বুদ্ধদেব বসু
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সেপ্টেম্বর, ২০২৩ মেল ট্রেনের মূল ভাবনা ‘অনুবাদ’। সেই প্রসঙ্গেই বুদ্ধদেব বসুর এই গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধটি আমরা স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে পুনঃপ্রকাশ করলাম। নিবন্ধটি ‘কবিতা’ পত্রিকার পঞ্চদশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যায় (আষাঢ় ১৩৫৭) প্রকাশিত হয়
রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি পশ্চিমে আজ লুপ্তপ্রায় দেখে আমাদের মনে বেদনাবোধ অনিবার্য। এ-প্রসঙ্গে এডওয়ার্ড টমসনের খেদোক্তি এই যে ধূসর এলিঅটী যুগে ঠাকুরকবির সমাদর অসম্ভব, কিন্তু সেটা-যে প্রকৃত কারণ নয়, কিংবা প্রধান কারণ নয়, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ পুনরায় পড়লেই তা প্রাঞ্জল হয়। এখানে, এই কাব্যসংগ্রহেই, এই অবক্ষয়ের প্রকৃত কারণ অন্তর্নিহিত। প্রথম কথা এই যে রচনার দিক থেকে, শিল্পকর্মের দিক থেকে গীতাঞ্জলির প্রাথমিক কৃতিত্ব পরবর্তী ইংরেজি গ্রন্থে অনুপস্থিত। ইংরেজি গীতাঞ্জলি মূলের তুলনাতেও মহত্তর, জাত-বাঙালিরও বরেণ্য। আমি আবার তুলনা ক’রে দেখলাম;— কোনো-কোনো কবিতা, যা বাংলায় গৌণ, নিষ্প্রভ, ঘোর রবীন্দ্রভক্তেরও অল্প-চেনা, যে-সব গান আজকের দিনেও কখনো প্রায় শুনি না, ইংরেজি রূপান্তরে সেই সব কবিতাই দীপ্যমান। যেমন ৮০ এবং ৮৭ নম্বর কবিতা— ‘আমি শরৎশেষের মেঘের মতো’ (খেয়া), ‘আমার ঘরেতে আর নাই সে যে নাই’ (স্মরণ)— বাংলার তুলনায় ইংরেজির স্বচ্ছতা এখানে স্বতঃস্ফুট। উপরন্তু যেসব রচনা বাংলায় অবিস্মরণীয়, অনুবাদে তাদেরও কোনো ক্ষতি হয়নি; শুধু তা-ই নয়, যেহেতু এই কবিতাবলী ভগবানের পূজা, মূলের কারুকলার ইন্দ্রিয়সুখবর্জিত হ’য়ে বরং এখানে নগ্ন আবেগ তীব্রতর আঘাত করে। সাহিত্যক্ষেত্রে একে প্রায় অঘটন বলতে হয়।
কিন্তু এই অঘটন দ্বিতীয়বার ঘটেনি, সেটা আশা করাও অন্যায় হ’তো। শিশু এবং ক্ষণিকা, অন্তত ইংরেজি সাহিত্যে যে-দুটি গ্রন্থের তুলনা নেই, বিদেশীর বাংলা শেখার পরিশ্রমের পুরস্কারস্বরূপ যে-দুটি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ইংরেজিতে তার মৌল বৈশিষ্ট্যের অনুমান সুদ্ধু অসম্ভব। পরবর্তী অন্যান্য অনুবাদ বিষয়েও এই কথাই প্রযোজ্য। নাটকের মধ্যে উত্তীর্ণ হ’তে পেরেছে শুধু ডাকঘর। এই পরোৎকৃষ্ট নাটিকাটি এমনই নির্ভার, এখনে এতই সহজে এবং স্বল্পায়তনে মানবজীবনের গভীরতম ব্যাকুলতা ব্যক্ত হয়েছে যে, অনুবাদে যদিও পরিমার্জনের অবকাশ ছিল, অন্তত আমি