মণিপুরে বিভাজনের রাজনীতির পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে

প্রদীপ দত্ত

 


বর্তমান জাতিগত-সাম্প্রদায়িক হিংসা অতীতের সংঘর্ষের চেয়ে আলাদা। কুকিদের বিরুদ্ধে নাগাদের উসকানো হয়েছে। নাগা ও কুকিরা সম্মিলিতভাবে মেইতেইদের আদিবাসী স্টেটাস দেওয়ার বিরোধিতা করলেও আক্রমণ করা হচ্ছে শুধু কুকিদের। মণিপুরে সংঘর্ষে এই প্রথম সাম্প্রদায়িক রং লাগাতে ধর্মীয় স্থান আক্রমণ করা হয়েছে। সব ঘটনা পরপর সাজালে বোঝা যায় এই সংঘর্ষ সুপরিকল্পিত, তার জন্য টাকাও ঢালা হয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মানুষের মধ্যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি নিয়ে খেলছে। এটাই সংঘর্ষের কারণ এবং তা মেটানো মোটেই সহজ নয়। অথচ কুকি ও মেইতেইরা এক সঙ্গেই থাকত এমনকি পাহাড়েও

 

চিরকাল মণিপুরকে বলা হয় দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাজ্য। সেখানকার পরিস্থিতি বরাবরই অস্থির। নানা সময়ে সেখানে নাগাদের সঙ্গে কুকিদের, মেইতেই হিন্দুদের সঙ্গে মেইতেই মুসলমানদের, তামিলদের সঙ্গে অন্যদের— নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকে। তবে এবারের মণিপুর হিংসা শুধু গুরুতর মানবিক সঙ্কটই নয়, দেশের পক্ষেও রীতিমত লজ্জার বিষয়।

অথচ এই ভয়ঙ্কর অবস্থাকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যেমন অবজ্ঞা করেছেন, তেমনি করেছে দিল্লিভিত্তিক বড় টেলিভিশন মিডিয়া। তবে আড়াই মাস আগে (৪ মে) কাঙ্কোপকি অঞ্চলে একই গ্রামের এক যুবতী ও এক মধ্যবয়স্কা প্রাক্তন সামরিক কর্মীর স্ত্রীকে তুলে এনে বিবস্ত্র করে হাঁটানো এবং তাদের ঘিরে জনতার উল্লাস এবং যৌন নিপীড়নের দৃশ্যের ভিডিও ১৯ জুলাই সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশ হওয়ার পর গোটা দেশের সংবাদমাধ্যম এবং লোকসভায় তা নিয়ে হইহই বেধেছে। একই দিনে একই গ্রামের ২১ ও ২৪ বছরের দুই যুবতীকে তুলে এনে গণধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে। আড়াই মাস আগে ঘটা ওইসব ঘটনার কথা জেনে দেশের অনেকেই কেঁপে উঠেছে। একটি ভিডিওই প্রকাশ হয়েছে, তবে ওইরকম ঘটনার সংখ্যা অসংখ্য। মুখ্যমন্ত্রীও সেকথাই বলেছেন।

এর আগে, মণিপুরের রাজ্যপাল অনসূয়া উইকে ১৩ জুলাই বলেছিলেন, আমি জানতে পেরেছি রাজ্যে সংঘর্ষের পিছনে বহিরাগতদের হাত রয়েছে। সেরকম অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মায়ানমার থেকেও লোক এসে রাজ্যে ঝামেলা বাধাচ্ছে, তাদের ধরে নিজের দেশে ফেরত পাঠাতে হবে। শুধু রাজ্যপালই নন, মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং কুকি জাতিগোষ্ঠীর জঙ্গি গোষ্ঠীর উপর বর্তমান হিংসার দায় চাপিয়েছেন। মে মাস থেকেই তিনি ওই কাজ করে চলেছেন। দিল্লিতে তখন কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ চলছে, অলিম্পিকজয়ী বক্সার মেরি কম শুকনো গলায় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে আবেদন করে চলেছেন, আমার মণিপুরকে বাঁচান! আবেদন নয়, সে ছিল আর্তনাদ। যিনি প্রতি মাসে মনের কথা বলেন আর বাকি সময় মৌন হয়ে থাকেন তাঁর কানে সে আওয়াজ পৌঁছয়নি।

জনজাতি যৌথ মঞ্চ রাজ্যপালের বক্তব্যের প্রতিবাদে বলেছে, মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং ও মেইতেইরা কুকিদের বহিরাগত ও জঙ্গি বলে যেভাবে দাগিয়ে দিচ্ছে রাজ্যপাল সেই সুরেই সুর মিলিয়েছেন, এভাবে তিনি সংঘর্ষের রাজনৈতিক কারণকেই অস্বীকার করলেন। মে মাসের শেষে দুই দিনের মণিপুর সফরে গিয়েছিলেন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল অনিল চৌহান। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, মণিপুরের এই বিশেষ পরিস্থিতির সঙ্গে কাউন্টার ইন্সার্জেন্সির কোনও সম্পর্ক নেই, তা মূলত দুটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ এবং আইনশৃঙ্খলার সমস্যা, আমরা রাজ্য সরকারকে সাহায্য করছি।

ওদিকে ২০০৮ সালে ৩টি কুকি সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে (কুকি ন্যাশনাল আর্মি, কুকি রেভলিউশনারি আর্মি এবং জোমি রেভলিউশনারি আর্মি) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ত্রিপাক্ষিক চুক্তি ‘সাসপেন্স অফ অপারেশনস’ (এসওও) স্বাক্ষর করেছিল। সেই সময় জঙ্গিরা তাদের বন্দুক পুলিশের কাছে জমা দেয়।[1] বর্তমান সংঘর্ষ চলাকালীন বীরেন সিং বলেছিলেন, জঙ্গিদের সমর্পিত অস্ত্র যথাযথভাবে মজুত রয়েছে, খোয়া যায়নি।

ইন্ডিজেনাস ট্রাইবাল লিডার্স ফোরাম (আইটিএলএফ) জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে যে, আরামবাই টেঙ্গল গোষ্ঠী কুকি-জো সম্প্রদায়কে আক্রমণ করতে যে বন্দুক ব্যবহার করেছিল সেইরকম একটি বন্দুক পেয়েছে হেংসি গ্রামের হোলজাকাই। বন্দুকটি এসওও স্বাক্ষরের সময় কুকি জঙ্গিদের পুলিশের কাছে জমা দেওয়া বন্দুকেরই একটি। অথচ তাতে খোদাই করে লেখা আছে “আরামবাই টেঙ্গল সেট ২”। তার মানে জঙ্গিদের জমা করা বন্দুক মেইতেইদের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরামবাই টেঙ্গলের হাতে চলে গেছে। পুলিশ ও সরকারের মদত ছাড়া তা হয় না। বিজেপি সরকারের আমলে মণিপুরের হাল-হকিকত এরকমই বিস্ময়কর, গোলমেলে।

 

জ্বলন্ত মণিপুর

ভারতীয় সামরিক বাহিনি থেকে অবসর নেওয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল এল নিশিকান্ত সিংহ ১৭ জুন টুইটারে যে কথা বলেছেন তা থেকে মণিপুরের চূড়ান্ত অসহায় অবস্থা কিছুটা বোঝা যায়। তিনি লিখেছেন: আমি মণিপুরে অবসরজীবন কাটানো স্রেফ এক সাধারণ ভারতীয়। রাজ্যটি এখন রাষ্ট্রহীন। লিবিয়া, লেবানন, নাইজেরিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি দেশের মতো যে-কেউ যে-কোনও সময় জীবন ও সম্পত্তি ধ্বংস করতে পারে। মনে হয় মণিপুরকে যেন নিজের রসের ভাপেই সিদ্ধ করার জন্য ছেড়ে রাখা হয়েছে। কেউ কি শুনছেন?

যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ার সঙ্গে তাঁর মণিপুরের তুলনা টানা রাজ্যটিতে বিশৃঙ্খলার মাত্রা কতটা চূড়ান্ত হতে পারে তাই বোঝায়। ওই টুইটের পর সামরিক বাহিনির প্রাক্তন প্রধান বেদ মালিক লেখেন: মণিপুরের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেলের অসামান্য দুঃখজনক বার্তা। মণিপুরের আইনশৃঙ্খলায় জরুরি ভিত্তিতে সর্বোচ্চ স্তরের নজর দেওয়া দরকার।

মে মাসের ৩ তারিখ থেকেই বহু মানুষ প্রাণ ও ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। বিবিসি জানিয়েছিল, ৪ মে রাতে মণিপুরের পাহাড়ি এলাকা চূড়াচাঁদপুর শহরে ভেনাস হোটেলের সামনে প্রতিবাদী জনজাতীয় মানুষদের উপরে নিরাপত্তা বাহিনি গুলি চালালে দুজন নারী সহ তিনজন মারা যান। আরও অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেনাবাহিনি আর অসম রাইফেলসের সদস্যদের সঙ্গে মানুষের ধস্তাধস্তি হলে সেনা গুলি চালাতে বাধ্য হয়। সেই কারণেই মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। পিটিআই জানিয়েছিল, ১৬টি মৃতদেহ চূড়াচাঁদপুর জেলা হাসপাতালের মর্গে রয়েছে, ১৫টি দেহ আছে ইম্ফলের জওহরলাল নেহরু ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সে। ইম্ফল ওয়েস্ট জেলার রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেও ২৩টি মৃতদেহ রয়েছে।

৪ মে কুকি বিধায়ক ভাঞ্জাগিন ভল্টে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসার সময় ক্ষিপ্ত জনতার আক্রমণে আহত হলে সঙ্কটজনক অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তবে তাঁর ড্রাইভার থাঙ্ঘৌলাল বাঁচেননি, তাঁকে এমনভাবে মারা হয়েছিল যে মুখ একেবারে বিকৃত হয়ে যায়।

