প্রবীর মুখোপাধ্যায়
গীতা প্রেস তার প্রথম দিন থেকে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-এর শুধু অনুসারী নয়, বরং প্রবল সফল এক প্রচারক। দেশের হিন্দু জনগণের ব্যাপক অংশকে যে কোনও সংস্কারমুখী বৈজ্ঞানিক সংস্কার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা গীতা প্রেস আর এর পরিচালকেরা পালন করেছেন আর এখনও করে চলেছেন তার উদাহরণ অজস্র। দেশে রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতা এখন যাদের হাতে তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ‘হিন্দু’ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করা। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা গীতা প্রেস এবং এ ধরনের সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। সেই কারণে গীতা প্রেসের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি যাবেন, অগ্নিগর্ভ মণিপুরে যাওয়ার সময় না পেলেও প্রধানমন্ত্রী যাবেন গোরক্ষপুরে। এসব ঘটনা এখন স্বাভাবিক
যেদিন থেকে মোদি সরকার ঘোষণা করেছে যে ২০২১ সালের গান্ধি শান্তি পুরস্কার দেওয়া হবে গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস-কে সেদিন থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতে শুরু হয়েছে। “অহিংস ও অন্যান্য গান্ধিবাদী পথে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথে অসামান্য অবদান”-এর জন্য গীতা প্রেসকে এই পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে বলা হয়েছে সরকারি প্রেস নোটে। ‘সনাতন ধর্ম’ প্রচার করতে এই সংস্থা দায়বদ্ধ এমনটাই গীতা প্রেসের স্বঘোষিত নীতি। যে উদ্দেশ্যে গান্ধি শান্তি পুরস্কার প্রদান শুরু করা হয়েছে গীতা প্রেসের অনুসৃত নীতি তার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হওয়া সত্ত্বেও সরকার কেন এই সংস্থাকে এই বিশেষ পুরস্কার প্রদানের জন্য মনোনীত করল সেই প্রশ্ন উঠছে। স্বাভাবিকভাবেই বিগত একশো বছর ধরে গীতা প্রেস আর তার মুখপত্র কল্যাণ পত্রিকা আর এদের পরিচালকেরা কী আদর্শ প্রচার করে চলেছেন সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।
আলোচনা শুরু করা যাক দেশের কোন সামাজিক প্রেক্ষাপটে গীতা প্রেস তার কাজ শুরু করে সে সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে। উত্তরভারতের গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চল, যার অনেকটাই আজকের উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড বিহার আর মধ্যপ্রদেশ জুড়ে আছে, সেখানে ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে আর বিংশ শতকের শুরুতে হিন্দু আর মুসলিম এই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এর ফলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনও ধর্মীয় বিভাজনের ফাঁদে পড়তে শুরু করে। গো-রক্ষার প্রশ্ন নিয়ে তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ (এখনকার উত্তরপ্রদেশ) আর বিহারের নানা অংশে দাঙ্গা হতে থাকে। একদিকে উর্দু ভাষার অধিকারক্ষেত্র ক্রমে ক্রমে সঙ্কুচিত হতে থাকে, অপরদিকে হিন্দি ভাষা ক্রমশ ‘হিন্দু’দের ভাষা হিসেবে আর দেবনাগরী ‘হিন্দু’দের লিপি হিসেবে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে। বহুদিন ধরে যে ঊর্দু ভাষা আর লিপি এই অঞ্চলে সকলের মধ্যে প্রচলিত ছিল তারা ক্রমে ক্রমে কোণঠাসা হতে হতে শুধুমাত্র ‘মুসলিম’দের ভাষা আর লিপি হিসেবে পরিগণিত হতে লাগল। ভাষা আর লিপির মাধ্যমেও হিন্দু-মুসলিম বিভাজন সৃষ্টি হল। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি ভাষার প্রসারে পত্র-পত্রিকা, সংবাদপত্র, প্রকাশনা সংস্থা এবং জননেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করলেন।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই মনে করছিলেন যে তাঁদের আচরিত রীতিনীতিই হিন্দু ধর্ম, আর এই হিন্দু ধর্ম অনন্তকাল ধরে অপরিবর্তিত অবস্থায় প্রবহমান। এই ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’ প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমেই লোকহিতৈষণার কাজ করা যাবে। দেশে প্রথাগত বিদ্যালয়-শিক্ষাব্যবস্থা বাড়তে থাকায় সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পায়। ফলে শুধু বড় শহরেই নয় বরং ছোট ছোট শহরেও সহজ ভাষায় লেখা সহজ মূল্যে পাওয়া যাবে এমন ধর্মীয় পুস্তকের একটা চাহিদা তৈরি হতে লাগল। সেই চাহিদা পূরণে এগিয়ে এল গীতা প্রেস।
মারওয়াড়ি মালিক হলেও মুনাফা অর্জন করাই গীতা প্রেসের মূল লক্ষ্য ছিল না, এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় লোকহিতৈষণা। সুলভ মূল্যে পাওয়া যাবে সহজ ভাষায় লেখা এমন পুস্তক-পুস্তিকার মাধ্যমে ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’ সংক্রান্ত ভাবধারা ও রীতিনীতি সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সেই লক্ষ্য অর্জনের পন্থা ছিল। হিন্দি সাহিত্যজগতে এইরকম মহান আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে আর কোনও প্রকাশন সংস্থাকে সে-সময়ে বা আজও দেখতে পাওয়া যায়নি।
একদিকে হিন্দি সাহিত্য ও ‘হিন্দু’ ধর্মগ্রন্থের চাহিদা ক্রমবর্ধমান, অপরদিকে সহজেই পুণ্যলাভ করা যাবে এই আশায় অনেক ব্যবসায়ী ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’ প্রচারে অর্থ দান করতে প্রস্তুত। আর এই সময়ে ধর্ম ও রাজনীতির মাঝের দেওয়াল ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে— এই তিনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে গীতা প্রেস ও এর মুখপত্র কল্যাণ পত্রিকা।
১৯২৬ সালে হিন্দি পত্রিকা কল্যাণ তার যাত্রা শুরু করল, তখন তার প্রচার-সংখ্যা মাসিক ৩০০০ কপি। পাঁচ বছরে সেই প্রচারসংখ্যা বেড়ে হল মাসিক ১৬০০০ কপি, আর তার তিন বছর পরে অর্থাৎ ১৯৩৪-এর শেষে সেটা দাঁড়াল ২৭৫০০ কপি। আজকের দিনে এই পত্রিকার মাসিক প্রচার সংখ্যা ২ লক্ষ, আর এর ইংরেজি সহযোগী Kalyana-Kalpataru-র প্রচারসংখ্যা ১ লক্ষের ওপরে। ওই সময়ে, ত্রিশের দশকে যখন হিন্দি আর ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’[1] নিয়ে বাজার বেশ সরগরম সেই সময়ের অন্য যে কোনও ধর্মীয়, সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক পত্রিকার প্রচারসংখ্যা এর ত্রিসীমানাতেও আসতে পারেনি। আর এখানেই আছে গীতা প্রেস-এর সাফল্য।
