অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যে, কোনও কোনও কেন্দ্রে, রাজ্য প্রশাসনেরই আমলাদের যদি ব্যবহার করা হয় – আর সেই সমস্ত কেন্দ্রগুলিতেই যদি ভোট-জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে, তদুপরি, প্রদত্ত ভোট ও প্রাপ্ত ভোটের হিসেবে যদি সেই কেন্দ্রগুলিতেই বিপুল শতাংশে গরমিলেরও হিসেব পরিলক্ষিত হয়, আর তারই হিসেবে সেই কেন্দ্রগুলিতেই যদি ক্ষমতাসীন দলেরই জয় নিশ্চিত বলে গণনাতে উঠে আসে - তাহলে কি সেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক?
শোনা যায় জোসেফ স্তালিন নাকি একান্তে মন্তব্য করেছিলেন, “কে ভোট দিল বা না দিল, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে ভোট কে গুনল, আর কেমনভাবে গুনল।” [সূত্রঃ বরিস বাঝানভ, ‘দ্য মেমোয়্যার্স অব স্তালিনস ফর্মার সেক্রেটারি’, ১৯৯২]
এই উক্তির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু ২০২৪-এর ভোট যতই এগিয়ে আসছে, ততই সেই নির্বাচনের নিরাপত্তা নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী চলতি সপ্তাহেই ইভিএম হ্যাক করা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যদিও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বা প্রযুক্তিগত দিক থেকে এখনও যে বৈদ্যূতিন ভোটযন্ত্রের ভিতরকার কলাকৌশলকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, তা প্রমাণিত নয়। ঠিক একই সময়ে দিল্লির অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সব্যসাচী দাসের এই সংক্রান্ত এক গবেষণায় দেশজুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছে। অধ্যাপক দাসের বক্তব্য অনুসারে ২০১৯ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি বা নরেন্দ্র মোদি সরকারের যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসা, সেই নির্বাচনের একাধিক কেন্দ্রে ভোট-জালিয়াতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। যদিও, তিনি কিন্তু ইভিএম অথবা কোনও প্রযুক্তিগত দিক থেকে ভোটযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রসঙ্গ তোলেননি। অধ্যাপক দাসের যে গবেষণা, তা সম্পূর্ণভাবে মনে পড়িয়েছে স্তালিনের সেই সম্ভাব্য উক্তিকেই। এখানে ভোট-জালিয়াতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন– সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির প্রতিক্রিয়াতেও অস্বস্তির প্রমাণ মিলেছে। তার চেয়েও বড় বিষয় হল, অধ্যাপক দাসের বক্তব্য অনুসারে ২০১৯-এর এই ভোট-জালিয়াতির নীল নকশা কিন্তু সাজানো শুরু হয়েছিল আরও অনেক আগেই। তাঁর গবেষণায় সেই তথ্যও উঠে এসেছে।
পূর্ণাঙ্গ গবেষণাটির বিষয়ে আলোচনার পরিসর এখানে নেই। তদুপরি, গবেষণাপত্রটিকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে, রাশিবিজ্ঞান অথবা সংখ্যাতত্ত্বের জটিলতর পরিভাষায় ব্যুৎপত্তির প্রয়োজন। সেই পথে না হাঁটতে চেয়ে, আমরা বরং সহজ অনুবাদ ও ফলাফল বিশ্লেষণের দিকেই নজর রাখতে চেষ্টা করি।
গবেষণার প্রধান ফলাফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে, লোকসভা কেন্দ্রগুলির মধ্যে যে সমস্ত কেন্দ্রে বিজেপির হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মুখে পড়ার সম্ভাবনা ছিল, সেগুলির মধ্যে অধিকাংশতেই ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্যরা জয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। কেউ কেউ বলতে পারেন এর পিছনে ভোট-জালিয়াতির অঙ্ক রয়েছে, এমন সিদ্ধান্তে কেমনভাবে পৌঁছানো গেল? তথ্য বলছে, অধ্যাপক দাস বিগত একাধিক লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের এমন কেন্দ্রগুলিতে incumbent অথবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এমন বিপুল সংখ্যাতে জিতে আসা, ২০১৯-এর নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে রীতিমতো অস্বাভাবিক। অর্থাৎ কিনা, সংখ্যাতত্ত্বের পরিভাষায় যাকে outlier বলা হয়, ২০১৯-এর নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কেন্দ্রগুলিতে ক্ষমতাসীন বিজেপির এমন বিপুল সংখ্যাতে জিতে আসা সেই outlier-এরই বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছে। এই outlier-এর সংজ্ঞা নিরূপণের ক্ষেত্রে একটি সহজ উদাহরণ দিয়ে রাখা ভালো। ধরা যাক, ভারতীয় জনতার গড় আয় নির্ণয় করতে গিয়ে আমরা যদি কয়েকটি নির্দিষ্ট পরিসংখ্যানকে বেছে নিই, যেমন– আমরা পুরুলিয়ার প্রান্তিক চাষিদের চারজনকে বেছে নিলাম, আর বেছে নিলাম মুকেশ আম্বানি অথবা গৌতম আদানির মতো একজন শিল্পপতিকে। তারপর তাদের বার্ষিক আয় যোগ করে, পাঁচ দিয়ে সেই সংখ্যাকে ভাগ করে যা পাওয়া গেল, আমরা দাবি করলাম সেটিই ভারতীয় জনতার গড় আয়ের হিসেব। এক্ষেত্রে মুকেশ আম্বানি বা গৌতম আদানির আয়, outlier হিসেবে পরিগণিত হবে। কারণ গড় আয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমরা যে তথ্যবিন্যাস বেছে নিয়েছিলাম তা সুষমের পরিবর্তে উৎকট রকমের এক বিচ্যুত তথ্যের হিসেব দিয়েছিল। একইরকমভাবে, এত বছর ধরে চলে আসা ভারতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক যে গতিপ্রকৃতি দেখা যায়, ২০১৯-এর নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কেন্দ্রগুলিতে incumbent অথবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এমন বিপুল সংখ্যাতে জিতে আসা – তেমনই এক উৎকট বিচ্যুতিরই লক্ষণ দেখিয়েছে।
এই বিচ্যুতিতেই যে ফলাফল অথবা গবেষণা শেষ হয়ে গেল এমনটা নয়। দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-এর নির্বাচনে এমন কেন্দ্রগুলিতে মোট প্রদত্ত ভোটের সংখ্যার হিসেবেও ব্যাপক গরমিল পাওয়া গিয়েছে। এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অধ্যাপক দাস দুইটি ভিন্ন তথ্যবিন্যাস বা dataset নিয়ে কাজ করেছেন। প্রথমে তিনি নিয়েছেন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তরফে দাখিল করা প্রদত্ত ভোটের হিসেব। এরই সঙ্গে তিনি মিলিয়েছেন, গণনার সময় ভোটযন্ত্র থেকে গুণতি হওয়া, সমস্ত দলেরই মোট প্রাপ্ত ভোটের হিসেব। দেখা গিয়েছে, একাধিক কেন্দ্রে এই দুইটি সংখ্যার ভিতরে বিস্তর ফারাক পাওয়া গিয়েছে। ২০১৯-এর নির্বাচনের পরপরই, একাধিক রাজনৈতিক দল ও কিছু সংবাদমাধ্যমের তরফে এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হলে, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন তাদের ওয়েবসাইট থেকে এই সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য সরিয়ে নেয়। কিন্তু নিজের গবেষণাপত্রে অধ্যাপক দাস আগে থাকতেই নামিয়ে রাখা এই সমস্ত তথ্যের পূর্ণাঙ্গ হিসেব তুলে ধরেছেন। তিনি আরও দেখিয়েছেন, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের যে সমস্ত কেন্দ্রে নির্বাচন কমিশনের তরফে দাখিল করা প্রদত্ত ভোটের হিসেবের সঙ্গে, গণনার সময়ে সমস্ত প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের মিলিত সংখ্যার– যত বেশি পরিমাণে গরমিল পাওয়া গিয়েছে, সেই সমস্ত কেন্দ্রগুলিতে ক্ষমতাসীন বিজেপির জয়ের ব্যবধানও প্রায় সমানুপাতিক হারে বেড়ে গিয়েছে। কোন জাদুবলে এই আশ্চর্য গাণিতিক রেখাচিত্রের হিসেব ভোটবাক্সের গায়ে এসে পড়ল, সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির তরফে এই বিষয়টিকে খোলসা করা উচিত।
