দেবাশিস্ ভট্টাচার্য
বিজ্ঞান তথা যাবতীয় গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে এবং বিচিত্র আইনকানুনের জালে জড়িয়ে তাকে বিকলাঙ্গ করে তোলা হবে, বিজ্ঞান-গবেষণাকে আটকে ফেলা হবে বাণিজ্যিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে, মুক্তচিন্তা অনুসন্ধিৎসা জ্ঞানচর্চাকে প্রতিহত করা হবে, সরকারি শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলো বেচে দেওয়া হবে, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তোলা হবে পৌরাণিক মিথ্যা-নির্ভর ও অন্তঃসারশূন্য। এবং, এই ধ্বংসলীলাকে আড়াল করার জন্য লাগবে চন্দ্রবিজয়ের মতো দু-একটি বড়সড় গণমাধ্যম-বান্ধব সাফল্য, যে সাফল্য হিন্দুরাষ্ট্রের যাথার্থ্য ও হিন্দুবীরের শৌর্যকে নস্যাৎ করবে না, বরং তাকে এনে দেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইজ্জত
ভারতীয় মহাকাশযান চাঁদে নেমেছে, দেশ উত্তাল, সে তো হওয়ারই কথা বটে! পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশীয় দূরত্ব অতিক্রম করে উপগ্রহের মাটিতে সফলভাবে স্বয়ংক্রিয় যান নামানো, যা নাকি আবার চান্দ্র-উপরিতলের গর্ত ও বাধা এড়িয়ে নিজে নিজেই বহুদূর অতিক্রম করবে, অসংখ্য মহামূল্যবান ছবি তুলে পাঠাবে, নানা জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে, এবং তার ফলাফল ফেরত পাঠাতে থাকবে আমাদের কাছে— আমাদের মতো একটি দরিদ্র দেশের পক্ষে অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত এসব ছিল স্বপ্নেরও অতীত। আর তার ওপর, এইসব করা গেছে দেশে তৈরি প্রযুক্তিতে, এবং অনেক কম খরচেও। এর আগে আর মাত্র তিনটে দেশ এইটা পেরেছিল— আমেরিকা, রাশিয়া আর চিন, তাও এর চেয়ে বহু বহু বেশি খরচাপাতি করে। ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সি তাদের জিনিস চাঁদে নামাতে পেরেছিল, কিন্তু ‘সফট ল্যান্ডিং’ পারেনি। এরা সকলেই অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। তার মধ্যে রাশিয়া আবার ঠিক এই সময়েই আরেকবার একই চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা ভেঙে পড়েছে, যদিও ভারত সফল হয়েছে। সাফল্য, অতএব, কম নয় মোটেই!
কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, আমাদের মতো গরিব দেশের কাছে তো মহাকাশ-গবেষণা এক শ্বেতহস্তী পোষার মতো ব্যাপার— কী হবে এই শ্বেতহস্তী পুষে, দেশ যেখানে জর্জরিত দারিদ্র্যে, বেকারিত্বে, অসাম্যে, অশিক্ষায়, ধর্মান্ধতায়? এ প্রশ্নে অনেক সংবেদনশীলতা থাকলেও, কাণ্ডজ্ঞান থাকে না সব সময়ে। এইসব সমস্যা যতদিন না দূর হবে ততদিন বিজ্ঞান দর্শন শিল্প সাহিত্য এইসব থামিয়ে রাখা উচিত তো নয়ই, এবং সম্ভবও নয়, চাইলেও পারা যাবে না। আর, এইসবের অনুশীলন যদি বন্ধ হয়ে যায়, সমাজের অন্যায় অযুক্তি অক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াইটাই বা হবে কী দিয়ে? কাজেই, দেশে প্রবল সমস্যা থাকলেই জ্ঞানের দুয়ার বন্ধ করতে হবে, কথাটা বোধহয় ঠিক সে-রকম না। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও স্বপ্নদ্রষ্টা জে ডি বার্নাল একদা বলেছিলেন, বৃক্ষের যেমন মুকুল, সমাজের তেমনি গবেষণা। সব মুকুল ছেঁটে দিলে গাছ বেঁচে থাকবে কিন্তু তার বাড়বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি, গবেষণা বন্ধ করে দিলে সমাজ টিকে থাকবে, কিন্তু তা হয়ে দাঁড়াবে স্থবির, শিলীভূত।
এবং তবুও, মানুষের অন্য সবকিছুর মতোই, বিজ্ঞান গবেষণার পেছনে কিছু মোদ্দা নৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি তো থাকতেই হয়, না থাকলেই চলে না। সে নিয়েও দু-চার মন্তব্য করাটা খুব জরুরি এখানে। কিন্তু তার আগে একটা জিনিস একটু ছোট্ট করে ভেবে দেখা দরকার। ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘প্রযুক্তি’, যে দুটো আলাদা কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত জিনিসকে আজকে আমরা মোটা কথায় একসঙ্গে ‘বিজ্ঞান’ বলে থাকি, সে তো আর আকাশ থেকে পড়ে না, এবং কিছু প্রাজ্ঞ মানুষের আকাঙ্ক্ষা আর সদিচ্ছা থেকে আপনা-আপনি গজিয়েও ওঠে না। তার জন্য বড় বড় ঘরদোর লাগে, নানা বিচিত্র ও দামি যন্ত্রপাতি ও উপকরণ লাগে, নামীদামি পত্রিকা ও বইপত্তর লাগে, উচ্চশিক্ষিত মেধাবী লোকবল লাগে। আবার, এইসব জোটাতে গেলে অনেক অনেক টাকা লাগে, সামাজিক রাজনৈতিক প্রশাসনিক সমর্থন লাগে, এবং বিজ্ঞান গবেষণার উপযোগিতা ও নৈতিকতার প্রসঙ্গ এর থেকে খুব দূরে নয়। তো তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কোথা থেকে কীভাবে আসে এইসব সমর্থন? এবং, এইসবের ওপরে বিজ্ঞানের ভালমন্দ ঠিক কীভাবে কতটা নির্ভর করে? এই বিষয়টা সামান্য একটু ঝালিয়ে নিয়েই ফিরব চন্দ্রযানের প্রসঙ্গে।