তো ইংরেজিতে প’ড়েও পবিত্র আনন্দের অশ্রুপাত না-ক’রে পারিনি। কিন্তু চিত্রা, অর্থাৎ চিত্রাঙ্গদা, অতিকথনে ভারাক্রান্ত, গঠনে দুর্বল, আর তার উপরে এই আশ্চর্য কাহিনীর টেনিসনীয় পরিসমাপ্তির পাণ্ডুর শোচনীয়তা, বাংলায় যা আবাল্য আমাদের মনঃপীড়ার কারণ, ইংরেজিতে তার সান্ত্বনা কোথায়? অন্তত বিসর্জন বা ফাল্গুনীতে তো নেই, কেননা অনুবাদ এখানে আক্ষরিক ব’লেও কিংবা আক্ষরিক ব’লেই, যথোচিত প্রাণসঞ্চার হয়নি, ফাল্গুনীর পুষ্পিত গীতিগুচ্ছ ইংরেজিতে কী বিশীর্ণ।
বিভিন্ন গ্রন্থের আন্তরিক মূল্য কোনো কবিরই সমান হয় না, কিন্তু অনেক সময় প্রকরণের বৈচিত্র্যেই বহুলতা সার্থক হয়। এ-কথা বাংলায় রবীন্দ্রনাথের পক্ষে বিশেষভাবে সত্য, কিন্তু ইংরেজিতে এই বৈচিত্র্যের একান্ত অভাব নিঃসন্দেহে তাঁর পশ্চিমী খ্যাতির পরিপন্থী। যে-গদ্যছন্দ গীতাঞ্জলিতে বিষয়গুণে সংগত ছিল, পরবর্তী অন্যান্য কাব্যের অনেক ক্ষেত্রেই তা অনুপযোগী। আর, যদি উপযোগীও হ’তো, তাহ’লেও অবিরল গদ্যকবিতার ক্লান্তি থেকে নিস্তার ছিলো না। হুইটম্যানের ভাবে আর ভঙ্গিতে বিরোধ নেই, শক্তিও অসামান্য, কিন্তু লীভস অফ গ্রাস একসঙ্গে কতক্ষণ পড়া যায়? তেমনি, গীতাঞ্জলির পর দি ক্রেসেন্ট মূন যদি-বা উপভোগ্য, দি গার্ডেনারে যদি-বা কোনো রত্ন মেলে, এর পরে আর বেশিক্ষণ প্রাচ্য কবির সহযাত্রী হ’তে প্রতীচী পাঠকের উৎসাহ আশাতীত। এবং, বলা বাহুল্য, বিদেশী ভাষার একেবারে মর্মস্থলে পৌঁছানো প্রতিভাবানেরও অসাধ্যপ্রায়; এমন-যে উৎকৃষ্ট গীতাঞ্জলি তাও যে উৎকৃষ্টতর হ’তে পারতো তার প্রমাণ মেলে ৬৭ নং কবিতায় (‘Thou art the sky and thou art the nest as well’) রবার্ট ব্রিজেস-এর সূক্ষ্ম-নিপুণ হস্তক্ষেপে। এই কবিতার ব্রিজেস-কৃত পাঠান্তর তাঁরই সম্পাদিত ‘স্পিরিট অব ম্যান’-এ মুদ্রিত আছে, ইএটস-এর ‘অক্সফোর্ড বুক অব মডার্ন ভর্স’-এও সেটাই সংকলিত। দুটো মিলিয়ে পড়লে বিস্মিত হ’তে হয়।
কবিতার অনুবাদের সমস্যা এখানে আলোচ্য। কখনো মনে হয় যে সব কবির, বা সব কবিতার, ভাষান্তর হতেই পারে না। যে-কবিতার শরীর থেকে বক্তব্যের বিচ্ছেদ সম্ভব, অর্থাৎ যার সারাংশ গদ্যে লিখেও বোঝানো যায়, সেখানে ভাষান্তরে কিছু-না-কিছু ধরাই পড়ে। কিন্তু যেখানে রূপের সঙ্গে বস্তুর মিলন এমনই একান্ত যে প্রথমটা ছাড়লে দ্বিতীয়টাও হারায়, সেখানে অনুবাদের সার্থকতা বিরল। যেমন বোদলেয়ারের বক্তব্যের অংশ রীতিমতো স্পর্শসহ, এমন কি তাতে উপন্যাসেরও উপাদান প্রচ্ছন্ন; তাই অনুবাদে তাঁর ধ্বনির প্রতিধ্বনি যদি না জোটে, অন্তত তাঁর মনের পরিচয় পাই, অন্তত তাঁর আকার