৮ মে পশ্চিম ইম্ফলের বিজেপির বিধায়ক সোরাইসাম কেবির বাড়িতে মোটরসাইকেল থেকে বোমা ছোঁড়া হয়। জুন মাসের মাঝামাঝি পূর্ব ইম্ফল জেলা থোংজুতে কয়েকশো জনতা বিজেপি বিধায়ক থোংজাম বিশ্বজিৎ সিং-এর বাড়িতে আগুন লাগানোর চেষ্টা করে। র‍্যাফ বাহিনি তা রুখে দেয়। জনতা ওই জেলার সিঙ্গাজামেই অঞ্চলে বিজেপির দপ্তর এবং এক বিজেপি নেতার বাড়িতে ভাংচুর চালাতে গেলে নিরাপত্তা বাহিনি তা প্রতিহত করে।

কেন্দ্রীয় বিদেশ প্রতিমন্ত্রী রাজকুমার রঞ্জন সিংহের বাড়িতে তিনবার আক্রমণ করা হয়। ২৫ মে তিনি যখন তাঁর পরিবারের সঙ্গে ইম্ফলের বাড়িতে ছিলেন সেই সময় একবার। তারপর ১৫ জুন যখন বাড়িতে ছিলেন না, তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, বাড়িপাহারায় নিরাপত্তাকর্মী সহ মোট বাইশজন উপস্থিত থাকার পরও। তিনি জানিয়েছেন, দুষ্কৃতিরা পেট্রল বোমা নিয়ে এসেছিল, বাড়ির নিচতলা ও দোতলার ক্ষতি হয়েছে। বলেন, আমাকে মেরে ফেলতেই আক্রমণ করা হয়েছিল। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার সার্বিক ব্যার্থতার কথাও বলেন। তারপর ২৪ জুলাই তৃতীয়বার। সেদিন তাঁর বাড়ির সামনে মহিলাদের বিক্ষোভ মিছিল চলছিল। অনেকে ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়িতে পাথর ছুড়তে শুরু করে।

শুধু রাজ্য বিজেপির নেতারাই নন, উঁচু প্রসাশনিক পদের মানুষও আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন। ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ (ডিজিপি) পি ডৌঙ্গেল, অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ (এডিজিপি) ক্লে খোংসাইয়ের বাড়িও উচ্ছৃঙ্খল জনতা আক্রমণ করেছে। কুকি সরকারি চাকুরেরা উন্মত্ত জনতার হাত থেকে এবং অফিস-আদালতে দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক অবিশ্বাসের দমচাপা পরিবেশ থেকে বাঁচতে ইম্ফল ছেড়ে পাহাড়ে চলে গেছেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, আট দিনের তফাতে বিএসএফ-এর দুই জওয়ানকে গুলি করে মারা হয়েছে। ২৯ মে মোঢ়েতে নরেন্দ্র কুমার এবং ৬ জুন সেরৌ-এ রঞ্জিত যাদবকে। বাহিনি জানিয়েছে, কুমারের গুলি লেগেছিল মাথায়, যাদবের গলায়। একটি করে গুলিতেই দুজনে মারা গেছেন। গুলি করা হয়েছে অনেক দূর থেকে, এতটা দূর যা সহজে চোখে পড়বে না। দুটি ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে উপযুক্ত রাইফেল (একে-৪৭ নয়)। গুলি যারা করেছে তারা রাইফেল চালানোয় দক্ষ এবং দক্ষতা অল্পদিনে অর্জিত নয়। মণিপুরের মানুষের হাতে এখন এত বেশি অস্ত্র রয়েছে যা কাশ্মিরের চেয়ে বহুগুণ বেশি।

২৫ জুন মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষের হালহকিকত জানাতে এসেছিলেন। দেখা করার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেইতেই প্রতিমন্ত্রী রাজকুমার রঞ্জন সিংহ এবং রাজ্যের মন্ত্রী সুসিন্দ্র মেইতেইয়ের বাড়িতে আগুন ধরানো, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস ও নিরাপত্তা বাহিনির চলাচলে বাধা সৃষ্টি করার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। বীরেন শাহকে বলেছেন, রাজ্যের অবস্থা খুবই বিশৃঙ্খল, কী যে ঘটছে তা তিনি জানেন না।

কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা নাজেহাল করে ছাড়ছে। মেইতেই জনতা অসম রাইফেলসের কনভয়কে এক সপ্তাহের বেশি অবরোধ করে রেখেছিল। তাদের খাবারের রেশন পর্যন্ত শেষ হয়ে গিয়েছিল। আধা সামরিক বাহিনি হলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ করে ভারতীয় সেনা। ভারত সরকার মণিপুরের প্রশাসনের দখল নিলেও কেন্দ্রিয় মন্ত্রীর বাড়ি পোড়ানো এবং বাহিনিকে অবরোধ প্রমাণ করে দেশের সরকার মণিপুরের মানুষকে বাঁচাতে এবং নিজেকে রক্ষা করতে হিমসিম খাচ্ছে।

১৩ জুন ড্রোনের নজরদারি এবং গোপন খবরের ভিত্তিতে সেনাবাহিনি পূর্ব ইম্ফল থেকে নিষিদ্ধ কাংলেই ইয়াওল কানা লুপ গোষ্ঠীর (কেওয়াইকেএল) জঙ্গি সংগঠনের মাথা মৈরাংথেম টাম্বা ওরফে উত্তম সহ ১২ জন মেইতেই জঙ্গিকে হাতে পেয়েছিল। ইম্ফল উপত্যকায় বসে উত্তম বর্তমান সংঘর্ষে জোরদার অংশ নিচ্ছিল। ৮ বছর আগে চান্ডেল জেলায় ওই জঙ্গি গোষ্ঠীর হানায় ১৮ জন জওয়ান নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু হাজার খানেক একরোখা, বেপরোয়া মহিলা-সহ প্রায় দেড় হাজার জনতা সেনাদের ঘিরে ধরে জঙ্গিদের নিয়ে যেতে বাধা দেয়। সেনাকর্তৃপক্ষ জানায়, ওই অবস্থায় গুলি চালালে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হতে পারত। তাই জঙ্গিদের অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

১২ জন জঙ্গিকে ছেড়ে দেওয়ার দুদিন পরই মণিপুরের সামরিক কর্তৃপক্ষ এক ভিডিও প্রকাশ করে। দেখা গেছে দুটি খোলা ভ্যানে চড়ে প্রচুর মহিলা সহ সশস্ত্র দাঙ্গাকারীরা চলেছে। ভিডিওটির শিরোনাম, ডিমিস্টিফাইং মিথ অফ পিসফুল ব্লকেড লেড বাই উইমেন ইন মণিপুর। ভিডিওয় দেখা গেছে ইথাম অঞ্চলে ভারী যন্ত্র দিয়ে রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে, অসংখ্য মহিলা জায়গাটি ঘিরে বাহিনিকে ঠেকিয়ে রেখেছে। বাহিনি জানিয়েছে, তাদের কাজে বাধা দিয়ে সশস্ত্র দাঙ্গাকারীদের পালিয়ে যেতে মহিলারা যে সাহায্য করছে এই ভিডিও তার প্রমাণ। ভিডিওর দৃশ্যে দেখা গেছে পূর্ব ইম্ফলের খামেনলকের কাছে নানশাং অঞ্চলের রাস্তায় একইরকম অবরোধ চলছে। সেই দিনই (১৩ জুন) উন্মত্ত মেইতেই জনতা খামেনলকের আটটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তারপর কুকিদের পালটা আক্রমণে মেইতেই সম্প্রদায়ের ৯ জনের মৃত্যু হয়।

মেইতেইরা কোনও কুকি গ্রামে আক্রমণ করলে মহিলা বাহিনি বারবার নিরাপত্তা বাহিনি বা সেনাদের ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দেয়নি। সামরিক বাহিনি ও অসম রাইফেলসে আস্থা নেই— এই অজুহাতে মহিলারা উপত্যকার রাস্তায় অবরোধ করার জন্য যেখানে গুলি চলছে, আগুন ধরানো হচ্ছে সেখানে বাহিনি পৌঁছতে পারছে না বা পৌঁছতে অনেক দেরি হচ্ছে। এমনকি বিবস্ত্র হওয়ার হুমকি দিয়ে তাদের ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। এইভাবে বেপরোয়া মহিলারা নিজেদের গোষ্ঠীর স্বার্থে নিরাপত্তা বাহিনিকে দীর্ঘদিন ধরে অকেজো করে রেখেছে।

হিংসা ছড়িয়ে পড়ার প্রথমদিকে নিরাপত্তা বাহিনি পাহাড় থেকে মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষকে নিরাপত্তা দিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেছে। অথচ ইম্ফল উপত্যকায় কুকি উপজাতির তেমন নিরাপত্তা ছিল না, পুলিশও তাদের দেখেনি। কুকিরা দাবি করেছিল, পাহাড় থেকে মেইতেইদের যেমন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, অন্যান্য জনজাতির মানুষকেও ইম্ফল থেকে যেন সেইভাবে সরিয়ে আনা হয়। কিন্তু তা হয়নি। ইম্ফলে মেইতেই আক্রমণে তারা অকাতরে সম্পত্তি ও প্রাণ হারিয়েছে।

