার এবং দিল্লির শাহী দরবারজাত তা এক অকথিত সত্য। কর্মজীবনে দুঁদে আমলা সিভি আনন্দ বোস মাঝেমাঝেই বাঙালিকে রবীন্দ্রনাথ এবং শেকসপিয়র পড়াচ্ছেন। কিন্তু আইনে যে রয়েছে একবার কোনও ব্যক্তিকে নির্বাচন কমিশনারের মতো সাংবিধানিক পদে নিয়োগ করলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া বিস্তর ঝক্কির কাজ, এটা কি তিনি জানতেন না? তাঁর মতো দুঁদে আমলার এটা জানার কথা। অথচ নিয়োগপত্র রাজভবন থেকে নবান্নে ফেরত পাঠানোর নাটকটা তিনি করলেন কেন? ‘লার্জার দ্যান পলিটিক্স’ হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা। রাজ্যপাল বলছেন তিনি গ্রাউন্ড জিরো রাজ্যপাল। গ্রাউন্ড জিরোতে যাচ্ছেন, কিন্তু বাক্যবিন্যাস ছাড়া করছেন কী? ঠোঙা ভরা বাদামভাজা খাচ্ছেন কিন্তু গিলছেন না। আসলে সংবিধান তো ওঁকে গেলার ক্ষমতা দেয়নি। শাহী দরবারকৃত নাগপুরিয়া ঘরানার নাট্যরূপে তো এর বেশি কিছু লেখাও নেই! নাটক এখনও বাকি। শেষ দৃশ্যে অবশ্যই পর্বত মুষিক প্রসব করতে চলেছে— ঘোড়ার মুখের খবর।

আমলাতন্ত্র সুবিধাভোগী এবং দর্পিত সুবিধাবাদী হয়, এটা ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু তারা যে এহেন ক্লীব, মেরুদণ্ডহীন, অসত্যচারী ও ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করতে পারে, এটা এই বাংলায় অন্তত অদৃষ্টপূর্ব ছিল। নির্বাচনপর্বে বঙ্গীয় আমলাতন্ত্রের ওয়ান পয়েন্ট এজেন্ডা ছিল তৃণমূলকে জয়ী করতে হবে। তাই তাঁদের কর্মকাণ্ডের দৃশ্যমানতা এই পর্বে প্রতিদিননই প্রবলতর হয়েছে। গণনাপর্বে তা একেবারে বিস্ফোরণের চেহারা নিয়েছে। যার অভিঘাতে অসংখ্য বিরোধী প্রার্থী জনগণের ভোটে জিতেও বিজয়ীর শংসাপত্র পাননি। তৃণমূলের হেরো প্রার্থীর হাতে বিজয়ীর শংসাপত্র তুলে দিয়েছেন বিডিও। মক্কা থেকে মনোনয়ন দাখিল, এমনটাও দেখতে হল। মনোনয়নপত্রে কারচুপি করে বাতিলের অভিযোগে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। পরে বিভাগীয় এবং এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির তত্ত্বাবধানে রাজ্য পুলিশের তদন্তের নির্দেশ দেয় ডিভিশন বেঞ্চ। গোটা বঙ্গীয় আমলাতন্ত্র কেন রে রে করে তৃণমূলকে জেতাতে ময়দানে নেমে পড়ল, তার একটি বিস্তারিত পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ থাকলেও আমলাতন্ত্রকে এই নির্লজ্জ চেহারা নিয়ে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। কারণ তখন তৃণমূলের কবজির জোর ছিল। চড়াম চড়াম ঢাক ঢ়াজিয়ে আর গুড় বাতাসা বিলি করেই ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে নিয়েছিল। বাকিটা তো বাঁয়ে হাত কা খেল। ২০২৩ সালে নবজোয়ার যাত্রা করতে গিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পারলেন কবজির জোর আর নেই। ফাঁকা হয়ে গিয়েছে নিচের তলা। অতঃপর প্ল্যান বি ছাড়া উপায় কী! বশংবদ আমলাতন্ত্র এঢ়ং পুলিশ দিয়েই কাজ হাসিল। যারা তৃণমূলের হয়ে বোমা-গুলি বর্ষণ করছে, তারা কেউই দলীয় কর্মী নয়। হয় চৌর্যবৃত্তির বেনিফিশিয়ারি, নয় তো মার্সিনারি— ভাড়াটে গুণ্ডা।