গীতা প্রেস যে কেবল গীতা, রামায়ণ-মহাভারত, রামচরিতমানস বা পুরাণ-উপনিষদ-প্রাচীন শাস্ত্র এই সব প্রকাশ করে তাই নয়, হিন্দু মহিলা ও শিশুদের আদর্শ কর্তব্য কী হওয়া উচিত বা এই ধরনের আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপরে ২০১৫ সাল অবধি ৯ কোটি ৪৮ লক্ষ বই বিক্রি করেছে। আর ৬ কোটি ৫০ লক্ষ বই বিক্রি করেছে ভারতের পৌরাণিক কল্পকথা, সাধুদের জীবনী এবং ভক্তিসঙ্গীত প্রসঙ্গে। এইসব বই বিক্রি হয়েছে খুবই অল্প দামে, রেলস্টেশনে, বাসস্ট্যান্ডে এমনকী ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতাদের মাধ্যমে গ্রামেগঞ্জে-হাটেবাজারে। ভারতের প্রকাশনাজগতে এই বিক্রি-ব্যবস্থার কোনও তুলনা নেই।
গীতা প্রেসের কর্মকাণ্ডের অন্যতম সহায়ক মদনমোহন মালব্য ছিলেন একই সঙ্গে হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা এবং কংগ্রেসের নেতা। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য কংগ্রেসের প্রচেষ্টায় মালব্যজির মতো বেশ কয়েকজন নেতার উৎসাহ তো ছিলই না, বরং প্রচ্ছন্ন বিরোধিতা ছিল। ১৯২৩ সালে বেনারসে মদনমোহন মালব্য আর আর্য সমাজের নেতারা মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন যে গো-রক্ষা এবং অন্য ধর্ম থেকে হিন্দুধর্মে পুনঃ-ধর্মান্তরকরণ এইসব প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করা হবে। ফলে রক্ষণশীল হিন্দু গোষ্ঠীদের হাত আরও শক্ত হল। ১৯২৫-এ জন্ম নিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)। গীতা প্রেসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরএসএসের জন্মলগ্ন থেকে, ফলে গীতা প্রেসের মুখপত্র কল্যাণ-এর প্রচার আরও প্রসারিত হল।
শুরুতেই বলা হয়েছে যে গত শতকের বিশের দশকে, বিশেষ করে আজকের দিনে যে এলাকাকে ‘গো-বলয়’ বলে চিহ্নিত করা হয়, সেই এলাকায় হিন্দু আর মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা শুরু হয়। প্রধানত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উভয় সম্প্রদায়ের বেশ কিছু ব্যক্তি ও সংস্থা নিজেদের কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণা ত্যাগ করে যুক্তিবাদী পথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। একই সময়ে আবার উভয় সম্প্রদায়েরই অপর গোষ্ঠী ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে শুধু বাঁচিয়ে রাখা নয়, বরং নবরূপে তাকে আরও ব্যাপকভাবে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত প্রধান জাতীয়তাবাদী সংগঠন কংগ্রেসে এই দুই গোষ্ঠীরই উপস্থিতি দেখা যায়। ব্যাপকতর জনসমর্থনের আশায় কংগ্রেসের নেতারা সবাইকে নিয়ে চলার নীতি নিয়ে চলছিলেন। স্বভাবতই পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় সংখ্যাগুরু উদারপন্থী হিন্দু নেতারা দলের নীতিকে বেশি করে প্রভাবিত করে ফেলছে দেখে উভয় গোষ্ঠীরই কট্টরপন্থীরা ক্রমে ক্রমে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব, প্রয়োজনে দলের বাইরে গিয়ে, গড়ে তুলতে থাকে।
ঠিক এই ছবি আমরা গীতা প্রেসের কাজকর্মে দেখতে পাই। প্রথমদিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের অকুণ্ঠ সমর্থন পায় গীতা প্রেস ও কল্যাণ পত্রিকা। এই পত্রিকায় যেমন লিখতে থাকেন মোহনদাস গান্ধি, বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি, গোবিন্দ বল্লভ পন্থ-এর মতন কংগ্রেসি নেতা তেমনই আরএসএস-প্রধান গুরু গোলওয়ালকর, রাম রাজ্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী করপতৃ মহারাজ, আধ্যাত্মিক নেতা প্রভুদত্ত ব্রহ্মচারী। বিপরীত মেরুর নেতাদের এই সহাবস্থান কল্পনা করা আজকের দিনেও দুঃসাধ্য। কিন্তু গীতা প্রেস আর কল্যাণের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হনুমান প্রসাদ পোদ্দার এটা করতে পেরেছিলেন বলেই উত্তরভারতের হিন্দুধর্মীদের মধ্যে তাঁর শিকড় এত গভীরে প্রোথিত।
অনন্য এই সহাবস্থান কী কৌশলে পোদ্দারজি বজায় রেখে চলছিলেন তার একটা উদাহরণ দেখা যাক। ছেলেদের বয়স ১৮ আর মেয়েদের বয়স ১৪ হলেই তারা আইনানুগভাবে বিবাহযোগ্য হবে বলে সারদা আইন পাশ করা হয় ১৯২৯ সালে। হনুমানপ্রসাদজি, যিনি ১৯৭১ সালে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত কল্যাণ-এর সম্পাদক ছিলেন, এই আইনের কট্টর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু কল্যাণ পত্রিকা এই সারদা আইন প্রসঙ্গে একটি বাক্যও উচ্চারণ করল না সে-সময়ে। ওই সময়ে তিনি গীতা প্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জয়দয়াল গোয়ান্দকা-কে চিঠি লিখে জানাচ্ছেন: “আমি এই আইনের তীব্র বিরোধী শুধু এই কারণে নয় যে এই আইন বালিকাদের বয়স সংক্রান্ত প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত, বরং এই কারণে যে এই আইন আমাদের ধর্মীয় বিষয়ে অনুপ্রবেশ করছে। ভবিষ্যতে যাতে এই সব বিষয়ের ওপর আইন তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করা হয় সেই কারণে এই আইন প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। একমাত্র পন্থা হচ্ছে এই আইন ভঙ্গ করা আর জেলে যাওয়া। আমার মনে হয় সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করে লাভ হবে না। রাজনৈতিক দিক থেকে এই আইনের বিরোধিতা করতে হবে।” এর সঙ্গে উনি এটাও বললেন: “এই প্রশ্নে কল্যাণ পত্রিকার জড়িত না হওয়াই উচিত। বরং মানবতা, আদর্শ আচরণ এবং ভগবানের প্রতি ভক্তি এই সব বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত। আজকের দিনে কল্যাণ-এর বার্তা হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে প্রচারিত হচ্ছে। যে মুহূর্তে আমরা রাজনৈতিক [পত্রিকা] হয়ে যাব এরা আমাদের থেকে সরে যাবে। এটা গ্রাহক হারানো নয় বরং নীতিভ্রষ্ট হওয়া।”
