অশোক মুখোপাধ্যায়
২০১৪ সালের আগে আমাদের দেশের যে অবস্থা ছিল, খুব কিছু ভাল না-হলেও একটা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী একদলীয় হিন্দুরাষ্ট্রীয় শাসনের দিকে দেশ এগোচ্ছিল না। সরকারের বহু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমালোচনা এবং আন্দোলন করার পরিসর ছিল। মুসলিম দলিত ও নারী নিপীড়ন একটা শাসক দল আশ্রিত ও প্রশ্রিত দৈনন্দিন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়নি। কর্পোরেট স্বার্থের দিকে তাকিয়ে সমস্ত অর্থনীতি পরিচালিত হলেও কর্পোরেট দালালি এত নির্লজ্জ ও প্রকাশ্য ছিল না। এই হেরফেরগুলো যেহেতু ছিল, নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে তা আবার ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনাও এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে। এই মুহূর্তে প্রাক-২০১৪ পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হতে পারে এবং দেশের সমস্ত বামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তির এখন এটাই দাবি ও চাহিদা হওয়া উচিত
কোপারনিকান গ্যালিলেয়ান কেপলারিয়ান মডেলে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে ২০২৪ সালের দিকে যত এগোচ্ছে, ভারতের এক ভিআইপি-র ঘুম ততই ছুটে যাচ্ছে। আর কয়েক মাসের মধ্যে লোকসভার নির্বাচন। নির্বাচনে তাঁর দলের ভরাডুবির বিরুদ্ধে রবি বা বৃহস্পতিকে যদি-বা ছককাটা কাগজে সামিল করাও যায়, বাইরের লাইনে দাঁড়ানো নির্বাচকমণ্ডলীর কতাংশকে যে পক্ষে সামিল করা যাবে তা নিয়ে তিনি নিজে খুবই নিঃসন্দেহ। গত প্রায় দশ বছরে তাঁর হাতে একটা কোনও সামান্যতম কৃতিত্ব কার্ড নেই যা ঝুলিয়ে তিনি সামনের ভোট-নাও পার করতে পারেন। আগের নির্বাচনের মতো আর একবার কোনও সামরিক বা আধাসামরিক কনভয়ে হামলানাট্য আয়োজন করে ৪০-৫০ জন হিন্দু জওয়ানকে ভোগে পাঠিয়ে নিজের এবং দলের ভবি তৈরি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অতঃ কিম?
অনেক টালবাহানা এবং অপেক্ষার পর কংগ্রেস-সহ সমস্ত বিরোধী দলগুলি একত্রিত হয়ে একটা জোট গঠন করে ফেলেছে, যাকে মনে হচ্ছে আর ভেঙে ফেলা যাবে না। এই জোট জবরদস্ত হওয়ার পেছনেও তাঁর বদ-শাসনের বিরাট অবদান আছে— এটাও তিনি এখন রাতে ঘুমোনোর সময়ে জেগে জেগে বুঝতে পারছেন। ইডি সিবিআই পিএমএলএ বেছে বেছে বিরোধীদের উপর প্রয়োগ করতে গিয়ে এবং নিজ দলের পুরনো এবং আগত নেতা তথা পেয়ারের বানিয়া আদানিকে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি তদন্ত থেকে দুহাতে আগলে রেখে তিনি নিজেই বিরোধীদের এককাট্টা হওয়ার রাস্তায় ঠেলে দিয়েছেন। এখন না পারা যাবে ইডি সিবিআই-দের ফিরিয়ে আনতে, না যাবে আগলায়িতদের বিরুদ্ধে সেই সংস্থাগুলিকে লেলিয়ে দিতে।
অতঃ পুনঃ কিম?