বিজ্ঞান গবেষণায় একটা খুব জানা কথা এইটা যে, এই জিনিসটার প্রায় সবটাই হয় অল্প কয়েকটি মাত্র ধনী দেশে, এবং বাকি যাবতীয় দেশে যৎসামান্য। কেন? উত্তরটা একদমই সোজা। গবেষণাতে টাকা লাগে, এবং যাদের তা আছে তারা পারে, বাকিরা পারে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের মতো একটা গরিব দেশ তবে এতবড় একটা ব্যাপার করে উঠতে পারল কীভাবে? সেটা বলছি, কিন্তু তার আগে একটু বলে নিই, ভারত ঠিক কতটা গরিব এবং পিছিয়ে থাকা দেশ। এইসব ব্যাপার মাপবার নানা মাপকাঠি বেরিয়েছে আজকাল, এবং তার হালচাল সংক্রান্ত তথ্যাবলি অন্তর্জালে বেশ সুলভ। কাজেই, এখানে যা যা বলব সে সব সকলে খুব সহজেই নিজে নিজে যাচিয়ে নিতে পারবেন।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সবচেয়ে পরিচিত যে মাপকাঠি, সেই মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখে ভারতের স্থান একশো চল্লিশতম, প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিতের শতাংশের নিরিখে একশো উনষাট, রোজগেরে কর্মক্ষমদের নিরিখে পঞ্চাশ, চরমভাবে দরিদ্র নয় এমন জনসংখ্যার শতাংশের নিরিখে একশো বারো, ক্ষুধিত জনসংখ্যার মাপকাঠিতে একশো সাত (পাকিস্তান নেপাল বাংলাদেশের পেছনে), রোজগারের অসাম্যের নিরিখে পঁচাত্তর, মানবোন্নয়ন সূচকে একশো বত্রিশ। অর্থাৎ, সবক্ষেত্রেই একেবারে তলানিতে।
তো, এই যদি সামগ্রিক দশা হয়, তাহলে বিজ্ঞানের অবস্থাও খুব একটা ভাল হওয়ার কথা না, এবং তা নয়ও। জাতীয় আয়ের কত শতাংশ বিজ্ঞানের গবেষণায় খরচ করা হচ্ছে সেটা বিজ্ঞানের অবস্থা বোঝবার পক্ষে একটা ভাল মাপকাঠি বলে ধরা হয়, তাতে ভারতের স্থান আটান্নতম। প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যাপিছু প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র আরেকটি পরিচিত মাপকাঠি, এবং তাতে ভারতের স্থান বিরাশিতম। এই যে এখুনি বললাম, জাতীয় আয়ের যে শতাংশ আমরা গবেষণায় খরচ করি সেটা খুব ভাল নয়, এ ব্যাপারে অল্প করে আরেকটু বিস্তারে যাওয়া যায়। উন্নত দেশগুলো গবেষণা খাতে মোটামুটিভাবে জাতীয় আয়ের দুই থেকে চার শতাংশ খরচা করে। একটা সুস্থ সবল অর্থনীতিতে গবেষণার জন্য কত ব্যয় করা উচিত, মোটা দাগে তার নিয়ম ওটাই— যাকে ইংরেজিতে বলে ‘রুল অফ থাম্ব’। যারা বিজ্ঞানকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়, সেইরকম অল্প কয়েকটা দেশ ওর চেয়েও বেশি খরচ করে। যেমন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো সাড়ে চার, দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় পাঁচ, ইজরায়েল প্রায় ছয়— এইরকম। যাঁরা এই বিষয়টি নিয়ে কখনও চর্চা করেননি তাঁরা জানলে হয়তো খুবই অবাক হবেন যে, ওই খাতে ভারতের খরচের মাপটা হচ্ছে দশমিক সাত শতাংশ। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, ০.৭%! এই তালিকায় সলজ্জ আটান্নতম স্থানটি, বলা বাহুল্য, সেই কারণেই। নোবেল প্রাপকদের তালিকায় কেন আমাদের বিজ্ঞানীদের নাম থাকে না, এবং যদি বা থাকে তো কেনই বা সেটা সাধারণত অন্য দেশের নাগরিক হিসেবে, সেটা এ থেকে বোঝা যায়। তাহলে, এই প্রেক্ষিতটা একটু মাথায় রেখে আমরা এবার ওপরের প্রশ্নে ফিরে আসি।
অবস্থা যদি এতই খারাপ, তো তাহলে আমরা এই অসাধ্য সাধন করতে আদৌ পারলাম কীভাবে? তার উত্তরটা হচ্ছে, উপরোক্ত যাবতীয় দুর্দশা সত্ত্বেও, আমাদের অর্থনীতির আয়তনটা বেশ বড়সড়। বড় দেশ, বিপুল জনসংখ্যা, অতএব তাদের মোট বাৎসরিক আয়ের যোগফলটাও বড়সড় হবে, এই আর কি। ফলত, তার থেকে সামান্য একটা অংশ সরিয়ে রাখলেও মোট অঙ্কের হিসেবে সেটা বেশ খানিকটা টাকা হবে। এখন, একটা বিশেষ গবেষণার জন্য বিশেষ একটা পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করলেই চলে, জনগণ কেমন রোজগার করতে পারছে বা দুবেলা খেতে পরতে পাচ্ছে কিনা সে সব তো আর দেখার দরকার পড়ে না। ভারতের ক্ষেত্রে বর্তমানে এই পরিমাণটি প্রায় পঁয়ষট্টি বিলিয়ন ডলার। জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে এই অঙ্কটা যৎসামান্য (০.৭) হলেও, টাকার মোট অঙ্কে কিন্তু মোটেই তা নয়। ফলত, জাতীয় আয়ের শতাংশ হিসেবে এ বরাদ্দ সারা বিশ্বে আটান্নতম স্থানে থাকলেও, গবেষণা-ব্যয়ের মোট অঙ্ক হিসেবে বিশ্বে সাত নম্বর, ব্রিটেন সহ বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশকে পেছনে ফেলে। তার মানে হচ্ছে, জাতীয় আয় একটুও না বাড়িয়েই ভারত যদি আজ গবেষণায় ইজরায়েলের মতো ছয় শতাংশ ব্যয় করতে থাকে, তাহলে মোট গবেষণা-বরাদ্দের নিরিখে আমরা ঝট করে তালিকার অনেক ওপরের দিকে উঠে আমেরিকার পরেই ঠিক দ্বিতীয় স্থানে পৌঁছে যাব, চিনকে সরিয়ে। এবং ঠিক ওই একই কারণে, প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যাপিছু গবেষণাপত্র প্রকাশে আমরা বিরাশিতম স্থানে থাকলেও (ওপরে বলেছি), মোট গবেষণাপত্রের সংখ্যায় কিন্তু আমরা চতুর্থ— চিন আমেরিকা আর ব্রিটেনের পরেই। গবেষক প্রযুক্তিবিদ চিকিৎসক এইসবের সংখ্যা যদি হিসেব করি, তাহলেও মোদ্দা ব্যাপারটা ঠিক ওইরকমই দাঁড়াবে। এমনকি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্কীর্ণ পরিসর ছাড়িয়ে আমাদের সমগ্র অর্থনীতির দিকে তাকালেও ওই একই মোদ্দা নকশা দেখা যাবে। মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখে ভারতের স্থান একশো চল্লিশতম (ওপরে বলেছি) হলেও, বিলিওনেয়ারদের সংখ্যায় তৃতীয়, আমেরিকা ও চিনের পরেই।
