কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়
তাঁর শক্তিশালী ন্যারেটিভের মধ্যে দিয়ে কুন্দেরা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে অতীত শুধুমাত্র একটি নিশ্চল পরিসর নয়, বরং একটি সদাবিদ্যমান শক্তি যা আমাদের বর্তমান জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে
কালের এই অন্তহীন যাত্রায় সমাজ প্রায়ই এক অদ্ভুত প্রপঞ্চময়তায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে যাকে আমরা ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি— যা হল অতীতের কোনও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, মানুষ ও শিক্ষার ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত বিস্মরণ। এই কপট অবস্থার পরিণতি হতে পারে খুব গুরুতর, যা আমাদের বর্তমানের উপলব্ধিকে অস্পষ্ট করে দেয় অথবা ভবিষ্যৎ উন্নততর করে তোলার ক্ষমতাকে প্রতিহত করে। বিখ্যাত চেক-ফরাসি লেখক মিলান কুন্দেরা এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি এই ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির বিপদকে তাঁর লেখায় প্রকটভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে কুন্দেরা আমাদের সমষ্টিগত অতীতের অপচ্ছায়ার মুখোমুখি হওয়ার চ্যালেঞ্জ জানান, উৎসাহিত করেন আমাদের ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণে এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায়। এই প্রবন্ধে আমরা ধরার চেষ্টা করব ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির বিপদের দিকটিকে এবং বোঝার চেষ্টা করব কীভাবে কুন্দেরা তাঁর লেখায় এর মর্মার্থকে ফুটিয়ে তুলেছেন, তাড়িত করেছেন আমাদের যৌথ ইতিহাসের জ্ঞানকে পুনরুদ্ধার করতে।
ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির বিপদ
ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তি বিভিন্ন রূপে উদ্ভূত হতে পারে— যেমন, সময়ের ব্যবধানের কারণে সমষ্টিগত বিস্মরণ অথবা ক্ষমতাসীন শক্তির নিপুণভাবে তৈরি করা কোনও ন্যারেটিভের দ্বারা ইচ্ছাকৃত বিস্মরণ। এই দুর্বিপাকের প্রভাব বহুমুখী যার মধ্যে সবচেয়ে সুষ্পষ্ট হল আমাদের শেকড় থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া যা আমাদের পরিচয় ও অধিকারের ধারণাকে দুর্বল করে তোলে। ঐতিহাসিক নৃশংসতা, বিজয় এবং সংঘর্ষের স্মৃতিকে অবহেলা করে আমরা আমাদের সমাজের বৈচিত্র্যবিষয়ক বোধকে বিকৃত করে ফেলি যার ফলে অতীতের ভুল পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির একটি বিপজ্জনক উদাহরণ হল যুদ্ধের বীভৎসতাকে ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা জাতি তাদের সামরিক অতীতকে নিয়ে ভাবপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে এবং তাকে শোধন করে ফেলতে পারে যাতে যুদ্ধকে একটা বীরগাথার আলোয় দেখানো যায়, ঢেকে ফেলা যায় তার দ্বারা সৃষ্ট অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশাকে। এই ঘটনাগুলিকে মুছে ফেলার মধ্যে দিয়ে আমরা সংঘাতকে মহিমান্বিত করা এবং সমসাময়িক ঘটনার কূটনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের গুরুত্বকে অগ্রাহ্য করার মতো বিপদ ডেকে আনি।
শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তি পারে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজনকে ত্বরান্বিত করতে। যেসব লড়াই অতীতে তাদের সংঘবদ্ধ করেছিল, তা সমাজ যখন ভুলে যায় তখন মানুষ এই যৌথ মূল্যবোধ বা উদ্দেশ্যের বোধ হারিয়ে ফেলে। এই বিভাজনের ফলে বিভেদকারী শক্তিরা আরও বেশি করে সুযোগ পেয়ে যায় যাতে তারা এই ঐতিহাসিক অজ্ঞানতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মধ্যে বিরোধের বীজ বপন করে নিজেদের উদ্দেশ্যে সাধন করতে পারে।
মিলান কুন্দেরা: ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির একটি বিরুদ্ধ স্বর
সমসাময়িক সাহিত্যের অগ্রভাগে মিলান কুন্দেরা ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রবক্তা। ১৯২৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন কুন্দেরা। স্বৈরাচারী শাসনকাল অর্থাৎ নাৎসি আগ্রাসন ও তৎপরবর্তী সাম্যবাদী শাসনের প্রভাব তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে। এই অভিজ্ঞতা তাঁর লেখাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, বাধ্য করেছিল মানুষের চারিত্রিক জটিলতা এবং ব্যক্তিজীবনে ইতিহাসের গুরুত্ব অন্বেষণে। তাঁর অন্যতম উপন্যাস ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’-এ কুন্দেরা কয়েকটি অন্তঃসম্পর্কযুক্ত গল্পের ট্যাপেস্ট্রি রচনা করে স্মৃতি, পরিচয় ও কৌশলগতভাবে নিয়ন্ত্রিত ইতিহাসের গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করেছেন। তাঁর চরিত্রের মধ্যে দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সত্যকে চেপে রাখা ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইতিহাসের বিকৃতকরণ আমাদের বিপদ ডেকে আনতে পারে।
