সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
[একটা খোলা জমি। যাই যাই করেও শীত এখনও চলে যায়নি। কুয়াশা ঢাকা মঞ্চ। কোনও কিছুই খুব স্পষ্ট নয়। মঞ্চের এক কোণায় ছোট্ট ঠোঁটে খুঁটে খুঁটে কিছু খেতে ব্যস্ত একটা চড়াইপাখি। অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলে ওঠে…]
চড়াই: আহা! কতদিন পরে এই তল্লাটে এলাম! সবকিছু কেমন বদলে গেছে! বছর কয়েক আগের চেনা চিহ্নগুলো বেমালুম লোপাট হয়ে গেছে। কেবল এই একচিলতে জমিটাই কোনওরকমে টিকে আছে। ভাগ্যিস আছে, না-হলে আমাদের ছেড়ে যাওয়া বসতিটার হদিশ পাওয়া ভারি মুশকিল হত। পাগলা ঝড়ের দাপটে ডানা ভেঙে পড়েছিল ঠাম্মি। আমি তখন খুব খুব ছোট। চামড়ায় ঢাকা শরীরে তখনও পালক গজায়নি। আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ঠাম্মি বলেছিল আমাদের পুরনো বসতি এই ছোট্ট শান্ত পাড়াটার কথা। তখন তো ডানা মেলে উড়তে শিখিনি, তাই তক্কে তক্কে ছিলুম। আজ অনেকদিন পরে একটু ফুরসৎ মিলতেই একেবারে সটান এখানে এসে হাজির হয়েছি। বাবুইভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে বেশ হত। দুজনে মিলে মন খুলে সেই ফেলে আসা দিনের কথা কইতাম!
[এমন সময়ে একটা অস্ফুট শব্দ ভেসে আসে কিচিরমিচির করে। চড়াই কথা থামিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। শব্দটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট শোনা যায়। বাবুইপাখির ডাক। মঞ্চে প্রবেশ করে বাবুই। হলুদ আর খয়েরি রঙের মিশেলে তাকে বেশ উজ্জ্বল মনে হয়]
বাবুই: কে গো তুমি? সাতসকালে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছ? বছর কয়েকের মধ্যে এমন চেহারার কাউকে এই তল্লাটে দেখেছি বলে তো মনে হয় না। অনুপ্রবেশকারী নয় তো!
চড়াই: আরে বাবা, তেমন কিছু নয়। আমার নাম চড়াই। এককালে আমার দাদু-ঠাম্মিরা এই চত্বরেই থাকত। তোমার দাদু-ঠাম্মির সঙ্গে তাদের বিলকুল আলাপ-পরিচয় ছিল। তা তুমি এখন কোথা থেকে এলে বাবুইভাই?
বাবুই: এদিকপানে এসো। ওই যে দূরে তালগাছের সারি দেখছ আমরা তো ওখানেই থাকি। আমাদের নামেই তো ওই পাড়ার নাম হয়েছে বাবুইপাড়া।
চড়াই: বাঃ ভারী সুন্দর নাম। কিন্তু তোমাদের পাড়াটা এখনও আগের মতো মাথা উঁচিয়ে টিকে আছে দেখে ভারী আনন্দ হচ্ছে।
বাবুই: সে কি আর সহজে হয়? রীতিমতো লড়াই করে আমরা আমাদের টিকিয়ে রেখেছি। মানুষদের মতিগতি বোঝা ভার। নিজেদের বাড়িঘর বানাতে গিয়ে ওরা যে আমাদের থাকার আস্তানাগুলোকেই চিরকালের মতো নষ্ট করে দিল। তা বাপু! তোমরা তো মানুষের সঙ্গে গলাগলি করে এক ঠাঁয়ে ছিলে! কী এমন কাণ্ড ঘটল যে তোমাদের চেনা মুলুক ছেড়ে দূরে, আরও দূরে পাড়ি দিতে হল?
