আশীষ লাহিড়ী
বিজ্ঞান, সেকিউলারিজম, প্রতিবেশ আন্দোলন আর মানবাধিকারকে যে-মানুষটি একসূত্রে গাঁথতে চেয়েছিলেন তিনিই হলেন সমর বাগচি
বহু বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গের বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মীদের কাছে সমর বাগচি একটি নিত্যস্মরণীয় নাম। বিজ্ঞান ও প্রতিবেশ আন্দোলনের জাগ্রত বিবেক ছিলেন তিনি। কয়েক প্রজন্ম ধরে তিনি এখানকার বিজ্ঞান আন্দোলনের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। কত তরুণ যে তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিজ্ঞান আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই।
বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত জ্ঞান সঞ্চয় করতে করতে, ভুল জ্ঞান বর্জন করতে করতে এগোয়। তাই বিজ্ঞানের নিত্যনব বিকাশের সঙ্গে তাল রাখাটা খুব জরুরি। নইলে চর্বিতচর্বনের ফাঁদে আটকে পড়তে হয়। সমরবাবু সারা জীবন নিজেকে তত্ত্বগতভাবে শিক্ষিত করতে করতে এগিয়েছেন। পেশাগত কারণে বিশ্বের নানা দেশের বড় বড় বিজ্ঞান সংগ্রহশালা ভ্রমণ করেছিলেন তিনি; সেইসব জায়গা থেকে আহরিত অজস্র নতুন তথ্য সোৎসাহে বিতরণ করতেন অনুজ ও সহকর্মীদের মধ্যে। কোনও নতুন আবিষ্কারের কথা জানলে, কোনও নতুন বই পড়লে তৎক্ষণাৎ সে বিষয়ে তাঁর পরিচিতজনকে অবহিত করতেন। তরুণ-প্রবীণ যেকোনও লেখকের বিজ্ঞান-রচনা ভাল লাগলে তাকে ফোন করে বা ব্যক্তিগতভাবে উৎসাহ জোগাতে ভুল হত না তাঁর। মনে কোনও নতুন ভাবনা এলে সহমর্মীদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় কোনও দ্বিধা ছিল না। এমনকী তাত্ত্বিক মতভেদ সত্ত্বেও মূল উদ্দেশ্যে মিল থাকলে কথোপকথনে বা বিতর্কে কখনও কোনও আপত্তি হত না। গান্ধি ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে তাঁর মূল্যায়নের সঙ্গে অনেকে একমত হতেন না; তাঁদের প্রতিও ওঁর স্নেহ-ভালবাসার এতটুকু খামতি ছিল না। বিজ্ঞান আন্দোলনে ঠিক এই ধরনের খোলা মনের মানুষের দেখা খুব বেশি মেলে না।
বিজ্ঞান আন্দোলনেরও আবার অনেক ধরন আছে। কেউ কেউ বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে বস্তুবাদী যুক্তিবাদকে মেলাতে চান না। বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে ধর্মীয় আন্দোলনের কোনও সংঘাত দেখতে পান না তাঁরা। তাঁদের মতে বিজ্ঞান কেবল কিছু প্রমাণিত তথ্যের সমাহার। কেউ কেউ জোর করে সেইসব তথ্যকে ধর্মীয় বাণীর সঙ্গে মেলাতে চান। কেউ কেউ আবার প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে ধর্মীয় আচরণের সংঘাত বাধলে স্পষ্ট ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মর বিরোধিতা করতে ভয় পান। সমরবাবুর বিজ্ঞানচেতনার সঙ্গে কিন্তু ধর্মের কোনও সংস্রব ছিল না। বিজ্ঞান-ধর্ম সংঘাতে তাঁর অবস্থান সরাসরিই ছিল বিজ্ঞানের দিকে। স্বভাবভদ্র মানুষটি সারা জীবন নম্র কিন্তু দৃঢ় ভাষায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানবিরোধী এবং/অথবা সাম্প্রদায়িক কাজকর্মের বিরোধিতা করে গেছেন।
তার একটি নমুনা: সমরবাবুর কাছ থেকে ৪ মার্চ ২০১৮ প্রথমে একটি ফোন এবং পরে একটি ই-মেল পাই আমি। গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার-এর সচিব স্বামী সুপর্নানন্দকে পাঠানো ই-মেলটি তিনি আমাকে ফরোয়ার্ড করেন। বঙ্গানুবাদে ই-মেলটি এইরকম:
শ্রদ্ধেয় স্বামী সুপর্ণানন্দ মহারাজ,
সচিব, আরকেএমআইসি, গোলপার্কআমি পূর্বভারতের পাঁচটি বিজ্ঞান সংগ্রহশালার অধ্যক্ষ ছিলাম, যেগুলির সদর দপ্তর ছিল কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেক্নোলজিক্যাল মিউজিয়াম। আপনার প্রতিষ্ঠানের বহু অনুষ্ঠানে আমি যোগ দিয়ে আসছি। স্বামী লোকেশ্বরানন্দ মহারাজ যখন সচিব ছিলেন, সেই সময় আমি আপনার প্রতিষ্ঠানে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। তিনি আমার সেই বক্তৃতার সময় উপস্থিত ছিলেন।
আপনাকে এ চিঠি লেখার উপলক্ষ্য হল গত কালকের (৩ মার্চ) আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর। খবরটি আমার মনকে খুশিতে ভরিয়ে তুলেছে। বেশ কিছুকাল ধরে আমি স্তম্ভিত হয়ে লক্ষ করছিলাম যে আরএসএস এবং বিজেপি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য স্বামী বিবেকানন্দর ছবি নিয়ে মিছিল বার করছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দর ভাবধারা আরএসএস-এর মতাদর্শর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থিত। নানা রঙের তথাকথিত হিন্দু মৌলবাদীরা যে-অসহিষ্ণুতাকে চিরস্থায়ী করে তুলছে, দিল্লির রামকৃষ্ণ মিশন তার প্রতিবাদ করেছে।
আনন্দবাজারে প্রকাশিত সেই খবরটি হয়তো আপনার নজর এড়িয়ে গিয়ে থাকবে, তাই খবরটি আমি উদ্ধৃত করে দিলাম:
গো-রক্ষার তাণ্ডব
গো-রক্ষক বাহিনীর বাহুবল কিংবা জোর করে ধর্মান্তরকরণ হিন্দু ধর্মের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য নয়। বরং হিন্দু ধর্মের বিচ্যুতি। গো-রক্ষার নামে তাণ্ডবের মধ্যে এই মত রামকৃষ্ণ মিশনের দিল্লি শাখার সচিব স্বামী শান্তাত্মানন্দের। স্বামীজী বলেন, “রাজনীতির সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা সেই হিন্দু ধর্মে আস্থা রাখি যে সুপ্রাচীন ধর্ম সহিষ্ণুতা, বহুত্ববাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত।” উনি আরও মন্তব্য করেন, “সন্ত্রাসবাদ আর ইসলামকে এক করে দেখা ঠিক নয়। কারণ ইসলাম কখনোই সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে না।” (আবাপ, ৩ মার্চ ২০১৮)
খবরের কাগজে পড়লাম, আরএসএস-এর অধ্যক্ষ মোহন ভাগবত বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশনে এসেছিলেন। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র থেকে আমি শুনেছি যে মালদায় একটি সভায় রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতি স্বামী আত্মস্থানন্দজি মহারাজ এবং আরএসএস-এর অধ্যক্ষ মোহন ভাগবত একই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের সভাপতি, হিন্দু মতাদর্শ প্রচার করার জন্য আরএসএস-এর অধ্যক্ষ মোহন ভাগবতের প্রশংসা করেন। শুনে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। এ তো গুরুনিন্দার সামিল। এ খবর মিথ্যা হলে আমি খুশি হব।
আমার খুব আনন্দ হবে, যদি আপনার প্রতিষ্ঠান অবিলম্বে (দিল্লি শাখার অনুরূপ) একটি বিবৃতি প্রচার করে।
আন্তরিক শ্রদ্ধা সহ,
সমর বাগচিছিয়াশি বছর বয়স্ক এক তরুণ, যে জীবনের মধ্যে মগ্ন হয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায়: “বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়/অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ।