 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর, প্রধানমন্ত্রীর মৌনতা

৩ মে হিংসা বা সন্ত্রাস শুরু হওয়ার ২৭ দিন পরে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মণিপুর সফরে এসেছিলেন। ছিলেন ২৯ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত। শাহ মণিপুরে আসার আগে মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পৌঁছনোর আগে রাজ্য পুলিশ কম্বিং অপারেশন করে ৪০ জন কুকি ‘জঙ্গি’-কে মেরেছে। ইন্ডিজিনাস ট্রাইবাল লিডারস ফোরামের (আইটিএলএফ) নেতারা অবশ্য দ্য প্রিন্টকে জানিয়েছেন, মৃতেরা গ্রামবাসী এবং সশস্ত্র গ্রামপ্রহরী— কেউই জঙ্গি ছিলেন না।

শাহ পৌঁছনোর পর রাস্তার ধারে মানুষ মানববন্ধন তৈরি করেছিল। হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে স্লোগান ছিল, “উই ওয়ান্ট সেপারেট অ্যাডমিনিসস্ট্রেশন”, “নো সেপারেট অ্যাডমিনিসস্ট্রেশন নো রেস্ট”, “সেপারেশন ফ্রম মণিপুর আওয়ার ওনলি হোপ ফর সার্ভাইভাল”। শাহ মণিপুরের বিশিষ্ট নাগরিক, সুশীল সমাজ, ছাত্র, মহিলা ও আদিবাসী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে এবং সর্বদলীয় বৈঠকে কীভাবে রাজ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে কথা বলেন। আদিবাসীরা রাষ্ট্রপতি শাসন ও স্বতন্ত্র প্রশাসনের দাবি জানান। শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা হিংসার জন্য যেসব ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়ায় ছেদ পড়ছে তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের আশ্বাস দিয়ে শাহ ১৫ দিন শান্তির কথা বলেন, অস্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন। তিনি তাঁদের বলেন, ফের জুন মাসে তিনদিন এবং জুলাইয়েও তিনদিনের জন্য তিনি আসবেন। কিন্তু সেই যে ফিরে গেলেন, আর যাননি।

শাহ আসার আগে ও পরে প্রায় প্রায়শই নিরাপত্তা বাহিনির সঙ্গে সশস্ত্র নাগরিকের লড়াই চলেছে। তিনি এসে পৌঁছনোর দু্দিন আগে, ২৮ মে বিকেলে মণিপুরের সেরু, সুগনু অঞ্চলে আরামবাই টেঙ্গল গোষ্ঠীর জঙ্গিদের সঙ্গে ৩৭ অসম রাইফেলস-এর ভয়াল গুলি বিনিময় হয়। সেইদিনই কুকি অধ্যুষিত এলাকায় আক্রমণ চালাতে গিয়ে পাল্টা প্রতিরোধে কয়েকজন মেইতেইয়ের প্রাণহানি ঘটে। সেদিন রাতেই বিজেপির দফতরে হামলা হয়, অন্যত্র জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধে স্টান গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহৃত হয়। শাহ সেখানে থাকা অবস্থায়, ৩০ মে মেইতেইরা চান্ডেলের ৮টি এবং কাংপোকপির ৭টি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। মোট ১৫টি গ্রাম, ১৫টি চার্চ এবং ১১টি স্কুল জ্বালিয়ে দিয়েছিল। অমিত শাহ তথাকথিত ‘চাণক্য’ হয়েও থই পাচ্ছেন না।

নানা হিসাবে জাতিগত হিংসা শুরু হওয়ার পর থেকে সে রাজ্যে দেড়শোর বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, ৬০ হাজার মানুষকে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁদের সিংহভাগ কুকি। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের বিবৃতি অনুযায়ী ৩ জুন পর্যন্ত আহত হয়েছিলেন ৩০১০ জন, আগুন লাগানোর ঘটনার সংখ্যা ৪১,০১৪টি। অন্তত ৫০ হাজারের বেশি মানুষ রাজ্যের ৩৪৯টি শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নিয়েছেন, প্রায় ১২ হাজার মানুষ মিজোরামে। শরণার্থী শিবির মানে যেমনতেমন ছাদওয়ালা মাথা গোজার জায়গা। একই সম্প্রদায়ের স্থানীয় মানুষ বা ক্লাব কোনওরকমে তাঁদের দুবেলা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, মনোচিকিৎসার ব্যবস্থাও অনেক ক্ষেত্রে হয়। দ্য কুইন্ট সহ অনেক সংবাদমাধ্যম এইরকম কয়েকটি শিবির ঘুরে এসেছে। এখন পাহাড়ে এবং রাজ্যের বাইরে রয়েছে কুকি সম্প্রদায়, ইম্ফল উপত্যকায় শুধু মেইতেইরা। কুকিরা রাজ্য পুলিশকে অবিশ্বাস করে, মেইতেইরা সেনাবাহিনি ও আধা-সেনাবাহিনি মোতায়েনের প্রতিবাদ করছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লি ফিরে গিয়ে, দু সপ্তাহ পর খবর পেলেন, ১৭ জুন একটি ক্ষেত্রে মেইতেইরা প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’-এ এতদিন ধরে মণিপুর নিয়ে একটি কথাও না শুনতে পেরে রাগে-দুঃখে রাস্তায় আছাড় মেরে রেডিও ভেঙেছে। ২৮ জুন রাতে দিল্লি থেকে বীরেনকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। পরের দিন, ২৯ জুন তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিতে রওনা হলে রাজভবনের পথে সমর্থকরা তাঁর পথ আটকান। সমর্থকদের দাবিকে মান্যতা দিয়ে তাঁর পদত্যাগপত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়। অথচ সেদিনই ওই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির কথা ছিল। পরে বীরেন টুইট করে জানান যে, এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন না। ৩০ জুন পশ্চিম ইম্ফলের খুরাঙে মহিলা সমাবেশে কয়েক হাজার মেইতেই মহিলা জানান তাঁরা বীরেনের পদত্যাগ মেনে নেবেন না, রাষ্ট্রপতি শাসনও না।

মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ নিয়ে এমন নাটকীয় ঘটনা এদেশে এই প্রথম। বীরেন এক ঢিলে দুটি পাখি মারলেন। প্রথমত, ৫৮ দিন ধরে রাজ্যে আইনব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ার জন্য তাঁর দিকে কেন্দ্রের আঙুল তোলা বন্ধ করলেন। এছাড়া, পার্টির মধ্যে তাঁর বিরোধীদের এবং কেন্দ্রকে বোঝালেন, উপত্যকায় মেইতেইদের মধ্যে তাঁর জনসমর্থন এখনও কত বিপুল। মণিপুর কংগ্রেসের দাবি, রাজভবনের রাস্তায় আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে ভিড় জড়ো করা হয়েছিল।

যখন হিংসা শুরু হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্নাটক ভোটের প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন (সেখানে বিধানসভা নির্বাচন হয় ১০ মে)। এরপর তিনি জাপান, পাপুয়া নিউগিনি ও অস্ট্রেলিয়া সফর করলেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বললেন, অথচ মণিপুরে সাড়ে তিনশোর বেশি গির্জা ধ্বংস এবং সন্ত্রাসে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেননি। এরপর সামরিক বাহিনির জন্য ড্রোন কিনতে আমেরিকা ঘুরে এলেন। আমেরিকা ও মিশর সফর সেরে ভারতের মাটিতে নামার পরই মোদি বিজেপি সভাপতি নাড্ডাকে প্রশ্ন করেন, দেশে কী চলছে?

অদ্ভুত প্রশ্ন! মণিপুর নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী মণিপুর সঙ্কটের দিকে নজর রাখছেন। তাই দেশে ফিরেই নরেন্দ্র মোদির এমন প্রশ্নের কথা শুনে সাংবাদিকরা অবাক হয়েছেন। যেখানেই থাকুন তিনি গোয়েন্দা দপ্তরের সূত্রে সব খবরই পান। দেশের বাইরে গেলে তাঁর সঙ্গে থাকে তাঁর কার্যালয়। আশা ছিল দেশে ফিরে দীর্ঘদিন ধরে চলা মণিপুর সঙ্কট নিয়ে এবার নিশ্চয়ই কিছু বলবেন। তার ধারপাশ দিয়ে না গিয়ে ভোটমুখী মধ্যপ্রদেশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন! চারদিনের মধ্যে দুবার গেলেন সেখানে। অথচ মণিপুর নিয়ে কোনও কথা নেই! এ কেমন প্রধানমন্ত্রী?

মণিপুরের এই দুঃসহ অবস্থা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও তা নিয়ে ইউরোপীয় সংসদ চিন্তিত, সেখানে ভারতের সংখ্যালঘুদের নিয়ে, বিশেষ করে মণিপুরের সংঘর্ষ ও হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে স্ট্রসবার্গের ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাশ করা হয়। প্রস্তাবে খ্রিস্টান এবং অন্য সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার এবং হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের নিন্দা করা হয়। এরপরও প্রধানমন্ত্রী স্পিকটি নট। ফের তিনি ফ্রান্সে চলে গেলেন, তারপর আরব আমিরশাহী। নরেন্দ্র মোদির বিশ্বভ্রমণ চলছেই। ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসে বেশিরভাগ দেশই ঘুরে এসেছেন। সেই রেকর্ড ভারতে তো বটেই সম্ভবত বিশ্বে আর কোনও প্রধানমন্ত্রীর নেই। দ্বিতীয় দফায় জিতে আসার পর কোভিড-১৯ মহামারির জন্য প্রথমদিকে তাঁর বিশ্বভ্রমণ থমকে যায়। তারপর ফের তা শুরু হয়। দেশের জন্য সময় দেওয়া, দেশের জন্য ভাবা তাঁর ধাতে নেই। মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এতদিনের নিস্পৃহতায় কারও সন্দেহ হতেই পারে যে, সেখানকার জাতিগত নির্মূলীকরণের পরিকল্পনায় কেন্দ্রও জড়িত।

 