চড়াই: আমি তো জন্ম-ইস্তক অন্য ঠাঁইয়েই আছি, তাই সবটা আমার জানা নেই। তবে এখন তো একটু বড় হয়েছি, তাই বুঝতে পারি আমাদের পুরনো বাসস্থানের চেনা চেহারাটাকে রাতারাতি বদলে ফেলাটাই হল সমস্ত কাল। তাকিয়ে দেখো, চারদিকে কেমন আকাশছোঁয়া স্কাইস্ক্র্যাপারের সারি। ইটের ওপর ইট গেঁথে অজানা খেয়ালে গড়ে ওঠা ওইসব বাড়িগুলোতে সেকালের মতো কড়ি, বরগা, আলসে, ঘুলঘুলির পাট নেই। এমন ফাঁকফোকরের মধ্যেই তো চড়াইরা বাসা তৈরি করে মহাসুখে থাকার বড়াই করত। হাল আমলের ফুলটুস ফ্ল্যাটবাড়িতে সে-সবের বালাই নেই। তাই বড়াই ছেড়ে কেবল টিকে থাকবার লড়াই করছি চড়াইরা।
বাবুই: বেশ বলেছ তো ভায়া— ফুলটুস ফ্ল্যাটবাড়ি। আরে বাপু! আমাদের মতো তালগাছের মাথায় অমন খাসা বাসা বানিয়ে দেখাও দেখি! কত কত ঝড়ঝাপটার দাপট সয়ে আমাদের উল্টোপানা কুঁজোর মতো দোলনাবাড়িগুলো এতকাল টিকে রয়েছে। তার কথা তো আমরা কখনও বড়াই করে গলা উঁচিয়ে বলে বেড়াই না!
তোমরা চড়াই,
করতে বড়াই—
‘অট্টালিকায় থাকি।’
এখন কেন,
মলিন মুখে
দুঃখেরে রও ঢাকি?
চড়াই: বা রে! এমন সাততাড়াতাড়ি ছড়া বুনে ফেলতে পারো তুমি!
বাবুই: তাঁতিদের মতো গাছের পাতার আঁশ জুড়ে বাসা বানানোই যে আমাদের কাজ। সেই কাজের তুলনায় কথার সঙ্গে কথা জুড়ে ছন্দ মিলিয়ে ছড়া বাঁধা তো খুব সহজ। অন্যের ভরসায় থাকতে থাকতে তোমাদের নিজেদের চেনা ছন্দটাই বোধহয় সব বদলে গেছে।
চড়াই: তা হয়তো ঠিক খানিকটা, তবে আমি তো কোকিলগুরুর পাঠশালায় যাই। সেখানে বন্ধুরা মিলে নানা ছন্দের ছড়া কাটি। দু-দণ্ড রোসো। আমি তোমায় একটা ছড়া শোনাই।
কেমন খাসা—
গাছসুতোর বাসা,
বানাও যে তালগাছে!
নিজের গড়া
বাসায় থাকো,
তাই কি হৃদয় নাচে?
বাবুই: বা! ছড়া বুনতে তো তুমিও ভারি ওস্তাদ দেখছি! আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম, কেমন! আপত্তি আছে নাকি তোমার?
চড়াই: মানুষের দৌরাত্ম্যের কারণে আমাদের সকলেরই যে কোণঠাসা অবস্থা। এখন যে আমাদের কাছাকাছি আসতেই হবে। নইলে সবারই তো বিপদ। তোমার বন্ধুত্বের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারি?
[এমন সময়ে হেঁড়ে গলায় কা-কা-কা করে কেউ ডেকে ওঠে। দাঁড়কাক প্রবেশ করে]
বাবুই: কে এমন হেঁড়ে গলায় হেঁকে উঠল এই বিহানবেলায়?