চিনতে পারি। কিন্তু র্যাঁবো বা মালার্মের কিছুই প্রায় পৌঁছয় না। অর্থাৎ, শব্দের জাদুবিদ্যায় যে-কবিতার যত বেশি নির্ভর, ততই তার অনুবাদের উপযোগিতা ক্ষীণ এবং রবীন্দ্রনাথের লৌকিক রচনাবলী যেহেতু বহুলত এই ইন্দ্রজালেরই উদাহরণ, তাই, স্বয়ং অনুবাদক হ’য়েও, অনুবাদের ছলনাতেও তিনি ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু ক্ষণিকারই নয়, বলাকা কিংবা লিপিকার ক্ষেত্রেও মূলের সঙ্গে ব্যবধান দুস্তর। বাঙালির মনে কৃষ্ণকলির মোহবিস্তার ইংরেজি পাঠকের কল্পনারও অগম্য।
অতএব রবীন্দ্রনাথ এখন নতুন অনুবাদের মুখাপেক্ষী। এই কঠিন কাজ, বলা বাহুল্য, যথার্থরূপে সম্পন্ন হ’তে পারে তাঁরই হাতে, যিনি, শুধু বোদ্ধা নন, প্রেমিক নন, শুধু জন্মসূত্রে অনুবাদের ভাষায় অধিকারী নন, উপরন্তু সেই ভাষায় অভ্যস্ত কারিগর, নিজেও শিল্পী। গীতাঞ্জলি, শুনতে পাই, ইংরেজির তুলনাতেও ফরাশি ভাষায় অংশত শ্রেয়তর— নিশ্চয়ই তার কারণ আঁদ্রে জীদ-এর প্রশিক্ষিত লেখনী। ব্রিজেস-এর ঐ একটি কবিতার পরিমার্জনাও শিক্ষাপ্রদ। যদি ইংরেজি ভাষার কোনো অভিজ্ঞ আধুনিক কবি বাংলা শিখে অনুবাদকর্মে হাত দেন, কিংবা, সেই উদ্দেশ্যে, বিশ্বভারতী বৃত্তি দিয়ে তেমন কাউকে আহ্বান করেন, তাহ’লে বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের পুনর্জীবন শুধু কালের খেয়ালে আর নির্ভর করে না।
সেই শুভযোগের প্রত্যাশায় ব’সে না-থেকে যাঁরা এই সৎকর্মে সাহসী, ইতিমধ্যে তাঁদের চেষ্টাও লক্ষ্যণীয়। এডওঅর্ড টমসন এবং ভবানী ভট্টাচার্যের পরে মার্জরি সাইক্স এ-ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। শ্রীমতী সাইক্স, বলা বাহুল্য, এ-পথের বিঘ্ন বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন, বিনয়ের অভাবও তাঁর নেই, কেননা ‘থ্রী প্লেজে’র ভূমিকায় তিনি মেনে নিয়েছেন যে এই ফুল বিদেশী হাওয়ায় শুকিয়ে যায়। শুকিয়ে যাতে না যায়, তারই ব্যবস্থা অনুবাদকের কর্তব্য, পাঠকের এই স্বগতোক্তি অবশ্য অনিবার্য, কিন্তু এখানেও তিনি নিরুত্তর, কেননা অনেক গান ‘অসাধ্য ব’লে’ বর্জিত, আর কোনো-কোনোটি নাট্যপ্রসঙ্গে অপরিহার্য ব’লেই উদ্ধৃত, যদিও ‘the translation is very imperfect’। এর পর সমালোচকের কিছু বলার থাকে না, তবে সাহিত্যে যাঁরা রসের তেমন পিপাসু নন, তত্ত্ব পেলেই খুশি, এই গ্রন্থ তাঁদের পক্ষে উপকারী।