প্রাথমিকভাবে পোদ্দারজি রাজনীতির ওপরে আধ্যাত্মিকতাকে স্থান দিয়ে ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের আপাত-ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক পথে চলার প্রচেষ্টাকে তিনি ভাল চোখে দেখেননি বলে ক্রমে ক্রমে দূরে সরে আসছিলেন। স্বাধীনতার ঠিক পুর্ববর্তী সময় থেকে তিনি কট্টরপন্থীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রথমে তথাকথিত ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ গোষ্ঠীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর পরবর্তী সময়ে জনসঙ্ঘের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কংগ্রেস সরকারের নীতির প্রত্যক্ষ বিরোধিতার রাজনীতিতে সরাসরি নেমে পড়লেন। ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ যতই সোচ্চার হতে লাগল গীতা প্রেস আর কল্যাণ ততই কট্টরপন্থী রক্ষণশীল গোষ্ঠীদের সঙ্গে মিলে যেতে লাগল।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে সমাজ সংস্কারের আন্দোলন, বিশেষ করে নিম্নবর্গের মানুষের সম-অধিকার দাবীর আন্দোলনও গড়ে উঠছিল। এই আন্দোলন বিশেষ করে বর্ণাশ্রম-ভিত্তিক হিন্দু সমাজকে বেশি ধাক্কা দিতে শুরু করে। ভারতের বিস্তৃত অংশে ছড়িয়ে থাকা হিন্দুদের ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে বিভিন্নতা এতই বেশি যে আদালতের পক্ষে ব্যক্তিগত সমস্যা সংক্রান্ত বিরোধিতার সুষ্ঠু সমাধান করা দুরূহ হয়ে পড়ছিল। একেক বিচারক একেকভাবে নিজস্ব দৃষ্টিতে হিন্দু ল ব্যাখ্যা করে বিচার করছিলেন। এই সমস্যার সমাধানে ১৯২১ সালে দুই ভারতীয় সদস্যের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাকে সামনে রেখে ব্রিটিশ সরকার “হিন্দু কোড অফ ফ্যামিলি ল” তৈরি করার উদ্যোগ নেয়। স্থাবর সম্পত্তিতে বিধবা পুত্রবধূকে অধিকার প্রদান করে দেশমুখ আইন নামে পরিচিত ‘হিন্দু উওমেন’স রাইটস টু প্রপার্টি অ্যাক্ট’ পাশ হয় ১৯৩৭ সালে।
১৯৪১ সালে ব্রিটিশ সরকার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি বিএন রাউ-কে চেয়ারম্যান করে চার সদস্যের এক হিন্দু ল কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান কাজ ছিল দেশমুখ আইন কার্যকরী করতে যে সব অসুবিধা হচ্ছে সেগুলি দূর করা। ওই বছরের শেষের দিকে রাউ কমিটি জানাল যে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে লিঙ্গসাম্য স্বীকৃতির মতো মৌলিক পরিবর্তন আনা যেতে পারে কেবলমাত্র সামাজিক প্রগতি আর আধুনিকতার মাধ্যমে। তার জন্য প্রয়োজন সকল ‘হিন্দু’ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক অভিন্ন ‘হিন্দু কোড’। প্রবহমান, রক্ষণশীল আর সংস্কারপন্থী ব্যক্তিদের সাহায্য নিয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আর সাম্প্রতিক হিন্দু আইনের বিভিন্ন ধারার সংমিশ্রণে এই কোড রচনা করা যেতে পারে। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯৪৪ সালে বিএন রাউ-কে চেয়ারম্যান করে হিন্দু ল কমিটি পুনর্গঠন করা হল। উত্তরাধিকার স্বত্ত্ব (Inheritance), প্রতিপালন (Maintenance), বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ (Marriage and Divorce), অপ্রাপ্তবয়স্কদের অভিভাবকত্ব ও দত্তক হিসাবে গ্রহণ করা (Guardianship and Adoption)— এই সব বিষয় নিয়ে খসড়া প্রস্তাব ‘হিন্দু কোড বিল’ নামে এই কমিটি প্রকাশ করে। বারোটি আঞ্চলিক ভাষায় এই বিল সারা দেশে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। রাউ কমিটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে সাক্ষ্য গ্রহণ করে। এই কমিটি আরও এগিয়ে গিয়ে ১৯৪৭ সালে সুপারিশ করে: ১. যৌথ পরিবারভিত্তিক সম্পত্তি মালিকানা ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে; ২. পিতার সম্পত্তিতে পুত্রের সঙ্গেই কন্যারও উত্তরাধিকার বর্তাবে; ৩. ভিন্ন জাতি বিবাহের সব বাধা তুলে দিতে হবে; ৪. আদালতে সম্পন্ন আইনসিদ্ধ বিবাহ আর ধর্মীয় আচারসিদ্ধ বিবাহ উভয়কেই একস্তরে স্বীকৃতি দিতে হবে; ৫. বিবাহ বিচ্ছেদ প্রথার সূত্রপাত ঘটাতে হবে।
১৯৪৩ সাল থেকেই কিন্তু আইনসভার ভিতরে আর বাইরে এই কোড তৈরির প্রচেষ্টার বিরোধিতা শুরু হয়ে যায়। সামাজিক সংস্কারের নামে আমাদের ধর্মকে আক্রমণ করা হচ্ছে বলে এই বিলের বিরোধিতায় নেমে পড়ে কট্টরপন্থী হিন্দুদের নানা গোষ্ঠী। কট্টরপন্থীদের এই পাঁচমিশেলি ঘোঁটের অন্যতম শরিক হয় গীতা প্রেস আর কল্যাণ হয় হিন্দু কোড বিরোধিতার প্রধান মুখপত্র। পাঠকদের কাছে এখন আর শুধু ধর্মপ্রচার নয়, ‘হিন্দু’ ধর্মাচরণের যে কোনও সামাজিক সংস্কারের প্রচেষ্টার সরাসরি বিরোধিতায় নেমে পড়ার আহ্বান আসতে লাগল কল্যাণ-এর কাছ থেকে। ১৯৪৬ সালে নির্বাচিত কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে কী কী আইন পেশ করা হচ্ছে সেদিকে সচেতন সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে কল্যাণ পত্রিকা। স্বামী-বিচ্ছিন্না মহিলাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাবের দিকে নজর গেল জয়দয়াল গোয়ান্দকা-র। আগস্ট ১৯৪৬-এ প্রকাশিত হিন্দু বিবাহ কী পবিত্রতা এবম্ তৎসম্বন্ধী কানুন শীর্ষক প্রবন্ধে গোয়ান্দকা যুক্তি দিচ্ছেন: “হিন্দুদের সামাজিক কাঠামোতে নারীস্বাধীনতার কোনও প্রতিশ্রুতি নেই। বিবাহ হওয়া পর্যন্ত সব মহিলাকে তার পিতার সঙ্গে থাকতে হবে, [বিবাহের পরে] স্বামীর সঙ্গে বিবাহিত নারী হিসাবে থাকতে হবে, আর স্বামীর মৃত্যুর পর থাকতে হবে হয় নিজের পুত্রের সঙ্গে অথবা কোনও আত্মীয়ের সঙ্গে। কোনওভাবেই তিনি স্বাধীন থাকতে পারেন না।”
হিন্দুজীবনের সব দিক নিয়ে শাস্ত্রের বিধান আছে— সেসব বিধান নিয়ে কোনও পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা অনুচিত— শাস্ত্রবাক্যই সবার ওপরে, লিখছেন গোয়ান্দকা। বিবাহবিচ্ছেদ, ভিন্ন জাতির মধ্যে বিবাহ আর সমগোত্রের মধ্যে বিবাহ— এই তিন বিষয়কে আইনসিদ্ধ করার যে প্রচেষ্টা কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি-তে শুরু হয়েছিল তার তীব্র বিরোধিতা করে চলেছেন তিনি। তাঁর মতে এই তিনটি আইন মহিলাদের ক্ষমতায়ন করবে না, যা করবে তা হচ্ছে মহিলাদের নৈতিক স্খলন। সেই কারণে হিন্দুদের উচিত হবে ঐক্যবদ্ধভাবে এইসব আইনের বিরোধিতা করা। গোয়ান্দকা আরও লিখলেন যে হিন্দুদের মহান নেতা মালব্যজি মনে করেন যে দেশের সামনে গুরুত্বপূর্ণ যে সব সমস্যা আছে তার থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য এই সব আইন আনা হচ্ছে।