চতুর্থত এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে যেটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তা হল মানুষের প্রতিরোধ। প্রায় একযুগের পুঞ্জীভূত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করা গেল। গ্রামে-গ্রামান্তরে যাবতীয় বঞ্চনা, অপমান, শোষণ, আক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষ পথে নেমেছে। যদিও ভোটের ফলাফলে তা ধরা পড়েনি, বরং বলা ভাল ধরা পড়তে দোওয়াই হয়নি। মূলত বাংলার সংখ্যালঘু জনসংখ্যা, যাঁরা এতদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁদের ‘মসিহা’ বলে ভাবতেন, উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁদের মোহভঙ্গ হয়েছে। রিগিং তথা ছাপ্পাভোটের প্রতিরোধ করতে গত একযুগে মানুষকে এভাবে পথে নামতে দেখা যায়নি। প্রতিরোধ যে সব জায়গায় সরব এবং উচ্চকিত হয়েছে, তেমনটা নয়, নীরব প্রতিরোধও হয়েছে ভোটবাক্সে। কিন্তু গণনার দিনে বাহুবল এবং পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে জনরায়কে বদলে দেওয়া হয়েছে। ব্যালট উড়ছে বাতাসে, ব্যালট ভাসছে নর্দমায়, ব্যালট রোদ পোহাচ্ছে খোলা মাঠে। প্রতিটি ব্যালটেই বিরোধী প্রার্থীদের প্রতীকের পাশে ছাপ। ভোটগণনার নামে এমনতর প্রহসন দেখে কেবল আমবাঙালিই নয়, বিস্মিত বিচারব্যবস্থাও। তবে এই নির্বাচনের সারাংশ হিসাবে এটা বলা যায় যে তৃণমূলের বিপুল বিজয় আদৌ কোনও জনরায়ের প্রতিফলন নয় এবং বোতলের ছিপি খুলে গিয়েছে, বোতলবন্দি দৈত্য এবায় রাস্তায়। তাকে ফের বোতলবন্দি করা শাসকদলের পক্ষে আক্ষরিকভাবেই অসম্ভব।

এই পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশন যে সমস্ত তথ্য এবং পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তা নিয়ে আলোচনা এবং পর্যালোচনা করা বস্তুতই নিরর্থক। কেননা এই ফলাফলে বঙ্গীয় জনমানসের কোনও প্রতিফলন নেই। এই তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কোনও সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াও অসম্ভব। তবু আলোচনা করতেই হয়। তৃণমূল গত বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পেয়েছিল প্রায় ৪৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল ভোট পেয়েছে ৫২ শতাংশ। এই চার শতাংশ ভোট বৃদ্ধির পিছনে কোনও বাস্তব কারণ নেই। গত বছর খানেকের মধ্যে “তৃণমূল মানেই চোর”— এই গণ-পারসেপশন গড়ে ওঠা ছাড়া এমন আর কোনও উপাদান তৈরি হয়নি, যাতে আমবাঙালির তৃণমূলপ্রেম এহেন উথলিয়া উঠিতে পারে। সুতরাং তৃণমূলের জনসমর্থন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তা এই ফলাফল থেকে নির্ধারণ করা অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় জনতা পার্টি ২২ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচন কমিশনের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৩৮ শতাংশ ভোট। বিজেপির এ-রাজ্য থেকে ১৮ জন সাংসদ এবং ৭৭ জন বিধায়ক রয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির ভোট কমেছে ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ বিজেপির জনসমর্থন হ্রাস পেয়েছে ব্যাপক হারেই। একটি রাজনৈতিক দলের ১৬ শতাংশ ভোট এক ধাক্কায় কমে যাওয়াটা বিপর্যয়েরই নামান্তর। অন্যদিকে গত বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট ছিল শতাংশের হিসাবে মাত্র সাত শতাংশ। এর মধ্যে বামপন্থীদের সাড়ে চার শতাংশ এবং কংগ্রেসের আড়াই শতাংশ ভোট ছিল। লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা শূন্য হয়ে গিয়েছিল তার আগেই। যদিও কংগ্রেস অধীর চৌধুরীর আসনটি ধরে রাখতে পেরেছিল। বিধানসভা নির্বাচনে বাম ও কংগ্রেস শূন্য হয়ে যায়। কেবল জোটসঙ্গী আইএসএফ একটি আসনে জেতে। এই পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস এবং আইএসএফের হারানোর কিছুই ছিল না। নির্বাচনের প্রহসনের ফল প্রকাশের পর একটি অপ্রত্যশিত চিত্র সামনে চলে এল। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ তাদের ভোট বাড়িয়েছে প্রায় তিনগুণ। সাত শতাংশ ভোট বেড়ে হয়েছে ২১ শতাংশ। ভোট যে বাড়বে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল বালিগঞ্জ এবং সাগরদীঘি উপনির্বাচন থেকেই। কিন্তু তিনগুণ ভোট, এই প্রহসনেও, বেড়ে যাওয়াটা কিছুটা অপ্রত্যাশিতই ছিল।