তাহলে, এখন পর্যন্ত যা দেখলাম, সে সব থেকে আমরা কী বুঝব? আপাতত যা বুঝব, তা কিঞ্চিৎ ভীতিপ্রদ হলেও, খুব বেশি অজানা নয়। সহজ কথাটা এই যে, জাতীয় অর্থনীতি থেকে যথেষ্ট টাকা বিজ্ঞানের জন্য সরিয়ে রাখলেই গবেষণায় খানিকটা সাফল্য সম্ভব, দেশ সমাজ জনগণের দশা যা-ই হোক না কেন। বহু সংখ্যক মানুষ যদি দারিদ্র্য রোগভোগ বেকারিত্ব অশিক্ষা অন্ধত্বে ডুবে থাকে, তাতে সমস্যা নেই। তা সত্ত্বেও চন্দ্রবিজয় হতে পারে, হাইড্রোজেন বোমা হতে পারে, সেগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চমৎকার সব ক্ষেপণাস্ত্রও হতে পারে। ওপরতলার লোকজন যাতে স্বচ্ছন্দে ও নিরাপদে থাকে, যাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ঠিকঠাক টক্কর দেওয়া যায়, এবং যাতে দেশের জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়— এটুকুর জন্য যতটা বিজ্ঞান-টিজ্ঞান লাগে ঠিক ততটুকুই হবে, তার চেয়ে বেশি নয়— এটাও ক্ষমতাসীন সরকারের বাস্তব নীতি হতেই পারে। এতে নৈতিক সমস্যা তো আছেই। কিন্তু শাসকরা যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন যে নৈতিকতা বস্তুটিকে একদমই পাত্তা দেবেন না, কিম্বা তাঁরা ন্যায়-অন্যায় সংক্রান্ত ভিন্ন কোনও এক সংজ্ঞায় বিশ্বাসী হন, তাহলেই সমস্যা মিটে গেল— গণতন্ত্র মানবাধিকার যুক্তিবাদ এইসব রইল না গেল তাতে কিছু যায় আসে না।
কথাটা ভয়ের কথা তো বটেই, কিন্তু আরও অনেক বেশি ভয়ের হতে পারত, যদি ব্যাপারটা আসলে ঠিক অতটাই সোজাসরল হত। সুখের বিষয় বলে মনে করুন বা দুঃখের, কথাটা আসলে কিন্তু ঠিক অতটা সোজা নয়, এর মধ্যে বেশ একটু জটিলতা আছে। যেমন ধরুন, প্রথমত, মাথাপিছু আয় খুব নিচু হলে অর্থনীতিতে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা হয়, তখন মোটা দাগের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সামলাতেই জাতীয় আয়ের এক বড় অংশ বেরিয়ে যায়, এবং গবেষণার জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ করাটা প্রায় বিলাসিতার জায়গায় চলে যায়। গরিব দেশগুলো যে জাতীয় আয়ের খুব অল্প এক ভগ্নাংশ মাত্র গবেষণায় ব্যয় করতে পারে, তার কারণ মূলত এটাই। সেই কারণে, ভারত মোট জাতীয় আয়ে প্রথম সারিতে থাকলেও, শতাংশের হিসেবে বিজ্ঞান-বরাদ্দের নিরিখে দরিদ্রতম দেশগুলোর সঙ্গে একাসনে আসীন। দ্বিতীয়ত, উচ্চশিক্ষায় মাথাপিছু ব্যয় কম হলে ভাল গবেষণার জন্য একান্ত জরুরি উচ্চমানের মানবসম্পদ তৈরি হয় না, ফলে গবেষণার মানও মোটেই ভাল হয় না। আমাদের দেশ থেকে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির সংখ্যা যে যৎসামান্য, তার কারণটা হয়তো-বা এটাই। তৃতীয়ত, এই ধরনের অর্থনীতিতে বেসরকারি সংস্থারাও গবেষণায় বেশি খরচ করে না, ফলে বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযোগী প্রাযুক্তিক উদ্ভাবনও অনেক কম হয়, ফলে সফল ‘পেটেন্ট’-ও অনেক কম। আবার তারই উল্টো প্রভাবে, উচ্চমানের প্রাযুক্তিক উদ্ভাবনের অভাবে অর্থনীতিরও সেভাবে বৃদ্ধি ঘটে না। আমাদের দেশ কেন এখনও মাইক্রোচিপ বানাতে পারে না, এবং কেনই বা এত বড় একটা অর্থনীতি প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন-সূচকে সারা পৃথিবীতে চল্লিশতম, তার উত্তর বোধহয় এর মধ্যে আছে। চতুর্থত, রাষ্ট্রে যারা ক্ষমতাসীন তারা যদি ভাবে যে, ওপরতলার লোকজনকে স্বচ্ছন্দে ও নিরাপদে রাখা, প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ঠিকঠাক টক্কর দেওয়া, এবং দেশের জনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা— এটুকুর জন্য যতটা বিজ্ঞান-টিজ্ঞান লাগে ঠিক ততটুকুরই ব্যবস্থা হবে, তার চেয়ে বেশি হওয়াটা ভাল নয়— তাহলে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটাবার ব্যাপারে তাদের আগ্রহটাও খুব সীমিত হবে। পঞ্চমত, ‘গবেষণা’ ব্যাপারটার মানে হল নতুন জ্ঞানের খোঁজ, এবং তার জন্য পুরনো জ্ঞান পুরনো বিশ্বাস পুরনো ধ্যানধারণাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে যাওয়া। এখন, ক্ষমতাসীন শাসক যদি মনে করে যে এই প্রশ্ন করার মনোভাব বা সংস্কৃতিটা তার অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক, তাহলে তারা মুক্ত অবাধ জ্ঞান ও যুক্তির চর্চাকে খুব বেশি বাড়তে দেবে না। সেটাও বিজ্ঞানের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর। এই বিষয়টা নিয়ে আলাদা করে দু-এক কথা বলা যাক।
সাধারণ বিজ্ঞানশিক্ষার (এবং অন্য যে কোনও শিক্ষার) সঙ্গে গবেষণার মৌলিক তফাতটা হচ্ছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যা জানা আছে সেটা যদ্দুর সম্ভব হুবহু আয়ত্ত করে নিতে হয়, আর গবেষণার ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যা জানা ছিল না সেইটা জানতে এবং জানাতে হয়। যা জানা আছে তা যতই মোক্ষম হোক, শুধু তার পুনরাবৃত্তি করলে হবে না, তা নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে এবং তাতে কিছু যোগ করতে হবে— তবেই একজন গবেষকের প্রবন্ধ প্রকাশের ছাড়পত্র পাবে, নইলে নয়। এই ব্যাপারটা টানা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রথমেই যা দরকার সেটা হচ্ছে, কী কী জানা নেই অথচ জানা দরকার ছিল— সেই বিষয়ে একটা যথাযথ অভাববোধ। এই