স্বাধীন ভারতের জন্য সংবিধান রচনার কাজ শুরু করে কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি। বহু ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতির এই ভারতে ভারতীয়ত্বের অভিন্ন পরিচয় গড়ে তুলতে হলে একটা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (Uniform Civil Code UCC) প্রণয়ন করা দরকার বলে মনে করলেন কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি-র অনেক সদস্য। আবার অন্য অনেক সদস্যের মতে অভিন্ন বিধি চালু হলে অনেক জাতিগোষ্ঠী, বিশেষ করে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, তাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা হারিয়ে ফেলবে। এটা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। উভয়পক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে সমঝোতা হিসেবে সংবিধানে ৪৪ নম্বর ধারা সংযোজিত হল: “ভারতের সমগ্র এলাকার নাগরিকদের জন্য এক অভিন্ন দেওয়ানি বিধি অধিকারে আনার প্রচেষ্টা করবে রাষ্ট্র।”[2] বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন প্রধানত ধর্মীয় শাস্ত্র আর কিছুটা প্রচলিত রীতিনীতির দ্বারা পরিচালিত হয়। এর পরিবর্তে দেশের সকল নাগরিকের জন্য এক অভিন্ন ব্যক্তিগত আইন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা রাষ্ট্র করবে। মনে রাখা উচিত সংবিধানের এই ৪৪ নম্বর ধারাটি সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতি অংশে আছে— সুতরাং এটি আদালতের বিচারযোগ্য বিষয়ের মধ্যে পড়ে না। যারা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়ণের পক্ষে ছিলেন তারা এই সমঝোতার বিরোধিতা করে বললেন যে কীভাবে আর কতদিনের মধ্যে এই বিধি প্রস্তুত করা হবে তার কোন কথা সংবিধানের এই ৪৪ নম্বর ধারায় বলা নেই, সুতরাং এই ধারা সংবিধানে যুক্ত করা অর্থহীন। নেহরু এবং আরও অনেকের মতে এই ধারাটি প্রতীকী হলেও জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পথে প্রয়োজনীয় এক দিশানির্দেশ। নেহরু নিজে অভিন্ন বিধি-র পক্ষে হলেও এটা বুঝেছিলেন যে ভারতে ব্যক্তি আইন [Personal Law] ধর্মের সঙ্গে এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে খুব সহজে একে পালটানো যাবে না। রাজনৈতিক বাস্তবতাবোধ নেহরুকে বাধ্য করেছিল ‘বিচারপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাকে কার্যকরী করা যাবে না’ এমন এক ধারা সংবিধানে যুক্ত করতে। নেহরু চেয়েছিলেন কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক আচরণবিধি পরিত্যাগ করে এক যুক্তিবাদী আচরণবিধি যেন স্বাধীন ভারতে গড়ে ওঠে। সামাজিক সংস্কারের এই কাজে সংখ্যাগুরু “হিন্দু” সম্প্রদায়ের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে, তাহলে সংখ্যালঘু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষেরাও বুঝতে পারবে যে এই সংস্কারমুখী কার্যক্রম তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে আঘাত করবে না। সেইজন্য নেহরু প্রথমেই হিন্দু কোড বিলের ব্যবস্থা করতে উৎসাহী ছিলেন।
বিচারপতি রাউ-এর নেতৃত্বাধীন কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন সেই রিপোর্টে খুব সুন্দরভাবে প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ আর বর্তমান সমাজে যে নীতিগুলি আইনসঙ্গত এই দুটিকে মেলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই রচিত হিন্দু কোড বিল সামনে এল ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে। এই বিলে আদালতে আইনসিদ্ধ বিবাহ আর ধর্মীয় রীতি মেনে যে বিবাহ উভয়কেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় অনেক স্বাধীনতা আর নমনীয়তা আনা হয়েছে। বহুবিবাহ বে-আইনি করা হয়েছে, অন্য জাতি বা ধর্মাবলম্বীদের ও সমগোত্রীয়দের মধ্যে পারস্পরিক বিবাহে যে বাধা ছিল তা দূর করা হয়েছে, নপুংসকতার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ আইনসিদ্ধ করা হয়েছে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্বের প্রশ্নে এই বিল ব্যক্তির অধিকার ও রক্তের সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। বিধবা পত্নী, কন্যা ও পূর্বে মৃত যে পুত্র তার স্ত্রী— এদের সম-অধিকার দেওয়া হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে অনেক প্রগতিশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এই বিলের সরাসরি প্রত্যুত্তর পাওয়া গেল কল্যাণ পত্রিকায় সঙ্গে সঙ্গে। পত্রিকার জুন সংখ্যায় হিন্দু কোড বিল প্রসঙ্গে এক বিস্তারিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হল যার শীর্ষক: “হিন্দু সংস্কৃতি ধ্বংসের পরিকল্পনা”। প্রবন্ধের লেখকের নাম প্রকাশ করা হয়নি। প্রবন্ধে লেখা হল: যারা শাস্ত্র সম্বন্ধে কিছুই জানে না, কিন্তু পশ্চিমি সভ্যতা দ্বারা এতটাই প্রভাবিত যে শারীরিক চাহিদাকেই প্রাধান্য দেয়, হিন্দু জাতিকে ধ্বংস করার জন্যে এইসব হল তাদের কাজ।
বর্ণাশ্রমভিত্তিক পুরুষতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদী উপাসনা পদ্ধতিকে ‘সনাতন ধর্ম’ এই শব্দবন্ধের আড়ালে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন গীতা প্রেস ও কল্যাণ পত্রিকার পরিচালকেরা। সেই কারণে হিন্দু কোড বিলের মাধ্যমে হিন্দু সমাজের সংস্কারের এই প্রচেষ্টা তাদের কাছে হয়ে দাঁড়াল “হিন্দু সংস্কৃতি ধ্বংসের পরিকল্পনা”।
কল্যাণ পত্রিকার সমালোচনার অপর আরেক লক্ষ্য ছিলেন বাবাসাহেব আম্বেদকর, সে-সময়ের আইনমন্ত্রী। অচ্ছুতদের সম-অধিকার দাবি করছেন বলে এই পত্রিকা আগে থেকেই আম্বেদকরকে আক্রমণ করত। শুধু কুরুচিকর মন্তব্য নয় তাঁর জাতি নিয়েও আক্রমণ করা হয়। স্যার সুলতান আহমেদ, যিনি এই প্রস্তাব অ্যাসেম্বলিতে উত্থাপন করেছিলেন তিনিও এই আক্রমণ থেকে বাদ যাননি। রাউ কমিটির অন্যতম সদস্য বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র অন্য তিন সদস্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে নোট দিয়েছিলেন। সেই নোট অবলম্বন করেই কল্যাণ পত্রিকা তার আক্রমণ শানায়। বিচারপতি মিত্র কিন্তু যুক্তিতর্কের মধ্যে না গিয়ে ভিন্নমত পোষণ করার কারণ হিসাবে জানান: “হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মতামত এইদিকে ঝুঁকে আছে যে হিন্দু আইন-কে ‘কোড’ হিসাবে [শৃঙ্খলাবদ্ধ রূপে] লিপিবদ্ধ করা সম্ভবপর নয়, উচিত-ও নয়।”[3]
এই বিল প্রসঙ্গে বিচারপতি মিত্রের ভিন্নমত আর কট্টরপন্থী সব সংস্থা যেমন ভারত ধর্ম মহামণ্ডল, হিন্দু মহাসভা, অখিল ভারতীয় ধর্ম সঙ্ঘ, অখিল ভারতীয় বর্ণাশ্রম স্বরাজ সঙ্ঘ আর বিভিন্ন জৈন সংগঠনের বিরোধিতা গীতা প্রেসের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়াল। রক্ষণশীল নেতা যেমন মদনমোহন মালব্য ও কৈলাসনাথ কাটজু, মহিলা ঔপন্যাসিক অনুরূপা দেবী ও আরও অনেকে যে এই বিলের বিরোধিতা করছেন সেটা জানিয়ে কল্যাণ পত্রিকার ১৯৪৮ সালের জুন সংখ্যায় প্রশ্ন তোলা হল “এইসব ব্যক্তিদের কি কোনও জ্ঞানবুদ্ধি নেই? মুষ্টিমেয় কয়েকজন সংস্কারবাদী-ই শুধু সব কিছু জানে?”