দাঁড়কাক: আমি গো আমি— শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে। নিবাস ৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপট্টি। আমি সনাতন বায়সবংশীয় দাঁড়িকুলীন, অর্থাৎ দাঁড়কাক।
চড়াই: থাক থাক, তোমার আর সুকুমারী ছড়া কাটতে হবে না। তোমার শরীরের এই লম্বা কালো চাপকান দেখেই বুঝতে পেরেছি তুমি হলে কাগেয়াপট্টির শ্রী কুচকুচে কাক্কেশ্বর। তা তোমার স্বগোত্রীয় পাতিকাকের দলবলের খবর কী? তাদেরও তো এই তল্লাটে সেভাবে দেখি না।
দাঁড়কাক: সে-কথা জানাতেই তো তোমাদের কাছে উড়ে এসেছি।
বাবুই (সভয়ে): একটু তফাতে দাঁড়াও কাক্কেশ্বরদাদা! তোমাদের দেখলেই আমার ভয় লাগে! যা মারকুটে স্বভাব তোমাদের!
দাঁড়কাক: কী আর করব বলো! বিধাতা যে আমাদের এমন ধাঁচেই গড়েছেন। চেহারাটাও গড়েছেন এমন মিশকালো রঙের বাহারে। আর এখন মানুষের পাল্লায় পড়ে বায়স-সমাজে গেল গেল রব উঠেছে! চড়ুইভাই, তোমাদের মতো বায়সকুলও যে আজ বিলীয়মান। গৃহচটকের মতো গৃহবায়সরাও যে লোপাট হয়ে যাচ্ছে শহর আর শহরতলির আবাস থেকে।
চড়াই: সত্যিই কী দিনকাল এল! শহর আছে অথচ এতকালের সঙ্গী কাক-চড়াই-শালিকপাখিরা নেই! যে-সহাবস্থানের নীতির ওপর আস্থা রেখে আমরা মানুষের সঙ্গে সহবাসী হয়েছিলাম, সেই নীতিটাই যে আজ ধ্বস্ত হচ্ছে মানুষের হাতে।
বাবুই: আমরা চিরকালই শহুরে মানুষদের থেকে দূরে দূরে থেকেছি, বাসা বেঁধেছি একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছের মাথায়। পাখা বানাতে তালপাতাই চাই মানুষের, তাই পাতা কাটতে কাটতে তড়বড়িয়ে গাছের মাথায় উঠেছে মানুষ। তবে তারা কখনওই মারমুখী হয়ে আমাদের শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবেনি। কিন্তু একালের লোকজনের মধ্যে সেই সহনশীলতাই বুঝি কমে গেছে।
দাঁড়কাক: আসলে কী জানো, আমরা মানুষের সঙ্গে থেকে তাদের যে কত উপকার করি, তার হিসেব ওরা রাখে না। আমরা কাকেরা হলাম ঝাড়ুদার পাখি। শহুরে ময়লা-আবর্জনা ঘেঁটে আমরা খুঁজে নিতাম আমাদের খাবার। কী না খাই আমরা! মরা পশুপাখি থেকে শুরু করে মানুষের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট-অবশেষ।
বাবুই: মাঝেমাঝে অন্য পাখির বাসা থেকে ডিম চুরি করে খাও সে-কথাটাও বলো। আমি তো গাছটাওয়ারে বসে সব দেখতে পাই।
দাঁড়কাক: সে-অন্যায় যে আমরা মোটেই করি না তেমনটা নয়, তবে সে-ও তো করি শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি মেটাতে। আর এখন তো এমনটা করার সুযোগই নেই। সদাচঞ্চল বায়সের দল এই তল্লাট থেকে বেমালুম উধাও হয়ে গেছে। এই দুঃখ কোথায় রাখি বলো তো!
চড়াই: ঠিক বলেছ, দাদা। আমি ভাবতাম এই হারিয়ে যাওয়ার হাহাকার বুঝি কেবল আমাদেরই সমস্যা! এখন তো দেখছি এটা বৃহত্তর খেচরসমাজেরই সমস্যা!
