সুমিত দাস
প্রশ্ন সঙ্গত, ভারতের সরকারি নাম বদলের প্রস্তাব যখন মোদি-সরকারের দিক থেকে আসছে, তখন 'এক দেশ, এক নির্বাচন'-এর প্রস্তাবও আছে। দুটি বিতর্ক পাশাপাশি আয়োজন করে কি কোনও বড় বদল, বলা ভাল, আমূল বদল আনতে চাইছে বিজেপি? যাতে ইউনিয়নের রাজ্যগুলির ক্ষমতা লোপ পায়? ভাষা ও ভূগোলের বৈচিত্র্য কমিয়ে এনে যে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় উপনিবেশ?
জাদুকর ম্যানড্রেকের এক উত্তরসূরি বহু যুগ পেরিয়ে পৌঁছেছেন পৃথিবীতে। খুঁজে পেলেন বহু আগের ম্যানড্রেক আর লোথারকে। কথায় কথায় আগামী প্রজন্ম খবর দিল, তাঁরা ভবিষ্যতের পৃথিবী থেকে ধর্ম আর রাজনীতি গুটিয়ে দিয়েছেন। আসলে, তখনও সোভিয়েতের পতন হয়নি। ইন্দ্রজাল কমিকসের পাতায় কাল্পনিক মহাকাশ দখল নিয়ে রাশিয়া-আমেরিকার ঠান্ডাযুদ্ধ তুঙ্গে। যা ছুঁয়ে যেত ইন্দ্রজাল কমিকসের পাতা। তখনও বুঝিনি, মার্কিনি চরিত্ররা কীভাবে বাকি বিশ্বকে স্রেফ আবিষ্কার করতে করতে রচনা করে ‘চিন্তার সাম্রাজ্যবাদ!’
ভারত ছুঁয়ে ফেলল চাঁদ। আট ও নয়ের দশকের সরকারি স্কুলের পড়ুয়া, বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞানে শৈশব-কৈশোর পার করা বিজ্ঞানীরা ইসরোর কুঠুরি থেকে ঘোষণা করল— আমরাও পারি। রামমন্দির নির্মাণের যা বাজেট, তার তিনভাগের এক ভাগে চাঁদে পৌঁছনো যায়! শুধু অযোধ্যার রামমন্দিরের সৌন্দর্যায়নের জন্য উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারের বরাদ্দ ৭৯৭ কোটি টাকা, সেখানে চন্দ্রযান-৩-এর খরচ মাত্র ৬০০ কোটি। বিজ্ঞান কী সুন্দর! এই অন্ধবিশ্বাসে বিনিয়োগ করা রাষ্ট্রটিতে যেন ম্যানড্রেক বা সনাতন নামের কারও উত্তরসূরি জানতে পারে ‘বিশ্বাসের কি মহিমা!’ আর নিজেদের উজাড় করেও যেন অন্ধ থাকতে বাধ্য হন প্রফুল্লচন্দ্র রায় বা রামাস্বামী পেরিয়ারের ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম।
না, দেশটি, আজব নয়। এই যে ধুলোবালি, গাছপাখি, জন্তুজানোয়ার আর মানুষে মানুষ জুড়ে যে দেশ, তাতে রাষ্ট্র খানিক দূরে। জন্মের পর হামাগুড়ির উঠোন ছিল আমাদের। বেড়া টপকে পাড়া ছিল, উঠোনে উঠোন জুড়ে দেওয়ার মাধুকর ছিলেন কেউ। পাড়া মিশত এলাকায়, বড় হতে হতে এলাকা হত অঞ্চল, অঞ্চল ঘাটে বা রেলস্টেশনে মিশে পাড়ি দিত সদরে। ওই যে ধুলোবালি, আরও আরও দূরের জনপদ, সেও তো ভারত নাকি! সেও বুঝি গেয়ে ওঠে— ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা/পঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট…।’ তখন আমরা দেশ বলতে ‘দশ’ বুঝি। ‘দশে মিলে করি কাজ।’ টিভি এল একদিন, দেশকি ধরতি সোনা উগলালো, মিলে গেল সুর মেরা-তুমাহারা! নানা ভাষার সুরের যাত্রা আজও আমাদের কারও কারও মুখস্থ! দেশ এমনও হয় মাগো!
এ বাংলার গানে গানে, কবিতায় বা স্লোগানে যে ভারত, তা এল কোত্থেকে! এই যে জেলা বা রাজ্য বদলালে দেশ বদলায় মজুর বা কর্মজীবী, দেশের বাড়ি ছেড়ে— আবার ফেরে যে স্মৃতির কাছে, যে স্মৃতিতে উঠোন জুড়ে ভাত ছড়িয়ে রাখেন মা, সেও তো দেশ! আস্তিক হই বা নাস্তিক, বেড়ে ওঠার অভ্যাসে সে দেশ হয় মা, বা ফর্জ, মানে দায়িত্ব। সীমানা নেই তাঁর। আছে নানা রং, নানা বুলি, নানা মত, নানা ধর্ম— একেই তো ভারত বলে জানি। অজস্র দেশ দিয়ে গাঁথা কবেকার সহাবস্থান!