হিন্দু কোড বিল সমাজে জাতি-বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস করবে এই যুক্তির জবাবে ওই একই প্রবন্ধে কল্যাণ বলল সমাজে সমতা যদি পশ্চিমি দুনিয়ায় শান্তি এনে থাকে তাহলে “অবিবাহিত মহিলাদের সংখ্যাধিক্য, অসংখ্য গর্ভপাত, ক্রমবর্ধমান বিবাহবিচ্ছেদ, নিজেদের মান-সম্মান আর পবিত্রতা বিসর্জন দিয়ে হোটেল আর দোকানে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে মহিলারা— এসব চিৎকার করে বলছে যে পাশ্চাত্য সভ্যতা নারীজাতির ক্ষেত্রে এক অভিশাপ।” “ঋষি মুনিরা তাঁদের জ্ঞান নিষিক্ত করে ভারতীয় মহিলাদের জন্য গৃহে ও সমাজে এই ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছেন।” সুতরাং সেই ব্যবস্থা অপরিবর্তনীয় এই হল কল্যাণের বক্তব্য।
হিন্দু-মুসলিম বিভেদের বিচ্ছুরণের আলোকে আলোকিত করে দিলে হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে এই সব যুক্তি সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিবর্গের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে বুঝতে পেরে সেটাও করা হতে লাগল। পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার দেওয়া সরাসরি তুলে আনা হয়েছে মুসলিম ল থেকে: “যেহেতু এই [হিন্দু কোড] বিল স্যার সুলতান আহমেদের মস্তিষ্কপ্রসূত, এটাই স্বাভাবিক যে এই ধরনের ব্যবস্থা [পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার] এই বিলে করা হয়েছে।” মহিলাদের এই অধিকার দেওয়া হলে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তার এক চিত্র কল্যাণ পত্রিকা তার পাঠকদের সামনে তুলে ধরছে: “এখন [সম্পত্তির উত্তরাধিকার স্বত্ব নিয়ে] শুধু ভাইদের মধ্যে যে বিবাদ হয় সেটা এবার থেকে ভাই-বোনেদের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে। কন্যা তার পিতার কাছ থেকে [সম্পত্তির ভাগ] হয়তো পেয়ে যাবে, কিন্তু সেই একই অধিকার তাকে দিতে হবে তার স্বামীর বোনেদের। লাভ কিছুই হবে না, বরং আমাদের গৃহে শান্তি-প্রশান্তি উবে যাবে। কন্যারা তাদের স্বামীর সঙ্গে থাকে। পিতার সম্পত্তির অংশ সেই কন্যা পেলে [তার স্বামীর] পরিবারের কী উপকার হবে?”
এদিকে ১৬ বছর বা তার থেকে অধিক বয়স্ক নারীদের স্বেচ্ছা-বিবাহের অধিকার দেওয়া হলে কী হতে পারে? সেই নারী মুসলিম পুরুষের সঙ্গেও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। নারী অঙ্ক— কল্যাণ পত্রিকার ১৯৪৮ সালের ৮৮২ পৃষ্ঠার এই বিশেষ সংখ্যায় লেখা হচ্ছে: “ঘরের এক কোণে ভগবান পূজিত হচ্ছেন, অপর প্রান্তে কোরান পাঠ করা আর গো-মাংস রান্না করা হচ্ছে। এই ধরনের আইন কোন হিন্দু সহ্য করবে?” সমগোত্র বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ করার প্রথা তুলে দিলে একই ধরনের ভীতির মুখোমুখি হতে হবে। ‘বিবাহবিচ্ছেদ মার্কিন সমাজের এক কলঙ্ক’ মার্কিন এক লেখকের এই উদ্ধৃতি দিয়ে কল্যাণ পত্রিকায় লেখা হচ্ছে যে আমরা বিবাহবিচ্ছেদ ব্যবস্থা নামক এই সামাজিক ব্যাধিকে গ্রহণ করছি।
হিন্দু বিবাহ ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করা বা এর কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক সেটা বলার অধিকার আছে কেবলমাত্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত আর বিদ্বজ্জনেদের— এই কথা বলে কল্যাণ তার পাঠকদের আহ্বান করছে হিন্দু কোড বিলের প্রতিবাদ করে জওহরলাল নেহরুর কাছে চিঠি পাঠাতে।
এই বিল নিয়ে সিলেক্ট কমিটিতে আলোচনা হবে ১৯৪৮ সালের ২০ জুলাই, আর অ্যাসেম্বলি অধিবেশন শুরু হবে ৪ আগস্ট। কল্যাণ হিন্দু কোড বিলের যারা বিরোধিতা করছে তাদের সবাইকে— এমনকি জৈনদের, আর্য সমাজের সদস্যদের এবং শিখদের— সোচ্চার হওয়ার আহ্বান করল। বিরোধীদের মধ্যে আগে থেকেই সোচ্চার ছিলেন স্বামী করপতৃ— গীতা প্রেসের পুরনো বন্ধু শুধু নন, যে দৈনিক পত্রিকা সন্মার্গ-এর তিনি প্রতিষ্ঠাতা তার পাতায় পাতায় এই প্রসঙ্গ নিয়ে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। এখন দুই পত্রিকাই তাদের শক্তি একজোট করে এই বিলের বিরোধিতায় নামল। সন্মার্গে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তি ওই বছরের জুলাই সংখ্যায় কল্যাণ পত্রিকায় প্রকাশিত হল। “প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত আছে। সরকার বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নেবে আর এই বিল পাশ করাবে। সরকারের উচিত হবে গণতন্ত্রের নীতি অনুসরণ করা… যারা গ্রামে থাকে তারা এই হিন্দু কোড বিল নিয়ে কিছুই জানে না। …আমরা নেহরুকে অনুরোধ করব তিনি যেন মনোযোগ সহকারে [বিচারপতি] মিত্র যে ভিন্নমতের নোট দিয়েছেন সেটা পাঠ করেন। যারা এই বিলের বিরোধী তাদের সবাইকে ৪ আগস্টের আগে [বিরোধিতার] চিঠি ও টেলিগ্রাম পাঠাতে অনুরোধ করব। এখন এটা না করা হলে পরে বলা হবে যে বিলের বিরুদ্ধে যথেষ্ট মত ছিল না।”
কল্যাণ-এর আগস্ট সংখ্যায় সরকারের কাছে আবার এক ঐকান্তিক আবেদন করা হল। আগের সব যুক্তির পুনরুক্তি করে এই বিলের অন্যতম সক্রিয় বিরোধী মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী ভগবান দাস হালনা তাঁর ভাষায় ‘হিন্দু ভারতের মুকুটহীন রাজা’ মদনমোহন মালব্যের মতামতের দিকে নজর দিতে বললেন অ্যাসেম্বলির সদস্যদের। একই সঙ্গে বিবেচনা করতে বলা হল কলকাতা হাইকোর্টের চারজন বিচারপতির লিখিত মত যাতে বলা হয়েছে: “হিন্দু ল-এর অধিকাংশ রীতিনীতি এখন মোটামুটি স্থির করা হয়ে গেছে আর উপলব্ধি করা গেছে। এবং সেই কারণে আর কোনও কোড প্রস্তুত করার প্রয়োজন হচ্ছে না। কোনও দেশে যে কোনও সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনের সম্পূর্ণাংশ একটি কোডের মধ্যে আবদ্ধ করা হয়েছে বা এরকম করার চেষ্টা করা হয়েছে এটা আমাদের জানা নেই। এবং আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস যে ভারতের সব সম্প্রদায়ের লোকেরা, যেমন উদাহরণ হিসাবে মুসলিমেরা, তাদের ওপর ব্যক্তিগত আইনের এক কোড চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করবে। হিন্দুদের জন্য কেন আলাদা ব্যবস্থা হবে এর কোনও যুক্তি আমরা দেখছি না।” দেশের সাংস্কৃতিক বহুমুখিনতা রক্ষা করার লক্ষ্যে বিচারপতিরা এই মত প্রকাশ করেছিলেন। গীতা প্রেসের বিরোধিতা কিন্তু সনাতন ধর্মের নামে ব্রাহ্মণ্যবাদের কুসংস্কার ও অবৈজ্ঞানিক আচরণবিধি পরিবর্তনের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এটা মনে রাখতে হবে।