শুরুর ঘটনা

৩ মে রাজধানী ইম্ফল থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের উপত্যকা শহর চূড়াচাঁদপুরে অ্যাংলো-কুকি ওয়ার সেন্টেনারি গেটে কিছু দুষ্কৃতির ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ জনজাতিদের উত্তেজিত করে তোলে যা থেকে ঘোরতর হিংসার শুরু।

হাইকোর্টে মণিপুর ট্রাইবস ইউনিয়নের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ মার্চ কোর্ট রায় দিয়েছিল, যেন এক মাসের মধ্যে রাজ্য সরকার মেইতেইদের শিডিউলড ট্রাইব (এসটি) তালিকায় অন্তর্ভুক্তির কথা বিবেচনা করে। মণিপুর হাইকোর্টের ওই নির্দেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মণিপুর (এটিএসইউএম) ৩ মে সমস্ত পাহাড়ি জেলায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ ডেকেছিল। উপত্যকার কিছু মেইতেই নাগরিক গোষ্ঠী তা নিয়ে আপত্তি জানায় এবং এটিএসইউএম-এর সমাবেশের বিরোধিতায় ২ মে বিকালে উপত্যকায় উল্টো প্রতিবাদ শুরু হয়, পাহাড়ে যাওয়ার রাস্তা ব্লক করা হয়।

ওদিকে ৩ মে চূড়াচাঁদপুরে এটিএসইউএম-এর সমাবেশের সময় যুব বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি বড়িশ শর্মা বেশ কিছু লোকজন নিয়ে যোগ দেন, ছাত্রদের সঙ্গে তর্ক করে গোলমালের চেষ্টা করেন। তা হলেও সমাবেশ শান্তিপূর্ণই ছিল এবং প্রতিবাদের শেষে ডিস্ট্রিক্ট কালেকটরকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।

হঠাৎ খবর এল, লেইসাং-মোংলেনফাইয়ে অ্যাংলো-কুকি সেন্টেনারি গেটে[2] কিছু মেইতেই দুষ্কৃতি আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। বস্তুত বড়িশ শর্মার নেতৃত্বেই অ্যাংলো-কুকি সেন্টেনারি গেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কয়েক কিলোমিটার দূরের সমাবেশে যোগ দেওয়া কয়েক হাজার মানুষের অনেকেই সেন্টেনারি গেটে আগুন ধরানোর কথা শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে যায়, তাদের কাছে ওই গেটের প্রতীকী অর্থ অনেক। গেটটি দাহ্যবস্তুতে তৈরি নয়, তাই  কাঠামোর তেমন ক্ষতি না হলেও এ যেন দাঙ্গা লাগানোর পরিকল্পিত ঘটনা।

একই সময় খবর আসে মেইতেইরা তরবুং ও কাংভাইয়ের দিকে এগিয়ে কুকিদের ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাদের প্রথম শিকার ছিল তরবুং গ্রামের হাওপি কিপগেন, তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কুকি সম্প্রদায়ের এক পরিবারের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। কুকিরা যখন বুঝল রাজ্য পুলিশ তাদের রক্ষা করবে না, মেইতেইরা ঘর পোড়ালে বাধাও দেবে না, হিংসা আরও বেড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে কুকিরা পাহাড়ি জেলার, মেইতেইরা ইম্ফল উপত্যকার দখল নেয়।

প্রাক্তন লোকসভা সদস্য এবং কুকি উইমেন হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক কিম গাংটে বলেছেন, চূড়াচাঁদপুরে এটিএসইউএম সমাবেশের জন্য তৈরি রাস্তার ধারের এক অস্থায়ী চা ও মিনারেল ওয়াটারের দোকানে মেইতেই ট্রাকড্রাইভার ধাক্কা মারে। মানুষ উত্তেজিত হয়ে ড্রাইভারকে মারে। ড্রাইভার লোকজন ডেকে এনে কাংভাই গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এরপর কুকিরাও মেইতেই গ্রামে আক্রমণ করে। এইভাবেই সংঘর্ষের শুরু।

সোশ্যাল মিডিয়ায় সেদিনই খবর ছড়িয়েছিল যে, মণিপুরের এক হাসপাতালের মেইতেই নার্স, উরিপোকের বাসিন্দা ডঃ কে আচৌবার মেয়েকে চূড়াচাঁদপুরে মেডিকেল কলেজে কুকিরা ধর্ষণ করেছে। মৃত মহিলার ছবি সহ খবরটা ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়। দ্য কুইন্ট ফ্যাক্ট-চেক করতে গিয়ে দেখেছে, যে ছবি ভাইরাল হয়েছে তা কোনও মেইতেই মহিলার নয়, ২০২২ সালে মথুরায় বাবা-মার হাতে খুন হওয়া এক ২১ বছরের মেয়ের। ওদিকে পরের দিন আচৌবা স্থানীয় ইম্প্যাক্ট টিভিতে বলেন, তার মেয়ে নিরাপদেই আছে।

একই দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় বলা হয় কুকিরা (মূলত খ্রিস্টান) আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ করছে। পরে ৯ মে মণিপুরের বিহারি সোসাইটি, বেঙ্গলি সোসাইটি এবং মাড়োয়ারি সোসাইটি যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে যে, কুকি অঞ্চলে অমণিপুরি হিন্দুদের আক্রমণ অথবা ক্ষতি করা হয়নি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার এইসব মিথ্যা রটনায় হিংসা লাগামছাড়া হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যে ঘটনা আদৌ ঘটেনি তা সত্যি করে তোলা, মিথ্যা প্রচার, অপপ্রচার ইত্যাদি ইদানীংকালে যে রাজনৈতিক দল জলভাত করে তুলে সমাজকে অশান্ত করছে মণিপুরে তাই বড় আকারে দেখা গেল। হিংসা নিয়ন্ত্রণ করতে ৩ মে সন্ধ্যা থেকে ইন্টারনেট শাটডাউন করা হয়। কুকিরা অবশ্য মনে করে, রাজ্য প্রশাসন ইম্ফল শহরে কুকিদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় যে ব্যর্থ সেই ঘটনা চাপা রাখতেই শাটডাউন করা হয়েছে।

এখানে বলা দরকার মে মাসের ৩ তারিখ থেকে মণিপুরে ইন্টারনেট শাটডাউন চললেও সাংবাদিকরা শরণার্থী শিবিরের স্বেচ্ছাসেবক এবং সেখানে আশ্রিতদের মোবাইলে ঘরবাড়ি জ্বালানো ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের ছবি এবং ভিডিও দেখেছেন। হোয়াটসঅ্যাপের বদলে ব্লুটুথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁরা পরস্পরের মোবাইলে ছবি ও ভিডিও পাঠাচ্ছে।

 

সন্ত্রাসের নমুনা

৪ মে রাতে মণিপুরের পাহাড়ি এলাকা চূড়াচাঁদপুর শহরে ভেনাস হোটেলের সামনে প্রতিবাদী জনজাতি মানুষদের উপরে নিরাপত্তা বাহিনি গুলি চালালে দুজন নারী সহ তিনজন মারা যায়। আরও অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিবিসিকে চূড়াচাঁদপুর জেলা সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেছেন, ওইদিন দিনের বেলায় বিষ্ণুপুর আর চূড়াচাঁদপুর জেলার সীমান্ত অঞ্চল থেকে তাঁর হাসপাতালে চারটি গুলিবিদ্ধ দেহ আসে। দেহগুলি দেখে মনে হয়েছে নিহতদের আটক করে প্রথমে হাত বেঁধে রাখা হয়েছিল, অত্যাচারের শেষে গুলি করে মারা হয়েছে। তিনি বলেন, শহরের সব দোকানপাট বন্ধ, খাদ্যদ্রব্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্র দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। তাঁরা বিশ্রামের সময় বিশেষ পাচ্ছেন না। তিনি তিনদিন ঘুমোতে পারেননি, কারণ মেইতেই চিকিৎসকদের বেশিরভাগই পাহাড় ছেড়ে চলে গেছেন। যাঁরা রয়ে গেছেন তাঁদের উপরই হাসপাতাল সামলানোর দায়িত্ব পড়েছে। চিকিৎসক, নার্স সবাই হাসপাতালেই থাকছেন। প্রতিদিনই অনেক গুলিবিদ্ধ আহতরা আসছে। অনেকেরই অপারেশন করা দরকার, কিন্তু প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। ইম্ফল থেকে কিছু আসছে না, অনেক কিছুই স্থানীয়ভাবে জোগাড় করতে হচ্ছে। যেসব ওষুধ ও চিকিৎসার সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছে না, তা মিজোরামের বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে।

প্রাক্তন লোকসভা সদস্য কিম গাংটে জাতিতে কুকি। মে মাসের ৩ তারিখে মণিপুরে যখন সন্ত্রাস শুরু হল, তিনি ইম্ফলের বাড়ি ছেড়ে প্রাণের ভয়ে পলায়মান জনতার ভিড়ে মিশে গিয়েছিলেন। এখন দিল্লিতে রয়েছেন। নিউজক্লিকের প্রজ্ঞা সিং-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সেনারা না আসা পর্যন্ত মনে হচ্ছিল যেন এক অপহরণ করা বিমানে বন্দি রয়েছি। কেউ খায়নি, ঘুমোয়নি। অনেকেই তাদের ঘর, প্রিয়জনকে হারিয়েছে। তাঁর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় বাবা-মাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু আক্রমণকারীরা তাকে ধরে ফেলে। তারপর মারধর করে জ্বলন্ত বাড়ির মধ্যে ফেলে দেয়। ক্যাম্পের অনেকেরই কমবেশি এইরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাঁর বাড়ির টেরাস থেকে তিনি শত শত মারমুখী উন্মত্ত পুরুষ-মহিলাকে ছুটে আসতে দেখেছেন। সংখ্যায় তারা এত বেশি ছিল যে সেনা এলেও তাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারত না। তাদের নেতৃত্ব দিয়েছে কালো টি-শার্ট, জামার কাঁধে স্ট্যাম্প লাগানো আরামবাই টেঙ্গলের যুবকরা।