রবীন্দ্রনাথের বৈদেশিক অবক্ষয়ের আরো একটি কারণ আছে। ‘কলেক্টেড পোএমস অ্যাণ্ড প্লেজ’-এ যেহেতু প্রেম, বাৎসল্য, হাস্য, ওজঃ, এই সব মানবিক ভাবাপ্লুত রচনা বহুলাংশে নিস্তেজ, তাই এখানে বিষয়ের কোনো বৈচিত্র্য মেলে না, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বক্তব্যেরও ক্রমবিকাশ নেই। আছে, প্রত্যাশিত পরিণতির বদলে, সম্প্রসারণ। কবি তাঁর সব কথা গীতাঞ্জলিতেই বলেছেন, ডাকঘর তারই একটি সূত্রের নাট্যরূপ, সাধনা তারই দার্শনিক ভাষ্য। অন্যান্য রচনায় নতুন কোনো বক্তব্য ফোটেনি, এবং কিছুদূর অগ্রসর হ’লে যে-কোনো কবিতা অন্য যে-কোনো কবিতা ব’লে ভ্রম হয়। গীতাঞ্জলির বক্তব্যের মূল্যেই ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথ মূল্যবান, কিন্তু সেখানে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁরই অনূদিত কবির, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সাক্ষাৎ উপনিষদ। পশ্চিমে কেউ-কেউ ভাবতে পারেন যে একেবারে মূল উৎসেই পান করা শ্রেয়।
কিন্তু এখানেই রবীন্দ্রনাথ জয়ী। উপনিষদ জানলে, ভারতীয় মরমীদের জানলে, তবু তিনি তৃষ্ণায় বারিস্বরূপ। মূলত তাঁর যা বক্তব্য, তা এতই মহৎ, এতই বিস্ময়কর, এতই সহজ ক’রে বলা, যে সেই কথা শুনতে পেলে যেমন হৃদয়দল উন্মীলিত হয়, মন দিয়ে শুনতেও তেমনি গভীর অভিনিবেশ প্রয়োজন। অনেকে আছেন গীতাঞ্জলি যাঁদের তরল লাগে, দ্বন্দ্বহীন ব’লে তৃপ্তি দেয় না, সংগ্রামের ক্ষতচিহ্নের অভাব তাঁদের বিমুখ করে, কিন্তু তাঁরা, খুব সম্ভব, শুধু আপাতদৃষ্টিতে দেখেছেন, কিংবা তাঁদের বিশ্বাস যে বিশেষ-কোনো সংঘবদ্ধ ধর্মের নির্দিষ্ট নিয়মাবলী ছাড়া ভগবানের করুণালাভ অসম্ভব। বস্তুত গীতাঞ্জলি সুলভ জীবন্মুক্তির কাহিনী নয়— ও বস্তু কখনোই সুলভ হয় না; বস্তুত গীতাঞ্জলির ১০৩টি কবিতার মধ্যে একেবারে মিলনের কথা মাত্রই কয়েকবার শোনা যায়। অধিকাংশই বিরহের গান, সন্দেহের, আকাঙ্ক্ষার, প্রতীক্ষার। কিন্তু এই বিরহচেতনাও মধুর, ভগবানের সন্ধানেও মানুষ ধন্য। (‘তোমার সুর শুনায়ে যে-ঘুম ভাঙাও সে-ঘুম আমার রমণীয়।’) তাই গীতাঞ্জলিতে আনন্দ ছাড়া কিছু নেই, দুঃখে আনন্দ, বঞ্চনায় আনন্দ, মৃত্যুও আনন্দময়। হয়তো সেই কারণেই সংগ্রামের চিহ্ন দেখতে ভুল হয়— কিংবা দেরি হয়।
আঁদ্রে জীদ তাঁর গীতাঞ্জলির ভূমিকায় বলেছেন যে এই কাব্যের তত্ত্বকথায় তিনি মজেননি, কেননা ঔপনিষদিক তত্ত্বের কোনো পরিবর্তনে কবি অনিচ্ছুক, অতএব তাতে নূতনত্ব নেই। কিন্তু এই পুরোনো তত্ত্বের আনন্দিত, সংরক্ত সঞ্জীবন, তার অভিনব শিল্পরূপের উজ্জ্বলতা— এরই প্রশংসায় জীদ পঞ্চমুখ। ‘Passion’, ‘daring’ (ইএটস-এর ভূমিকা), রবীন্দ্রনাথের পশ্চিমী গুণগানে যখন এ-সব কথা বার-বার শুনি, আমাদের তখন একটু অবাক লাগে। কিন্তু খৃষ্টীয় মতে যেহেতু তত্তমসি অমান্য এবং জীবাত্মা পরমাত্মায় ভেদবোধ প্রবল, তাই গীতাঞ্জলির অন্তরঙ্গতা পাশ্চাত্ত্য চোখে দুঃসাহসিক, তার উচ্ছল আনন্দ কারো কাছে দূষ্য, কারো কাছে মহান।
