অশোক মুখোপাধ্যায়
ঈশ্বর যদি একজন নকশাকার হয়, যে আবার সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ, সে পরিকল্পনা করে করে যে অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ বানাল তার বেশিরভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেল— তাহলে নকশাকার হিসাবে তার যোগ্যতা কী? তার তো অধিকাংশ নকশাই খারাপ! এই যুক্তিগুলোও সমাজের মধ্যে আসতে শুরু করল। জীবাশ্মের অস্তিত্ব স্বীকার করলে, ডারউইনবাদ মানলে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বকে মানলে আর ঈশ্বরের নকশা তত্ত্বকে মানা যায় না
পূর্ব-প্রসঙ্গ: ল্যমার্ক নয়, ওয়ালেস নয়, শুধু ডারউইন
একে একে বলি।
প্রথম, হ্যাঁ, একেবারে সর্বপ্রথম বিবেচ্য হল ডারউইনের উপাত্ত ভাণ্ডার। তথ্যপ্রাচুর্যই বলা যেতে পারে। তিনি ১৮৩১-৩৬ সময়কালে পাঁচ বছর ধরে যে অতি-অজস্র সংখ্যক তথ্য, অর্থাৎ, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের বিচিত্র নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন, এবং বাক্সে ভরে ভরে দেশে পাঠিয়েছিলেন, তাতে— “ভগবানের তৈরি এত বড় দুনিয়ার উনি কতটুকুই বা আর দেখেছেন”— এরকম কিছু বলার সুযোগই ছিল না। বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে গোলা নিক্ষেপের সময় এই সুযোগটি হাতছাড়া হলে অন্ধবিশ্বাসীদের যে কতখানি রাগ হয়, ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে বোঝা খুব মুশকিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, হুমবোল্টও একইরকম বিপুল পরিমাণ উদ্ভিদনমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু তিনি যেহেতু ডারউইনের মতো কোনও তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, তাই তাঁকে সেদিন খ্রিস্টোপাসকগণ এবং পরবর্তীকালে ইসলামি মৌলবি ও সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বলা ভাল, দিতে হয়নি।
দ্বিতীয়ত, (অসচেতনভাবে) নিউটনের মতো এবং (সচেতনভাবে) লাপ্লাস বা ল্যমার্কের মতো ডারউইন কোথাও বলেননি, জীবজগতের বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন বোঝার জন্য আমাদের ঈশ্বর-ধারণা লাগবে না। বলে ফেললে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করার খানিক সুবিধা হত। একটা পরিচিত পরিসর পাওয়া যেত যেখানে খ্রিস্টবাদীরা (এবং পরে অন্যরাও) তাদের তর্ক-পসরা সাজিয়ে নিয়ে হাজির হতে পারত। উলটে, টমাস হেনরি হাক্সলি বা আর্নস্ট হেকেল তাঁদের লেখালেখিতে যাই বলুন, ডারউইন তাঁর “প্রজাতির উদ্ভব” বইতে “ভগবান” শব্দটা না লিখলেও অনেক জায়গাতেই, বিশেষ করে শেষ অধ্যায়ে, “স্রষ্টা” শব্দটা বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছেন। আর তাতে কোনওরকম অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়নি!
ঝামেলাটা বুঝেছেন?