কয়েক বছর আগে একটি মিটিঙে ৩৫ জন নাগা, কুকি ও মেইতেইকে নিয়ে তিনি দিল্লি গিয়েছিলেন। তাঁর এলাকায় তাদের একজনের (মেইতেই) চায়ের দোকান ছিল। তিনি লোকমুখে শুনেছেন, সেই মহিলা যখন দেখলেন কুকিদের ঘর লুঠ হচ্ছে, লুঠেরাদের খুব বকাবকি করেন। যারা বিছানাপত্র, টিভি, ড্রেসিংটেবিল, আলমারি নিয়ে যাচ্ছিল তাদের চিৎকার করে বলেন, কুকিদের তাড়া করে হঠিয়ে সম্পত্তি লুঠ করছ! পরে কয়েকজন মেইতেই মহিলা এসে তাঁর চায়ের দোকান ভাংচুর করে। কুকি মহিলারা মেইতেইদের বাঁচিয়েছেন সেই উদাহরণও আছে।

অরুণাভ সইকিয়া স্ক্রলে লিখেছেন, ইম্ফলে হাওকিপ ভেং হল কুকিদের পাড়া। ৪ মে সেই এলাকাটি একেবারে জ্বালিয়ে দেওয়ার আগে হিংস্র জনতা ২৪ ঘন্টায় তিনবার হানা দিয়েছিল। প্রতিবারই হামলাকারীরা ছিল কালো টি-শার্ট পড়া মেইতেইদের জঙ্গি দল আরামবাই টেঙ্গলের যুবক।

৬৭ বছর বয়সী আন্নু ডৌঙ্গেল স্বামী সহ পরিবারের পাঁচজনকে নিয়ে ৩ মে থেকে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা থাকতেন ইম্ফল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের এক জনজাতি গ্রামে। ফোনে পিটিআইকে আন্নু জানান, স্বামী আর তিনি দুজনেই সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলেন। একদিন ভোরে খবর এল যে বহু মানুষ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রাম জ্বালাতে জ্বালাতে এগিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি কিছুটা চাল, কয়েকটা বাসন আর পোশাক নিয়ে কোনওমতে গ্রাম ছেড়ে অনেকের সঙ্গে তাঁরা পাহাড়ের উপরে জঙ্গলে পালিয়ে আসেন। সেখানে বাঁশ আর ত্রিপল খাঁটিয়ে তাঁবু তৈরি করে থাকছেন। চাল, বুনো শাক-সব্জি আর পাহাড়ি ঝর্নার জল খেয়েই দিন কাটছে।

টুইটারে অনেকেই বলেছেন, স্মার্ট সিটি সার্ভে টিম ইম্ফলের প্রত্যেকের বাড়িতে গেছে, তবে শুধু কুকিদের বাড়িতেই লাল মার্কিং করেছে। তারপর সময় হলে বেছে বেছে লাল দাগ দেখে হত্যা ও ধ্বংস করেছে। উপত্যকায় মোটেই জাতিগত দাঙ্গা হয়নি, জাতিগত নির্মূলিকরণের প্রচেষ্টা হয়েছে। মেইতেইরা কুকিদের অঞ্চল দখল করতে চায়। কিন্তু শুধু সেই কারণে তাদের তাড়িয়ে দিতে বা হত্যা করতে পারে না। তাই তাদের বলা হচ্ছে শরণার্থী, সন্ত্রাসবাদী এবং দখলকারী। এইসব বলে মেইতেই জনতাকে এককাট্টা করে কুকিদের বিরুদ্ধে যা করেছে এবং করতে চায় তার পক্ষে যুক্তি তৈরি করেছে।

সংঘর্ষ শুরুর প্রথম দু-তিনদিনের মধ্যেই উপত্যকা এবং পাহাড় মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। উপত্যকা থেকে পালিয়ে কুকিরা এবং পাহাড়ের মেইতেইরা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সংঘর্ষ শুরুর একমাস পরেও তীব্র জাতিবিদ্বেষ এবং হিংসা এতটকু কমেনি। ৪ জুন বিকেলে মেইতেই জনতা পুলিশের সামনে একটি সাত বছরের ছেলে, তার মা এবং এক আত্মীয়কে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তারা ছিল মেইতেই খ্রিস্টান। আরও অনেক কুকিদের সঙ্গে তারা ৩ মে থেকে অসম রাইফেলসের ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিল। শিশুটির বাবা ছিল জাতিতে কুকি। তাই সে দূরের গ্রামে আত্মীয়দের কাছে চলে গিয়েছিল। দাঙ্গাকারীরা বাইরে থেকে ক্যাম্পের কুকিদের লক্ষ করে গুলি চালাত। ৪ জুন বিকেলে সেই গুলিতে শিশুটি সহ তিনজনেই আহত হন। তাদের প্রাথমিক শুশ্রূষার পর ক্যাম্প থেকে ইম্ফল পশ্চিমের এসপিকে যোগাযোগ করে তিনজনকে ইম্ফলের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। ছেলেটির মা এবং আত্মীয়া জাতিতে মেইতেই ছিল বলে সবাই ভেবেছিল তাদের আক্রমণ করা হবে না। ঘন্টাখানেক পর একজন নার্স সহ অ্যাম্বুলেন্সে ওই তিনজনকে চড়িয়ে এসপি রওনা হন। অসম রাইফেলসকে মেইতেইরা নানাভাবে নাজেহাল করে। পাছে তারা সঙ্গে থাকলে গোলমাল বাড়ে, অ্যাম্বুলেন্স আটক করে, সে কথা ভেবে বাহিনি অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে ছিল না। ইম্ফল থেকে ৫ কিলোমিটার আগে দু হাজার মেইতেই জনতা তাদের ঘিরে ধরে। এসপি বাহিনির জন্য ক্যাম্পে ফোন করেন। বাহিনি রওনা হওয়ার কিছু পর তিনি বাহিনিকে ফিরে যেতে বলেন। তারপরই তিনজনকে পুড়িয়ে মারার কথা জানা যায়। ড্রাইভার ও নার্স ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।

পাহাড়ে কুকিরাও মেইতেইদের মেরেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তবে তা সংখ্যায় কম। তারাই মরেছে বেশি, ক্ষতিও তাদের অনেক বেশি হয়েছে। উপত্যকা থেকে তারা পালিয়েছে। সাংবাদিকদের বিবরণে তাই মেইতেইদের আক্রান্ত হওয়ার খবর কম পাওয়া যায়। সংঘর্ষ নিয়ে সংবাদের হেডলাইন লেখা হয়েছে ‘অ্যাটাকস অন খ্রিশ্চিয়ানস’। সাড়ে তিনশোর বেশি গির্জা এবং ১৯টি মন্দির ভাংচুর করা হলেও আজ পর্যন্ত তা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব টু শব্দ করেনি। এর প্রতিবাদে মণিপুরে না হলেও সম্প্রতি মিজোরামে প্রদেশ বিজেপির সহ-সভাপতি আর ভানরামচুয়াঙ্গা ১৩ জুলাই ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থনেই গির্জা ধ্বংস হয়েছে। অনেকদিন ধরে মণিপুরের জটিল জাতিসম্পর্ক এবং জমিব্যবস্থার জন্য যা ছিল শুধু জাতিসংঘর্ষ সেখানে আজ সাম্প্রদায়িকতার রং লাগানো হয়েছে। বিবদমান জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সেতু নির্মাণের বদলে সচেতনভাবে বিভাজনকে উসকে দেওয়া হয়েছে।

এইসব চার্চের বেশিরভাগই খ্রিস্টানবাড়ির একটা ঘর। প্রতিটি গ্রামে কোন বাড়িতে চার্চ রয়েছে সেটা বাইরের লোকের জানার কথা নয়। কুকি গ্রামে কে আক্রমণকারীদের চার্চ চিনিয়ে দিল সেটাই প্রশ্ন। সমতলে কিছু মন্দিরও পুড়েছে, তবে কারা তা পোড়াল? গোষ্ঠীগত বিভাজন থাকলেও এতদিন পর্যন্ত মণিপুরে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছিল না। তবে আশার কথা ধর্মীয় স্থান পুড়িয়েও মণিপুরের হিংসাকে সাম্প্রদায়িক করে তোলা যায়নি। আগেও জমি ও জীবিকা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই ইম্ফল উপত্যকায় কয়েকটি গির্জায় আক্রমণের জন্য বিষয়টি সাম্প্রদায়িক রং নিয়েছিল। এরপর কুকি, নাগা সহ বিভিন্ন আদিবাসী— যাঁরা অতীতে একে অন্যের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াই করেছেন— একই ধর্মবিশ্বাস খ্রিস্টধর্মকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হন এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদিবাসী প্রতিবাদ গড়ে তোলেন।

কোচির থ্যালাসারি আর্চবিশপ মার জোসেফ প্যামপ্লেনি ২৯ জুন বলেছেন, মণিপুরের হিংসা গণহত্যার রূপ নিয়ে গুজরাত দাঙ্গার আরেকটি সংস্করণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় দাঙ্গা ঘটানোর সমবেত চেষ্টা রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই মানুষ সন্দেহ করছে যে দাঙ্গার পিছনে যারা রয়েছে সরকার তাদের রক্ষা করছে। ভারতে কোনও বৈষম্য করা হয় না— আমেরিকা সফরের সময় নরেন্দ্র মোদির এই উক্তির উল্লেখ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যদি আন্তরিক হন তাহলে মণিপুরে যে সব খ্রিস্টান অত্যাচারের ঠেলায় বনে বা অন্য রাজ্যে পালিয়ে যাচ্ছেন, যাঁরা ঘরবাড়ি, উপাসনার স্থল এবং আত্মীয়স্বজন হারিয়েছেন তাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মন্তব্য করা উচিত।