অভাববোধটা আসে একটা সুসংবদ্ধ সংশয় ও প্রশ্নশীলতা থেকে। আমি যা ঠিক বলে জেনে এসেছি, সেটা ঠিক তো? কোন অর্থে, কতদূর পর্যন্ত ঠিক? তার অর্থ সবটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে তো? তার মধ্যে কোনও লুকিয়ে থাকা অন্তর্বিরোধ নেই তো? আমার জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেটা মেলে তো? অমুক অমুক ক্ষেত্রে তো মেলে বলে দেখেছি, কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে সেটাকে পরীক্ষা করে দেখা যায় কি? বিজ্ঞান এগোয় কঠোর যুক্তি সহকারে ক্রমাগত এই প্রশ্নগুলোর মোকাবিলা করতে করতে, এই প্রক্রিয়া ছাড়া ‘বিজ্ঞান’ জিনিসটা টেকে না। আর, এই প্রক্রিয়াটাকে ঠিকঠাক চালু রাখতে একটা বিশেষ ধরনের সংস্কৃতি লাগে। অর্থপূর্ণ প্রশ্ন কাকে বলে সেই বোধ তৈরির সংস্কৃতি, প্রশ্নের অধিকারকে মর্যাদা দেওয়ার সংস্কৃতি, যুক্তির শৃঙ্খলা আয়ত্ত করবার সংস্কৃতি, স্বাধীন বিচারক্ষমতা নির্মাণের সংস্কৃতি, তর্ক ও মতপ্রকাশের অধিকারকে স্বীকার করার সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সত্যের তফাত বিষয়ে সচেতন থাকার সংস্কৃতি, সত্যের স্বরূপ ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারার সংস্কৃতি, অযুক্তি ও মিথ্যাকে ঘৃণা করতে শেখবার সংস্কৃতি। বলা বাহুল্য, এ সংস্কৃতি আমরা জন্মসূত্রে পাই না, তা হাজার বছরের প্রক্রিয়ায় নির্মিত হয়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান, যা নাকি বিজ্ঞানের সঙ্গে এক অমোঘ ঐতিহাসিক ও দার্শনিক সম্পর্কে আবদ্ধ। এ সংস্কৃতি যেমন আধুনিক বিজ্ঞানকে সম্ভব করে তোলে, তেমনি আবার উল্টোভাবে, বিজ্ঞানের বড়সড় সাফল্যগুলোও একে পুষ্ট ও পোক্ত করে। কিন্তু, বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে এখন এ সংস্কৃতি নির্মিত হচ্ছে না, বরং তার ঠিক উল্টোটা ঘটছে— প্রবল উদ্যোগে রচিত হচ্ছে সন্দেহ কুসংস্কার অযুক্তি অন্ধত্ব ঘৃণা হিংস্রতার বাতাবরণ। বিজ্ঞানের স্থান কোথায়, সেখানে?
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারি ও বেসরকারি উভয় তরফে প্রবল ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও, আমাদের এই চন্দ্রবিজয় আসলে ঘটেছে আমাদের অর্থনীতি রাজনীতি সংস্কৃতির পোক্ত ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে নয়, বরং এক প্রবল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। ওপরে যে প্রান্তিক বিজ্ঞান-বরাদ্দের (০.৭ শতাংশ) কথা বলেছি, সেটা কিন্তু আকস্মিক নয়, ধারাবাহিক। বর্তমান সরকারের আমলে এ-বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। আগে থেকেই তা ছিল যৎসামান্য, বর্তমান সরকার অতি নিষ্ঠার সঙ্গে যৎসামান্যতর করে তুলছে তাকে ক্রমশই। দশমিক নয় থেকে দশমিক সাত, দশমিক সাত থেকে দশমিক ছয়। তার ওপরে যুক্তিবিরোধী গণতন্ত্র-বিরোধী ঘৃণা ও হিংসাভিত্তিক রাজনীতি, এবং তার ওপরে আবার পৌরাণিক মিথ্যাভিত্তিক এক পশ্চাৎমুখী সংস্কৃতি নির্মাণের সুসংগঠিত কার্যক্রম।
এবার বরং তবে ফেরা যাক সেই গোড়ার প্রশ্নে। এইরকম এক ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক বাতাবরণের মধ্যে দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিজয়ের মতো এক বৃহৎ সাফল্য আদৌ হতে পারল কীভাবে? তার একটা আংশিক উত্তর ওপরে আছে— আমাদের অর্থনীতির বৃহদায়তনের কারণে— কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর কারণগুলো আজ আর খুব অস্পষ্ট নয়।
ক্রমশ বিজ্ঞান তথা যাবতীয় গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে এবং বিচিত্র আইনকানুনের জালে জড়িয়ে তাকে বিকলাঙ্গ করে তোলা হবে, বিজ্ঞান-গবেষণাকে আটকে ফেলা হবে বাণিজ্যিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের সঙ্কীর্ণ গণ্ডির মধ্যে, মুক্তচিন্তা অনুসন্ধিৎসা জ্ঞানচর্চাকে প্রতিহত করা হবে, সরকারি শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিষ্ঠানগুলো বেচে দেওয়া হবে, গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে করে তোলা হবে পৌরাণিক মিথ্যা-নির্ভর ও অন্তঃসারশূন্য। এবং, এই ধ্বংসলীলাকে আড়াল করার জন্য লাগবে চন্দ্রবিজয়ের মতো দু-একটি বড়সড় গণমাধ্যম-বান্ধব সাফল্য, যে সাফল্য হিন্দুরাষ্ট্রের যাথার্থ্য ও হিন্দুবীরের শৌর্যকে নস্যাৎ করবে না, বরং তাকে এনে দেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইজ্জত।
