মহুয়া সাঁতরা
তবে কি ‘গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল, অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিম কাল?’ না। তাহলে তো আফস্পার প্রতিবাদে মণিপুরি মেয়েদের সম্মিলিত নগ্ন প্রতিবাদ ভুলে যেতে হয়
যখন গায়ের সব পোশাক খুলিয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে গ্রামের রাস্তা ক্ষেত মাঠ পেরিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে যেতে তাঁর যোনি স্পর্শ করছিল একের পর এক পুরুষ, প্রকাশ্য দিনের আলোয় ধর্ষণ করছিল একের পর এক, আর হাজার খানেকেরও বেশি মানুষ তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, ভিডিও তুলছিল কেউ কেউ, সেই ফোন-ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সে অকথ্য নির্যাতনটাকে আরও যেন বেশি করে দেখাতে চাইছিল কী এক হিংস্র উল্লাসে, আর বলছিল, দ্যাখ কেমন লাগে! শিক্ষা দিচ্ছি তোদের! তোরা কুকি। আমরা মেইতেই। তোরা আমাদের সুযোগ কেড়ে নিচ্ছিস। সেই, ঠিক সেই মর্মান্তিক অবমাননার বীভৎস মুহূর্তেও তিনি শুধু বলছিলেন, আমি তো মা-ও! আমায় প্রাণে মেরো না। আমার চার বছরের সন্তান আছে। ওর জন্য আমায় বেঁচে থাকতে দাও। মে মাসের সেই ভিডিও ১৮ জুলাই ভাইরাল হওয়ার পর এক সাংবাদিক যখন ফোন করেছিলেন তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য, তখনও সেই মা তাঁর সেই সন্তানের জন্য খাবার বানাচ্ছি্লেন। জানি না সেই মা শিশুপুত্রের জননী না শিশুকন্যার। এও জানি না, কোনও সন্তানই শেষ পর্যন্ত মনে রাখে কিনা মায়েদের কথা। তবে বড় হয়ে তারা নিশ্চয়ই জানবে, যে আবহমান কাল ধরে যুদ্ধ দাঙ্গা গোষ্ঠী সংঘর্ষে বোমা-গুলির মতোই মেয়েদের শরীরও অন্যতম অস্ত্র বলে বিবেচিত হয়! মেয়েদের ধর্ষণ, শারীরিক অত্যাচার, নির্যাতন যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার। জেন্ডার ভায়োলেন্স অন্যতম ওয়েপন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ঘরের পাশের ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ঘরের ভেতরে ১৯৮৪-র শিখ নিধন কিংবা এ মুহূর্তের লাঞ্ছিত অপমানিত মণিপুর। সে ট্র্যাডিশন সমানে চলছেই!
মণিপুরে হিংসা চলছিলই। মণিপুরে এই হিংসা বহুদিনের। পুরোটাই গোষ্ঠী সংঘর্ষ। মেইতেই বনাম কুকি-নাগা, আবার কুকি-নাগা ও অন্যান্য উপজাতিদের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ। সঙ্গে তো আছেই দিল্লি সহ বাকি ভারতের সচেতন ‘উত্তর-পূর্ব’ অবহেলা। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় তবু পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়, নাহলে বিহারের পর আর ভারত আছে বলে মনে হয় না দিল্লিতে থাকলে। ৩ মে জনজাতি ছাত্র সংগঠন অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুরের কর্মসূচি ঘিরে অশান্তির সূত্রপাত। মণিপুর হাইকোর্ট মেইতেইদের তফসিলি জনজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে রাজ্য সরকারকে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছিল। এতেই আগুনে ঘি পড়ে। কুকি, জ়ো-সহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংগঠনগুলি এই নির্দেশের বিরোধিতায় রাস্তায় নামেন। শুরু