সাংবাদিকদের অনেকেই বলেছেন, রাষ্ট্র পরিচালিত সন্ত্রাস চলছে, আমরা ভয়ের রাজত্বে রয়েছি।

 

মেইতেইদের দুই চরমপন্থী গোষ্ঠী

আরএসএস এবং বজরং দলের সম্প্রতি আদলে মণিপুরে দুটি উগ্র হিন্দু গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। একটি আরামবাই টেঙ্গল, অন্যটি মেইতেই লিপুন। লোকে বলে আরামবাই টেঙ্গল ও মেইতেই লিপুন মেইতেইদের এই দুই জঙ্গি সংগঠনই আরএসএস-এর সৃষ্টি। দুই গোষ্ঠীকেই আগে তেমন কেউ জানত না, মে মাসে শুরু হওয়া সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসে তাদের বিরাট ভূমিকার জন্য তারা ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। দুটি গোষ্ঠীই ইম্ফল উপত্যকায় শত শত যুবককে গোষ্ঠীতে ঢুকিয়েছে এবং নিজেদের সশস্ত্র করে চলেছে।

আরামবাই টেঙ্গল গোষ্ঠীর কালো টি-শার্টের পিছনে ছাপা থাকে তিনজন ঘোড়ায় চড়া আগ্রাসী যোদ্ধার ছবি। আরামবাই টেঙ্গলের কালো পোশাকে এক সঙ্গে শতাধিক যুবক কাঁধে বন্দুক নিয়ে মোটরসাইকেল ও জিপসিতে চড়ে নানান জায়গায় হানা দিয়েছে। তারা কুকিদের চার্চ পোড়ায়, গ্রাম পোড়ায়, সম্পত্তি লুঠ করে নরক তৈরি করে। বিরোধী এবং কুকিদের অভিযোগ, ওই গোষ্ঠী মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-এর আশীর্বাদধন্য। বাস্তবিকই তার অনেক সাক্ষ্য রয়েছে।

গত বছর (২০২২) ১৬ আগস্ট আরামবাই টেঙ্গল-এর ফেসবুক পেজে গোষ্ঠীর সঙ্গে বীরেন সিং যে মিটিং করেছেন সেই ছবি ছাপা হয়েছে। অন্যান্য ছবির মধ্যে বিজেপি মণিপুর থেকে যাঁকে রাজ্যসভার সদস্য করেছে সেই মণিপুরের রাজা খেতাবধারী লেইশেম্বা সানাজাওবা রয়েছেন। গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর ওই গোষ্ঠীর শপথ অনুষ্ঠানের ছবি পোস্ট করে সানাজাওবা লেখেন, স্বেচ্ছাসেবকদের “শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠান হয়েছে আমার বাড়িতে।” বেশ কয়েকবার একই ঘটনা ঘটেছে।

ইম্ফল ফ্রি প্রেস ২৬ মে জানিয়েছে, ওই গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, গোষ্ঠীটি কিছুদিনের জন্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। এত সব ভয়ানক সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসে জড়িয়ে থাকার পর! ভারী মজার ব্যাপার! চাপ এলে বলব গোষ্ঠী ভেঙে ফেলেছি, চাপ কমে গেলে ফের অসুর হয়ে মাঠে নামব!

কুকি সম্প্রদায়কে আক্রমণে মেইতেই লিপুন গোষ্ঠীও অতি সক্রিয়। তাদের কর্মীদের পরিধান সাদা শার্ট। এই গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ নেতা প্রমোত সিং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-এর উপাসনা করেন। কারণ, বীরেন যে ভাষা ব্যবহার করেন তা তাঁদের পছন্দ, বীরেনের লক্ষ্য তাঁদেরও লক্ষ্য। প্রমোত দাবি করেন, মেইতেই লিপুন কুকিদের আক্রমণ করছে না, কুকি আক্রমণ প্রতিহত করছে। তিনি জানান, তাঁর সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। এর মধ্যে বর্ষীয়ান নাগরিক, মহিলা ও শিশুরাও রয়েছে। অনেক সদস্যই প্রাক্তন সৈনিক, তাই অস্ত্রের ব্যবহার জানে। এছাড়া ১০০০ জন প্রশিক্ষিত ক্যাডার রয়েছে, যাদের অনেকে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছে।

পাহাড়ি উপজাতিরা মনে করে, এই হিংসা ওই দুই জঙ্গি গোষ্ঠীর পূর্বপরিকল্পিত। কয়েকটি অনুষ্ঠানে বীরেন সিং যে ওই দুই সংগঠনের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন তার সাক্ষ্য রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দল এবং কুকিরা বলে, ওই দুই জঙ্গি গোষ্ঠীর পিছনে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-সহ বিজেপি নেতাদের সমর্থন ও সহযোগিতা রয়েছে।

এত কিছুর পরও নরেন্দ্র মোদি কেন মণিপুর নিয়ে কথা বলেননি? শান্তির আবেদন করেননি? জুলাই মাসেও মোদির নীরবতার প্রতিবাদে মেইতেই অধ্যুষিত পশ্চিম ইম্ফলে তাঁর কুশপুতুল পোড়ানো হয়েছে।

 

হিংসায় পুলিশের যোগসাজস

বেশিরভাগ পুলিশই মেইতেই সম্প্রদায়ের। সংঘর্ষের সময় মণিপুর পুলিশ নিজেদের জাতের পক্ষ নিয়েছে। বাহিনির বিরাট অংশ তাদের পেশাগত নৈতিকতা বর্জন করেছিল, যেভাবে কাজ করেছে তা পেশাগত নৈতিকতার বিরুদ্ধে। সঙ্কটের সময় পুলিশের মধ্যে এই জাতিগত বিভাজন রাজ্যটিকে একেবারে পঙ্গু করে দিয়েছে। অনেক উঁচু পদের মেইতেই পুলিশ আধিকারিকও ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। সাংবাদিকদের অভিযোগ, সিংহভাগ মেইতেইরা যেখানে থাকে সেই ইম্ফল উপত্যকার হিংসা ও হত্যাকাণ্ডকে ছোট করে দেখিয়ে পুলিশের মেইতেই পুলিশ আধিকারিকরা চূড়াচাঁদপুর ও তার আশপাশের ঘটনাকে বাড়িয়ে দেখিয়েছে।

বর্তমান সঙ্কটের প্রথম পনেরো দিনের মধ্যে জনতা পুলিশের ১০০০ রাইফেল সহ অজস্র গোলাবারুদ ‘লুঠ করেছে’। চতুর্থ সপ্তাহে দখল করেছিল আরও ৩০০০ অস্ত্র সহ গোলাবারুদ ও হ্যান্ড গ্রেনেড। ৩ মে জাতিগত হিংসা শুরু হওয়ার পর থেকে ২৭ তারিখের মধ্যে অন্তত ৪০০০ অস্ত্র এবং লক্ষাধিক গোলাবারুদ পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে লুঠ হয়েছে। অস্ত্র লুঠ হয়েছে অথচ কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশের বাধা দেওয়ার বা সংঘর্ষের খবর নেই। আজব পরিস্থিতি! অভিযোগ রয়েছে, রাইফেল ও অন্য অস্ত্রশস্ত্র পুলিশই বিলিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর কোনও গণতান্ত্রিক দেশের একটি রাজ্যে এত ব্যাপক হারে আধুনিক অস্ত্র লুঠের কথা জানা নেই। মণিপুরের ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ বলেছেন বিষয়টি নিয়ে এনআইএ-র (সিবিআই নয়) তদন্তভার নেওয়া উচিত এবং তাই প্রয়োজন।

এখনও পর্যন্ত ৪০০০-এর মধ্যে ১৬০০ অস্ত্র, অল্প কিছু গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। বাকি বিপুল সংখ্যক অস্ত্র বাইরে থেকে যাওয়া খুবই উদ্বেগের বিষয়। মেইতেইদের মহিলা বাহিনি অস্ত্র লুঠের তদন্তের জন্য সিবিআইকে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে প্রবেশই করতে দেয়নি। ১০ জুলাই ইম্ফলের সুশীল সমাজের গোষ্ঠী কোঅর্ডিনেটিং কমিটি অন মণিপুর ইন্টিগ্রিটি (কোকোমি) মানুষের কাছে আবেদন করে, অস্ত্র সমর্পন করবেন না। ওই আবেদনের ভিত্তিতে অসম রাইফেলস কোকোমির আহ্বায়কের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি এবং গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা প্রচারের মামলা করেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে হিংসায় পুলিশের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের ছবি পরিষ্কার ফুটে ওঠে। আক্রমণের থেকে বেঁচে যাওয়া কুকিরা বলেছেন, সঙ্গে থাকা পুলিশ দাঙ্গাকারীদের প্ররোচিত করেছে। ইম্ফল ও তার আশেপাশে উগ্র মেইতেই জনতাকে পুলিশ পাহারা দিয়ে নিয়ে গেছে, তারপর কুকিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে। স্ক্রল-এ সাংবাদিক অরুণাভ সাইকিয়া লিখেছেন, মণিপুর পুলিশ দাঙ্গাকারীদের উৎসাহ জুগিয়েছে। তিনি ৪ মে দুপুরে পাহাড়ি কাংপোকপি জেলার কামুচিং গ্রামের একটি ঘটনার কথা বলেছেন। দুপুর দুটো নাগাদ গ্রামপ্রধানের মেয়ে টেরেসা ভাইফেই দেখলেন ২০-৩০ জনের একটি দল তাঁদের গ্রামের দিকে আসছে। আগের দিনই আশপাশের কুকি গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই ৮০টি পরিবার গুলতি ও একনলা পাখিমারা দেশি বন্দুক নিয়ে তৈরি ছিল। মণিপুরে আদিবাসী সম্প্রদায়ের অনেকের কাছেই এই বন্দুক থাকে। তাই ওই ছোট দলকে তাড়িয়ে দিতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। একটু পরে তারা দেখল ইউনিফর্ম পরা মণিপুর পুলিশ কমান্ডোরা গ্রামের দিকে আসছে। টেরেসারা ভাবলেন, পুলিশ যখন আসছে তাঁরা নিরাপদ। পরে বোঝা গেল, কমান্ডোরা উচ্ছৃঙ্খল জনতা দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ওদিকে আক্রমণকারীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। পুরুষদের পরণে কালো টি-শার্ট, তারা গুলি চালাতে শুরু করল। গ্রামের মানুষ পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিল। সেখান থেকে তারা দেখল গ্রাম জ্বলছে— চার্চ, স্কুল, শস্যভাণ্ডার— সব জ্বলছে। আক্রমণকারীরা ফেরত যাওয়ার সময় তারা যা যা পারল— গৃহপালিত জন্তু, মোষ সবকিছুই নিয়ে গেল।

