জুয়েল মাজহার
কাল রাতে ফল্গুদার মৃত্যুসংবাদটি দিলেন গৌতমদা; কবি গৌতম চৌধুরী। যখন দিলেন তখন অনেক রাত। গত ক’দিন অনলাইনের বাইরে ছিলাম। ভাতিজির বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি গিয়েছিলাম। ফিরেছি কেবল ঘণ্টাকয় আগে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর। ফেসবুকে ঢুকেই এই সংবাদ!
গৌতমদা ইনবক্সে লিখলেন:
একটি দুঃসংবাদ– ফল্গু বসু আর নেই
SUN 11:57PM
কিছু লিখব কিন্তু কী লিখব? কিছু একটা লিখতে গিয়ে দেখি কী-বোর্ডে বাংলা লেখা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না জানি না। অগত্যা লিখলাম ভিনদেশি ভাষায়: ”haay! I LIKED AND LOVED HIM SO MUCH”. বসে রইলাম। অনেকক্ষণ।
আমার কেমন যেন লাগছিল; এমন একজনের জন্য যাকে চাক্ষুষ করিনি কখনও। কবিতা নামের জগৎসংসারে কোনও-কাজে-লাগে-না এমন এক অলাভজনক, অহিতকর আগুন নিয়ে খেলবার, অথবা, গতানুগতিক জীবনের উল্টোস্রোতগামী এক কুটো ধরে ভেসে থাকবার অভিন্ন নিয়তির বাইরে আর কোন আত্মীয়তা ছিল আমাদের? তবু কেন এই স্বজনবিয়োগবেদনা আমাকে মধ্যরাতে স্তব্ধ করে দ্যায়!
ফল্গুদা আমার খুব একজন প্রিয় কবি শুধু নন, আমার খুব শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় মানুষও; বয়সের ব্যবধান উজিয়ে আমরা বন্ধু হতে পেরেছিলাম। হয়তো বা তিনি আমায় কিছুটা বুঝতে পারতেন বলে এবং সহ্য করতে পারতেন বলে। বহুবার এমনও হয়েছে, সদা-নির্বিরোধ ফল্গুদা আমার বক্তব্যকে সমর্থন করে দু’এক লাইন লিখেছেনও ফেসবুকে মন্তব্যের ঘরে– অতি-ভারতীয় উগ্র দু’একজনের অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। অথচ তাদের সঙ্গে নাকি ওঁর ছিল দীর্ঘদিনের জানাশোনা। এমনই প্রখর ছিল ওঁর ন্যায়বোধ। ওঁর চরিত্রের এই ব্যাপারটি আমায় মুগ্ধ করেছে। আমরা ক’জন এমন পারি?
ওঁর কবিতার শক্তিই আমাদের পরস্পরকে কাছাকাছি এনেছিল। পরে বন্ধুতার আবেগ তাতে যোগ করেছিল লাবণ্য। ওঁর কবিতার প্রসাদগুণ আমার মধ্যে বহুকাল মুগ্ধতার বোধ জাগিয়ে রাখবে।
ফল্গুদাকে নিয়ে আমার একটা আক্ষেপ আছে। বাংলাকবিতার পাঠকগোষ্ঠী, মিডিয়া ও মাইয়োপিক সমালোচকেরা কেন যেন এই শক্তিমান কবিকে তার প্রাপ্য স্বীকৃতি ও মর্যাদাটুকু দ্যায়নি। যেমন, কীর্তির তুলনায় প্রায় তেমন কিছুই দ্যায়নি আরেক প্রতিভাবান বীতশোক ভট্টাচার্যকে।
ফল্গুদা সস্তা ঠাটবাট আর চমকের কবি ছিলেন না। অনেক প্রস্তুতি আর পরম্পরাবাহিত এক দীর্ঘ যাত্রার ভেতর দিয়ে কবি হয়ে উঠেছিলেন। সে-সবের কুললক্ষণ ছড়ানো তার কবিতায়।
ফল্গু বসুর কবিতার ছিল এক নিজস্ব ভঙ্গি ও ম্যানারিজম যা অন্যদের কবিতা থেকে তার কবিতাকে আলাদা করে। যাকে আমরা বলি নিজস্বতা বা সিগনেচার। তাঁর ক্রিয়াপদের ব্যবহারেও ছিল বিস্তর মুন্সিয়ানা। তবে এসব কিছু, এসব ভঙ্গি ও প্রকাশকৌশল, কবিতার নিহিতার্থ ও ব্যঞ্জনার পায়ে শেকল পরায়নি; ফল্গু বসুর কবিতা পড়লে বলে দেওয়া যায়, এটা ফল্গু বসুর কবিতা।
আমার জানা মতে সকল দলাদলি, গোষ্ঠীপ্রেম, কাব্যহিংসার ঊর্ধ্বে ছিলেন ফল্গু বসু। কবি ও মানুষ ফল্গু বসুর সম্বন্ধে সর্বপ্রথম ধারণা আমি পাই কবি গৌতম চৌধুরীর কাছ থেকে। ফল্গু বসু যে একজন শক্তিমান কবি এবং কীর্তির তুলনায় প্রায় অনালোচিত– আমার এই ধারণার বিষয়েও, মনে পড়ে, সহমত হয়েছিলেন গৌতমদা।
ফল্গুদার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা এখানে টানব না। ওসব জমা থাকুক আমার বুকের বাম পাশটায়। ওঁর কথা মনে হলে নিজের ‘দিল কা ধরকান’ আমি নিজেই টের পেতে থাকব ওখানটায় হাত রাখলে।
বর্ষাকালকেও হার-মানানো এই অঝোর গ্রীষ্মের ভেতরে চোখ-কান-নাক-মাথাসহ সর্বাঙ্গ ডুবিয়ে এখন আমি ফল্গু বসুর কবিতাকে অনুভব করছি; আর, এখন যে গানটি শুনছি সেটি তার উদ্দেশে নিবেদন করছি :
‘যেও না যেও না ফিরে
দাঁড়াও বারেক দাঁড়াও…’
কিন্তু এই অগস্ত্যযাত্রাকালে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাবার, একটিবার দাঁড়াবার সময়টুকু তাঁর নেই। তাই সে অনুরোধ তাঁকে আমি করব না।
ফল্গুদা, এবার আপনার উদ্দেশে নিবেদন করি আপনারই লেখা একটি কবিতা। হোক তা গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা!
বালিমূর্তি
আবার সম্ভব হোক উপস্থিত দর্শক সমীপে সেই অবিস্মরণীয় ইন্দ্রজাল থেকে উঠে আসা সমুদ্রপানের দৃশ্য, অবয়বহীন জনপদ
পুনর্বাসনের ক্রোধে আত্মহারা দেবদেবীগণ কোথায় যে যাবে তার ঠিক নেই, পাতাল ভরসা। কাঁধে সোয়েটার নিয়ে গণদেবী ঘুরে দাঁড়ালেন
আগুননিঃশ্বাস থেকে নিজেকে বাঁচাতে ডুব দেবে সমুদ্র কোথায়? লতাপাতা সাপ হয়ে গেল। সারি সারি হেঁটে আসছে চন্দনভূমির লোকজন
অবস্থার চাপে পড়ে মানুষ কঠোর হলো আরো দর্শক নির্বাক। যেন যুদ্ধের পরের কথা জানে ভাঙা অস্ত্রে লেগে থাকে পিপাসার্ত নীল শস্যদানা।
সন্দেহ থেকেই শুরু… অবশেষে জানা গেল আঙুল ছিল না যার সে শুধুই আংটি জমাত।