শুভাশিস মৈত্র
বোঝাই যাচ্ছে বিরোধী রাজনীতির নেতাদের বিরুদ্ধে এজেন্সির হানা আরও জোরকদমে চলতে থাকবে। প্রমাণ করার চেষ্টা হবে, বিজেপির লড়াইটা আসলে, ভ্রষ্টাচার বনাম বিকাশের। বিজেপির প্রবল শক্তিশালী প্রচারযন্ত্রের আক্রমণের সামনে জোট লড়াইটাকে ‘নফরত' বনাম ‘মহব্বত’-এর বাইনারিতে টেনে আনতে পারবে কিনা সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন
পরিবর্তনের ইঙ্গিত যে সবসময় আগাম বোঝা যায় তা নয়। তবু রাজনীতির ঝোঁকগুলো ধরেই কথা বলতে হয়। রাজনীতিতে এরকমই বারবার ঘটে। কখন যে জনপ্রিয়তার স্রোত উল্টো দিকে বইতে শুরু করে আগাম আন্দাজই করা যায় না। ইন্দিরা গান্ধি যে ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান দিয়ে বিপুল সমর্থন নিয়ে ১৯৭১-এ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, বাংলাদেশ যুদ্ধে জয়ের ফলে তিনি যে দেশ জুড়ে তুলনাহীন জনসমর্থন পেয়েছিলেন, ইতিহাস বলে, তা খুবই ক্ষণস্থায়ী ছিল। ক্ষমতা ধরে রাখতে ১৯৭৪-এ তাঁকেই জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল। এবং ১৯৭৭-এ পরাজয়। রাষ্ট্রনীতির পড়ুয়াদের জন্য সেটা একটা বিরাট শিক্ষা। আবার জরুরি অবস্থা যে উঠে যাবে, গণতন্ত্র ফিরে আসবে, সেটাও সাংবাদিকরা এবং রাজনীতিকরা আগাম আন্দাজ করতে পারেননি।
ভূমিকা ছেড়ে মূল কথায় ফেরা যাক। ২৬ দলের একটা বিরোধী জোট ‘I.N.D.I.A.’ গঠিত হয়েছে। তারা বিজেপির রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়তে চায়। অন্যদিকে ৩৮টি রাজনৈতিক দল নিয়ে আচমকাই সামনে এসেছে নতুন করে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ। এতদিন এনডিএ-এর প্রায় কোনও অস্তিত্বই ছিল না। ‘I.N.D.I.A.’-র জন্ম হতে না হতেই দেখা গেল বাঁচিয়ে তোলা হল এনডিএ-কে। যাই হোক দু পক্ষের শক্তি যোগ করলে দাঁড়ায় মোট ৫৪টি রাজনৈতিক দল। অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও, ৫৪টি রাজনৈতিক দল দুভাগে বিভক্ত হয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। এক পক্ষ হিন্দুত্ববাদী। বিপরীত পক্ষ ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে। এরকম আগে হয়নি। এটা একটা বড় পরিবর্তন।
অনেকে বলতে পারেন, ১৯৭৭-এও তো এরকমই হয়েছিল। একটু ফারাক ছিল। তখন ইন্দিরার বিরোধী দলগুলি কৌশলগত কারণে একজোট হলেও, তারা আদর্শগতভাবে অনেকেই এক পথের পথিক ছিলেন না। এবারে ব্যতিক্রম এটাই যে, হিন্দুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ, গোদাভাবে হলেও, এরকম দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। যদিও এই ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ভবিষ্যৎ এখনও অস্পষ্ট। এ বছরের শেষে পাঁচটি বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের হয়তো কিছুটা আন্দাজ করা যাবে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির অবস্থান কোথায় হতে চলেছে। তাছাড়া তৃণমূল-সহ অনেক আঞ্চলিক দল, সমস্যায় পড়লে তারা যে তাদের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান ছেড়ে বিজেপির দিকে চলে যেতে পারে, এমন নজির অতীতে রয়েছে। ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে। আর নেতারা তো নীতির বালাই ভুলে নিয়মিতই যাচ্ছেন কখনও এধার কখনও ওধারে।