বাবুই: একদম তাই। আগে আমাদের বাবুইপাড়ায় খান পঞ্চাশেক তালগাছ ছিল। এখন সেই সংখ্যাটাই কমতে কমতে পনেরোটায় এসে ঠেকেছে। নতুন কিছু গাছ মাটি ফুঁড়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াচ্ছে বটে তবে তারা কতদিন টিকবে বলা মুশকিল।
দাঁড়কাক: আমাদের আশ্রয়ের অভাব একটা বড় কারণ হারিয়ে যাওয়ার পিছনে। শহরের বুকে যদি গাছ না থাকে তবে আমরা বাসা বাঁধব কোথায়? এখনকার মানুষদের বাড়িগুলোর চেহারা দেখেছ? কেমন শ্রীহীন, ইটের ওপর ইট চাপিয়ে কতগুলো বাক্সবাড়ি বানিয়েছে। অথচ আমাদের বাড়ি কখনওই তেমনটি নয়। প্রত্যেকের বাড়ির গড়নপিটন একদম আলাদা।
চড়াই: এসব কথা ওই মানুষেরা জানে না ভেবেছ? ওরা সব জানে। দুঃখের কথা কী জানো? আমাদের ওই মানুষদের কাছেই মিনতি জানাতে হবে নিজেদের সুরক্ষার জন্য। সৃষ্টিকর্তা যে সহাবস্থানের অনুশাসনে আমাদের সকলকে জুড়ে জুড়ে থাকার কথা বলেছেন। এই চিরন্তন নীতির কথাই আজ নতুন করে বোঝাতে হবে এই সময়ের মানুষজনকে।
[এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে মঞ্চে প্রবেশ করে ফিঙেপাখি। পাখিসমাজে তার পরিচয় কোতোয়াল হিসেবে। কালো ছিপছিপে চেহারায় কাটা লেজের বাহার। মাথায় একটা লাল শালুকাপড় বাঁধা]
ফিঙে: এই যে… তোমরা এখানেই জটলা পাকিয়ে রয়েছ? ভালই হয়েছে, আমাকে আর দশ দুয়ার ঘুরে ঘুরে বিপদের খবর পৌঁছে দিতে হবে না।
বাবুই (অবাক ভয়ার্ত কণ্ঠে): বিপদ?! কীসের বিপদ গো কোতোয়ালদাদা? ঝড়-টর আসছে নাকি?
ফিঙে: ঝড়ই বটে! বাবুইপাড়ার পূবদিকে যে বড় মাঠটা আছে, যেখানে চোং লাগিয়ে ঝান্ডাবাবুরা সময়ে-অসময়ে বক্তিমে করে আর আমাদের কান ঝালাপালা করে, সেই মাঠেই বিস্তর লোকজন সব জড়ো হয়েছে। এদের কাছে চোং নেই বটে তবে মুখে বুলি আছে, গান গাইছে সব গলা ছেড়ে। অবশ্য একটা বিষয় আমার বেশ অন্যরকম মনে হচ্ছে…
দাঁড়কাক: অন্যরকম মানে?
ফিঙে: দলে ছেলেছোকড়ারাই বেশি। সব পাঠশালে যাওয়া ছেলেমানুষের দঙ্গল। সঙ্গে অবশ্য পাকাচুলের বয়স্ক মানুষও রয়েছে কয়েকজন। তাদের অনেকের হাতেই কালো রঙের দোনলা এক যন্তর। বারবার সেটা চোখের সামনে ধরছে। মনে হচ্ছে কিছু যেন খুঁজছে। আমার বাপু এদের হালগতিক তেমন সুবিধের ঠেকছে না। তাই তোমাদের সাবধান করতে এলাম।
চড়াই: কোতোয়ালসাহেব, তুমি যেমন বললে যদি সত্যিই তেমন হয় তাহলে ভয়ের কিছু দেখছি না। তবে…
[এমন সময়ে স্লোগান দিতে দিতে বেশ কিছু মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। তাদের হাতে ছোট ছোট প্ল্যাকার্ড, তাতে নানা কথা লেখা। দলে কয়েকজন কচিকাঁচা ছেলেমেয়ে, এবং দুজন বয়স্ক মানুষ]
বাবুই: ওরা তো এসে পড়ল। চলো আমরা একটু আড়ালে যাই। ঠিক কী ম্যলব নিয়ে এখানে এসেছে, তা ভাল করে না-বুঝে সামনে আসা ঠিক হবে না। চলো আড়ালে চলো।
[সকলে ঝোপের আড়ালে যায়। আলো মানুষদের ওপরে পড়ে]
মহম্মদ দিলওয়ার: জোসেফ সাহেব, এদিকটা দেখছি এখনও বেশ নির্জন। বড় গাছপালাও তেমন নজরে পড়ছে না। এখানে কি হারানিধির খোঁজ পাব বলে মনে হয়?