অতএব, চন্দ্রবিজয় দিয়ে হিন্দু-শৌর্য প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না স্বনামধন্য ইসরো-কর্তা শ্রীধর পানিকর সোমনাথ সায়েব। তিনি চন্দ্রবিজয় অভিযানের সাফল্য কামনায় ঢাকঢোল পিটিয়ে পুজো দিয়েছেন সোৎসাহে, এবং তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে এর কোনও বিরোধ তিনি আদৌ দেখেন না, কারণ, তিনি নাকি বিজ্ঞানচর্চা করেন বাইরের জগৎকে জানার জন্যে, আর মন্দিরে পুজো দেন অন্তর্জগৎকে জানার জন্যে। নিতান্ত বাজে যুক্তি, সন্দেহ নেই। অন্তর্জগৎকে জানার জন্য শিল্প সাহিত্য সমাজবিজ্ঞান মনোবিজ্ঞান এইসবের চর্চা করতে পারেন, মন্দিরে পুজো দিতে যাবেন কোন দুঃখে? মন্দির কী দিতে পারে আমাদেরকে, শুধু অজ্ঞতা ও আত্মপ্রতারণার পরমতৃপ্তি ছাড়া? ঠিক একইরকম কুযুক্তি তিনি পেশ করেছেন চন্দ্রাবতরণের নাম ‘শিবশক্তি’ রাখার সপক্ষে, যে নামটি স্থির করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদিজি স্বয়ং। সোমনাথ সায়েব বলেছেন, এ নাম চমৎকার, কারণ এর মধ্যে আছে ভারতীয়ত্ব। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক, কারণ এর মধ্যে আছে আমাদের সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে নস্যাৎ করে হিন্দুত্বের সঙ্গে ভারতীয়ত্বের সমীকরণ বানাবার ছক। আর, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হচ্ছে এর অন্তর্নিহিত মোটাদাগের রুচি ও ঔদ্ধত্য।
মহাকাশীয় কোনও বস্তুর ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বা সামরিক নামকরণ করা আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থার ঘোষিত নীতি অনুযায়ী নিষিদ্ধ, কিন্তু মোদিজি ওসবের তোয়াক্কা করেন না। তিনি জানেন যে, হয় তিনি আন্তর্জাতিক লবির জোরে শেষতক ওই নামের অনুমোদন জোগাড় করে ফেলতে পারবেন, আর যদি একান্তই তা না পারেন সে তো আরও ভাল, তখন তিনি হিন্দুর বিরুদ্ধে খ্রিস্টানি ষড়যন্ত্রের গল্প ফেঁদে আরও জমিয়ে জনসমর্থন ও ভোট আদায় করতে পারবেন।
যদি ‘শিবশক্তি’-র বদলে ‘নচিকেতা’ বা ‘মৈত্রেয়ী’ গোছের ঔপনিষদিক নাম আহরণ করা হত, তো তাতে থাকত শৈল্পিক রুচির আড়াল, এবং হয়তো তার পেছনে এ যুক্তি দেওয়া চলত যে, এর মধ্যে দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসু চরিত্রকেই আসলে সমর্থন করা হচ্ছে, প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে। কিন্তু, মোদিজি ইনিয়েবিনিয়ে ওইসব ঢাকঢাক গুড়গুড় করবার লোক নন। তিনি সেইসব গোত্রের লোকজনের বাসনাকে জাতীয় বাসনায় রূপান্তরিত করতে চান, যাদের তিনি প্রকৃত নেতা। এবং তাঁর এক মস্ত গুণ, তিনি কী চান সেটা মোটেই লুকোতে চান না। কপালে তিলক কাটা যে স্থানীয় বিজেপি নেতা যে-কোনওদিন আপনার বাড়ির পাশে একটি হনুমান মন্দির স্থাপন করে মাইক্রোফোনে উচ্চগ্রামে হনুমান চালিশা চালিয়ে দিতে পারেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীজি তাদেরকে চাঙ্গা করে তুলতে চান। তাদের (এবং অন্য সকলেরই) কাছে তিনি এই স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিতে চান যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে তাদেরই প্রতিনিধি, এবং তাদের বোধবুদ্ধি রুচি আকাঙ্ক্ষা যাতে গোটা দেশ তথা জাতির নির্ধারক বোধবুদ্ধি রুচি আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে, তিনি তার জন্য যথাসাধ্য করবেন।
এখন লাখ টাকার প্রশ্নটা হচ্ছে, এসবের মধ্যে দিয়ে কোথায় যাচ্ছে আমাদের প্রিয় দেশটির বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎ? উত্তরটা হচ্ছে, ওটা সম্ভবত যাচ্ছে হিন্দু নরকের সেই ফুটন্ত কড়াইয়ে, যেখানে যমরাজের অনুগত দানবেরা বেয়াদবদেরকে ভাজা ভাজা করেন।
এবং, লাখতর টাকার প্রশ্নটা হচ্ছে, এই ভাজা হতে চলা বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যৎকে কি আমরা আটকাতে পারি না?
এর সঠিকতম উত্তরটি বোধহয় কারওই জানা নেই। তবে মানুষের ইতিহাস আমাদেরকে শেখায় যে, মানুষের সভ্যতা আর অগ্রগতির সঙ্গে এর কোথাও একটা গিয়ে মৌলিক বিরোধ আছে, তাই শেষপর্যন্ত কোথাও তো থামতেই হবে একে। আধুনিকতার অন্তর্নিহিত কোনও মৌল ভিত্তি ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধ তুঙ্গে উঠলে কোনও এক পর্যায়ে গিয়ে রাষ্ট্র অবশ্যই তার ন্যুনতম বৈধতা ও শক্তিটুকু হারাবে। দেশ ও জাতির কাছে সে একটা ভয়ঙ্কর সঙ্কট হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
সে সঙ্কট ঠিক কবে কোথায় কীভাবে কতটুকু হবে, আর কীভাবেই বা আমরা তা থেকে উত্তীর্ণ হব, সে বোধহয় কেউই জানে না। আমাদের তো শুধু এটুকুই জানা আছে যে, মানুষ চিরকাল চেষ্টা করে চলে, এবং চেষ্টা করে যাবে!
‘চন্দ্রবিজয়, হিন্দুত্ব এবং আমাদের বিজ্ঞান-ভবিষ্যৎ’ শিরোনামে চার নম্বর প্লাটফর্মে প্রকাশিত লেখাটি যে বন্ধুবর দেবাশিস্ ভট্টাচার্যর রচনা তা বিশ্বাস হতে চায় না। লেখাটির ছত্রে ছত্রে যেভাবে যুক্তির ও কাণ্ডজ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হয় তাতে দুচার কথা না বললেই নয়। বিশেষত লেখক যখন আমার বিশেষ পরিচিতি এবং যাকে আমি শ্রদ্ধা করি তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির মতো গুরুগম্ভীর নামের একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বলে নয়, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর নিবিড় অধ্যয়নের কারণে।
এই লেখাটির প্রথমেই দেখা যায় দেবাশিসদা তাঁর নিজের মনে উত্থিত একটি প্রশ্ন জনগনের নামে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন এইভাবে যে “কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, আমাদের মতো গরিব দেশের কাছে তো মহাকাশ-গবেষণা এক শ্বেতহস্তী পোষার মতো ব্যাপার— কী হবে এই শ্বেতহস্তী পুষে, দেশ যেখানে জর্জরিত দারিদ্র্যে, বেকারিত্বে, অসাম্যে, অশিক্ষায়, ধর্মান্ধতায়?”