সংবাদপত্র টিভিচ্যানেল এবং পত্রকারদের এক বিরাট অংশকে খরিদ করে নিয়েও হয়েছে এক মহাবিপত্তি। মনিপুরের যে চারমাসব্যাপী চলমান ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের খবর চার-পাঁচ লাইনও ছাপা কাগজে নেই, তিন-চার মিনিটও সঙ্গে সুমনে নেই, সেইসব প্রিন্ট মিডিয়া এবং এভি মিডিয়া যখন পাতার পর পাতা এবং ঘন্টার পর ঘন্টা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রবীন্দ্রপ্রেম বা প্রধানমন্ত্রীর চিতা-সফর নিয়ে মেতে ওঠে, তার বিশ্বাসযোগ্যতা যে কোথায় তলিয়ে যায়, বলার অপেক্ষা রাখে না। চ্যানেল না-হয় নিছক দেখার ব্যাপার। খবরের কাগজ তো ঘরে ঘরে বা রাস্তার মোড়ে বিক্রি করতে হবে এবং লোকে পয়সা দিয়ে কিনবে। তা টিনটিন বা অরণ্যদেব না কিনে শুধু শুধু তারা পদ্মতোতাদের কাহিনি কেন কিনবে? ফলে চ্যানেলে না এলেও ছাপার অক্ষরে এখন কুকীর্তিগুলি একে একে রোজই কিছু না কিছু ফুটে বেরোচ্ছে। কেন্দ্রীয় বাজেটের এক বিরাট হিসসা বিজ্ঞাপনে ব্যয় করেও তাকে আড়াল করা যাচ্ছে না।
জি-বিশ সম্মেলন দিল্লিতে সংগঠিত করে একটা চেষ্টা হয়েছিল বিশ্বজনমতকে বোঝাতে যে এই পিএম এখন ভারতকে এক উন্নত দেশে রূপান্তরিত করতে চলেছেন। হায়! সেটা করতে গিয়ে দিল্লিতে বিভিন্ন রাস্তায় উন্নয়নের আসল চিহ্ন গরিব লোকেদের বস্তিগুলোকে উঁচু প্লাস্টিক শিট দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ফলে কারও আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি, প্লাস্টিকের ওধারে কী আছে। কেননা, যাঁরা এসেছেন তাঁরাও নিজ নিজ শাসনভূমিতে যে অনুরূপ অনেক ছ্যাঁচড়া কীর্তিকলাপ করে থাকেন, এবং সেই সুবাদে এগুলো দেখেই যে যাঁর মতো বুঝে যান, প্লাস্টিকে মোড়া উন্নয়ন আসলে কেমন হচ্ছে! তাঁদের সঙ্গে আগত সাংবাদিককুলও যথেষ্ট আগ্রহের সঙ্গেই প্লাস্টিক শিটগুলিকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং ছবি তুলে রাখেন। কিছুদিন আগে আমেরিকার পূর্বতন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সফরকালে গুজরাতেও এই কায়দা নেওয়া হয়েছিল। তখন আবার প্লাস্টিকের উপর ভরসা না করে সরাসরি ইট বালি সিমেন্টের দেওয়ালই তুলে দিয়েছিল গুজরাতের গেরুয়া সরকার। হয়তো এই প্লাস্টিক কাণ্ডের কথা মাথায় রেখেই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের দপ্তর জানিয়েছে, ভারতে ৯৭ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। ওরা তো আর জানে না, সেই দুঃখে আমাদের পিএম তাঁর প্রতিদিনের এক এক বেলার ভোজ মেনুতে লাখ খানেকের বেশি সরকারি টাকা খরচ করতে খুবই দ্বিধাগ্রস্ত ও মনোক্লেশ বোধ করে থাকেন। কখনও কখনও জনসভায় তাঁকে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতেও দেখা গেছে বলে আদানি ও আম্বানির মালিকানাধীন টিভি চ্যানেলগুলি সচিত্র প্রচার করে থাকে।