নজির নেই তা নয়। নজির আছে। অতীতে বিরোধী জোট ক্ষমতাসীন সরকারকে (কংগ্রেসকে) ক্ষমতাচ্যুত করেছিল ১৯৭৭ এবং ১৯৮৯-এ। এবং সেটা করেছিল তথাকথিত কোনও বড় মুখ ছাড়াই। ফলে, ওদের একজন ‘৫৬ ইঞ্চি’ আছে, ফলে আমাদেরও ভোটে জিততে একজন অন্তত ‘৫৮ ইঞ্চি’ দরকার, এই ধারণাটা ভুল। তবে সেক্ষেত্রে লড়াইটাকে ব্যক্তির না করে অবশ্যই আদর্শের করে তুলতে হবে।
খুব ছোট দুটি পদক্ষেপেই দেখা যাচ্ছে বিরোধী জোটের দলের সংখ্যা ১৬ থেকে ২৬ হয়েছে। সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারে। কমার সম্ভাবনাও যে নেই জোর দিয়ে বলা যাবে না। জোটের লড়াই মূলত তিনটি শক্তির বিরুদ্ধে। প্রথম ‘নরেন্দ্র মোদি’, দ্বিতীয় ‘এজেন্সি’ এবং এবং তৃতীয় ‘টাকার পাহাড়’। এই তিনের মিলনই বিজেপি।
কাজটা খুবই কঠিন। একথা ঠিক, মোদির সমান্তরাল কোনও নেতা বিরোধী জোটে এই মুহূর্তে নেই। সর্বত্র মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত, দেশের পরিস্থিতি তেমনও নয়। দেশের অর্থনীতি গোল্লায় চলে গিয়েছে, এমনও বলা যাবে না। কিন্তু যে সমস্যা মোদি সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও মেটাতে পারেনি এবং ধর্মীয় স্লোগান, হিজাব, লাভ জিহাদ দিয়ে যে ছবিটা আর ঢাকা যাচ্ছে না, সেটা হল, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, দারিদ্র্য। সঙ্গে, গণতন্ত্রের সবকটি স্তম্ভকে গত নয় বছরে ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দেওয়া হয়েছে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় সাংবাদিক গ্রেফতারে, তিস্তা শেতলওয়াড়দের জেলে পাঠানোয়, তথ্য জানার অধিকারের আইনকে শাসকদলের উপর নির্ভরশীল করে তুলতে সংশোধনী আনার মধ্যে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে বলেই মণিপুরে এতদিন ধরে এত বড় অন্যায় করেও নিশ্চিন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দিব্যি হেসে-খেলে এদিক-ওদিক এটা-ওটা উদ্বোধন করে বেড়ানো এখনও সম্ভব হচ্ছে।
১৮ জুলাই, যেদিন ২৬ বিরোধী দলের বেঙ্গালুরু-বৈঠক হল, সেদিনই দিল্লিতে হল ছোট-বড় ৩৮ দলের নেতাদের নিয়ে এনডিএর বৈঠক। হাতে ৩০০-র বেশি আসন থাকায় বিজেপির কাছে এনডিএ গুরুত্বহীন হয়ে গিয়েছিল। বিজেপিও বুঝেছিল কাশ্মির থেকে ৩৭০ প্রত্যাহার, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ইত্যাদি চালু করতে গেলে শরিক দল থেকে প্রশ্ন আসবে। যেমন কৃষি বিল নিয়ে প্রশ্ন তুলে এনডিএ ছেড়েছিল ‘অকালি দল’। তারা এখনও এনডিএতে ফেরেনি। ১৮ তারিখের এনডিএ বৈঠকে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিরুদ্ধে। এতদিন বিজেপি নেতাদের অনেকেই বলছিলেন, লোকসভা ভোটের আগে সিএএ চালু হয়ে যাবে। এই যে ‘ইন্ডিয়া’-র চাপে এনডিএ-তে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করতে হল, তাকে টিকিয়ে রাখতে হলে, আপাতত, সিএএ, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এসব ভোটের আগে কার্যকর করা খুবই কঠিন হবে বিজেপির। ২৬ দলের জোটের এটা হল প্রথম সাফল্য।
