দেবাশিস সেনগুপ্ত
কলকাতা ময়দানে তাঁকে ঘিরে যত প্রাচীন প্রবাদ উড়ে বেড়ায়, তাতে নিঃসন্দেহে তাঁকে ডাকা যায় অরণ্যদেব নামে। থ্রু পাস, ট্যাকলিং, জোরালো শট, হেড আর ভলি যখন প্রাণপণ লড়াইয়ের সঙ্গে মিশে যেত, তার নাম হয়ে যেত মহম্মদ হাবিব
১৯৭৮-এ, একটি নতুন খেলার খবরের পাক্ষিক পত্রিকা (অধুনালুপ্ত) আর একটি নামকরা সাপ্তাহিকে এক নবাগত খেলার লেখকের তিনটি লেখা আলোড়ন তুলে দিয়েছিল ফুটবল ও ফুটবলার মহলে।
প্রথম লেখা “কেন এত বাইরের ফুটবলার?”-এ ছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কলকাতার বাঙালি ফুটবলারদের “টাইট দিতে” পরের মরশুমে অনেক ভিনরাজ্যের ফুটবলার আনার প্রস্তুতি নেওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ, যাকে কেউ কেউ নাম দিয়েছিলেন “ক্যালকাটা ফুটবলার্স মেনিফেস্টো”। এই লেখাটির ফলশ্রুতিতে পুরো বছর জুড়ে “খেলার কথা” বনাম একটি বড় ক্লাবের কর্তাদের লড়াইয়ের ফ্রন্ট খুলে গিয়েছিল।
দ্বিতীয় আলোড়ন তোলা লেখাটির শিরোনাম ছিল “মহম্মদ হাবিব সমীপেষু”। সর্বজনশ্রদ্ধেয় ফুটবলার মহম্মদ হাবিবের দলবদল ও খেলা সংক্রান্ত কিছু ঘটনা তুলে ধরে তাঁকে আক্রমণ করা হয়েছিল ওই লেখাটিতে, যা উথালপাথাল করে দিয়েছিল, পাঠকের সঙ্গে অনেক ফুটবলারকেও। এবং তাঁরা খোলাখুলি হাবিবের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। উল্টোদিকে লেখাটির সমর্থক ফুটবলারের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না।
আর ওই ১৯৭৮-এরই আগস্টে একটি অধুনালুপ্ত ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকার একটি সংখ্যায় কলকাতার ফুটবলারদের জ্বালাতন করার উদ্দেশ্যমূলক একটি লেখা ছাপা হয়, যাতে ক্লাবের কাছ থেকে ফুটবলারদের প্রাপ্য অর্থমূল্যের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছিল। এই কারণে আয়কর দপ্তর ফুটবলারদের পিছনে পড়ে যায় এবং পত্রিকাটি ফুটবলারদের প্রবল রোষের মুখে পড়ে। একটি বড় ক্লাবের ফুটবলাররা সমস্ত সাংবাদিকদের বয়কট করেন। তারপরেই এই লেখা এবং এটির সমগোত্রীয় আরও দু-একটি লেখার তীব্র প্রতিবাদ করে প্রথমেই বলা নামকরা সাপ্তাহিকে পত্রিকায় একটি তীব্র শ্লেষাত্মক লেখা লিখেছিলেন (আগে উল্লিখিত তৃতীয় লেখা) সেই নবাগত খেলার লেখক। যাতে কলকাতার সর্বজনশ্রদ্ধেয় পেশাদার ফুটবলার মহম্মদ হাবিবের ক্ষোভের কথা তুলে ধরা ছিল এইভাবে— “এত বছর অন্য কোনও পেশায় না জড়িয়ে ঘাম রক্ত ঝরিয়ে ফুটবল খেলার পর এই পুরস্কার কি আমার প্রাপ্য ছিল? এটা ছেপে ওরা কি সৎ সাংবাদিকতা করল?” এই লেখা তখন বেশ শোরগোল ফেলেছিল কলকাতার ফুটবলমহলে। একটু পুরনো মানুষেরা এটা জানেন।