তারপর তিনি নিজেই তা খণ্ডন করেছেন এই বলে,’…এইসব সমস্যা যতদিন না দূর হবে ততদিন বিজ্ঞান দর্শন শিল্প সাহিত্য এইসব থামিয়ে রাখা উচিত তো নয়ই, এবং সম্ভবও নয়, চাইলেও পারা যাবে না।” এই বক্তব্যের সমর্থনে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জে ডি বার্নালের একটি উক্তিও ব্যবহার করেছেন, বৃক্ষের যেমন মুকুল, সমাজের তেমনি গবেষণা। সব মুকুল ছেঁটে দিলে গাছ বেঁচে থাকবে কিন্তু তার বাড়বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি, গবেষণা বন্ধ করে দিলে সমাজ টিকে থাকবে, কিন্তু তা হয়ে দাঁড়াবে স্থবির, শিলীভূত।
কিন্তু পরক্ষণেই ‘তবুও, মানুষের অন্য সবকিছুর মতোই, বিজ্ঞান গবেষণার পেছনে কিছু মোদ্দা নৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি তো থাকতেই হয়, না থাকলেই চলে না’ ইত্যাদি বলে তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে সেই মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখে ভারতের স্থান, ক্ষুধা এবং ক্ষুধা সূচকে ভারতের অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এই ধরণের চন্দ্রাভিযান যে ভারতের মতো দরিদ্র দেশের পক্ষে যথার্থ নয় তা বলবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান এই সব দেশগুলোর সাম্প্রতিক অবস্থা সম্পর্কে একটু আধটু খোঁজখবর রাখলে এই সমীক্ষিত বিদঘুটে সূচকগুলোর পেছনে যে বাস্তবতার চাইতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ভূরাজনৈতিক রসায়ন বেশি ভূমিকা রাখে তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। একজন চোখকান খোলা রাখা মানুষ যদি এইটুকু জানেন যে বিগত পাঁচ বছরে ভারত উনিশটি দেশের ১১৭টি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে ১১০০ কোটি টাকা উপার্জন করেছে তাহলে তার চন্দ্রবিজয়কে ‘হিন্দু-শৌর্য প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা’ বলে মনে হওয়ার কথা নয় এবং নিজেকে যুক্তিবাদী দাবি করা একজন মানুষ নিজের চোখকান এটুকু খুলে রাখবেন আশা করাই যায়।
এই ভাবে বিপুল অর্থাগমের সম্ভাবনা ছাড়াও মহাকাশ গবেষণার সুফল কীভাবে কৃষি, মৎস্যচাষ, আবহাওয়া বিভাগ, অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যপক ভাবে ব্যবহৃত হয় দেবাশিসদা তা ভালোই জানেন। এছাড়াও চন্দ্রাভিযানের সাফল্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি যেভাবে উজ্জ্বল করেছে তার গুরুত্বও কম নয়। সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো যেভাবে ভারতের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে তাতে এই উজ্জ্বল ভাবমূর্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
আর একজন কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের জানার কথা যে কোনো দেশের অর্থনীতি যখন দ্বাদশ থেকে একাদশ, একাদশ থেকে দশম এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে বৃদ্ধি পেতে পেতে পঞ্চম অবস্থানে পৌঁছায় তখন সেই বৃদ্ধি ওই দেশের সব মানুষের সমহারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সুচিত করে না। কিন্তু সামান্য হলেও ওই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফল নীচের তলার সব মানুষের কাছেই পৌঁছায়। এখন অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফল নীচের তলার সব মানুষের কাছে কেন সমহারে পৌঁছায় না সেটা অর্থনীতির অন্য প্রশ্ন তবে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেই যে ভারতবর্ষ বিগত দেড় দশকে ৪১৫ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্য সীমার উপরে নিয়ে আসতে পেরেছে এটা তো ঘটনা। অ্যামেরিকার মোট জনসংখ্যার থেকেও বেশি মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের এই বিষয়টি ইউ এন-এর রিপোর্টেও প্রশংসিত হয়েছে। শুধু তাই নয় সরকারি বিভিন্ন অনুদানের অর্থের অধিকাংশই প্রাপকের কাছে পৌঁছানোর আগে চুঁইয়ে মধ্যবর্তী বাহকের হাতে চলে যাবার বিষয়টি প্রযুক্তির সাহায্যে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।
আমরা যারা চল্লিশ পঞ্চাশ বছর বয়স ছুঁয়েছি তারা অবশ্য এতসব তথ্য পরিসংখ্যান না জেনেও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে ভারতের এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিষয়টি টের পাই। আমাদের পনের কুড়ি বছর আগের জীবনযাপনের সঙ্গে এখনকার জীবন যাপনের মান তুলনা করলেই যে কোনো ভারতীয়র বিষয়টি টের পাবার কথা, যদি না কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন তার যুক্তিবোধ ব্যহত করে।
আর শিবশক্তি নামটা নিয়ে আগেও দেবাশিসদার সঙ্গে কথা হয়েছে। এই নামে তিনি কোথায় ‘অন্তর্নিহিত মোটাদাগের রুচি ও ঔদ্ধত্য’ খুঁজে পেয়েছেন বলা শক্ত। হয়তো তাঁর মনে হয়েছে যেহেতু ট্র্যান্সপোর্ট কোম্পানি এই ধরণের নাম রাখে বা কোনো কোনো লরির পেছনে এই শব্দবন্ধটি লেখা থাকতে দেখা যায় তাই এতে ইন্টেলেকচুয়াল ভাবসাবের অভাব রয়েছে। তাই তিনি উপনিষদ থেকে মৈত্রেয়ী বা নচিকেতা টাইপের কিছু একটা শৈল্পিক নামকরণ হলে যথার্থ হতো বলে ব্যক্ত করেছেন। ভাবতে অবাক লাগছে দেবাশিসদার মতো পড়াশোনা করা মানুষ কি সত্যিই “শিবশক্তি” শব্দবন্ধটির তাৎপর্য বোঝেন না? এই নামটিও কিন্তু উপনিষদে আছে। এর অর্থ অর্ধনারীশ্বর। মানুষের শ্রেষ্ঠ বিমূর্ত কল্পনাগুলির একটি। এর বিশিষ্ট এইখানেই যে পৃথিবীর সকল ধর্মের ঈশ্বর পুরুষ কিন্তু একমাত্র ভারতবর্ষের মানুষের কল্পনায় ঈশ্বর নারী ও পুরুষ উভয়ই। ইসরোর অর্ধশতাধিক মহিলা বিজ্ঞানীদের অবদানের বিষয়টি মাথায় রাখলে এই নামকরণকে প্রতীকী মনে হতে পারে।
শুধু এটুকুই নয়, ধর্মীয় নাম ব্যবহার করায় ভারতের সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দেবাশিসদার মনে হয়েছে। অথচ ভারতের সংবিধানেই শিবের (নটরাজ) ছবি ছাড়াও একাধিক ধর্মীয় চিত্র (লঙ্কা বিজয়ের পর সীতা ও লক্ষ্মণ সহ রামের অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন, কুরুক্ষেত্রে অর্জুনকে গীতার বাণী প্রদানরত শ্রীকৃষ্ণ ইত্যাদি) রয়েছে। ভারতের সংবিধান প্রণেতারা ভারতকে কখনোই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দেখাতে চাননি। সেকুলারিজমের ধারণায় যে নিরীশ্বরবাদী ঝোঁক আছে তার সঙ্গে ভারতের সংবিধান যে ভাবে ধর্মকে দেখতে চেয়েছে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ভারতের সংবিধানের সেকুলারিজমের অর্থ বরং ঠিক উল্টো তাই হিন্দি অনুবাদে ভারতকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ না বলে ‘পন্থানিরপেক্ষ’ বলা হয়েছে। ভারতের আবহমান কাল ধরে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির অনুসরণে সংবিধানে সব ধরনের উপাসনা পদ্ধতিকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আর সেই সঙ্গে ব্যপক ভাবে ধর্ম বলতে ভারতবর্ষ যা বুঝে এসেছে, অর্থাৎ কর্তব্য কর্ম, স্বভাব, গুণ বা নৈতিক শক্তি, জগতের পরম সত্য ইত্যাদি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতীকে, জাতীয় পতাকায় শুধু “ধর্মচক্র” জায়গা করে নিয়েছে তাই নয়, জাতীয় প্রতীকের নীচে দেবনাগরী হরফে লেখা “সতমেব জয়তে” কথাটি হিন্দু ধর্মের অন্যতম আকর গ্রন্থ বেদান্ত থেকে নেওয়া হয়েছে। এমনকি ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে দেশ কে দেশ মাতৃকা হিসেবে কল্পনা করে তার পূজা করবার কথা বলা হয়েছে। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ হলে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের লোগোর নীচে লেখা থাকত ‘যতো ধর্ম স্ততো জয়ঃ? গাজোয়ারি করে অঙ্ক বইয়ের মলাটে ইতিহাস লিখে দিলেই কি সেটা ইতিহাস বই হয়ে যায়?
