শুভায়ন মুখার্জি
একবার ভাবুন, এই যে ৬টা পেলোড এবং তার থেকে সংগ্রহ করা তথ্য, সেগুলো যখন একসঙ্গে নিয়ে আলোচনা বা গবেষণার ভাষায় ডেটা অ্যানালিসিস করা হবে তখন আমাদের কাছে চাঁদের ব্যাপারে ঠিক কতটা সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে
গুটিগুটি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রজ্ঞান আর পাহারা দিচ্ছে বিক্রম। ঠিক গল্পের মতো শোনালেও; এটাই বাস্তব। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণাগার ইসরো (ISRO: Indian Space Research Organisation)-র এক বিরাট বৈজ্ঞানিক সাফল্য হল চন্দ্রযান-৩। চন্দ্রযান নাম টাই যথেষ্ট এর উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে। চাঁদের উদ্দেশ্যে অভিযান বা চাঁদের গন্তব্যে পাঠানো যান হল “চন্দ্রযান”। সালটা ২০০৮, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন, ২০০৮, ইসরো-র তৎকালীন চেয়ারম্যান জি মাধবন নায়ারের তত্ত্বাবধানে ভারতবর্ষ থেকে প্রথম চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় চন্দ্রযান-১। সুতরাং, এই ১৫ বছরে তিনটি চন্দ্র অভিযান করে ভারতবর্ষ তথা ইসরো। সাফল্য ব্যর্থতা নিয়ে পরে কথা বলছি, তার আগে একটু আমার কথা বলে নিই।
আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল আমার “কর্ম পরিচয়”, এর কোনও ভাল বাংলা আছে কিনা তা আমার জানা নেই। অর্থাৎ, আমি কী নিয়ে কাজ করি। আমার কাজ মূলত বিভিন্ন পদার্থের ঘেরাটোপে সহাবস্থান করা, এবার পদার্থ যখন তখন তাদের অবস্থার পরীক্ষানিরীক্ষাও দরকার। পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য দরকার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ (Instruments), সুতরাং আমার কাজের পরিসরটা হল বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে পদার্থের অবস্থা নিয়ে গবেষণা করা।
এবার আসি, আমার লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে।
আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে একটা ধারণা আছে, ইসরো এবং মহাকাশযান মানেই মহাকাশ গবেষণা। এই ধারণাটা “ভুল”। আসুন এটা নিয়ে একটু আলোচনা করি।
“ভুল” শব্দটা হল আপেক্ষিক। আসলে “কেবলমাত্র মহাকাশ গবেষণা” এই কথাটা ভুল। মহাকাশযান বা এমন ধরনের কাজের জন্য বিজ্ঞানের সমস্ত শাখা (পদার্থবিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স, ডেটা সায়েন্স সমানভাবে দরকার, কিছু ক্ষেত্রে রসায়ন, পরিবেশ বিজ্ঞান ইত্যাদিরও যথেষ্ট প্রয়োজন)। আমি যেহেতু পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তাই ওটাতেই আলোকপাত করি। পদার্থবিজ্ঞানের মোটামুটি যে-কয়টি ভাগ বা শাখা আছে তার সমস্তগুলোর সম্মিলিত প্রয়োগ হয় মহাকাশ গবেষণায়। আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি যে শাখার ছাত্র তার নাম হল “Condensed Matter Physics”, কাজ করি মূলত “পদার্থ” নিয়ে। এই লেখার মাধ্যমে আমার চেষ্টা একটাই থাকবে, ছাত্রছাত্রীদের জানানো, একটা মহাকাশ গবেষণায় এই Material Science বা Condensed Matter Physics ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তারা জানুক, শিখুক এবং ভবিষ্যতে প্রয়োগ করুক।
চন্দ্রযান-১-এর অভিযান ছিল সফল; চন্দ্রযান-২ আংশিকভাবে সফল; আর চন্দ্রযান-৩-এর অভিযান এখনও পর্যন্ত সফল। “এখনও পর্যন্ত সফল” বলার কারণ হল— ১। সফলভাবে উৎক্ষেপণ হয়েছে, ২। সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর নিকটবর্তী অঞ্চলে অবতরণ করেছে, এবং ৩। বিক্রমের (Lander) মধ্যে থাকা প্রজ্ঞান (Rover)-এর চাকা চাঁদের ভূপৃষ্ঠে গড়াচ্ছে।
এবার বলি, এই যে চন্দ্রযান-৩-এর Lander ও Rover চাঁদে গিয়ে হাজির হল, তা কেন?