“প্রফেশনাল” কথাটার মানে প্রথম শিখেছিলাম মহম্মদ হাবিবকে দেখে। আজও খুব কম খেলোয়াড় এই কথাটার মানে বোঝে। জীবনে কোনওদিন ফুটবল ছাড়া অন্য কোনও পেশায় জড়াননি। ফুটবল ছাড়া তাঁর আর কোনও প্যাশন ছিল না। হায়দ্রাবাদের সিটি ওল্ড বয়েজ ক্লাব ও হায়দ্রাবাদ টেলিফোনসের হয়ে খেলার পরে ১৭ বছরের মহম্মদ হাবিবকে ১৯৬৬ সালে কলকাতায় এনেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের প্রবাদপ্রতিম কর্তা জ্যোতিষ গুহ। ১৭ বছরের কলকাতা কেরিয়ারের ৯ বছর ইস্টবেঙ্গলে (১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৭০, ১৯৭১, ১৯৭২, ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮০, ১৯৮২), ৬ বছর মোহনবাগানে (১৯৬৮, ১৯৬৯, ১৯৭৬, ১৯৭৭, ১৯৭৮, ১৯৮১) আর ২ বছর মহমেডানে (১৯৭৫, ১৯৭৯) খেলেছেন। যখন যে ক্লাবের হয়ে খেলেছেন তাদের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিতেন কলকাতা ময়দানের চিরকালীন দশ নম্বর জার্সি। ১০ বার করে কলকাতা লিগ ও আইএফএ শিল্ড, ৫ বার ডুরান্ড কাপ, ৮ বার রোভার্স কাপ, ৩ বার করে ফেডারেশন কাপ ও বরদলুই ট্রফি, ২ বার করে ডিসিএম ট্রফি, নাগজি ট্রফি ও দার্জিলিং গোল্ড কাপ এবং একবার অমৃতবাজার শতবার্ষিকী ট্রফি জিতেছিলেন মহম্মদ হাবিব। ৯ বছরে ইস্টবেঙ্গলকে দিয়েছেন ২৫টি ট্রফি আর তাঁর খেলা ৬ বছরে মোহনবাগান পেয়েছিল ২১টি ট্রফি। ২ বছর মহমেডানে খেলার সময়ে অবশ্য তিনি ছিলেন ট্রফিহীন।
কলকাতা ময়দানে তাঁকে ঘিরে যত প্রাচীন প্রবাদ উড়ে বেড়ায়, তাতে নিঃসন্দেহে তাঁকে ডাকা যায় অরণ্যদেব নামে। থ্রু পাস, ট্যাকলিং, জোরালো শট, হেড আর ভলি যখন প্রাণপণ লড়াইয়ের সঙ্গে মিশে যেত, তার নাম হয়ে যেত মহম্মদ হাবিব। ভারতের হয়ে খেলেছেন ১৯৭০-এর এশিয়ান গেমসে, জিতেছেন ব্রোঞ্জপদক। ১৯৭০-এর মারদেকা ট্রফিতে তৃতীয় স্থান পাওয়া ভারতীয় দলের হয়েও খেলেছেন তিনি। ১৯৮২ সালে পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার।
পাস ক্লাব (১৯৭০), পিয়াং ইয়াং সিটি ক্লাব (১৯৭৩), ডক রো গ্যাং (১৯৭৩), ক্রুকটাউন ফুটবল ক্লাব (১৯৭৬), কসমস ক্লাব (১৯৭৭), আরারাত ক্লাব (১৯৭৮) দেশে ফিরে জানার আগে জেনে গেছে, বিদেশি দলের বিরুদ্ধে খেলায় কতটা ভয়ঙ্কর ছিলেন অকুতোভয় মহম্মদ হাবিব।