তৃতীয়ত, তার বদলে তিনি যেটা করেছেন, সেটা আরও খারাপ। সেই পরম পূজনীয় বিশাল ক্ষমতাশালী সর্বদ্রষ্টা সবজান্তা স্রষ্টাকে একেবারে নাজেহাল এবং উপহাসাস্পদ করে তোলা। প্রজাতি রূপান্তরের প্রক্রিয়া বোঝাতে গিয়ে বিচিত্র সব তথ্য তুলে ধরতে ধরতে এমন একটা অবস্থায় তাকে তিনি নিয়ে ফেলেছেন, যেখানে তার মানসম্মান একেবারে ধুলোয় লুটিয়ে পড়েছে। সে পুনরুদ্ধার করার কোনও রাস্তাই খোলা নেই।
ব্যাপারটা এইবার আরও একটু খোলসা করে বলা যাক:
তখনও পর্যন্ত বস্তু ও জীবজগতের সৃষ্টি ও অপরিবর্তনীয়তার ধারণাটা যে ধর্মীয় বিশ্বাস বা ধ্যানধারণার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল তাকে কেউ কাটান দিতে পারছিলেন না। যাঁরা বিবর্তনের কথা বলছিলেন তাঁরাও কেউ এই জায়গায় ধাক্কা দিতে পারছিলেন না। অন্যদিকে, ধর্মবিশ্বাসী চিন্তাবিদরা তাঁদের যুক্তি ও বক্তব্যকে নতুনভাবে সাজিয়ে তুলছিলেন। বিশেষ করে, একদল খ্রিস্টান বুদ্ধিজীবী যখন দেখলেন, কোপারনিকাস গ্যালিলেও কেপলার নিউটনের আবিষ্কারগুলির পরে বাইবেলের সব কথাকে আর নির্ভুল বলা যাচ্ছে না, তাঁরা ধর্মবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে লাইন বদলে অন্য ধরনের তত্ত্বকথা শোনাতে শুরু করলেন। তার নাম natural theology বা প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব।
নিউটনের মতো ঈশ্বরবিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা হচ্ছেন এই মতবাদের জন্মদাতা। তাঁরা জগৎসংসারের ভৌত বা প্রাকৃতিক নিয়ম-শৃঙ্খলাকে দেখিয়ে বলতে চাইতেন, এই নিয়মগুলিই ভগবানের বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ। দুনিয়ার যাবতীয় পদার্থের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ও নিয়মকানুন সে এমনভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে, যাতে এই বিশ্বজগৎ সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হতে পারে, এখানে মানুষ ও অন্যান্য জীব অক্লেশে বসবাস করতে পারে, যার যা কিছু লাগবে সে পেতে পারে, ইত্যাদি। করুণাময় ঈশ্বর জগৎসংসারের সমস্ত ব্যাপারে সুবন্দোবস্ত করে দিয়ে নিজে চুপচাপ এক কোণায় সরে গেছে। গ্রহনক্ষত্রগুলোকে একবার একটা রামধাক্কা দিয়ে গতি চালু করে দিয়েছে। তারপর থেকে রোজ রোজ সে আর আরিস্ততলের কথায় জগৎসংসারে নাক গলাতে আসে না।
তাঁরা বললেন— বাইবেলকে আক্ষরিক অর্থে ধরতে যেও না। বাইবেলের কথাগুলিকে ধরতে হবে রূপক অর্থে। ঈশ্বর পৃথিবীকে ছয় দিনে সত্যিই সৃষ্টি করেছিলেন কিনা, এটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, ঈশ্বর সৃষ্টি না করলে এত সব জিনিস তৈরি হল কীভাবে। জগতের সমস্ত বস্তু ও জীবগুলি এমন যে তারা একে অপরের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যায়। নানা প্রকারের উদ্ভিদ ও প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য আছে স্থলভাগ জলভাগ ও বায়ুমণ্ডল; তাতে জলচর প্রাণীগুলির রয়েছে জলে ভেসে থাকা ও সাঁতার কাটার মতো অঙ্গসংস্থান। সেইজন্য মাছেদের রয়েছে এক ধরনের পাতলা কাঁটাওয়ালা ছোট ছোট পাখনা (fins)। অন্যদিকে যে পাখিরা আকাশে ওড়ে তাদের আছে পালকযুক্ত বড় ডানা (wing) আর হালকা হাড়গোর। স্থলচর প্রাণীরা চলাফেরার জন্য পেয়েছে আর এক ব্যবস্থা। আবার, আমাদের আছে দেখবার জন্য চোখ, শুনবার জন্য কান, ইত্যাদি। সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে এইভাবে যে মঙ্গলময় সুবন্দোবস্ত দেখা যাচ্ছে— এসব কে করে দিল? অন্য কথায়, প্রকৃতিই ঈশ্বরের অস্তিত্বের সবচাইতে বড় প্রমাণ।