সবার প্রথমে একটা বিষয় বলে দেওয়া ভাল— এখনও পর্যন্ত কোনও মহাকাশ অভিযান (যেগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত) কেবলমাত্র ঘুরতে যাওয়ার জন্য হয়নি। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হল এই সমস্ত অভিযানের অন্যতম প্রধান কারণ। সাম্প্রতিক সময়ের ‘কিউরিওসিটি’ হোক, বা ‘প্রিজার্ভারেন্স’ কিংবা ভারতবর্ষের ‘চন্দ্রযান-৩’— সকলেরই নির্দিষ্ট কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল বা আছে।
এই লেখায় আমি মূলত আলোচনা করব চন্দ্রযান-৩-এর ৬টি পেলোড (payload) নিয়ে। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে ল্যান্ডারের ৪টি ও রোভারের ২টি পেলোড। লেখাটিকে আমি বেশ কয়েকটি খণ্ডে লিখব। চেষ্টা করব প্রতিটি পেলোডের বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে। এই লেখায় সংক্ষেপে ৬টি পেলোডকে পরিচয় করাচ্ছি।
প্রথমে আসা যাক রোভার অর্থাৎ প্রজ্ঞানের কথায়। এটিতে দুটি পেলোড আছে—
- এপিএক্সএস (Alpha Particle X-ray Spectroscopy), এবং
- এলআইবিএস (Laser-Induced Breakdown Spectroscopy)।
যাঁরা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে একটু চর্চা করেছেন তাঁরা হয়তো এক্সআরডি অর্থাৎ X-ray Diffraction-এর কথা শুনেছেন। না শুনলেও Bragg’s Law? এটা শোনা শোনা লাগছে? ক্রিস্টাল স্ট্রাকচারের আলোচনার শুরুতেই আসে এই Bragg’s Law। আরও গভীরে সিঙ্গল ক্রিস্টালের আলোচনা এলে তখন আসে Laue Diffraction-এর প্রসঙ্গ। মূলত এমন ধরনের কিছু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র কাজে লাগে এই এক্স-রে ডিফ্র্যাকশনকে বর্ণনা করতে। উৎস হিসাবে অবশ্যই এক্সরে ব্যবহৃত হয়, অনেক সময় ফোটনও ব্যবহৃত হয়ে থাকে (কারও আগ্রহ থাকলে এগুলো নিয়ে পরে আলোচনা করা যেতে পারে)। এমন এক্স-রে ডিফ্র্যাকশন বা এক্স-রে স্ক্যাটারিং-এর মতোই আরও উন্নত মানের একটি যন্ত্র হল এই এপিএক্সএস। এটির মাধ্যমে চাঁদের মাটির বিভিন্ন পদার্থের গঠনগত দিক (যাকে ইংরেজিতে বলা হয় elemental composition) পরীক্ষিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে মূলত ম্যাগনেশিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, পটাশিয়াম, টাইটানিয়াম ইত্যাদির অনুসন্ধান অন্যতম উদ্দেশ্য।
এলআইবিএস-ও একধরনের স্পেকট্রোস্কোপি, এটির ক্ষেত্রে অবশ্য লেজার ব্যবহার করা হয় পদার্থের রাসায়নিক ধারণার জন্য। সুতরাং, এই এলআইবিএস ও এপিএক্সএস নিয়ে রোভারটি চন্দ্রপৃষ্ঠে ঘুরে বেড়িয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠের গঠনমূলক এবং রসায়নিক বর্ণনা অনুসন্ধান করবে।
আরও ৪টি পেলোড আছে বিক্রম তথা ল্যান্ডারটিতে। এটি কিন্তু স্থির। এই চারটি পেলোড হল—
- Radio Anatomy of Moon Bound Hypersensitive Ionosphere and Atmosphere (RAMBHA),
- Chandra’s Surface Thermo-physical Experiment (ChaSTE),
- Instrument for Lunar Seismic Activity (ILSA), এবং
- Laser Retro-Reflector Array (LRA)।
রম্ভা-র পুরো নাম থেকে ধারণা করা যায় এটির কাজ হল চাঁদের বায়ুমণ্ডলকে পর্যবেক্ষণ করা, অর্থাৎ সময়ের সাপেক্ষে এটির কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে বা কেমন পরিবর্তন হচ্ছে সেটা পর্যবেক্ষণ করা।
চেস্ট-এর কাজ হবে চন্দ্রপৃষ্ঠের তাপীয় অবস্থা এবং সেটির পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা।
ইলসা-র কাজ টা বেশ লক্ষণীয়, চাঁদে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প এবং সেই সংক্রান্ত গঠনমূলক তথ্য সংগ্রহ করবে এই ইলসা।
এলআরএ-টা কিন্তু নাসার। এটার উপস্থিতিটাই কেবল গুরুত্বপূর্ণ, বাকি কাজটা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকেই হবে। লেজার সিগনালের মারফত চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব এবং সেই সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় এটি সহায়তা করবে।
এবার একবার ভাবুন, এই যে ৬টা পেলোড এবং তার থেকে সংগ্রহ করা তথ্য, সেগুলো যখন একসঙ্গে নিয়ে আলোচনা বা গবেষণার ভাষায় ডেটা অ্যানালিসিস করা হবে তখন আমাদের কাছে চাঁদের ব্যাপারে ঠিক কতটা সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে।
আজকের লেখা আপাতত এইটুকুই। জানি, এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় হাজির হবে। প্রশ্নগুলোকে প্রশ্রয় দিন। আমি চেষ্টা করব পরবর্তী লেখাগুলোতে সেই সকল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ফিরতে, সঙ্গে থাকবে প্রতিটি পেলোডের বিষয়ে আলোচনা।