পিকে ব্যানার্জি তাঁকে বলতেন তাঁর দেখা সেরা খেলোয়াড়। সুধীর কর্মকার বলেছেন তাঁর খেলা টাফেস্ট ফরোয়ার্ডের নাম ছিল মহম্মদ হাবিব। গৌতম সরকারের মতে বর্ন ফাইটার ছিলেন তাঁর হাবিবদা। সুভাষ ভৌমিকের অনুভবে তাঁর জীবনে পিকে ব্যানার্জির চেয়েও বড় ফুটবলগুরু ছিলেন মহম্মদ হাবিব। সমরেশ চৌধুরীর মাঠে নেমে “হারকে ঘৃণা করার শিক্ষক” ছিলেন মহম্মদ হাবিব। সুরজিৎ সেনগুপ্ত তাঁর যাবতীয় লড়াইয়ের প্রেরণা বলে যাকে মানতেন, তাঁর নামও ছিল মহম্মদ হাবিব। আর সুব্রত ভট্টাচার্য তাঁর সদ্যোপ্রকাশিত আত্মজীবনী “ষোলো আনা বাবলু” উৎসর্গ করেছেন দুজনকে, একজন তাঁর মা পুতুল ভট্টাচার্য আর একজন তাঁর ফুটবলজীবনের কড়া অভিভাবক মহম্মদ হাবিব। আর আমার মতো আম ফুটবলপ্রেমীর কাছে “লড়াইয়ের প্রতিশব্দ” ছিলেন মহম্মদ হাবিব। রয়েড স্ট্রিটের মেসে সুব্রত ভট্টাচার্য, ভাই আকবর সহ জুনিয়রদের তাঁর আগলে রাখাটাও ইতিহাসে ঢুকে গেছে।
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সকালে একটি দৈনিক জানিয়েছিল, তিনি পার্কিনসন আর অ্যালজাইমারসে আক্রান্ত। বিস্মৃতি নামের হালকাফুলকা ডিফেন্ডাররাও তাঁকে বলে বলে আটকে দেয়। স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁর সঙ্গে, সামান্য দূরত্ব থেকেও শট মারে সুস্থতার গোলপোস্টের বাইরে। তাই সেদিন মনখারাপ ঘিরে ধরেছিল সকালবেলাতেই। ভাবছিলাম, তাহলে ময়দানের অরণ্যদেবেরও পার্কিনসন আর অ্যালজাইমারস হয়!
সেই থেকে অনেক লড়াই করেও আর সুস্থতার ট্র্যাকে ফিরে যেতে পারেননি ভারতীয় ফুটবলে ২ বার ত্রিমুকুট পাওয়া (১৯৭২, ১৯৭৭) মহম্মদ হাবিব। তবু কলকাতায় এসেছিলেন আরও ২ বার— ২০১৯-এ ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে আর ২০২১-এ মোহনবাগান তাঁবুতে পিকে ব্যানার্জী-চুণী গোস্বামীর যৌথ স্মরণসভায়। তারপরে ক্রমশ আরও অসুস্থ হতে হতে অবশেষে ২০২৩-এর স্বাধীনতা দিবসেই সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন ষাট-সত্তর-আশি তিন দশকেরই অনেকটা সময় ধরে কলকাতা ময়দানে লড়াই আর ফুটবলকে সমার্থক করে দেওয়া বড়ে মিয়াঁ ওরফে মহম্মদ হাবিব।
১৯৪৯-এর ১৭ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট ২০২৩, ৭৪ বছরের দৌড় শেষ করে চলে গেলেন কলকাতা ময়দানের অরণ্যদেব। কিন্তু যতদিন কলকাতায় ফুটবল শব্দটা বেঁচে থাকবে, ততদিনই লড়াইয়ের রাজপথ দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে আর একটা নামও বেঁচে থাকবে। সেই নামটা হল হার না মানতে চাওয়া মহম্মদ হাবিব।