খ্রিস্টান যাজক উইলিয়াম প্যালে-র নাম এখনকার দিনে খুব কম লোকই জানে। বিশেষ করে এদেশে। এই সব বিষয় নিয়ে তাঁর দুটো বিখ্যাত বই ছিল Evidences of Christianity (১৭৯৪) এবং Natural Theology: Or Evidences of the Existence and Attributes of the Deity (১৮০২)। এই বইগুলো ইউরোপের শিক্ষিত মহলে উনিশ শতকে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। ডারউইনও ছাত্রজীবনে এই সব বই পড়েছেন এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। এই সব বইতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ ও মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে একটা খুব আকর্ষণীয় যুক্তি তুলে ধরা হত। সেটাকে বলা হত argument of design বা নকশার যুক্তি।
এর মূল কথাটা ছিল, আমরা যখন একটা সুন্দর বানানো জিনিস দেখি যার মধ্যে একটা নকশা বা design আছে, তখন আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিই— জিনিসটা নিশ্চয়ই কেউ পরিকল্পনা করে বানিয়েছে; কেন না, নকশা আছে মানেই একজন নকশাকারও আছে; না হলে design-টা এল কোত্থেকে? রাস্তায় চলতে গিয়ে পায়ের সামনে একটা পাথরের চাঁই পড়ে থাকতে দেখলে তা নিয়ে আমাদের তেমন কৌতূহল হয় না। কিন্তু একটা ঘড়ি দেখে বুঝতে পারি, এর যে জটিল ও সূক্ষ্ম কলকব্জা, ছোট বড় মেজ তিন আকারের কাঁটা, স্প্রিং, দম দেওয়ার চাবি (আমরা এখানে প্রাক-ডিজিট্যাল যান্ত্রিক ঘড়ির কথা বলছি), এইগুলোকে পরিকল্পনা মতো তৈরি করে জুড়ে জুড়ে একজন কেউ এটা বানিয়েছে— যে বানিয়েছে তাকেই ঘড়ির designer বা নির্মাতা বলতে পারি। একইভাবে যদি চিন্তা করে দেখি, এই যে পৃথিবী, তার গাছপালা, বনজঙ্গল, উঁচু নিচু পাহাড়, নদী হ্রদ সমুদ্র, চারদিকে পরিব্যাপ্ত বাতাস, বর্ষাকালের বারিধারা, সবই কেমন সাজানোগোছানো, আমাদের কতভাবে কাজে লাগে, বেঁচে থাকা কত সুন্দর হয়ে ওঠে। আবার এই যে মানুষ, মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো এত সুন্দরভাবে বানানো এবং এত সুন্দরভাবে কাজ করছে— এই সবকিছুই তো মনে হয় যন্ত্রের মতো সুপরিকল্পিত। এসবের মধ্যেও তো design দেখা যাচ্ছে। তাহলে এই সব design-এরও designer থাকা উচিত। এই সব দেখে শুনে তো মনে হতেই পারে যে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পিছনেও একজন Grand Designer আছেন।
তিনিই হচ্ছেন ঈশ্বর!
এবার দেখুন, ডারউইন এসে কী সব্বোনাশটি করলেন। তিনি জীবজগতের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে যে তত্ত্বটা নিয়ে এলেন সেটা এই natural theology যে যুক্তিগুলিকে সামনে আনছিল এবং তার ভিত্তিতে খানিকটা বৈজ্ঞানিক যুক্তির আদলেই ঈশ্বরতত্ত্বকে আরও জোরদার করে তুলছিল— design থেকে designer, তার থেকে Grand Designer— এই তর্কপ্রবাহের গায়ে একটা বিচ্ছিরি রকমের লকগেট লাগিয়ে দিল। ঈশ্বর সম্পর্কে কোথাও একটা বিরূপ কথাও না বলে। অত সুন্দর একটা যুক্তিকাঠামোকে একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিল।
কীভাবে?