এডুইন জোসেফ: এত সহজে হাল ছাড়লে চলবে? আমাদের বেঙ্গালুরুর পাড়া থেকে যখন ওরা হারিয়ে গেল তখন তো আমি একেবারে হন্যে হয়ে ওদের খোঁজ করেছি। তারপর হঠাৎ একদিন… আরে অর্জুন ভাইয়া! প্লিজ কাম হিয়ার…
[অর্জুন এগিয়ে আসে। জোসেফ সাহেব মাটির ওপর কতগুলো পায়ের ছাপ খুঁজে পায়। অর্জুন সিং মাটিতে বসে ছাপগুলো পরীক্ষা করে]
অর্জুন সিং (অবাক হয়ে বলে): তাজ্জব কি বাত! ইয়ে তো চিড়িয়া কা প্যায়ের কি নিশান! ইস মেঁ শায়দ গৌরৈয়া কি প্যায়ের কি নিশান ভি হ্যায়। ইস কা মতলব হাম সহি জাগা মেঁ হ্যায়।
মহম্মদ দিলওয়ার: তাহলে তো আমাদের এখানে একটু অপেক্ষা করতে হবে। নিশ্চয়ই ওরা কাছেপিঠেই কোথাও আছে। আমাদের দেখে আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে।
এডুইন জোসেফ: এমনটাই যে স্বাভাবিক। বিশ্বাসের ভিত একবার টলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনতে যে সময় লাগবে। স্নেহা, কাম হিয়ার। সিং দ্য সং ইউ হ্যাভ কম্পোজড ফর দ্য টাইনি লিটল ফ্রেন্ড। আমার মনে হয় গান শুনে ও ঠিক বাইরে আসবে।
[একটি বাচ্চা মেয়ে, নাম স্নেহা, গান শুরু করে। সকলে হাততালি দিয়ে তাল দেয়]
স্নেহা: Dear Little Sparrow.
Where have you gone?
We are in great sorrow
Please come, come, come.
We are your friends
So don’t get afraid.
We are in search for you
Please come, come, come.