২৬ দলের বিরোধী জোটের মোট শক্তি ১৪৪ জন সাংসদ, ২০১৯-এ তাদের মোট প্রাপ্ত ভোট ৩৬ শতাংশের একটু বেশি। যা ২০১৯-এ বিজেপির শতকরা ভোটের প্রায় সমান। এটাতে হয়তো কিছু প্রমাণ হয় না। কিন্তু এটা বোঝা যায়, ২৬-এর জোট শক্তিহীন নয়। কংগ্রেস ১৯৯১-এর পরে একবারই, ২০০৯ সালে, ২০০-র বেশি আসন পেয়েছে। ‘ইন্ডিয়া’কে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হলে কংগ্রেসকে ২০০ না হোক, অন্তত ১০০-র বেশি আসন পেতে হবে। যদিও, এই মুহূর্তের কথা বলতে হয়, মানতেই হবে, অঙ্কে ‘ইন্ডিয়া’ এখনও অনেকটাই পিছিয়ে আছে এনডিএ-র থেকে।
কোনও সন্দেহ নেই রাজ্যে রাজ্যে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, কেরলে আসন বোঝাপড়া নিয়ে সমস্যা হবে জোটের মধ্যে। তার কিছু মিটবে, কিছু থেকে যাবে। এমনই হয়। ১৯৭৭-এ পশ্চিমবঙ্গে লোকসভায় জনতা পার্টির সঙ্গে জোট হলেও বিধানসভায় বহু আলোচনাতেও জোটধর্ম রক্ষা হয়নি। প্রয়োজনে যে দলীয় সঙ্কীর্ণতা অতিক্রম করা যায় তার অসংখ্য নজির রয়েছে। যেমন আরামবাগ লোকসভার ভোট। ১৯৭৭-এ লোকসভায় আরামবাগ কেন্দ্রে, সিপিএম যাঁকে চিরকাল কাঁচকলামন্ত্রী বলত, সেই প্রফুল্ল সেন জোটের প্রার্থী হয়ে যে ৭৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন, তার বিরাট অংশই তো ছিল সিপিএম-এর ভোট। সেটা আরও বোঝা গিয়েছিল, ১৯৮০র লোকসভা ভোটে যখন জোট হল না, আরামবাগ কেন্দ্রে প্রফুল্ল সেন ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে পরাজিত হয়েছিলেন সিপিএম-এর বিজয়কৃষ্ণ মোদকের কাছে। বিজয়কৃষ্ণ পেয়েছিলেন ৫৩ শতাংশ ভোট।
ভারত জোড়ো যাত্রা এবং কর্নাটকের জয়ের পর কংগ্রেসের যে একটা ঘুরে দাঁড়ানোর ঝাপসা ছবি দেখা যাচ্ছে সেটাকে উজ্জ্বল করতে হলে, আসন্ন কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটে, অন্তত মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে জিততে হবে কংগ্রেসকে। তেমন ঘটলে, একটা রসায়ন জন্ম নিতেও পারে জোটের সর্ববৃহৎ দলের পক্ষে।
টিএমসি, এনসিপি সহ অনেক দলেরই জন্ম কংগ্রেস থেকে। বেঙ্গালুরু বৈঠকে, প্রধানমন্ত্রীর পদ চাই না ঘোষণা করে এবং আচার আচরণেও, পুরনো বন্ধুদের প্রতি সোনিয়ার উপস্থিতিতে কংগ্রেস যেন একটা বার্তা দিল। এই ঘটনায়, নতুন রাজনৈতিক সমন্বয়ের ইঙ্গিত রয়েছে। বাকিটা সময় বলবে।
বিজেপির সবচেয়ে বড় সমস্যা এই যে নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তির ঔজ্জ্বল্য কমছে। কর্নাটকে গলা ফাটিয়ে ‘জয় বজরংবলি’ স্লোগান দিয়েও যে তিনি বিজেপির ভোট ২০১৮-র থেকে এক শতাংশও বাড়াতে পারলেন না, সেটা তার প্রমাণ। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে ভাবমূর্তি ছিল, আজ তার প্রায় সবটাই ক্ষয়ে গিয়েছে। কর্নাটকের ভোটপ্রচারে মোদিকে একবারও বলতে শোনা গেল না সেই চিরপরিচিত স্লোগান, ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’। তারপরও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বিরোধী জোটের বৈঠককে বলেলেন ‘ভ্রষ্টাচারীদের সম্মেলন’। বোঝাই যাচ্ছে বিরোধী রাজনীতির নেতাদের বিরুদ্ধে এজেন্সির হানা আরও জোরকদমে চলতে থাকবে। প্রমাণ করার চেষ্টা হবে, বিজেপির লড়াইটা আসলে, ভ্রষ্টাচার বনাম বিকাশের। বিজেপির প্রবল শক্তিশালী প্রচারযন্ত্রের আক্রমণের সামনে জোট কি পারবে লড়াইটাকে ‘নফরত’ বনাম ‘মহব্বত’-এর বাইনারিতে টেনে আনতে? সেটাই কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
*মতামত ব্যক্তিগত