ইন্ডিয়া নামক বহুদলীয় জোট স্থায়িত্বের সম্ভাবনা নিয়ে গড়ে ওঠার ফলে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে আদানির ভুবনজয়ী মেগাজোচ্চুরি ও মণিপুর ষান্মাসিক অগ্নিদহন কাণ্ড নিয়ে লোকসভায় ডবল ইঞ্জিন চান্দ্রেয় নীরবতা যে বিপুলভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলবে, এটা বুঝতে কোনও সোক্রাতীয় বা নাসিরুদ্দিনিক বিচক্ষণতা লাগে না। অন্য সকলের মতো নরেন্দ্র মোদিও বুঝতে পেরেছেন। তাঁর বিনিদ্র চাঞ্চল্যের পশ্চাদপট এটাই। এর জন্যই তিনি কখনও এক-দেশ-এক-ভোট স্লোগান বাজিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, কখনও ইন্ডিয়া নামটাই বাতিল করে দেওয়া যায় কিনা পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছেন, অথবা রাস্তা থেকে টুইট করে লোকসভার অধিবেশন ডেকে দিচ্ছেন, ইত্যাদি।
শুধুমাত্র এইদিকে লক্ষ্য রেখে চললেই যারা ভাজপা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দেশে একটা ন্যূনতম বদল আনতে চান তাঁরা তাঁদের কর্তব্য বুঝে নিতে পারেন। পারছেন যে না, বিভিন্ন রাজ্যে জোটভুক্ত দলগুলির স্থানীয় নেতাদের আচরণে যেমন তার প্রকাশ ঘটছে, তেমনই কিছু বামপন্থী দল বা গ্রুপের আচরণ ও বক্তব্যেও ফুটে উঠছে। সেই সব বিভ্রান্তি প্রসঙ্গেই এবারে দু-চার কথা বলা দরকার।
বিভ্রান্তি-১: ফ্যাসিবাদ ভোটে জিতে আসে, কিন্তু তাকে ভোটে পরাস্ত করা যায় না। মাঠেময়দানে শ্রেণিসংগ্রাম করেই তাকে পরাস্ত করতে হবে।
এই থিসিসে ধরে নেওয়া হয়েছে ফ্যাসিবাদ আর ফ্যাসিবাদী দলের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। যদি বলেন, ফ্যাসিবাদ ভোটে জিতে আসে না, তাই তাকে ভোটে পরাস্ত করা যায় না, তার একটা মানে হয়। সামগ্রিক পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ইত্যাদি মিলে পর্যায়ক্রমে যে ফ্যাসিবাদের আবাহন ঘটায় তা ভোটের মাধ্যমে আসেও না, যায়ও না। তার বিরুদ্ধে প্রতিটি ক্ষেত্রে তীব্র গণ-আন্দোলন ও শ্রেণিসংগ্রাম এবং পাশাপাশি মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু একটা ফ্যাসিবাদী দল যেমন ভোটে জিতেই ক্ষমতা করায়ত্ত করে, তেমনই যতক্ষণ সে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা তুলে দিতে না পারছে, তাকে ভোটে পরাজিত ও বিতাড়িত করার অবকাশ বিরোধী দলগুলির হাতে বেশ ভালমতোই থাকে। ভারতেও আছে। জার্মানিতে হিটলারিরাজ প্রতিষ্ঠার আগে এই পরিস্থিতি ১৯৩২ সাল অবধিও ছিল। ইতালিতে ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতা দখলের তরিকা বুঝতে না-হয় সে দেশের বামপন্থীদের অসুবিধা হয়েছিল, কিন্তু জার্মানিতে হিটলার তার বিরোধীদের অনেক দিন সময় দিয়েছিল। সমস্যা হল, যাদের বোঝার কথা, তারা ১৯৩৩ সালের আগে ধরতে পারেনি। সেখানকার বামপন্থী এবং কমিউনিস্টরা আমাদের মতোই তখন সমাজবদলের সপক্ষে প্রবল বৈপ্লবিক যুক্তিতর্ক চালিয়ে গেছে। হিটলার ক্ষমতায় জাঁকিয়ে বসার পরে ১৯৩৫ সালের পর সেই তর্ক থেমেছিল। আমরা চাইলে অবশ্য ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই সেইসব বৈপ্লবিক যুক্তিতর্ক থামিয়ে ১৯৩৫-এর কার্যকর তর্কগুলি স্মরণ করতে পারি।
বিভ্রান্তি-২: বিজেপি-র জোট আর এই তথাকথিত ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কংগ্রেস আর বিজেপি একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। দুটোই কর্পোরেটদের বিশ্বস্ত দালাল এবং সেবাদাস। একে হারিয়ে ওকে ভোটে জিতিয়ে আনলে জনগণের স্বার্থের কোনও হেরফের হবে না। বিজেপি-কে মাঠেময়দানে শ্রেণিসংগ্রাম করেই পরাস্ত করতে হবে। দিল্লির কৃষক বিক্ষোভ যে রাস্তা দেখিয়েছে বিজেপি-র অপশাসন দূর করার সেটাই একমাত্র রাস্তা। {সঙ্গে থাকে কার্ল মার্কস-এর একটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি!}