এখানেও শেষ নয়। অধ্যাপক দাসের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের যে সমস্ত কেন্দ্রে এমন বিপুল পরিমাণে গরমিলের তথ্য উঠে এসেছে, প্রধানত সেই কেন্দ্রগুলি কেবল যে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে অবস্থিত তাই নয়– তাদের ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রেও মূলত কেন্দ্রীয় আইএএস অফিসারদের বিপরীতে, রাজ্য প্রশাসনের আমলাদের উপরেই ভরসা রাখা হয়েছিল। ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যে, কোনও কোনও কেন্দ্রে, রাজ্য প্রশাসনেরই আমলাদের যদি ব্যবহার করা হয় – আর সেই সমস্ত কেন্দ্রগুলিতেই যদি ভোট-জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে, তদুপরি, প্রদত্ত ভোট ও প্রাপ্ত ভোটের হিসেবে যদি সেই কেন্দ্রগুলিতেই বিপুল শতাংশে গরমিলেরও হিসেব পরিলক্ষিত হয়, আর তারই হিসেবে সেই কেন্দ্রগুলিতেই সব ক্ষেত্রেই যদি ক্ষমতাসীন দলেরই জয় নিশ্চিত বলে গণনাতে উঠে আসে – তাহলে কি সেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক? পাঠকের হাতেই বিচারের ভার দিলাম।
সবশেষে, নৈবেদ্যের উপরে সাজানো চূড়ো সন্দেশের মতোই, অধ্যাপক দাস দেখিয়েছেন ২০১৪ থেকে ২০১৯-এর নিরিখে এই কেন্দ্রগুলিতেই ভোটার তালিকায় যথেষ্ট সংখ্যক নাম অত্যন্ত সন্দেহজনক হারে বাদ দেওয়া হয়েছে – এবং, সেই নামের অধিকাংশই সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটার, বিজেপি অথবা আরএসএস-এর বিষয়ে যাদের কী অবস্থান, তা বোধহয় আর আলাদা করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
এবারে আসা যাক এই গবেষণার নিরিখে প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে। অধ্যাপক দাস যে ঘরে-বাইরে সমস্ত জায়গাতেই বিজেপি ও আরএসএসের লাগাতার আক্রমণের মুখে পড়েছেন সে আর কোনও নতুন বিষয় নয়। তদুপরি, অশোকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবধি এই বিষয়ে অধ্যাপক দাসের গবেষণার বিষয়টিকে নিজস্ব ও ব্যক্তিগত বিষয় বলে দায়িত্ব এড়িয়েছেন। উলটে তাঁরা মন্তব্য করেছেন, ব্যক্তিগত বা এমন রাজনৈতিক গবেষণার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সচরাচর উৎসাহ বা সম্মতি প্রদান করে না। গবেষণার স্বাধীনতার প্রশ্নে তারা মন্তব্য এড়িয়েছেন। একথা সত্যি যে, লোকসভার বিপুল সংখ্যক আসনের প্রতিটিকেই অধ্যাপক দাস তাঁর গবেষণার আওতায় আনেননি। কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে এমন যে বিশেষ কেন্দ্রগুলিকে নিয়ে তিনি তাঁর দীর্ঘ বিশ্লেষণ সাজিয়েছেন, রাশিবিজ্ঞান ও সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবই বলছে– তেমন জালিয়াতি প্রত্যেক কেন্দ্রেই করা সম্ভব। এর পিছনে বিরাট কোনও প্রযুক্তি লুকিয়ে নেই। কেবল রয়েছে মানুষেরই হাতের কাজ, প্রশাসনিক পক্ষপাতিত্ব আর সাদা অঙ্কের হিসেব। কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর তাই স্বভাবতই অধ্যাপক দাসের এই গবেষণাকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুসারে, নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্ট সমস্ত দপ্তরের যদি অধ্যাপক দাসের এই গবেষণা ভ্রান্তিপূর্ণ বলে মনে হয়, তাদের উচিত এর বিরুদ্ধে সমস্ত যথাযথ তথ্য অবিলম্বে জনতার দরবারে হাজির করা। নচেৎ ভারতীয় গণতন্ত্রের বিষয়ে ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার বিষয়েও বিরাট এক আশঙ্কার অবকাশ রয়েছে। আমরা যথেষ্ট চিন্তিত, কোন পথে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’র ভবিষ্যৎ?