কামুচিঙের ঘটনা একইরকম অনেক ঘটনার মাত্র একটি। সেখান থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে রয়েছে লইবোল খুনৌ সজল গ্রাম। সেখানকার বাসিন্দা মোংখোচিন অরুণাভ সাইকিয়াকে হাওকিপ ভেং গ্রামের একই রকম ঘটনার কথা বলেছেন। তিনি জানান, ৩ মে পুলিশ কমান্ডোদের সঙ্গে আরামবাই টেঙ্গল-এর যুবকরা ঝড়ের গতিতে ওই গ্রামে প্রবেশ করে সব কিছু ধ্বংস করে, জ্বালিয়ে দেয়।

৪ মে মণিপুর পুলিশ কমান্ডোরা আরামবাই টেঙ্গলের ইউনিফর্ম পড়া উচ্ছৃঙ্খল জনতার সঙ্গে ইম্ফলের কুকি অধ্যুষিত হাওকিপ ভেং অঞ্চলের দিকে চলেছে— এই দৃশ্যের ভিডিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনতলা থেকে ভিডিওটি তুলেছিলেন ১৮ বছরের মার্ক হাওকিপ। শহরের অন্য কুকি অঞ্চলের বন্ধুদের কাছে সে শুনেছিল, আগের রাতে যেসব জায়গা আক্রান্ত হয় সেখানে আক্রমণকারীদের সঙ্গে পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে ছিল। সঙ্গে থাকলেও আক্রমণকারীদের বাধা দেয়নি। কথাটা যে সত্যি তা প্রমাণ করতে এবং সবাইকে জানাতেই সে ওই আক্রমণের ভিডিওটি করে। হাওকিপ এখন বাড়ি ছেড়ে শিলংয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

কিম গাংটে বলেছেন, আমি কিন্তু নিজের চোখে কমান্ডোদের কুকি সম্প্রদায়ের সম্পত্তি জ্বালিয়ে দিতে দেখেছি। পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে পুলিশ মেইতেইদের হাতে ৪০০০ অস্ত্র ও গোলাবারুদ তুলে দিল! তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসে বললেন, দয়া করে ওইসব অস্ত্র ফেরত দিন। এই নাটকের মানে কী?

 

বীরেনের সংসারে প্রতিবাদ

বীরেন সিং-এর মুখ্যমন্ত্রিত্বে বিজেপির মধ্যে অনেকেরই নানা অভিযোগ রয়েছে। প্রধান অভিযোগ তিনি স্বৈরাচারী, অন্য কারও কথার মূল্য দেন না।

হেইরক বিধানসভার প্রাক্তন মন্ত্রী, বর্তমান বিধায়ক এবং বীরেনের উপদেষ্টা থোকচোম রাধেশ্যাম সিং এপ্রিলের ১৩ তারিখে পদত্যাগ করেন। তিনি অভিযোগ করেন তাঁকে পদ অনুযায়ী কোনও কাজ দেওয়া হয়নি। লাংথাবল আসনের বিধায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী, মণিপুর টুরিজম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান করম শ্যাম সিং পদত্যাগ করে জানান, তাঁকে কোনও দায়িত্ব বা ক্ষমতাই দেওয়া হয়নি। ওয়াংজিং বিধানসভার বিধায়ক এবং মণিপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান পাওনাম ব্রোজেনও পদত্যাগ করেন। তিনি জানান তাঁর বিধানসভা ক্ষেত্রে এরই মধ্যে করে ফেলা কাজের ওয়ার্ক অর্ডার বাতিল করা হয়েছে। তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন ওই নির্মাণের কাজে ৬ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এখন তিনি বুঝতেই পারছেন না কীভাবে তাঁকে ওই টাকা ফেরত দেওয়া হবে। ওই তিনজন পদত্যাগ করলে কারও বুঝতে বাকি থাকেনি বিজেপি দলের মধ্যে প্রতিবাদ ও অসন্তোষ চলছে। গুজব ছড়ায় অন্তত ১৫ জন বিধায়ক জোট বেঁধে বীরেন সিংকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য দিল্লিতে বসে রয়েছেন। এরপর পাহাড়ি জেলার দশজন বিধায়ক, যাদের মধ্যে সাতজন বিজেপির, বীরেনের পদত্যাগের দাবি তোলেন।

২০২২ সালের মণিপুর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে। ৬০টি আসনের মধ্যে ৩২টি জয় করেছে। সরকার গড়তে মিত্র দলের দরকার হয়নি। তাই বিক্ষুব্ধ এমএলএ-দের বীরেন বিরোধিতায় আদৌ সরকারের বিপদ কিছু নেই।

২০১৭-র আগে ১৫ বছরে কংগ্রেস সরকার সাতটি নতুন জেলা তৈরি করে এবং তিনটি বিতর্কিত বিল পাশ করে পাহাড়ের জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল। ওই বিলে আদিবাসী পাহাড়ি জেলার জন্য যেসব সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছিল তা লঘু করেছে। তাই আদিবাসীরা অখুশি ছিলেন। তবে ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হারলেও ২৮টি আসন পেয়ে কংগ্রেসই সবচেয়ে বড় দল ছিল। বিজেপি ২১টি আসন পেয়েও মিত্র দলদের (নাগা পিপলস ফ্রন্ট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ও লোক জনশক্তি পার্টি) নিয়ে সরকার গড়েছিল। ২০২২ সালে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা কমে হয়েছে ৫টি।

 

বীরেন সরকারের হিংসায় মদত

৩ মে-র আগেও বীরেন কুকিদের বলতেন ‘বার্মিস কুকি’, ‘আফিং চাষি’। মুখ্যমন্ত্রীর এই আচরণ কুকিদের প্রতি মেইতেইদের ঘৃণা এবং হিংসাকে উসকে দিয়েছে। মণিপুরের বিবদমান জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সেতু নির্মাণের বদলে বিভাজনকে উসকে দেওয়া হয়েছে। বীরেন সিং কুকিদের সম্পর্কে দিনের পর দিন বিষ ঢেলেছেন। সাম্প্রতিককালে গড়ে ওঠা মেইতেইদের দুই উগ্র সশস্ত্র গোষ্ঠীকে বরাবর মদত দিয়েছেন। ওদিকে কুকিদের সঙ্গে বীরেনের শত্রুতামূলক সম্পর্কের পিছনে তাঁর নানা মন্তব্য দায়ী বলে মনে করা হয়, যা জাতি হিসাবে তাদের ছোট করেছে। বীরেন টুইট করে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রীকে সে রাজ্যের মেইতেই সম্প্রদায়ের নিরাপত্তায় নজর রাখার কথা বলেছেন। অথচ ঘরবাড়ি ছেড়ে সে রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল মূলত কুকিরা, ১২ হাজারের বেশি কুকি। তাদের নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। হিংসায় দায়ী মূল দুই মেইতেই গোষ্ঠীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কও সবার চোখে পড়েছে।

হিংসা থামাতে এত যে সময় লাগছে তার কারণ হিংসায় রাজ্য সরকার জড়িত। একেবারেই জাতিগত-সাম্প্রদায়িক হিংসাকে মুখ্যমন্ত্রী বললেন মাদক সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ। একথা বলে ইম্ফল উপত্যকার পাদদেশে একের পর এক কুকি-জো বসতি পোড়ানোর জন্য দুই উগ্র মেইতেই গোষ্ঠীকে রাজ্য পুলিশ বাহিনির সাহায্যের পক্ষে দাঁড়ালেন। এছাড়া ও কথা বলার আর অন্য কোনও মানে হয় না।

প্রশাসনে অনেক কুকি অফিসার থাকা সত্ত্বেও চরম হিংসার সময় নোডাল কনট্যাক্ট এবং জেলার হেল্পলাইনে তাদের অনুপস্থিতি নিয়ে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। সিনিয়র নিরাপত্তা অফিসাররা মুখ্যমন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, নেতাদের কাছ থেকে পরিষ্কার নির্দেশ আসেনি। এই ধরনের সঙ্কটের সময় কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা বেশিরভাগ মানুষের পছন্দ হয় না। সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনিকে ডাকা হয়েছে ৩ মে, কিন্তু দেখামাত্র গুলি করার ক্ষমতা ছাড়া তারা কাজে নামতে আগ্রহী ছিল না। সেই নির্দেশ দিতে ২৪ ঘন্টার বেশি সময় লেগেছে। সে কারণে সামরিক বাহিনির নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়েছে। নির্দেশ এল পরেরদিন বেশি রাতে, ইম্ফলের বহু কুকি বসতি পুড়ে যাওয়ার পর।