এই থিসিসে ধরে নেওয়া হয়েছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফ্যাসিবাদ আর প্রাক-ফ্যাসিবাদ অবস্থার মধ্যে কোনও মৌলিক পার্থক্য নেই। এটাও একটা আদ্যন্ত ভুল ধারণা। ধনতান্ত্রিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় যেমনটি হওয়ার কথা সেইটুকু সাধারণ পরিস্থিতি ধরে নিলেও, ২০১৪ সালের আগে আমাদের দেশের যে অবস্থা ছিল, খুব কিছু ভাল না-হলেও একটা ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী একদলীয় হিন্দুরাষ্ট্রীয় শাসনের দিকে দেশ এগোচ্ছিল না। নানারকম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারের বহু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমালোচনা এবং আন্দোলন করার একটা পরিসর ছিল। মুসলিম দলিত ও নারী নিপীড়ন একটা শাসক দল আশ্রিত ও প্রশ্রিত দৈনন্দিন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়নি। উচ্চতর আদালতগুলিতে বিচারব্যবস্থার একটা দৃশ্যমান স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় ছিল। কর্পোরেট স্বার্থের দিকে তাকিয়ে সমস্ত অর্থনীতি পরিচালিত হলেও কর্পোরেট দালালি এত নির্লজ্জ ও প্রকাশ্য ছিল না। এনআরসি-র আতঙ্ক ছিল না। এই হেরফেরগুলো যেহেতু ছিল, নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে তা আবার ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনাও এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে। এই মুহূর্তে প্রাক-২০১৪ পরিস্থিতিতে ফিরে যাওয়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হতে পারে এবং দেশের সমস্ত বামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তির এখন এটাই দাবি ও চাহিদা হওয়া উচিত। আমাদের যাবতীয় বৈপ্লবিক যুক্তিতর্ক সাধারণ তাত্ত্বিক অর্থে ভুল না হলেও কার্যকারিতার দিক থেকে সময়ের বিচারে শুধু ভুল নয়, মূর্খামির চূড়ান্ত।
বিভ্রান্তি-৩: এই ইন্ডিয়া জোট স্থায়ী হবে, না নিজেদের মধ্যে নানারকম স্থানীয় মুদ্দায় ঝগড়ায় ফেঁসে যাবে?
এই প্রশ্নবোধক থিসিসে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে যদি বিজেপি-বিরোধী জোট সর্বাংশে ভাল আচরণ দেখাতে পারে, আমরা একমাত্র তাহলেই তাকে সমর্থন জানাব। গগনোদ্যানে কুসুমপ্রস্ফুটনের আকাঙ্ক্ষা হিসাবে সেটা মন্দ নয়, তবে বাস্তব যে আমাদের চাহিদামতো গড়ে ওঠে না বা আবির্ভূত হয় না— এটা আমরা আর কবে বুঝতে পারব? বুর্জোয়া দলগুলির ভেতরে এমনিতেই বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের দ্বন্দ্বসংঘাত টানাপোড়েন চলতে থাকেই। কমিউনিস্টরাই বা এই সমস্যার থেকে আজকের দিনে কতটুকু মুক্ত— আমরা নিজেদের দিকে তাকালেই বুঝে নিতে পারি। সেখানে বুর্জোয়া দলের কাছে এরকম প্রত্যাশা করাটাই একটা কল্পনাবিলাস। আমাদের এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত, কতটা সর্বোচ্চ পরিমাণ ভাল ভূমিকা এই জোট পালন করতে পারে— সেইদিকে তাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া। তাদেরও দায় আছে। তারাও বিজেপি-র প্যাঁচকলে বিপন্ন। সেই দলগত দায় থেকেই তারাও খানিক বোঝাপড়ায় যাওয়ার এবং টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আমাদের সেই প্রক্রিয়াকে জোরদার করে দিতে হবে। খোঁচাখুঁচিগুলিকে বড় করে না দেখিয়ে কোথায় কতটা ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা থাকতে পারে, সেইগুলিকে বড় করে দেখিয়ে।