জাহাজে ভ্রমণকালে চার্লস লায়েলের Principles of Geology বই পড়ে যেমন তিনি জেনেছিলেন, তেমনি নিজেও ঘুরে ঘুরে উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবিত ও জীবাশ্মের নমুনা সংগ্রহ করতে করতে বুঝেছেন— উদ্ভিদ ও প্রাণীর বিবর্তনের পথে প্রতিটি পর্যায়েই যতরকম প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে ধাপে ধাপে তাদের বেশিরভাগটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অল্প কিছুই টিকে গেছে। আসলে ডারউইনের সময় জানা না থাকলেও এখন আমরা জেনেছি যে পৃথিবীর ইতিহাসে ভূত্বকের উপরে বিশাল মাত্রার পরিবর্তনের ফলে জীবজগতের ক্ষেত্রে অন্তত পাঁচটা খুব বড় আকারের গণবিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। আমরা আজ যে কয়লা পেট্রল ডিজেল ইত্যাদি জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করে থাকি, সেও আসলে এই সব গণবিলুপ্তিরই এক একটার জীবাশ্ম-ফসল। এইসব ঘটনার তাৎপর্য কী? ডারউইনের তত্ত্ব থেকে কথাটা এক সময় প্রকাশ্য আলোচনায় উঠে গেল যে, ওই তথাকথিত grand designer বারংবার উদ্ভিদ ও প্রাণীর যে অসংখ্য design বানিয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশই প্রতিক্ষেত্রেই ভুল নকশায় তৈরি ছিল, প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি, ফলে তারা বেশিকাল টেকেনি। বা এমন অনেক প্রজাতি যারা বেশ কিছুকাল টিকলেও পরিবেশ পালটে গেলে আর টেকেনি। অর্থাৎ, ভগবান যে পরিবেশে যে যে প্রাণী ও উদ্ভিদ সৃষ্টি করেছে, তার চোদ্দ আনাই খাপে খাপে মেলেনি। খুব অল্প কিছু মিলেছে।
আবার ঘড়ির যুক্তিটা ধরা যাক।
কোনও ঘড়ির কারিগর যদি একশোটা ঘড়ি বানান এবং তার মধ্যে মাত্র পাঁচটা ঘড়ি ঠিকমতো চলে আর পঁচানব্বইটা ঘড়ি দুদিন বাদেই খারাপ হয়ে যায়, তাহলে তাঁর ঘড়ি আর কেউ কিনবে? ঠিক সেইরকম, ঈশ্বর যদি একজন নকশাকার হয়, যে আবার সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ, সবই করতে পারে এবং সবই জানে, সে পরিকল্পনা করে করে যে অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদ বানাল তার বেশিরভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেল— তাহলে নকশাকার হিসাবে তার যোগ্যতা কী? তার তো অধিকাংশ নকশাই খারাপ! এই যুক্তিগুলোও সমাজের মধ্যে আসতে শুরু করল। জীবাশ্মের অস্তিত্ব স্বীকার করলে, ডারউইনবাদ মানলে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বকে মানলে আর নকশা তত্ত্বকে মানা যাবে না। বরং অবস্থাটা এমন দাঁড়াল যে বিলুপ্ত জীবগুলির ফসিলসাপেক্ষে নকশার যুক্তিটিই সেই সময় থেকে ঈশ্বর=ধারণার বিরুদ্ধে একটা বড় কাঁটা হয়ে উঠল।
ডারউইন তাঁর বিগল জাহাজে চড়ে দীর্ঘ পাঁচ বছরের সমুদ্রযাত্রাশেষে দেশে ফেরার পর তাঁর মনের অবস্থা বোঝাতে গিয়ে আত্মজীবনীতে লিখেছেন:
তখন থেকে ধীরে ধীরে আমার মধ্যে অবিশ্বাস দানা বাঁধতে থাকে, এক সময় তা সম্পূর্ণ হয়। এটা এত ধীর গতিতে হয়েছে যে আমার কোনও অস্বস্তি হয়নি, বা এক সেকেন্ডের জন্যও সন্দেহ হয়নি, যে ঠিক সিদ্ধান্ত নিলাম কিনা। এখন আর বুঝতেই পারি না কী করে লোকে খ্রিস্টধর্মকে সত্য বলে মনে করতে পারে; কেননা, যদি তা সত্য হয়, তার শাস্ত্রের পাঠে স্পষ্ট করেই বলা আছে, এতে যারা বিশ্বাস করবে না, তারা চিরকালের জন্য শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর এই অবিশ্বাসী দলের মধ্যে আছেন আমার বাবা, দাদা এবং প্রায় সমস্ত প্রিয় বন্ধুবান্ধব। এ এক ভয়ঙ্কর মতবাদ।[1]