দেবাশিসদা আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান সংস্থার মহাকাশীয় কোনও বস্তুর নামকরণের নীতি উল্লেখ করে আরও লিখেছেন যে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বা সামরিক নামকরণ করা অবৈধ। কিন্তু তাঁর জানার কথা মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্রের নাম ব্যবহার প্রায় সমস্ত দেশই করে থাকে। অ্যামেরিকার নাসার বিভিন্ন চন্দ্রাভিযান মিশনের নাম অ্যাপোলো। ১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই, যে চন্দ্রাভিযানে অ্যামেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিলো, সেই মিশনের নাম ছিল অ্যাপোলো-১১। গ্রিক ও রোমান মিথোলজিতে অ্যাপোলো গ্রিক দেবতা জিউস ও লেটোর পুত্র এবং সঙ্গীত, কবিতা, চিকিৎসা, দৈববাণী ও ধনুর্বিদ্যার দেবতা।
নাসার পরবর্তী মিশন আর্টিমিস। ২০২৫ সালে চাঁদের বুকে আবারও মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে নাসা। নাসার এই প্রকল্পে হাত মিলিয়েছে ইসরোও। নাসা ও ইসরোর এই যৌথ আয়োজনের নাম আর্টেমিস। গ্রিক পূরাণে এই আর্টেমিস চাঁদের দেবী। তিনি আবার অ্যাপোলোর জমজ বোন। রাশিয়ার মহাকাশযানের লুনা (Luna) ও সিনথিয়া (Synthia) নাম দুটিও গ্রিক ও রোমান পুরাণের দেবী। এমনকি চিনের বিভিন্ন চন্দ্রাভিযানের ‘চ্যাং’ (Chang’e) সিরিজের নামকরণটিও হয়েছে চৈনিক পুরাণের চন্দ্রদেবীর নামে। চৈনিক রিলে স্যাটেলাইট কিউকিয়াও (relay satellite Queqiao) নামটিও চৈনিক পুরাণের চরিত্র ।
এসব কথা তার জানার কথা বলছি এই কারণে যে কিছুদিন আগেই আমি এই প্রসঙ্গে আমার টাইমলাইনে একটি পোস্ট করেছিলাম সেখানে তিনি লিখেছিলেন ঠিকই বলেছেন ভাই, এইসব নামকরণের ক্ষেত্রে সব দেশই পৌরাণিক রেফারেন্স দেয়। কিন্তু, ভারতে যা ঘটছে তার সঙ্গে এর একটা গুরুত্বপূর্ণ তফাৎ আছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় গ্রিক পুরাণের রেফারেন্স মানে শুধুই পৌরাণিক, ধর্মীয় নয়। ওগুলো প্রাচীন প্যাগান ধর্মের সঙ্গে যুক্ত, এখন সেগুলো ওখানে মোটেই চালু নয়। ফলত, সেখানে মৌলবাদী রাজনৈতিক কোনও সমীকরণ মোটেই কাজ করেনা। বস্তুত, খ্রিস্টীয় মৌলবাদ এইসব প্যাগান রেফারেন্স একদমই পছন্দ করেনা। অথচ, এখানে যা ঘটছে সেটা কিন্তু পরিষ্কার চালু সংখ্যাগুরু মৌলবাদী রাজনীতির ছক মেনেই।
তার উত্তরে আমি জানিয়েছিলাম যেহেতু “শিবশক্তি একটি পৌরাণিক নাম তাই এই ধরনের ক্ষেত্রে নামকরণের যে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক নীতি আছে তা এখানে কোনো ভাবেই লঙ্ঘিত হয়নি। আর একেশ্বরবাদের শক্তিশালী থাবায় প্যাগানিজম বিলুপ্ত হওয়ায় অনুগামীর অভাবে সেটা নিয়ে এখন রাজনীতি করার সুযোগ নেই। কিন্তু একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো রাজনীতির উপাদান হিসেবে একদম প্রথম থেকেই বিপজ্জনক ভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং আজও হচ্ছে। বস্তুত পক্ষে ভারতে হিন্দুত্ববাদের সাম্প্রতিক যে উত্থান দেখা যাচ্ছে তা একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোরই প্রতিক্রিয়া।
আমি আরো বলেছিলাম যে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটির রাজনীতির অন্যতম উপাদান যে ধর্ম তা অবশ্য তারা অস্বীকার করে না। সেই হিসেবে এই নামকরণের পেছনে ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকা অসম্ভব তো নয়ই বরং খুব বেশি করে সম্ভব।বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটির রাজনীতির আরো একটি উপাদান জাতীয়তাবাদ। এবং সেই কারণেই তারা দ্বিতীয় চন্দ্রযানের ব্যর্থ ল্যান্ডিং পয়েন্টের নাম রেখেছে ‘তিরঙ্গা!’ কিন্তু প্রথম চন্দ্রযানের ব্যর্থ ল্যান্ডিং পয়েন্টের নাম দেওয়া হয়েছিল জওয়াহর পয়েন্ট। ভারতের শেষ দক্ষিণ বিন্দুর নাম দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরা পয়েন্ট, যা ২০০৪ সালের সুনামিতে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এই কারনেই আমাদের ভিসনারি প্রধানমন্ত্রীর দলটি আজ শাসন ক্ষমতায় থাকলে খুব সম্ভবত দ্বিতীয় চন্দ্রযানের ব্যর্থ ল্যান্ডিং পয়েন্টের নাম দেওয়া হতো ‘ইন্দিরা পয়েন্ট’ এবং তৃতীয় চন্দ্রযানের সফল ল্যান্ডিং পয়েন্টের নাম দেওয়া হতো ‘রাজিব পয়েন্ট।’ সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়াও কম প্রাপ্তি নয়।