১৯৪৮-এর আগস্ট অধিবেশনে কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে এই বিল আনা হল না। কিন্তু এই বিলের বিরুদ্ধে প্রচার কল্যাণ পত্রিকা চালিয়ে যেতে লাগল। পত্রিকার অক্টোবর সংখ্যায় পাঠকদের সতর্ক করে হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার সম্পাদকীয় লিখলেন: “আইনগত কারণ দেখিয়ে [তৎকালীন কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি] প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্র প্রসাদ এই আইন স্থগিত রাখার উপদেশ দিলেও সেটা গৃহীত হয়নি। পরবর্তী অধিবেশন অবধি এই বিল নিয়ে বিতর্ক আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ঠিক আগের মতো সাধারণ নাগরিক ও সংস্থাদের এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদসভা করতে হবে আর চিঠি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে যেতে হবে।”
এতদিন ধরে কল্যাণ পত্রিকা হিন্দু কোড বিলের বিরোধিতা করে আসছিল ধর্মীয় আর সাম্প্রদায়িক যুক্তিজালের মাধ্যমে। ১৯৪৯ সালের মার্চ সংখ্যায় ‘হিন্দু কোড বিল: সংস্কৃতি আর ধর্মের পক্ষে এক বিপদ’ শীর্ষক চার পৃষ্ঠার এক প্রবন্ধ প্রকাশ করে এখন থেকে সরাসরি রাজনৈতিক বিরোধিতায় নেমে পড়ল। তিনটি প্রশ্ন তুলে বিলের বিরোধিতা করা হল। প্রথমত, ধর্মীয় বিষয়ে আইন প্রণয়নের কোনও অধিকার নেই কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির। দ্বিতীয়ত, কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি যে বিবাহব্যবস্থা হিন্দুদের কাছে পবিত্রতম এক ধর্মীয় রীতি সেই বিবাহ বিষয়ে আইন করতে যাচ্ছে। এর ফলে ধর্মীয় বিষয়ে কন্সটিট্যুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি হস্তক্ষেপ করবে না বলে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেটি ভঙ্গ করা হচ্ছে। তৃতীয়ত, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে একটি বিশেষ ধর্মসংক্রান্ত কোনও আইন প্রণয়ন করা আপত্তিজনক। কৌশলে এ কথাও বলে দেওয়া হল যে সংখ্যালঘুদের ছেড়ে দিয়ে শুধু সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিষয়ে আইন তৈরির প্রচেষ্টা নেহরুর মুসলিমতোষণ নীতি নয় কি?
এই প্রবন্ধে বিলের এক একটি ধারা তুলে ধরে তার বিরোধিতা করা হয়েছে। এখানে সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবুও এই বিল গৃহীত হলে কী কী ধরনের বিপদ আসতে পারে বলা হয়েছে এই প্রবন্ধ থেকে তার একটা উদাহরণ দিচ্ছি। উচ্চবর্ণের যেমন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য পিতার কোনও অস্থিরমতি সন্তান নীচ জাতি বা খ্রিস্টান বা মুসলিম কোনও মহিলাকে বিবাহ করে নিয়ে এলে বা নিজে আমিষাশী হয়ে গেলে বর্ণাশ্রম পালন করে যে পরিবার, তার পক্ষে অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয় হবে। খ্রিস্টান বা মুসলিম কোনও ব্যক্তি যদি নিজেকে হিন্দু ঘোষণা করে হিন্দু মহিলাকে বিবাহ করে, তাহলে এই দম্পতির পুত্র মায়ের সম্পত্তিতে অধিকার লাভ করবে, আবার পিতার পুরনো ধর্মবিশ্বাসেও ফিরে যেতে পারবে।
তবে সবচেয়ে বড় যে বিপদ আসতে পারে বলে এই প্রবন্ধে বলা হয়েছে সেটা হল এই যে শাস্ত্রীয় মতে বিবাহ ক্রমে ক্রমে হ্রাস পাবে, ‘সিভিল ম্যারেজ’, বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাবে। ফলে ‘পতিব্রতা স্ত্রী’ যিনি স্বামীকে পূজা করেন তাদের সংখ্যাও কমে যাবে। বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলাকে ভরণপোষণের জন্য অর্থ যাতে না দিতে হয় সে কারণে স্বামীরাও স্ত্রীদের বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতার কাহিনি প্রচার করবে। যে কোনও হিন্দু ব্যক্তি অ-হিন্দু শিশুকে দত্তক নিতে পারবে এটা হল আরেকটি বিপদ।
হিন্দুদের যৌথ পরিবার প্রথা এই বিলের ফলে ভেঙে পড়বে এমনই আশঙ্কা কল্যাণ পত্রিকার। “সহস্র বছর ধরে চলে আসা শোষণকারী বিদেশি শাসন সত্ত্বেও হিন্দু পরিবারেরা যে তাদের সম্পদ বজায় রাখতে পেরেছে তার কারণ এই যৌথ পরিবার প্রথা।” পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিবারের কোনও এক ব্যক্তিকে তার অংশীদারিত্বের অধিকার দিলে সে সেই অধিকারের বলে তার অংশ বিক্রি করে দিতে পারে। ফলে সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে সঙ্কট সৃষ্টি হবে, নতুন বিলের মাধ্যমে উত্তরাধিকারের প্রশ্ন পুরুষ বংশধরদের মধ্যে যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ, অর্থাৎ, ‘কর্তা’-র কর্তৃত্ব হ্রাস পাবে বলে মনে করে কল্যাণ।
এই বিলের প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় এগিয়ে আসার জন্য পত্রিকা পাঠকদের কাছে আহ্বান করতে লাগল। এই বিল তর্কসম্মত নয়, শাস্ত্রসম্মত নয়, এমনকি লোকসম্মত-ও নয় বললেন স্বামী করপতৃ। কংগ্রেসের অনেকেই যে এই বিলের পক্ষে নেই তার প্রমাণ হিসাবে যুক্তপ্রদেশের আইনসভার কংগ্রেসি সদস্য অলগু রায় শাস্ত্রীর নাম উল্লেখ করা হল। বিস্মিত হতে হয় এই কারণে, যে শাস্ত্রীজি নিজে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন তিনিই সরকারকে উপদেশ দিয়ে বললেন যে এইসব বিষয় ধর্মগুরুদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত, সামাজিক সংস্কারের নামে সীমা অতিক্রম না করাই সরকারের পক্ষে ভাল।