এই আনন্দ কিসের? সে কি শুধুই ব্রহ্মস্বাদ, শুধু মায়ার পরপারে ধ্রুব সত্যের উন্মোচন? না, আনন্দ এই জীবনেও, এই মর্ত্য জীবনে, মৃত্যুকবলিত এই শরীরে, ইন্দ্রধনুতুল্য পৃথিবীতে। এই বোধ ভারতীয় ঐতিহ্যে যদিও সনাতন, তবু একদিকে ‘হিন্দুয়ানি’র পুনরুত্থান, অন্য দিকে ব্রাহ্ম পিউরিটানিকতা, এই দুই আন্দোলনের প্রভাবে ভারতীয়রাও প্রায় ভুলতে বসেছিলো। রবীন্দ্রনাথ, শুধু-যে পুনর্বার ঘোষণা করলেন তা নয়;— যেহেতু তিনি প্রকৃতপক্ষে দার্শনিক নন, শিল্পী, ধর্মগুরু নন, কবি, তাই জন্মভূমিতেই তার নবজন্ম দিলেন। উপরন্তু, এই কথা বস্তুতই জগতবাসীকে শোনাবার যোগ্য, কেননা এই বৈরাগ্যব্যতীত মুক্তির প্রস্তাব, প্রচলিত ধর্মমতের যা বিরোধী, মানবের পীড়িত আত্মার মূল্যবান শুশ্রূষা এখানে নিহিত। এই পার্থিব জীবন, যে-সব অলঙ্ঘ্য বিধানের মধ্যে জীবের জন্ম, যার মধ্যে বাঁচতে এবং মরতে সে বাধ্য, সেটা যে ভগবানের উপলব্ধির অন্তরায় নয়, সেটাও উপায়, এই প্রয়োজনীয় চেতনা রবীন্দ্রনাথে যেমন ভাস্বর, তেমন আর কোন আধুনিক কবিতে? বিশ্বের অণু-পরমাণুর সঙ্গে মানুষের ঐক্যবোধ আর কোন কবিতে এমন প্রবল? আধুনিক পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য যেখানে বহুলত নেতিবাদী, কখনো প্রায় অমানুষিক, কখনো প্রায় জীবনদ্বেষী, সেখানে— যদিও হিন্দুরই মায়াবাদী ব’লে দুর্নাম— মর্ত্য জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রেম, বিশ্বাসের অঙ্গীকার রবীন্দ্রনাথেই পরিকীর্ণ। এই বিশ্বাসেই তাঁর চরম মূল্য। তাঁর কাব্য প’ড়ে নাস্তিক হয়তো ভগবোন্মুখী হবে না, কিন্তু— কার্যত সেটাই মূল্যবান— উদ্ভ্রান্ত আধুনিক মানুষের জীবন-বিশ্বাস ফিরতে পারে। সাম্প্রতিক পশ্চিমী সাহিত্যের মৃত্যু-পূজা বোধ হয় আর বেশিদিন সহ্য হবে না, বোধ হয় এলিঅটের ককটেল পার্টিতে এই শূন্যবাদ তার বিবর্ণতম প্রান্তে পৌঁছলো। হয়তো এখনই পশ্চিমের নতুন ক’রে এই প্রাচ্য কবিতে প্রয়োজন।
অতএব ম্যাকমিলানের পুনর্মুদ্রণ সময়োচিত। আক্ষেপ শুধু এটুকু যে এই নতুন সংস্করণে ‘দি চাইল্ড’ নামক দুষ্প্রাপ্য কবিতাটি গৃহীত হ’তে পারলো না; এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলার কোনো উল্লেখ-সূচীর অভাবে সমালোচকের পরিশ্রম বাড়ে। এই সূচী বিশ্বভারতী স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করলে আমরা উপকৃত হই।
*বানান অপরিবর্তিত