বিজেপির ভোট কমেছে এবং বামজোটের ভোট বৃদ্ধি পেয়েছে, তার পিছনে গত দু বছরে এরাজ্যে যে সামাজিক-রাজনৈতিক সমীকরণগুলির বদল ঘটেছে, সেগুলিই বৃহৎ ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ করে, সংখ্যালঘুদের মধ্যে গত এক দশকে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে তৃণমূলের শাসনে আর যাই হোক না কেন, তাঁরা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বেন না। বিজেপির কেন্দ্রীয় শাসনে গোটা দেশেই সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে। কিন্তু তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের প্রশ্নটি মুখ্য নয়, তাঁর কাছে সংখ্যালঘুরা যে কেবলই ভোটব্যাঙ্ক, এটা তাঁরা বুঝতে শুরু করেছেন। ফলে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে ধস নামতে শুরু করেছে। সেই ভোট আংশিক হলেও চলে এসেছে বামজোটের ঝুলিতে। যে কারণে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত দুই ২৪ পরগনা, মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর ইত্যাদি জেলায় সন্ত্রাস এবং প্রতিরোধের ঘটনা সবচেয়ে বেশি।

দ্বিতীয়ত, গত লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের সমর্থকদের একটি বড় অংশ তৃণমূলকে প্রতিরোধ করার বাসনায় বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। সেই ভোটও এবার মোহভঙ্গের কারণে বামপন্থীদের কাছে আংশিক ফিরে এসেছে। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বামপন্থীরা কার্যত প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ময়দানে অনুপস্থিত ছিলেন। কোভিডজাত লকডাউনের অভিঘাত, আদালতের নির্দেশে তৃণমূলের চৌর্যবৃত্তির উদঘাটনে এজেন্সির তদন্ত, কোটি কোটি টাকা এবং সম্পদের পাহাড় উদ্ধারের দৃশ্য, আবাস যোজনা, একশো দিনের কাজ এবং নিয়োগ দুর্নীতি গ্রামীণ রাজনীতির সমীকরণ বদলাতে সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ সংগ্রামে ফিরে আসাটা একটি জরুরি অনুঘটকের কাজ করেছে। এর একটি বিপরীত চিত্রও রয়েছে। আদিবাসী সম্প্রদায় এবং তফসিলভুক্ত হিন্দুদের সমর্থন এখনও বাম-কংগরেসের পক্ষে আসেনি। এই নির্বাচন প্রহসনে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলাগুলিতে যে গণপ্রতিরোধের চেহারা দেখা গিয়েছে, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ জেলা— পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া এবং বীরভূমে সেই চিত্র অনুপস্থিত ছিল। এই জেলাগুলিতে মানুষের মধ্যে তৃণমূল-বিরোধিতা যে কম ছিল, তা একেবারেই নয়। কিন্তু সেই বিরোধিতার ফসল ঘরে তুলেছে বিজেপি।

আমি আবারও বলছি, এই নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে কোনও যথাযথ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। তবে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে কোনও দিগন্তপ্রসারী ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সমীকরণ আচমকা বদলে না দিলে তৃণমূল এবং বিজেপিকে যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হবে। সহজে, অন্তত মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো, জয় আর অর্জিত হবে না।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...