[স্নেহার গান শেষ হতেই এগিয়ে আসে আরেকটি বাচ্চা মেয়ে, প্রিয়া। সে আবৃত্তি করে]
প্রিয়া: ওরে চড়াই, ছোট্ট চড়াই,
আয় না আবার ফিরে।
কিচিরমিচির কথার সুরে
দে না রে মন ভরে।
কতদিন তো হয়ে গেল
মোদের ভুলেছিস,
যতন করে রাখব তোরে
এবার দেখে নিস।
ওরে চড়াই, মিষ্টি চড়াই, আয় না কেন ফিরে…
স্নেহা: খুব সুন্দর হয়েছে কবিতাটা। অ্যান্ড ভেরি নাইসলি রিসাইটেড। এবার নিশ্চয়ই ছোট্ট চিমনি বাইরে বেরিয়ে আসবে। চিমনি যেখানেই থাকো সব অভিমান ভুলে বাইরে এসো। দেখো কত মানুষ তোমারই পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে।
প্রিয়া: আচ্ছা স্নেহা, মহারাষ্ট্রে চড়াইকে বুঝি চিমনি বলে ডাকে? খুব সুন্দর নাম তো— চিমনি। চিমনিইই… আয় ফিরে আয়।
এডুইন জোসেফ: কন্নড় ভাষায় স্প্যারো ইজ কলড গুন্নাড্ডি, তামিল ভাষায় চড়াই হল চিটুক কুরুভি, অন্ধ্র আর তেলেঙ্গানায় পিচ্চুকা।
প্রিয়া: বাপ রে বাপ! ওই পুচকে পাখির এত নাম! আমার তো বাপু মাত্র দুটো নাম। ডাকনাম প্রিয়া, আর সেটাই একটু বড় করে প্রিয়দর্শিনী— আমার স্কুলের নাম।
স্নেহা: আমার তো একটাই নাম। অথচ চিমনির কত্ত নাম! চিমনি বাহের আ। আমহী তুমহালা শোধত আহোত।
মহম্মদ দিলওয়ার: চাকালি বাহার আভো। চিরি বাহার আ।
অর্জুন সিং: অব তো গুজরাতি অউর পাঞ্জাবি মেঁ ভি পুকারনে লাগা! আও বাচ্চা আও। নিকল আও।
[সবাই গোল হয়ে ঘুরতে থাকে বাইরের দিকে মুখ করে। সকলেই চড়াইপাখিকে খুঁজতে থাকে। এদিকে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাখিরা নিজেদের মধ্যে নতুন করে কথা শুরু করে। মানুষদের ওপর থেকে আলো ফেড হয়। পাখিদের ওপর আলো জ্বলে ওঠে]
দাঁড়কাক: কী ভাগ্য করেই না এসেছ চড়াইভাই! তোমাকে নিয়ে গান হচ্ছে, ছড়া বাঁধা হয়েছে, কত শত নামে ডাকাডাকি করছে! সত্যি বলছি, তোমাকে দেখে বড্ড হিংসে হচ্ছে।
বাবুই: হিংসে করব কেন? আমার তো বেশ ভালই লাগছে। আমাদের এক বন্ধুকে নিয়ে মানুষজন আবার নতুন করে উতলা হচ্ছে, এটা তো খুবই আনন্দের কথা। তুমি কী বলো কোতোয়ালদাদা?
ফিঙে: তোমার কথায় যুক্তি আছে। আমি তো এত লোক চরিয়ে খাই, তাই মানুষ দেখলেই আমি তাদের মতলব দিব্বি টের পাই। এই মানুষেরা খারাপ নয়। এরা আমাদের চড়াইভাইকে ফিরিয়ে আনতেই চাইছে মনেপ্রাণে। এই মানুষেরা ওই চোং-ফোঁকা লোকেদের মতো নয়। চড়াইভাই, তুমি যাও! ওদের দেখা দাও।
চড়াই (একটু দ্বিধা ভরে): যাব? বলছ তোমরা?
বাবুই: হ্যাঁ যাও, নির্ভয়ে যাও। এদের থেকে বিপদের শঙ্কা নেই।
চড়াই: তোমরাও এসো না আমার সঙ্গে। একা যেতে আমার একটু ভয় আর সঙ্কোচ হচ্ছে।
ফিঙে: আমরা তোমার ওপর কড়া নজর রাখছি। একটু বেগড়বাই দেখলেই আমরা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। কী বলো তোমরা?
দাঁড়কাক: হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরাও তৈরি।
[এমন সময়ে ঝোপটা একটু নড়ে ওঠে। মানুষেরা— আলো এখন তাদের ওপর ফিরে এসেছে— এই নড়াচড়া দেখে খুব শান্ত হয়ে যায়। গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার আর ক্যামেরা তাক করে তৈরি হয়ে থাকে নতুন কিছু দেখার আশায়। ছোট্ট চড়াই খুব সন্তর্পণে থপ থপ করে লাফাতে-লাফাতে বাইরে আসে। সবাই হইহই করে ওঠে। ক্যামেরার আলোর ঝলকানিতে ভরে ওঠে মঞ্চ]
এডুইন জোসেফ: উই হ্যাভ গট ইট। ডিয়ার গুব্বাচ্চি— উই অল ওয়েলকাম ইউ। ভয় পেও না। আমরা তোমার কোনও ক্ষতি হতে দেব না।
প্রিয়া: ওরে আমার চড়াই! আর কি তোকে হারাই!