আপনি কীভাবে খেলবেন তা শুধুমাত্র আপনার জানা স্কিলের উপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। আপনার বিপক্ষ টিম কীভাবে খেলছে বা খেলতে চাইছে, সেটাও বুঝতে হবে, সেই অনুযায়ী আপনার টিমের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হবে। এমনকি বদল করতেও হতে পারে।
আমরা অনেকেই যেটা লক্ষ করিনি বা বুঝতে পারিনি, সেটা হল, বিগত পাঁচ ছয় বছরে ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে বিজেপি-র আপাতত প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হল সর্বভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসকে মুছে দেওয়া, অন্তত একটা অকার্যকর শক্তিতে পর্যবসিত করা। বিহার এবং উত্তরপ্রদেশে এই কাজে তারা অনেকটাই সফল। মধ্যপ্রদেশ মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকে তারা এইদিকে লক্ষ্য রেখে নানা রকম পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে আছে। বিধায়ক কেনাবেচাও এই পরীক্ষার অন্তর্গত। পশ্চিমবঙ্গ এবং কেরলেও তারা একই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতারা— সোনিয়া রাহুল প্রমুখ— এত দিন এটা ধরতে না পারলেও সম্প্রতি পেরেছেন বলেই বোধ হচ্ছে। কিন্তু তাদের রাজ্যস্তরের নেতারা এখনও এই ঘটনাটা বুঝতে পেরেছেন বলে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরতে পারেননি।
এই একই লক্ষ্য থেকেই বিজেপি এখন জনগণের সামনে গান্ধি নেহরু প্রমুখর বিরুদ্ধে একটা সার্বিক সমালোচনা এবং বিরোধিতার পরিবেশ তৈরি করতে সচেষ্ট। এই প্রচেষ্টারই অঙ্গ হচ্ছে সুভাষচন্দ্র বসুকে এঁদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে ব্যবহার করার মরিয়া প্রয়াস। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে এই সময়ে সুভাষ বসুর চিন্তা ও কর্মের (ভালমন্দ মিশিয়ে) কোনও কার্যকরী প্রভাব নেই বললেই চলে। ফলে সেদিক থেকে তাঁর তরফে বিজেপি-র কর্মধারায় কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গান্ধি ও গান্ধিবাদের প্রভাব সারা দেশেই এখনও একটা শক্তিশালী উদার হিন্দুধর্মীয় সর্বংসহ অস্তিত্ব নিয়ে বেশ বড় আকারেই বিদ্যমান। যেটা আমাদের মার্কসবাদী ও বৈজ্ঞানিক বিচারে যতই ভ্রান্ত ও বাতিলযোগ্য মনে হোক না কেন, বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবার যে উগ্র ধর্মান্ধ হিন্দুত্বের ধ্বজা নিয়ে এগোতে চাইছে, তার পক্ষে একটা বড় বাধাস্বরূপ। আরএসএস যে স্বাধীনতার প্রভাতবেলাতেই গান্ধিকে হত্যা করেছিল, এটা নিছক তাৎক্ষণিক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার খেয়াল ছিল না; তার মধ্যে একটা সুচিন্তিত সুপরিকল্পিত সুদূরপ্রসারী ভাবনা ছিল। পরবর্তীকালে নেহরুর পরিচালনায় ভারতে যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের একটা সুস্থিত সাংবিধানিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল, যা সম্পন্ন করতে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বাইরে