বড় হতে হতে দেশের ভাবনায় তালগোল পাকাল রাষ্ট্র। ট্রাফিক পুলিশ, ভোটার আইডি, প্যানকার্ড, আধারকার্ডে উঠোনের ঠিকানা আর সংখ্যার চিহ্ন ঠাসা।
শুনছি নাকি, ভারত রাষ্ট্র মানে ইন্ডিয়া, নাম বদলে ভারত হবে। ভারতই তো জানতাম। জানতাম, ইন্ডিয়া মানে রিপাবলিক অফ ইন্ডিয়া, মানে ‘ভারত গণরাজ্য’। খাঁটি বাংলায় ‘ভারতীয় প্রজাতন্ত্র।’ কিন্তু এ নাম এল কী করে?
৭৪ বছর আগে একটা কঠিন সমাধান বের করেছিলেন আম্বেদকর। ইন্ডিয়া, নাকি ভারত, নাকি অন্য কোনও নাম? ৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ থেকে টানা ২ বছর ১১ মাসের বিতর্কের যবনিকাপাত হল ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯-এ। সংবিধান এল। এল, ইন্ডিয়া, মানে ভারত। ‘India, that is Bharat…। ভারত, হিন্দুস্তান, হিন্দ, ভারতভূমি, ভারতবর্ষ— এই নামগুলি সিদ্ধান্তের আগে নানাভাবে এসেছিল। ‘বেদের যুগের দুষ্মন্ত ও শকুন্তলাপুত্র ভরতের নামে ভারত নয় কেন?’ কামনাথ, ব্রজেশ্বর প্রসাদদের ‘ভারত’ নামকরণের দাবির পাশে মৌলানা হাসরাত মোহানির বক্তব্য ছিল— ‘ভারত বা ইন্ডিয়া আসলে রাজ্যগুলির ইউনিয়ন হবে।’ মানে রাজ্যগুলির সহাবস্থান। আর এই সহাবস্থানে থাকা দেশগুলির যে প্রজাতন্ত্র, নাম খোঁজা হচ্ছিল তার।
প্রশ্ন সঙ্গত, ভারতের সরকারি নাম বদলের প্রস্তাব যখন মোদি-সরকারের দিক থেকে আসছে, তখন ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’-এর প্রস্তাবও আছে। দুটি বিতর্ক পাশাপাশি আয়োজন করে কি কোনও বড় বদল, বলা ভাল, আমূল বদল আনতে চাইছে বিজেপি? যাতে ইউনিয়নের রাজ্যগুলির ক্ষমতা লোপ পায়? ভাষা ও ভূগোলের বৈচিত্র্য কমিয়ে এনে যে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকবে ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় উপনিবেশ? মনে রাখা জরুরি, মোহানি চেয়েছিলেন— রাজ্যগুলি স্বায়ত্তশাসিত হোক। ভারতীয় ইউনিয়ন হোক এই স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যগুলির সমন্বয়। ইন্ডিয়া নয়, ভারত হোক, এ দাবি আগাগোড়াই ছিল। কিন্তু ভারতীয় ইউনিয়নে রাজ্যগুলির সহাবস্থান নিয়ে সে অর্থে বিতর্ক তেমন ছিল না। প্রসঙ্গত, আইপিসি অর্থাৎ ইন্ডিয়ান পেনাল কোড বাতিল করে ইতিমধ্যে ন্যায়সংহিতা এনেছে মোদির সরকার।
বলা হচ্ছে, মহাভারতের যুগ থেকে ‘ভারত’ নামটি চলে আসছে। মহাভারতের যুগ কবে? বিতর্ক আছে। যদি মৌর্যযুগের ভারত দেখা যায়, তাতে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি নেই। তাতে কেরল-তামিলনাড়ুও নেই। ভারত নামে কিছু কি ছিল তখন? অন্তত কোনও ভূ-ভাগ? পুরাণে আছে, মানে বিশ্বাসে আছে! কারও কারও দাবি, গুপ্তযুগের সমসাময়িক মহাভারতে যে মণিপুরের কথা বলা হয়, তা আজকের ওডিশা উপকূলের কোনও জায়গা। কারণ, চিত্রাঙ্গদার মণিপুরে সমুদ্র ছিল। মুঘলরাও উত্তর-পূর্বে নেই। বরং, ব্রিটিশ মানচিত্র পশ্চিমের বালুচ থেকে পূবের বার্মা দখলের পথে দখলে আনল উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে। মনে পড়ে যায় সেই নাগা-বুড়োর গল্প। সাতচল্লিশের শেষ আগস্টে যিনি রেডিও শুনে বলেছিলেন— ‘ইন্ডিয়া নাকি স্বাধীন হয়েছে, আমরাও নাকি স্বাধীন হয়েছি!’ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর ওই উত্তর-পূর্বের মণিপুরে দাঙ্গা চলছে অবিরাম, কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই! ভারত নয়, যেন সত্যি অন্য কোনও সভ্যতা!