এ তো হল গিয়ে না-বাচক দিক থেকে ধর্মত্যাগ। যিশুর কথিত বাণী অনুসারে শুধু মাত্র নাস্তিক হওয়ার কারণে তাঁর বাবা, দাদা, এবং প্রায় সমস্ত ভাল ভাল বন্ধুদের নরকের আগুনে মরণোত্তর জারণ হবে— এটাকে তখন আর তিনি মন থেকে মানতে পারছেন না। মজার কথা হল, যতদিন তিনি খ্রিস্টের বাণীতে বাইবেলের বচনে বিশ্বাস করে এসেছেন, ততদিন কিন্তু বাপ-দাদাদের এই শাস্তির কথায় তাঁর তেমন অস্বস্তি হয়নি। কিন্তু এখন হচ্ছে। তাতেই তিনি এটাও বুঝলেন, ঈশ্বরে ভক্তি কীভাবে মানুষের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। অন্যদিকে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রেক্ষিতে তাঁর মনে হল, নকশার যুক্তিকেও আর গ্রহণ করা যায় না:
প্যালে এক সময় প্রকৃতিতে নকশার যে পুরনো যুক্তি দিয়েছিলেন, আমিও যাকে চূড়ান্ত বলেই মনে করতাম, প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম আবিষ্কারের পর তা অকার্যকর হয়ে গেছে। একটা শেলের দুটো পর্দা যে সুন্দর একটা কবজার গায়ে লেগে থাকে সেটাকে দেখিয়ে মানুষের তৈরি দরজার গায়ের কবজার সঙ্গে তুলনা করে আমরা আর বলতে পারি না যে এটাও কোনও বুদ্ধিমান সত্তার হাতে নির্মিত হয়েছে। বায়ুপ্রবাহের মধ্যে যেটুকু নকশা আছে জীবসদস্যদের প্রকারভেদ এবং তার উপর প্রাকৃতিক নির্বাচনের ভূমিকা দেখে তার মধ্যে তার চাইতে বেশি নকশা আছে বলে মনে করা যায় না। প্রকৃতিতে সবকিছুই নির্দিষ্ট নিয়মের পরিণাম। আমি এই বিষয়টা আমার Variation of Domestic Animals and Plants বইয়ের শেষে আলোচনা করেছি, এবং যদ্দূর দেখা যাচ্ছে, এখন পর্যন্ত কেউ তার উত্তর দিতে পারেননি।[2]
সেই বইটিতে তিনি কী বুঝিয়েছেন, পুত্র ফ্র্যান্সিস এক পাদটীকায় সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন:
My father asks whether we are to believe that the forms are preordained of the broken fragments of rock which are fitted together by man to build his houses. If not, why should we believe that the variations of domestic animals or plants are preordained for the sake of the breeder?[3]
অস্যার্থ, আপনি যখন প্রকৃতিতে পাওয়া নানা রকম আকারের পাথরের চাঁই একটার পাশে এবং উপরে আর একটা করে মিলিয়ে সাজিয়ে একটা ঘর বানাচ্ছেন, তখন কি বলবেন, ভগবান এইগুলো এইভাবে এক নকশার ভিত্তিতে কেটে কেটে বানিয়ে রেখেছে যাতে আপনি ঘরটা তৈরি করতে পারেন?
ফ্র্যান্সিস তারপর সেই বই থেকেও চার্লস ডারউইনের খানিক বক্তব্য একটা ছোট উদ্ধৃতির আকারে তুলে এনেছেন:
But if we give up the principle in one case,… no shadow of reason can be assigned for the belief that variations alike in nature and the result of the same general laws, which have been the groundwork through natural selection of the formation of the most perfectly adapted animals in the world, man included, were intentionally and specially guided.[4]
এই যে কেউ উত্তর দিতে পারছিল না, এর সাপেক্ষে একটা বেয়াড়া অনুমান আমি কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছি না। সুকুমার রায় সেইকালে ইংল্যান্ডে জন্ম নিলে হয়ত আর একটা ছড়া লিখতেন এইরকম:
Charlie the young and docile boy
Throws up and catches Him as a toy!
কিংবা বাংলায়—
খেলার ছলে চার্লিচরণ
স্রষ্টা নাচান যখন তখন!
[ক্রমশ]
_____
[1] Barlow (ed.) 1993, p. 87.
[2] Ibid, pp. 87-88.
[3] Ibid, p. 88.
[4] Cited, ibid.