এই ই-মেলের কোনও উত্তর সমরবাবু পেয়েছিলেন বলে শুনিনি। একজন বিজ্ঞান-সচেতন মানবাধিকারবাদীর উন্নত চেতনার নির্ভীক প্রকাশ হিসেবে এই চিঠিখানি আমাদের নতুন করে স্মরণ করা উচিত। মনে রাখা উচিত, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই মানুষটি হিন্দুত্ববাদী হিংস্র অমানবিকতার ‘কুৎসিত বীভৎসা ’পরে ধিক্কার’ হেনে গেছেন। যারা এই অমানবিকতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগী তাদের প্রতি ছিল তাঁর ঘৃণা।
এক সময় ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগ থাকলেও বহুকাল তিনি কোনও পার্টির সঙ্গে আলাদা করে ঘনিষ্ঠতা রাখতেন না। কিন্তু যাঁরাই যেখানে যখন, যে-মতাদর্শ থেকেই হোক, বস্তুবাদী যুক্তিবাদী বিজ্ঞান-আন্দোলনে নেমেছেন, তাঁদের প্রতিই দলমত-নির্বিশেষে সমর্থন ছিল সমরবাবুর। বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামের অধিকর্তা থাকার সময় কতভাবে কত বিজ্ঞানকর্মীকে যে সাহায্য করে গেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। সেখানে তাঁর বিচার্য বিষয় ছিল দুটো— বিজ্ঞানটা বিজ্ঞানের মতো করে পরিবেশিত হচ্ছে কিনা, আর বিজ্ঞানকে সমাজবিচ্ছিন্ন হস্তিদন্ত-মিনারের জিনিস বলে চিত্রিত করা হচ্ছে কিনা।
আবার একই সঙ্গে কৃষিজীবী মানুষের যে-যুগসঞ্চিত জ্ঞান ও তথ্য, তা রক্ষা করার জন্য, তাকে যথাযথ মূল্য দেওয়ার জন্য সদাসক্রিয় ছিল তাঁর মস্তিষ্ক আর হৃদয়। অগ্রসর জিন-প্রযুক্তির নামে, প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানের নামে, সেই অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডার ধ্বংস করার বিরুদ্ধে তিনি সতত সরব ছিলেন।
শেষ কয়েক দশক ধরে তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন সারা ভারতের বিজ্ঞান ও প্রতিবেশ আন্দোললনের এক ‘নোডাল পয়েন্ট’। যেখানেই অরণ্যবিনাশ ঘটছে, কিংবা মূলবাসীদের অধিকার পদদলিত হচ্ছে, তার খবর ও সেই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তাঁর মারফত পৌঁছে যেত আপামর মানুষের কাছে। ব্যক্তিগতভাবে, ফোনে, ই-মেলে যেভাবেই হোক, তিনি মানুষকে অবহিত রাখতেন, সনির্বন্ধ আবেদন করতেন এই সর্বনাশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। শুধু ভারতের নয়, সারা বিশ্বের প্রতিবেশ-রক্ষা আন্দোলনের খবরাখবর আসত তাঁর কাছে, আসামাত্র তিনি সেগুলিকে সযত্নে প্রচার করে দিতেন মানুষের কাছে, গড়ে তুলতে চাইতেন বিশ্বজনীন এক প্রতিবেশ-আত্মীয়তা।
সাহিত্যে, সঙ্গীতে যথেষ্ট রুচি ছিল তাঁর। কবিতাকে নানাভাবে কাজে লাগাতেন তিনি এই প্রচারে। রবীন্দ্রনাথ তো ছেড়েই দিলাম, আইরিশ কবি ইয়েট্স-এর কবিতার একটি পঙ্ক্তি তো তাঁর কাছে ধ্রুবমন্ত্রের মতো হয়ে উঠেছিল: Things fall apart; the centre cannot hold; হ্যামলেট নাটকের The world is out of joint-ও তাঁর একটি প্রিয়, বহু-উদ্ধৃত পঙ্ক্তি।
এইভাবে যেন আপনা থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন মানবাধিকার আন্দোলনেরও সক্রিয় প্রবক্তা। বিজ্ঞান, সেকিউলারিজম, প্রতিবেশ আন্দোলন আর মানবাধিকারকে যে-মানুষটি একসূত্রে গাঁথতে চেয়েছিলেন তাঁকে জানাই অকুণ্ঠ প্রণাম।