হয় ভয়ানক হিংসা, আগুন, মৃত্যু, অত্যাচার। এখনও পর্যন্ত মৃত প্রায় দুশো, ঘরছাড়া ৫০ হাজারের বেশি। একবারও কি কলকাতার কোনও ক্যাফেতে বা আমাদের তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল বন্ধু-বান্ধব গোষ্ঠীতে এ নিয়ে আলোচনা শুনেছেন? বা কোনও তেমন লেখা? যেটুকু পাওয়া গেছে, তা শুধু রাজনৈতিক চাপান-উতোর। এই সেদিন মণিপুরি চিত্রপরিচালক হাওবাম পবন কুমা্রের ‘নাইন হিলস ওয়ান ভ্যালি’ ছবিটা কলকাতায় দেখানো হয়। বিষয় মণিপুরের এই রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষ। তখন হালকা আলোচনায় উঠে আসে মণিপুরের এই ভয়াবহ পরিস্থিতি। না হলে সম্ভ্রান্ত বাঙালির কাছে এখনও মণিপুর শুধু বেড়ানোর জায়গা।
মেইতেইরা জনসংখ্যার বিচারে চিরকালই বেশি। ক্রমে তা কমে এসেছে। ইম্ফল বা সমতল অঞ্চলে তাঁদের বসবাস। মণিপুরে পাহাড় প্রায় ৯০ শতাংশ। কাজেই তাঁরা সংখ্যায় বেশি হলেও মণিপুরের মাত্র ১০ শতাংশ জমিতে তাঁদের বিচরণ। বাকি পাহাড় এবং জঙ্গলে কুকি-নাগা সহ আদিবাসী মানুষের বাস। আর এই পাহাড়ই হল নিকেল, তামা, প্লাটিনাম সহ মণিপুরের আশ্চর্য খনিজ ভাণ্ডার। এর আগে দিতে চাওয়া হলেও মেইতেইরা উপজাতির তকমা নিতে চাননি। এখন সেই তাঁদেরই আবার উপজাতি হতে চাওয়ার ইচ্ছের পেছনে আসল উদ্দেশ্য জঙ্গল পাহাড়ের ওপর অধিকার কায়েম করে পাহাড়ের খনিজ সম্পদ বাইরে বেচে দেওয়া বলেই মনে করছেন আদিবাসীরা। ব্যবসায়ীদের অনেকদিনের লোভ এই খনিজের ওপর। মেইতেইরা উপজাতি তকমা পেলে পাহাড়ে জমি কিনতে পারবেন, আর ব্যবসায়ীদের সে খনিজ সম্পদ লুঠ করতে সুবিধে হবে। রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংও মেইতেই। তাই কুকি নাগা সহ উপজাতিদের এই বিজেপি সরকারের ওপর আস্থাই নেই। তাঁরা মনে করেন, সরকারের সব সিদ্ধান্ত আসলে মেইতেইদের স্বার্থে। নাগা ও কুকির মধ্যেও প্রায় ২৯টি গৌণ উপজাতি আছে যাঁদের শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। তাঁদেরও নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই ছিল। এখনও আছে। মণিপুর আলাদা রাজ্য হয় ১৯৭২ সালে। ভারতের অঙ্গরাজ্য হতেই চায়নি মণিপুর। ৬০-এর দশকে কংগ্রেস মেইতেইদের স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে আসে ভারতের মধ্যে। তার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় জঙ্গি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। এদিকে কুকিদেরও একটা আন্দোলন আছে। ভোট-রাজনীতির উপর ভিত্তি করে তাঁরা লড়তেন।
সেদিন খুব সকালেই তাঁরা খবর পাচ্ছিলেন মেইতেইরা তাঁদের গ্রাম আক্রমণ করতে আসছেন। সেইমতো বাড়ির ছোটদের অন্য জায়গায় পাঠিয়েও দিয়েছিলেন। তিনি আর তাঁর স্বামী পালাতে যাওয়ার আগেই দুষ্কৃতিরা তাঁদের ধরে। দুজনকে দুদিকে নিয়ে যায়। তারপর ওই নির্যাতন। ছবিটি ৪ মে তোলা বলে দাবি মণিপুর পুলিশের। থৌবল জেলায় নংপোক সেকমাই থানার কাছেই। নির্যাতিতা বলেছেন, পুলিশই তাঁদের মেইতেইদের হাতে তুলে দেয়। যদিও অন্য একটা সূত্রের দাবি, ঘটনাটি কঙ্গপকপি জেলার। এরপরই তিনি এফআইআর করেন। পুলিশ প্রশাসন চুপটি করে বসেছিল। অবশেষে ভিডিও ভাইরাল হতে সে কী কান্নাকাটি সবার। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন শাস্তি হবেই। প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দুষ্কৃতিরা ধরা পড়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২১ জুলাই-এর মঞ্চ-ভাষণে বড় অংশ জুড়ে শুধুই মণিপুর। তৃণমূল বিজেপিকে দুষছে, কংগ্রেস বিজেপিকে দুষছে, বামেরা মিছিল করছে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ সহ অবিজেপি শাসিত রাজ্যের নারী নির্যাতন কত বেশি তার পরিসংখ্যান তুলে আনছে। তাছাড়া ভারত সরকার মনেই করছে যে এ কাজে প্রতিবেশী শত্রু দেশের হাত আছে। মণিপুরের সীমান্তে চিন ও মায়ানমার এবং মণিপুরে মায়ানমার-উদ্বাস্তু ও জঙ্গি সমস্যা আছে। আর, প্রায় আড়াই মাস বাদে এই ভয়ানক ভিডিও কোথা থেকে আপলোড করা হল প্রথম? না, উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে। কবে? না, সংসদে বাদল অধিবেশনের ঠিক আগের দিন!
বেশ চেনা চেনা লাগছে না সব?
চেনা রাজনৈতিক তরজা, চেনা ছেঁদো যুক্তি, চেনা অমানবিকতা, চেনা স্তব্ধতা, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির প্রতি চেনা ঔদাসীন্য, চেনা লোভ, লুটেপুটে খাওয়ার চেনা ছক। সবই চেনা। এরপরের সব ভুলে যাওয়াগুলোও চেনা লাগবে। কিন্তু যে চিত্রটা আমাদের প্রতিদিন মেয়েদের ওপর নির্যাতন শুনে যাওয়া দেশটাকেও হতবাক করে দিল, তা হল প্রকাশ্যে গণ-নির্যাতনের ও গণধর্ষণের এমন পাশবিক গণ-উদযাপন! অনেকে বলছেন, সভ্যতার শেষ আস্তরণটুকুও খসে গেল। তাই কি? আদিম পুরুষের মধ্যে এই পাশবিকতা ছিল? রাস্তায় যে কুকুর-বিড়ালদের নিত্য যৌনাচারে লিপ্ত হতে দেখি, তাকেও কি এমন বর্বরোচিত মনে হয় আমাদের? এই গণ-পৈশাচিক নির্মমতা কখনওই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে না। এর নেপথ্যে ভয়ানক পরাক্রমশালী ও সুচিন্তিত রাজনৈতিক ছক থাকতেই হবে। ঠিক যেভাবে যুদ্ধের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি হয়। এরপর যদি এই নির্যাতন দেশের বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়ে যায় তাতেও অবাক হওয়ার নেই।
তবে কি ‘গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল, অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিম কাল?’
না। তাহলে তো আফস্পার প্রতিবাদে মণিপুরি মেয়েদের সম্মিলিত নগ্ন প্রতিবাদ ভুলে যেতে হয়। ওই একই দিনে আরও এক তরুণীকেও একই হেনস্থা করা হয়। তাঁর স্বামী ও সন্তান প্রতিবাদ করেছিলেন বলে তাঁদের মেরেও ফেলা হয় চোখের সামনে। সমস্ত ধর্ষণ নারকীয় অত্যাচারের শেষে ওই দুটি মেয়েই ঘরে ফিরেছিলেন। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবেননি। অন্যের অন্যায়ে নিজেরা লজ্জিত হননি। দেহগত শুচিতার অলৌকিক কুযুক্তি মনে আনেননি। ঠিক যে কারণে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন, সব যন্ত্রণা সহ্য করে সেই একরত্তির যত্নেই মন দিয়েছেন। আর অপেক্ষা করছেন, বিচারের। এই যে অপমানে রক্ত মাংস মজ্জায় দাউদাউ করে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে যেতেও আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো, এ আমার কাছে অভূতপূর্ব, বিপ্লব-শলাকা।
*মতামত ব্যক্তিগত