বিশ্ব পুঁজিবাদ খুব বেশি দেশে সফল হয়নি, সেটা সঙ্ঘ পরিবার জনসঙ্ঘ হয়ে বর্তমান বিজেপি-র নেতারা জানে; কিন্তু সেটা তাদের একেবারেই মনঃপুত নয়। আমরা এই কাঠামো সম্পর্কে বাঁদিক থেকে যে-সমস্ত সমালোচনা করি, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে যে সমস্ত সীমাবদ্ধতার কথা বলি, বিজেপি-র বক্তব্য একেবারেই সেরকম নয়। সে বরং বিপরীত দিক থেকে এই রাষ্ট্রকাঠামোকে দুমড়ে মুচড়ে আরও প্রতিক্রিয়াশীল আরও স্বৈরতান্ত্রিক আরও কট্টরবাদী একটা হিন্দু-তালিবানি রূপদানের লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চাইছে। তাই তাদের কাছে গান্ধি-নেহরুর বিরুদ্ধে একটা মতসঙ্ঘর্ষ উপস্থাপন করা এত জরুরি হয়ে পড়েছে।
পুঁজিপতিশ্রেণির কাছে একটা শাসক দল নেহরু কায়দায় পরিষেবা দিচ্ছে না মোদি কায়দায়, জল জঙ্গল খনি ছত্তিশগড় স্টাইলে তুলে দিচ্ছে না মণিপুর মডেলে— এটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। পরিষেবা পাওয়ার প্রশ্নটাই তাদের কাছে একমাত্র বিবেচ্য। কিন্তু দেশের জনগণের কাছে এই বিকল্পের প্রশ্নটি গুরুত্বহীন নয়। বিরোধী দলগুলিরও এই বিষয়টি আর উপেক্ষা করতে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
বিজেপি-র সঙ্গে রাজ্যস্তরের স্থানীয় দলগুলিরও সংসদীয় প্রেক্ষিতে বিরোধ আছে। কিন্তু সেটা এই মুহূর্তে তার কাছে বড় বিরোধ নয়। কেরলে সিপিএম বা পশ্চিমবঙ্গে টিএমসি-কে তারা বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করতে থাকবে। কিন্তু সেগুলো হচ্ছে গৌণ লক্ষ্য এবং কার্যক্রম। আবার আদানিকে পাঠিয়ে তারা একটা হাইফেনও তৈরি করে রাখবে। অনেক রাজ্যে অ-বিজেপি সরকার গঠন হবে, এটাও এখনও তারা মেনে নিচ্ছে। কেননা, তার আসল লক্ষ্যপূরণ করতে এগুলো আগামীদিনে কোনও বিশেষ বাধাই হবে না। সর্বভারতীয় স্তরে যদি বিজেপি আবারও একটা বড় বিরোধিতার বাধা কাটিয়ে উঠতে পারে, এমনিতেই দুর্বল আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে সে এতটাই বিকৃত করে ফেলবে যে রাজ্য সরকার আর পঞ্চায়েত পুরসভার মধ্যে কোনও কার্যকর তফাৎ সেদিন আর অবশিষ্ট থাকবে না।
রাজ্যস্তরে বিচারব্যবস্থাকে ইতিমধ্যেই সে অনেকটা গ্রাস করে ফেলেছে। রাজ্য পুলিশ এবং প্রশাসনের মধ্যেও আইনি বে-আইনি নানা কায়দায় সে এনআইএ ফর্মুলেশন ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিএসএফ-এর সাঁড়াশিও চেপে বসছে। রাজ্যস্তরের শাসক দলগুলি সেই ব্যাপারেও প্রায় অনোয়াকিবহাল। বহরমপুর এবং খড়্গপুরের সাংবাদিক হেনস্থার ঘটনায় এই সব জিনিস শুধু বিরোধীরা নয়, রাজ্য সরকারও যে বুঝতে পারেনি— তা স্বতঃ স্পষ্ট। তারা দু-একজন প্রতিবাদী না-পোষ সাংবাদিককে টাইট দেওয়া গেছে ভেবে খুশি হয়ে গেছে; আসলে কে কাকে টাইট দিচ্ছে এবং ঘর গুছিয়ে নিচ্ছে, সেই ব্যাপারে তাদের অবস্থান রূপকথার বাল-কালিদাসের মতোই অদূরদর্শী।
আমরা কি সকলে মিলে পারব আর একটু বুদ্ধি খরচ করতে?
*মতামত ব্যক্তিগত
লেখকের কথা ধার করেই বল, ‘আমাদের এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত, কতটা সর্বোচ্চ পরিমাণ ভাল ভূমিকা এই জোট পালন করতে পারে— সেইদিকে তাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া।’– খুবই মূল্যবান ও সময়োপযোগী লেখা।