হিন্দু কোড বিল বিতর্কে কল্যাণ পত্রিকা এক অভিনব সাহিত্যিক হাতিয়ার কাজে লাগাল। এদেশে অনেক সময়েই সাধুবাবা বা পীরসাহেব কবচ, তাবিজ, এমনকি দেশজ ওষুধের ক্ষেত্রে বলে যে তারা এই বিশেষ জিনিসটি নিদ্রিত অবস্থায় স্বপ্ন থেকে পেয়েছেন। স্বপ্নে পাওয়া এইসব জিনিসের বাজার স্থানীয়ভাবে, বিশেষ করে অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে বেশ ভাল। সেই পথে গিয়ে বলা হল যে ১৫ জুন ১৯৪৯ তারিখে ‘মধ্যরাত থেকে প্রভাতকাল’ অবধি স্বামী করপতৃ এক স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটিতে শোনা গেছে যেসব কথাবার্তা তার সবগুলিই স্বামীজির মনে আছে। পত্রিকার আগস্ট সংখ্যায় সেই সম্পূর্ণ কথাবার্তা প্রকাশ করা হল। স্বপ্নে দেখা গিয়েছিল এক আদালতকক্ষ, সেখানে আম্বেদকর ছিলেন আইনজীবী হিসাবে। বিচার চলছিল একটি মামলার। এক ব্রাহ্মণ মহিলাকে তার ডাক্তার প্রলুব্ধ করে বিয়ে করেছে। নিজেকে মাদ্রাজি ব্রাহ্মণ বলে দাবি করলেও পরে জানা গেছে যারা পশুচর্মের কাজ করে ডাক্তার সেই অচ্ছুত নীচ চামার জাতিভুক্ত। ডাক্তারের জাতি নিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিল যে ব্যক্তি সে-ও দেখা যায় ওই নীচ জাতিরই লোক। ব্রাহ্মণ মহিলা অভিযোগ করে যে বিবাহিত অবস্থায় ওই মহিলা তার পিতার সম্পত্তির অংশ পায়। সম্পত্তির সেই অংশ বিক্রি করে দিয়ে প্রাপ্ত অর্থ মহিলার স্বামী হস্তগত করে নেয়। স্বপ্নে দেখা যায় যে মহিলার স্বামীর উকিল হিসাবে আম্বেদকর বলছেন যে হিন্দু কোড বিল অনুসারে তাঁর মক্কেল অন্যায় করেনি। কিন্তু, বিচারক হিন্দু কোড বিলকে বে-আইনি বলে ব্রাহ্মণ মহিলার পক্ষে রায় দেন। আম্বেদকর প্রতিবাদ করেন, এমনকি বিচারককে পদচ্যুত করা হবে বলে শাসানি দিলেও বিচারক জবাবে বলেন যে তিনি “প্রকৃতি মা”-কে অনুরোধ করবেন যে ঠিক যেভাবে “প্রকৃত সাদা ইংরেজ শাসকদের” চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে সেভাবেই “এই কালা ইংরেজ শাসকদের” যেন ছুড়ে ফেলা হয়। এরপরেই “প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে”।
হনুমানপ্রসাদ পোদ্দারের বৈরিতার প্রধান লক্ষ্য ছিলেন বাবাসাহেব আম্বেদকর। যে কোনও উপলক্ষ্যে আইনমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁকে অপসারণের দাবিতে সোচ্চার ছিল কল্যাণ পত্রিকা। হিন্দু দেবতা রাম ও কৃষ্ণ প্রসঙ্গে আম্বেদকরের সমালোচনামূলক বক্তব্যের সুযোগ নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে এবং আম্বেদকরের ‘হিন্দু বিরোধী’ মনোভাবের বিরুদ্ধে পত্রিকার পাতায় পাতায় ঝড় তুলেছে সে সময়ে। পত্রিকার মে মাসের সংখ্যায় ভবিষ্যদ্বাণী করা হল: “এই সব [হিন্দু বিরোধিতার] চিহ্ন গণতন্ত্রের শিশুকালের পক্ষে আদৌ ভাল ইঙ্গিত বহন করে না।… এতদিন ধরে হিন্দু জনগণ তাঁর [আম্বেদকরের] বক্তব্য ঐকান্তিকভাবে গ্রহণ করছিল। কিন্তু এখন এটা নিশ্চিতভাবে জানা গেছে যে আম্বেদকর যে হিন্দু কোড বিল উপস্থাপন করেছেন সেটি হিন্দু ধর্মকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এইরকম এক ব্যক্তি যে তাদের আইনমন্ত্রী এটা এক বিশাল অবমাননাকর বিষয়, হিন্দুদের পক্ষে লজ্জাজনক আর হিন্দু ধর্মের ওপর এক কলঙ্কচিহ্ন। আমাদের উচিত সরকারকে চাপ দিয়ে শান্তিপূর্ণ অথচ কার্যকরী এমন পন্থায় এঁকে [আম্বেদকরকে] অপসারণ করা আর হিন্দু কোড বিল প্রত্যাহার করা।”
কল্যাণ পত্রিকা ভারতের ‘ধর্মপ্রবণ’ রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ‘আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ’ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, ‘বিজ্ঞ অভিজ্ঞ’ গৃহমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল, আর কংগ্রেসের ওপরতলার নেতাদের আহ্বান করে লিখছে যে নিজেদের বিচারবুদ্ধি আর গণতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাস দেখিয়ে আম্বেদকরকে বরখাস্ত করুন আর হিন্দু কোড বিল প্রত্যাহার করুন। আইনসভায় নানা যুক্তিতর্ক, পয়েন্ট অফ অর্ডার এসবের মাধ্যমে এই বিলকে আলোচনায় আনতেই দেওয়া হল না। ঠান্ডা ঘরে চলে গেল বিল ১৯৫১ সালে আর বিরক্তি নিয়ে আইনমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করলেন আম্বেদকর।
কিন্তু এই ধরনের সামাজিক সংস্কার প্রচেষ্টার বিরোধিতা থেকে হনুমানপ্রসাদজি আর তাঁর কল্যাণ পত্রিকা থেমে থাকল না। ১৯৫১ সালের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় কল্যাণ পত্রিকা লিখল: “দেশের কোথাও খরা, কোথাও বন্যা। খাদ্যের জন্য লোকে হাহাকার করছে। অন্যদিকে পাকিস্তান জেহাদের আহ্বান জানাচ্ছে আর মিঞা লিয়াকত লড়াই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের নীতি হওয়া উচিত ঐক্য আর পারস্পরিক মমত্ববোধ জোরদার করা যাতে করে প্রত্যেকে এক সুরে সরকারকে সমর্থন আর শক্তিশালী করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এইরকম এক পরিস্থিতিতে সরকার হিন্দু কোড বিল নিয়ে আসছে।” পোদ্দার ভেবেছিলেন যে ১৯৫১-৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে এই হিন্দু কোড বিলের প্রসঙ্গ সামনে আনলে রক্ষণশীল গোষ্ঠী লাভবান হবে। কিন্তু ফল হল উলটো— কংগ্রেস দলের বিরাট জয় রোধ করা গেল না। নেহরুর নেতৃত্বাধীন নবনির্বাচিত সরকার আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এই সংস্কারের কাজে লেগে পড়ল। হিন্দু কোড বিলকে চারটি আলাদা আলাদা অংশে ভাগ করে চারটি পৃথক বিল পাশ করানো হল— হিন্দু বিবাহ নিয়ে হিন্দু ম্যারেজ বিল, উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে হিন্দু সাকসেশন বিল, শিশুদের অধিকার নিয়ে হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্জিয়ানশিপ বিল এবং দত্তক নেওয়া ও ভরণ-পোষণ সংক্রান্ত হিন্দু অ্যাডপশনস অ্যান্ড মেন্টেন্যান্স বিল। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সাল এই তিন বছরের মধ্যে বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে এই চারটি বিল আইনসভায় গৃহীত হয়ে আইনে পরিগণিত হল।