হিন্দুত্ব, মানে ‘হিন্দু’ ফারসি শব্দ, হিন্দ-ও তাই। শব্দ বদলে ‘হামারি সনাতন ধর্ম’, মানে ‘সনাতন ধর্ম’ নামটির ব্যপক প্রচার শুরু হয়েছে। জাতপাত-বিরোধী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের প্রকৃতিধর্ম বা সনাতন ধর্মের অনুসারী বলেন। ইতিহাসে আর্যাবর্ত হিসেবে কেউ কেউ এই উপমহাদেশকে চিহ্নিত করতে চান। তাতে ক্ষুদ্রতম আর্য জনগোষ্ঠীর দখলদারি প্রকট হয়। আর ব্রাহ্মণ্যবাদী, আর্যবাদী ‘সনাতন ধর্ম’ হয়ে ওঠে চরম জাতপাতবাদী। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে কঠিন পরীক্ষার সামনে ভারতীয় জনতা পার্টি। দলিত-সংখ্যালঘুর দেশ পুনরায় দখল করতে নতুন ‘লীলা’ প্রয়োজন। ‘এক দেশ এক নির্বাচন’-এর হাওয়া তুলতে ভারত, মানে ইন্ডিয়া, এবার ‘ভারত’ হবে, নাকি ইন্ডিয়া ডিলিট হবে, তা পরের বিষয়। আসলে, ‘নামে কিছু যায় আসে’— তা প্রমাণ করা জরুরি। হাতি হোক বা মানুষ, অশ্বত্থামা মরবেই!
শেষমেশ, শশীভূষণ নামের এক সনাতন, লোটাকম্বল নিয়ে বরিশাল ছাড়লেন। তাঁর সন্তান, আমার বাবা থিতু হলেন বর্ধমানে, আমি কলকাতায়, বোন দিল্লিতে। অবিভক্ত বাংলা বা পাঞ্জাব ছিল ভারতবর্ষে। এখন ভারতীয় উপমহাদেশে। ইন্ডিকার সমসাময়িক ভারতে পা রাখা ব্রাহ্মণ্যবাদ ছলে বলে ক্ষমতায় থাকতে চায়। ইন্ডিয়া না-হয় স্রেফ ভারত হবে, বিভাজন ঘুচবে? ভারত না হয় ব্রাহ্মণ্যবাদের ডাকনামে ‘সনাতনী’ হবে— তাতে কি জাত মুছবে? দূর হবে প্রবাহমান ভেদাভেদের নামে নিপীড়ন? দূর হবে দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের ওপর উত্তরের আর্যাবর্তের বহুকালের অধিকার-বাসনা? সনাতনে বিলীন হবে সিংহভাগ অনার্য? নাকি, তিনহাজার বছরের প্রবাহে নতুন ছলে নানারকমের হৃদয়পুর হয়ে উঠবে স্রেফ আর্যাবর্ত। অন্ধবিশ্বাসীর উৎসবে যেমন বিজ্ঞানের জয়যাত্রা হয়ে উঠল রাজার লীলা! তেমনই অবতার এক, সাজালেন ভারত নামের হৃদয়পুরের কঠিন শরসজ্জা। মহাকাব্য মহাভারত এক হতেও শিখিয়েছিল। জাতপাতের, বিভাজনের মতাদর্শ তা শেখে কই! আর আমরা, নানারকম হৃদয়পুরে বাঁচতে বাঁচতে মরতে মরতে গুনগুন করব ‘ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম/আমরা চলেছি সেই সূর্যের দেশে!… ভারতবর্ষ মানবতার এক নাম, মানুষের লাগি মানুষের ভালবাসা, প্রেমের জোয়ারে এ ভারত ভাসমান, যুগে যুগে তাই বিশ্বের যাওয়া আসা।” না, বিভাজনের সনাতনী, বর্ণবাদের আর্যাবর্ত নয়। হাজার হাজার বছরের প্রবাহে অজস্র হৃদয়পুর দেশ বলতে বুঝেছে ভারত, ভারত বলতে বুঝেছে বিশ্ব। সে ভারত বুদ্ধের লীলাক্ষেত্র, এ-দেশ কৃষকের, মজুরের, বিজ্ঞানীর, এই তো সেদিন যে চাঁদে উড়ে গেল।
*মতামত ব্যক্তিগত
খুবই সময়োপযোগী তথ্যসমৃদ্ধ বিশেষত মানচিত্র সহযোগে দৃষ্টান্তমূলক লেখা যা চিন্তা ভাবনার অবকাশ করে দেয়।