কুন্দেরার উপন্যাস ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’ প্রাগ স্প্রিং ও তার পরবর্তী সময়ের পেক্ষাপটে ভালবাসা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার জটিলতা নিয়ে কাটাছেঁড়া করে। তাঁর চরিত্রগুলোকে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের আবহে স্থাপন করে কুন্দেরা এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেন যে কোনও ব্যক্তিমানুষ আসলে এক বৃহত্তর ঐতিহাসিক ট্যাপেস্ট্রির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত, এবং তাদের ক্রিয়া সময়ের মধ্যে দিয়ে অনুরণিত হয়।
ইতিহাসের শিক্ষাকে গ্রহণ করা
মিলান কুন্দেরার লেখা আমাদের তীক্ষ্ণভাবে মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের শিক্ষাকে গ্রহণ করার গুরুত্ব। অতীত শুধুমাত্র কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রবাহ নয়, বরং তা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অভিজ্ঞতায় তৈরি হওয়া একটা জাল যা আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে চালনা করে। যখন আমরা ইতিহাসকে স্বীকার করে তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি, তখন আমরা একটা সহানুভূতিময়, ন্যায়পরায়ণ ও যথার্থ সমাজ গড়ে তোলার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠি।
ইতিহাসবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল অতীতের অন্ধকার অধ্যায়গুলিকে মোকাবিলা করা। সে গণহত্যা হোক, ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসন হোক বা সিস্টেমিক অন্যায়, অতীতের এইসব বিভীষিকাকে স্বীকার বা তার থেকে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা নিরাময় ও সমন্বয়সাধনের পথে হাঁটতে পারি। সেগুলো কখনও ঘটেইনি এমন ভাণ করা বা তাদের তাৎপর্যকে অগ্রাহ্য করা ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির পথকে প্রশস্ত করে এবং যেসব মানুষ সরাসরি এই ঘটনাপ্রবাহের শিকার বা তাদের বংশধরদের ন্যায়প্রাপ্তিকে অস্বীকার করে।
সেইসঙ্গে, ইতিহাসের বোধ আমাদের এমন কিছু ছক বা প্রবণতা সম্পর্কে অবগত করে যা সময়ের সঙ্গে ফিরে ফিরে আসে। এইসব পুনরাবৃত্তিকে উপলব্ধি করে আমরা ভবিষ্যতের কোনও ক্ষতির সম্ভাবনাকে অনুধাবন করতে পারি এবং তাকে রোধ করার জন্য যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হই।
ইতিহাসের ঐতিহ্য সংরক্ষণ
মিলান কুন্দেরার লেখা ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির শক্তিশালী প্রতিব্যবস্থা হিসেবে ইতিহাসের ঐতিহ্য সংরক্ষণের উপরে জোর দেয়। স্থাপত্য বা শিল্পকর্মের মতো স্পর্শনীয় বস্তুই যে কেবলমাত্র এই ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত তা নয়, এছাড়াও ভাষা, প্রথা, সমষ্টিগত স্মৃতি ইত্যাদি স্পর্শনাতীত বিষয়গুলিও এর মধ্যে পড়ে। যদি আমরা ইতিহাসের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে পারি, তাহলে এটা নিশ্চিত করতে পারব যে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের শেকড়ের সঙ্গে জুড়ে থাকবে এবং পূর্বপুরুষদের লড়াই ও কৃতিত্বের বিষয়গুলি সম্পর্কে তাদের একটা বোধ তৈরি হবে। এই ধারাবাহিকতার ধারণা তাদের বৈচিত্র্যকে মর্যাদা দিতে আরও গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করবে এবং আমাদের সমষ্টিগত পরিচয় তাতে আরও সমৃদ্ধ হবে।
উপসংহার
এই দ্রুত বিশ্বায়ন ও ব্যাপক তথ্যপ্রবাহের যুগে যত দিন যাচ্ছে তত ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির কাছে বশ্যতা স্বীকার করা সহজাত হয়ে উঠছে। সেখানে, মিলান কুন্দেরার লেখা যেন জ্ঞানালোকের দিকে আমাদের আহ্বান জানানোর ভূমিকা পালন করে, বিস্মরণকে প্রতিহত করে ইতিহাসের সুস্থায়ী তাৎপর্য গ্রহণে আমাদের তাড়িত করে।
তাঁর শক্তিশালী ন্যারেটিভের মধ্যে দিয়ে কুন্দেরা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে অতীত শুধুমাত্র একটি নিশ্চল পরিসর নয়, বরং একটি সদাবিদ্যমান শক্তি যা আমাদের বর্তমান জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে। ঐতিহাসিক স্মৃতিবিলুপ্তির মোকাবিলা করে এবং ইতিহাসের ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন যুগের জ্ঞানজাত শক্তি আহরণ করতে পারি যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি ন্যায়নিষ্ঠ ও সহানুভূতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ইতিহাসের জ্ঞানকে সমাদর জানানো কোনও বোঝা নয়, বরং তা একটি বিশেষ ক্ষমতা যা সকলের জন্য একটি উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ গড়ার শক্তিতে আমাদের বলীয়ান করে তুলবে। আমাদের উচিত কুন্দেরার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করা আর তখনই আমরা নিজেদের যথাযথভাবে বুঝতে পারব এবং আমাদের এই যৌথ মানবতার জটিলতার অন্বেষণ করতে পারব।
*ইংরেজি ভাষায় লিখিত মূল লেখাটিকে পত্রিকার জন্য অনুবাদ করে দিলেন সোমরাজ ব্যানার্জি
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখা। কল্পর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায় কুন্দেরার দীর্ঘকালীন মর্মভেদী পাঠক। মূল ইংরিজি লেখাটি পড়িনি তবে সোমরাজ ব্যানার্জির এই বঙ্গানুবাদটি অত্যন্ত সাবলীল। কুন্দেরা সংখ্যায় এটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সম্পাদক অভীক ভট্টাচার্যকে ধন্যবাদ।
মিলান কুন্দেরার একদা পরিত্যক্ত মাতৃভূমি থেকে এই ত্রয়ীকে অভিনন্দন জানাই।