কিন্তু পোদ্দারজি বা গীতা প্রেস হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। ১৯৫৪ সালে হিন্দু সাকসেশন আইনের প্রসঙ্গে জনমত সমীক্ষা করতে এগিয়ে এল সরকার। পোদ্দারজি পত্রিকার পাতায় বিলের বিরোধিতা করে পাঠকদের— “শিক্ষিত, বিচক্ষণ, হিন্দু জনতা, হিন্দু সংগঠন, ধর্মগুরু ও ব্যবসায়ী সংস্থাদের” অনুরোধ করলেন বিলের বিরোধিতা করে আইনমন্ত্রীকে চিঠি লিখতে। কিন্তু এই যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তবুও এই কাজের জন্য গীতা প্রেস কংগ্রেসকে, বিশেষ করে নেহরুকে, কোনওদিন ক্ষমা করেনি।
গীতা প্রেস ও তার পরিচালক হনুমানপ্রসাদ পোদ্দার মনে করেন যে এই ধরণের সংস্কারমূলক কাজ আসলে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাসের ওপর আক্রমণ। সেইজন্য এর পরবর্তী সময়েও গীতা প্রেস কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক ধর্মবিশ্বাসের প্রচারক হিসাবে নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে লাগল। তার প্রমাণ হিসাবে গীতা প্রেসের কয়েকটি প্রকাশনার কথা উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে বলে মনে হয়, যেমন হনুমানপ্রসাদের লেখা নারী শিক্ষা, জয়দয়াল গোয়ান্দকা-র লেখা ‘স্ত্রীয়োঁ কে লিয়ে কর্তব্য শিক্ষা এবং নারী ধর্ম’, প্রশ্নোত্তরের ঢঙে লেখা স্বামী রামসুখ দাসের ‘গৃহস্থ মেঁ কেইসে রহেঁ’ পুস্তিকা। শিব পুরাণ, মনুস্মৃতি এইসব থেকে অনেক উদ্ধৃতি সঙ্কলিত করেও পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। একটি ইংরিজি বইয়ের কথা উল্লেখ করা অবশ্যকর্তব্য— ‘Cremation of a Wife with her Husband’s Dead Body is the Backbone of Hindu Religion’, লেখক প্রভুদত্ত ব্রহ্মচারী। আজকের দিনে সতীদাহ প্রথাকে গৌরবান্বিত করে যিনি বই লেখেন আর যারা সেই বই প্রকাশ করে তাদের মানসিকতা কোন স্তরের সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকে কি?
গত শতকের বিশ-ত্রিশের দশক থেকে ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা হয়। ধর্মীয় জাতিগত বর্ণগত সব বিভেদকে দূরে সরিয়ে রেখে এক জাতীয়তাবাদ ‘ভারতীয়ত্ব’ এই উপমহাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে বিকশিত হতে শুরু করে। অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, নিম্নবর্গের মানুষদের সামাজিক ক্ষমতায়ন এইসব প্রচেষ্টা আর একই সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম গণমুখী হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে এই জাতীয়তাবাদী ধারণা এক নতুন রূপ গ্রহণ করে। একই সঙ্গে, সাম্রাজ্যবাদী শাসকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় কট্টর ধর্মীয়তাকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে বিভাজন ঘটানোর প্রচেষ্টাও শুরু হয়। এরই ফলশ্রুতি হিসাবে ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদের কথা উঠতে শুরু করে। ভারতীয়ত্বকে ছাপিয়ে তথাকথিত ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’, ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’, এমনকি ‘শিখ জাতীয়তাবাদ’ এসব প্রসঙ্গ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়ে। এর বিষময় ফল হিসেবে পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, আর দেশবিভাজন।
গীতা প্রেস তার প্রথম দিন থেকে এই দ্বিতীয় পন্থা, ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-এর শুধু অনুসারী নয়, বরং প্রবল সফল এক প্রচারক। দেশের হিন্দু জনগণের ব্যাপক অংশকে যে কোনও সংস্কারমুখী বৈজ্ঞানিক সংস্কার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা গীতা প্রেস আর এর পরিচালকেরা পালন করেছেন আর এখনও করে চলেছেন তার উদাহরণ ওপরের আলোচনার ছত্রে ছত্রে দেখা যাচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতা এখন যাদের হাতে তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ‘হিন্দু’ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করা। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা গীতা প্রেস এবং এ ধরনের সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। সেই কারণে গীতা প্রেসের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি যাবেন, অগ্নিগর্ভ মণিপুরে যাওয়ার সময় না পেলেও প্রধানমন্ত্রী যাবেন গোরক্ষপুরে। এসব ঘটনা এখন স্বাভাবিক। কলকাতায় মিনিবাসে কন্ডাক্টর যেমন যাত্রীদের বলে তেমনই আজ আমাদের দেশ ও সমাজ ‘পেছনদিকে এগিয়ে’ যাচ্ছে।
[1] ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ শব্দবন্ধটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। বহুমাত্রিক ভারতের মতো দেশে (বা উপমহাদেশে) জাতীয়তাও বহুমাত্রিক। কোনও একটি বিশেষ ধর্ম বা ভাষা দিয়ে এই জাতীয়তাকে সূচিত করা যায় না। সেই কারণে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ বা ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ শব্দবন্ধগুলি ‘সোনার পাথরবাটি’ বা ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ জাতীয় শব্দবন্ধ যেখানে বিশেষ উদ্দেশ্যে পরস্পরবিরোধী দুটি শব্দকে পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে। ভারতের প্রেক্ষিতে যে মুহূর্তে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে কোনও ধর্ম বা ভাষা-র নাম জড়িয়ে দেওয়া হল সেই মুহূর্তে সেটা আর ভারতীয়ত্বের প্রতিনিধিত্বকারী শব্দবন্ধ থাকল না, ভারতীয়ত্ব বিভাজিত হয়ে গেল। দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তারা একারণেই সচেতনভাবে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-জাতীয় শব্দবন্ধ ব্যবহার করে চলেছে। বহু প্রচারিত বলে আমরা ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ এই শব্দবন্ধ তাদের জন্য ব্যবহার করছি যারা ‘রক্ষণশীল কট্টরপন্থী হিন্দু’ তাদের চিহ্নিত করতে।
[2] 44. Uniform civil code for the citizens: The State shall endeavour to secure for the citizens a uniform civil code throughout the territory of India.
[3] “…the majority of the Hindus incline to the view that the codification of Hindu Law is neither possible nor desirable.”