স্নেহা: অরে প্রিয় চিমনি! তু শেবটি আলাস!
অর্জুন সিং: গৌরৈয়া! তু অকেলি হ্যায় কেয়া?
চড়াই: হ্যাঁ, আ-আমি একলা। না… না-না, আমার বন্ধুরাও আছে।
মহম্মদ দিলওয়ার: ওদেরও ডাকো। ভয়ের কিছু নেই। তোমাদের দেখতেই তো আমরা দূরদূরান্ত থেকে এসেছি।
চড়াই: ডা-ক-ব? ও কোতোয়ালদাদা, দাঁড়কাকদাদা, বাবুইভাই… তোমরা বাইরে এসো। কোনও ভয় নেই। এরা সব ভাল মানুষ।
[ঝোপের আড়াল থেকে একে একে বাইরে বেরিয়ে আসে বাবুই, দাঁড়কাক, ফিঙে। প্রত্যেকের চলার ভঙ্গি আলাদা]
স্নেহা: ওয়াও! এ যে একেবারে ত্রি মাস্কেটিয়ার্স! জোসেফ আঙ্কল, প্লিজ টেক এ শট।
[ক্যামেরা ঝলসে ওঠে]
প্রিয়া: তোমার বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবে না চড়াই?
চড়াই: কেন দেব না? এই হচ্ছে দাঁড়কাকদাদা। খুব বুদ্ধিমান পাখি। শহুরে নোংরা আবর্জনা সাফ করে এরা যে মানুষের অনেক উপকার করে। অথচ এখন আমাদের মতো এরাও হারিয়ে যাচ্ছে। ভাবতে পারো, শহর আছে কাক নেই! এই যে ছিপছিপে কালো সামলা এঁটে থাকা দাদাকে দেখছ, এর নাম ফিঙে। বন্ধুদের বাঁচাতে সদা নজরদারি করে চলে। আমরা ডাকি কোতোয়াল বলে। অন্যান্য পাখিদের ডাক নকল করে আমাদের জলসার আসর মাতিয়ে দেয় কোতোয়ালদাদা। এ হল হরবোলা কোতোয়াল। আর এই যে আমার মতো গোলগাল ছয়ছোট্ট চেহারার বন্ধুটিকে দেখছ, এ হল বাবুই। পাখিদের মধ্যে সেরা স্থপতিদের একজন।
স্নেহা: বা! কী সুন্দর করে সব বললে তুমি। এবার আমাদের কথা তোমাদের বলি? আমি স্নেহা, থাকি পুনে শহরে। এই হল প্রিয়া— থাকে কলকাতায়। আর এই যে তিনজন জোয়ান বন্ধুদের দেখছ, এঁরা হলেন চড়াই বাঁচানোর আন্দোলনের তিন স্তম্ভ। এডুইন জোসেফ— দ্য স্প্যারোম্যান অফ বেঙ্গালুরু। ইনি অর্জুন আঙ্কল— অর্জুন সিং, স্প্যারোম্যান অফ বিহার। আর ইনি হচ্ছেন মহম্মদ দিলওয়ার আঙ্কল— নাসিকের মানুষ, প্রকৃতিকে রক্ষা করার যে-কোনও আন্দোলনে পা বাড়ান সবার আগে।
বাবুই (খুব অবাক হয়ে): বাপ রে বাপ! এমন সব গুণী মানুষজন আমাদের নিয়ে ভাবছেন! তাহলে তো আমাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা খানিকটা বাড়ল বলেই মনে হয়।
ফিঙে: মানুষেরা যদি নিজেদের ভুলগুলোকে খানিকটা শুধরে নেয় তাহলে তো সবসময়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয় নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হয় না!