বর্তমান জাতিগত-সাম্প্রদায়িক হিংসা অতীতের সংঘর্ষের চেয়ে আলাদা। কুকিদের বিরুদ্ধে নাগাদের উসকানো হয়েছে, যেন তাদের মধ্যে সংঘাত লেগে যায়। নাগা ও কুকিরা সম্মিলিতভাবে মেইতেইদের আদিবাসী স্টেটাস দেওয়ার বিরোধিতা করলেও আক্রমণ করা হচ্ছে শুধু কুকিদের। মণিপুরে সংঘর্ষে এই প্রথম সাম্প্রদায়িক রং লাগাতে ধর্মীয় স্থান আক্রমণ করা হল। আক্রমণের সাক্ষীরা বলছেন, কালো জামা পড়া যুবকের দল মোটরবাইকে চড়ে ইম্ফল থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের চার্চও ধ্বংস করছে। এই প্রথম আরামবাই টেঙ্গল ও মেইতেই লিপুন গোষ্ঠী হিসাবে কুকিদের ধ্বংস ও হত্যায় মেতেছে।

পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানো হয়েছে, কয়েকজন মেইতেই মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, যেন প্রতিপন্ন করা যায় যে তার প্রতিশোধ নিতেই কুকি মহিলাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। অশীতিপর ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলেছেন, সব ঘটনা পরপর সাজালে বোঝা যায় এই সংঘর্ষ সুপরিকল্পিত, তার জন্য টাকাও ঢালা হয়েছে। ক্ষমতায় যাঁরা আছেন তাঁরা নিপুণভাবে তা প্রয়োগ করছেন। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মানুষের মধ্যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি নিয়ে খেলছে। এটাই সংঘর্ষের কারণ এবং তা মেটানো মোটেই সহজ নয়। অথচ কুকি ও মেইতেইরা এক সঙ্গেই থাকত এমনকি পাহাড়েও। তাঁদের সামাজিক জোরালো বন্ধন এখন ভেঙে গেছে।

কিম গাংটে স্ক্রলের সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কিছু গোপন অ্যাজেন্ডা মণিপুরকে ভেঙে টুকরো করছে। এই সংঘর্ষ আদিবাসীদের উন্নয়ন ও অধিকারের জন্য সংগ্রামের ফল। সঙ্গে রয়েছে ধর্ম, জমির রাজনীতি এবং নির্বাচনের হিসাব। ধর্ম রয়েছে, তবে তারা চায় না তা প্রকাশ্যে আসুক, তাহলে রাজ্য ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার অভিযোগ উঠবে। কারণ সরকারই উপত্যকার আক্রমণকারীদের সশস্ত্র করেছে। সমস্যা হল মেইতেইদের জঙ্গি গোষ্ঠীদের নিয়ে, যারা বলে কুকিরা বিদেশি, শরণার্থী, আফিংচাষি, অবৈধ অভিবাসী। এবং তাদের মারে। ইম্ফলে মানুষ নয় সরকার বৈষম্য করেছে। কেউ আমাদের মধ্যে সংঘাত লাগিয়ে দিয়েছে। বিজেপির নেতারা প্রতিবাদের অঞ্চলে গিয়ে হিংসা ছড়িয়েছে। রাজ্য ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমি মেইতেইদের ভেদাভেদ করতে দেখিনি। আমি চিৎকার করে বিজেপিকে দোষ দেব। কারণ তাদের রয়েছে আরএসএস, যাদের নিজেদের অ্যাজেন্ডা আছে। লোকে বলে ‘আরামবাই টেঙ্গল’ এবং ‘মেইতেই লিপুন’— এই দুই জঙ্গি সংগঠনই আরএসএস-এর সৃষ্টি, আরএসএস ও বজরং দলের আদলে গড়া। যখন রাজ্য প্রশাসন ব্যর্থ হল, কেন্দ্র রাষ্ট্রপতি শাষন জারি করল না কেন? পার্টিকে না দেখে প্রধানমন্ত্রীর দেশকে, দেশের মানুষকে আগে দেখা দরকার।

তিনি বলেন, এই হিংসা থেকে ধর্মকে আলাদা করা যায় না। বেশিরভাগ মেইতেই চার্চও পুড়িয়েছে আরামবাই। তারা সমাজে ভয় ও সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে। তাতে মদত দিচ্ছেন এবং প্ররোচিত করছেন বীরেন সিং। মুখ্যমন্ত্রী ক্রমাগত উদ্ধত কথাবার্তা বলেছেন যাতে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। যে মুখ্যমন্ত্রী হিংসায় ইন্ধন দেন তাঁর মুখে শান্তির কথা মানায় না। তাই কারও তাঁর উপর ভরসা নেই, তাঁর নেতৃত্বে কেউ শান্তি কমিটি চায় না। বহু মেইতেই এবং কিছু বিজেপি বিধায়কও বলছেন বীরেনের বদল দরকার।

 

মণিপুরের বিশেষত্ব

এ পর্যন্ত আমরা বিস্তারিতভাবে মণিপুরের বাস্তব অবস্থার ব্যাখ্যা করলাম। এর পরের পর্বে এই হিংসা ও সন্ত্রাসের কারণ কী তা বোঝার চেষ্টা করব। এখানে শুধু উল্লেখ করি, মণিপুর রাজ্যটি অনেকটা খেলার স্টেডিয়ামের মতো, যে স্টেডিয়ামের  মাঠটি ক্ষুদ্র। চারদিক ঘিরে রয়েছে পাহাড়, মাঝখানে উপত্যকা। এমন একটি রাজ্যের ১৬টি জেলার ৬০টি বিধানসভা ক্ষেত্রের ৪০টি রয়েছে উপত্যকায়, পাহাড়ি অঞ্চলে ২০টি। তাদের মাত্র ২০ জন বিধায়ক বলে জনজাতিদের বরাবরই ক্ষমতাশীলদের প্রতি অসন্তোষ রয়েছে। তবে এই হিংসা ও সন্ত্রাসের বড় কারণ পাহাড়ে জমির অধিকার নিয়ে মেইতেইদের এক দশকের দাবি এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়। দ্বিতীয় কারণ মায়ানমার থেকে শরণার্থী প্রবেশের সমস্যা এবং সেই সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলতে কুকিদের জনসংখ্যা অতি দ্রুত বাড়ছে ও খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের সংখ্যাও দ্রুত বেড়েই চলেছে— এই পরিকল্পিত রটনা এবং আরামবাই টেঙ্গল ও মেইতেই লুপেনকে বীরেনের মদত। তৃতীয় কারণ, কুকিরা আফিম চাষ করে ড্রাগের ব্যবসা করছে বীরেনের এই অভিযোগ এবং পাহাড়ের জমি থেকে তাদের উৎখাত করে আফিম খেত ধ্বংস করা। তাই অনেকদিন ধরে কুকিদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ জমা হয়েছে, আর মেইতেইদের মধ্যে আক্রোশ। স্বাভাবিকভাবে তা হয়নি, অসন্তোষ আর আক্রোশ বাড়িয়ে তুলতে বীরেন সরকারের জুড়ি নেই।

এখানে উল্লেখ থাক, ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী জনসংখ্যার হিসাবে মণিপুরে মেইতেইরা ৫৩ শতাংশ, নাগা জনজাতিরা ২৪, চিনকুকিমিজো গোষ্ঠী ১৬ শতাংশ, বাকিটা অন্যান্য। আবার ধর্মের হিসাবে হিন্দুদের অনুপাত ৪১.৩৯ শতাংশ, খ্রিস্টানদের ৪১.২৯ এবং মুসলমানদের ৮.৪ শতাংশ। তারপর রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ০.২৫ শতাংশ। বাকি ৮ শতাংশের বেশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা। মেইতেইরা বেশিরভাগই হিন্দু, তারপর রয়েছে মুসলমান। তবে তাদেরও একটি ছোট অংশ আদিবাসী ধর্ম পালন করে। অন্যদিকে ৩৩টি স্বীকৃত উপজাতি এবং নাগা ও কুকিরা নানা ধর্মের হলেও বেশিরভাগই খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাসী।[3]

 

(চলবে)


[1] ইদানিংকালে সরকারের আফিং চাষ নিয়ে কড়াকড়ির বিরুদ্ধে তিনটি পাহাড়ি জেলায় প্রতিবাদের পর এ বছর ১০ মার্চ সরকার এসওও চুক্তি থেকে সরে আসে— যার প্রবল সমালোচনা করেছে মণিপুরের নাগরিক গোষ্ঠী।
[2] ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত কুকি বিদ্রোহের স্মরণে তৈরি
[3] Population Census 2011.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. জাতিগত বৈসাম্যের কারনে সকল অস্থিরতা। এর থেকে পরিত্রানের একমাত্র উপায় হল, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, স্থান, কাল ভেদে সাম্য, সমঅধিকার, সামাজিক ন্যায় বিচার করতে হবে। সকলকে সম অধিকার দিতে হবে। কোন প্রকার বৈসম্য করা চলবে না। কিন্তু হিন্দু ধর্মে যা পওয়া সুদুর পরাহত। তাদের মানসিকতায় ইহা নেই। ব্রাম্মন্যবাদই হলো প্রধান সমস্যা। যেখানে মুষ্টিমেয় মানুষ (ব্রাম্মন, কায়াস্ত,ক্ষত্রিয়) সকল সুবিধা ভোগ করবে। আর মেজরিটি মানুষ তাদের দাস। এ ধর্মবাদী দাস প্রথা পরিত্যাগ করতে হবে।
    মোয়াজ্জেম,
    salehatex@gmail.com

আপনার মতামত...