এডুইন জোসেফ: এই কথাটাই খুব বড় কথা, ভাবনার কথা। মানুষ আর প্রাণীদের সম্পর্কের মধ্যে যদি ভয় আর অবিশ্বাসের পাঁচিল মাথা তুলে দাঁড়ায় তাহলে উভয়ের অস্তিত্বই যে বিপন্ন হবে। আমাদের সুস্থ, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাটা যে একান্তভাবেই সহাবস্থানের নীতির ওপর নির্ভরশীল। আমরা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রভাবে প্রকৃতি পরিমণ্ডলের ভারসাম্য আজ বিপর্যস্ত। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ সর্বত্রই আজ বিপন্নতার হাহাকার। এই অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। চড়াই তো একটা উপলক্ষ। সকলের জন্যই আজ রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করতে হবে।
চড়াই: খুব প্রয়োজনের কথাগুলি কী সুন্দর করে তুমি বুঝিয়ে দিলে! একদল মানুষের কৃতকর্মের ফলে একদিন আমরা ভিটেছাড়া হয়েছিলাম। আর আজ আরও একদল মানুষের হাত ধরেই আমরা ফিরে আসব আমাদের চেনা আস্তানায় নিশ্চিন্তে নিরাপদে থাকব বলে। ওহ… আজ আমার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। ঠাম্মি, তুমি শুনতে পাচ্ছ? আমরা আবার ফিরে আসছি আমাদের চেনা আস্তানায়!
স্নেহা: আজ নতুন বন্ধুদের পেয়ে আমারও খুব খুব আনন্দ হচ্ছে। প্রিয়া একটা গান ধর। আমরা সবাই গলা মেলাব একসঙ্গে। কি রাজি তো?
দাঁড়কাক: এ আবার জিজ্ঞেস করছ! আমরা সবাই রাজি। নাও, শুরু করো। মধুরেণ সমাপয়েৎ হোক।
[প্রিয়া গলাটা ঝেড়ে নিয়ে গান শুরু করে। সবাই হাততালি দিয়ে তাল ধরে]
প্রিয়া: আয় না চড়াই একসাথে গাই,
নতুন সুরের গান,
অনেক খুঁজে পেলাম তোরে
উঠল ভরে প্রাণ।
একসাথে আজ গাইবে সবাই
মনের আনন্দে।
কাক, চড়াই ফিঙে, বাবুই
নাচি নতুন ছন্দে।
ধরার এই ঘরখানিতে
আমরা আবাসিক।
একসাথেতে রইব সবাই
নিয়ম মেনে ঠিকঠিক।
একসাথে সব থাকলে পরে
আনন্দ যে অপার,
পাখপাখালির গানেই ভরুক
আমাদের সংসার।
[গানের রেশ চলতে থাকে। প্রিয়া মঞ্চের সামনে এগিয়ে আসে। দর্শকদের আহ্বান জানায় গলা মেলাবার জন্য। দর্শকরাও হাততালি দিয়ে গাইতে থাকে। মঞ্চের পর্দা নেমে আসে]
*২০ মার্চ বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় বিশ্ব চড়াই দিবস। একসময় আমাদের একান্ত পরিচিত পরিবেশ মুখরিত থাকত ছোট্ট এই পাখির কিচিরমিচির শব্দে। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে পরিবেশ পরিস্থিতি এতটাই বদলে ফেলেছি আমরা যে সেই অতি পরিচিত চড়াইয়ের দলেরা পাড়ি দিয়েছে কোনও অজানা ঠিকানায়। আয় ফিরে আয় নাটক সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের আবার ফিরে আসার আহ্বান জানায়।
খুব ভালো লাগলো লেখাটি। একদম ইউনিক! মঞ্চস্থ হলে দারুণ হবে ব্যাপারটা। 👌