এরপর দেবাশিসদা প্রশ্ন তুলেছেন ইসরোর বিজ্ঞানীর দৈববিশ্বাস নিয়ে। কিন্তু সাধারণ যুক্তিবোধ দিয়েই বোঝা সম্ভব যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে কাজ করার সঙ্গে ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকা বা না থাকার খুব একটা সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান যে বস্তুবাদী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত, একজন খুব সাধারণ মানুষ, বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন তত্ত্ব না জেনেও দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতায় সেই দর্শন অনুসরণ করতে পারেন (যেমন আমি রকেট সাইন্স বা কোয়ান্টাম ফিজিক্স বুঝি না কিন্তু আমি বস্তুবাদী, কিন্তু বস্তবাদী বলেই আমি রকেট সাইন্স বুঝবো এবং সেই বিষয়ে কাজ করতে পারব এটা ভাবা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়), আবার এবং প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী (বস্তুবাদী নন, জীবনের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে মন্দিরে যান কিন্তু রকেট সাইন্স বা কোয়ান্টাম ফিজিক্স শুধু বোঝেন না, তাই নিয়ে কাজ করেন) এই দর্শনের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে অপারগতা প্রর্দশন করতে পারেন। এমনকি ধর্ম ও দর্শনে জীবনের তাৎপর্য অনুধাবনের যে গভীর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় তা উপলব্ধি না করেও নিতান্তই সংস্কার বসে একজন বিজ্ঞানী ঈশ্বর বিশ্বাসী হতে পারেন।
বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিজ্ঞান চর্চার পাশাপাশি ঈশ্বরে আস্থা রাখা নতুন কোনো ঘটনা নয়। সারা পৃথিবীতেই এই ঘটনা দেখা যায়। PEW Research Organisation মার্কিন আমজনতা ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে ঈশ্বর বিশ্বাসের হার কেমন তা জানতে ২০০৬ সালে একটা সার্ভে চালায়। সেই সার্ভেতে দেখা যায় বিজ্ঞানীদের মধ্যে ৩৩ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, ১৮ শতাংশ ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও বিশ্বের পরিচালনায় কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির ভূমিকা আছে বলে বিশ্বাস করেন। নাসার বিভিন্ন অ্যাপোলো অভিযানে মহাকাশচারীদের বাইবেল নিয়ে যেতে দেখা গেছে। পরে সেই মহিমান্বিত চান্দ্রবাইবেল আবার নিলামে বিক্রিও করা হয়েছে। মার্কিন মহাকাশচারীদের পোপের আশির্বাদ যাচ্ঞা করা বা মহাকাশযানে মাদার মেরির ছবি রাখার একাধিক নিদর্শ আছে। ২০০৬ সালে সুনীতা উইলিয়ামস আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে যাত্রার সময় ভাগবত গীতা নিয়ে গিয়েছিলেন। রাশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে ক্রিসমাস উদযাপিত হতে দেখা গেছে। ইহুদি ধর্মাবলম্বী মার্কিন মহাকাশচারীদেরও মহাকাশ যাত্রার সময় সঙ্গে তোরা ও অন্যান্য ধর্মীয় নিদর্শ সঙ্গে রাখতে দেখা গেছে।
তাহলে মানুষের সমাজ কোনো দিনই ধর্ম থেকে মুক্ত হতে পারবে না? এর উত্তর খুব সোজা, না পারবে না। মানুষ যখন উপলব্ধি করে যে এই বিশাল মহাবিশ্বের নিরিখে সে নিতান্তই নগন্য, তার বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ায় মহাবিশ্বের কিছু আসে যায় না অথবা তার স্নায়ুতন্ত্রের কিছু অনুভূতি, সেগুলোকে সে প্রেম ভালোবাসা, পরার্থপরতা ইত্যাদি নাম দিয়ে মহিমান্বিত করে আর ঘৃণা, হিংসা, স্বার্থপরতা এইসব নামে বিনিন্দিত করে সেগুলো মহাবিশ্বের কাছে কোনো মূল্যই বহন করে না তখন তার বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে যায়। এই অর্থহীনতাকে অর্থবহ করতে সে ধর্মকে অবলম্বন করে। ধর্ম তার জীবনকে মহিমান্বিত করে, তার বেঁচে থাকাকে উদ্দেশ্যমণ্ডিত করে। কিন্তু এই ধর্ম যে ঈশ্বর ও অলৌকিকতা মণ্ডিত হতে হবে তার কোনো মানে নেই। সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি চর্চার মাধ্যমেও জীবনকে অর্থবহ করে তোলা সম্ভব। সেই সময় প্রচলিত ধর্মের জায়গা নেবে ঈশ্বর ও অলৌকিকতা বর্জিত সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদির চর্চা।
খুব সুন্দর। অনেক কিছু জানলাম।
দেবাশীষ ভট্টাচার্য মহাশয় “চন্দ্রবিজয়, হিন্দুত্ব এবং আমাদের বিজ্ঞান ভবিষ্যৎ” লেখায় খুব সুন্দর ভাবে পরিসংখ্যান দিয়ে এবং বিভিন্ন মাপকাঠি ব্যবহার করে বুঝিয়েছেন যে আমরা (দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ) মোটেই ভালো জায়গায় নেই কোন অর্থেই। বিজ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্যাপারে সরকার আদৌ আগ্রহী নয়, বরং এর বিপরীত পথে হাঁটতে চায় আমরা দেখেছি।
চন্দ্র অভিযান হয়েছে বা বলা ভালো করতে বাধ্য হয়েছে সরকার যদি এই হিন্দুত্বের গন্ধ মাখানো স্ট্যান্টবাজি দিয়ে সামনের ভোট বৈতরণী পেরানো যায়। লেখক সুন্দরভাবে এই চন্দ্র অভিযানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ব্যক্ত করেছেন। অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন লেখককে সুন্দর এবং প্রাসঙ্গিক একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।
অত্যন্ত জরুরি লেখা।
অশোক সাউ,
আপনার দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি তার জবাব লিখেছি, কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে পোস্ট করতে পারছি না। সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা চালাচ্ছি।
লেখাটি ভাল লেগেছে বলে যাঁরা জানিয়েছেন, তাঁদের সকলকেই ধন্যবাদ।
প্রিয় অশোক সাউ,
সাড়া দিতে আমার এই বিলম্ব মার্জনা করবেন। আপনি যেভাবে আমার লেখাটির সমালোচনা করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে এই লেখাটি হয়ত আপনাকে ক্ষুব্ধ করেছে। তা যদি হয়ে থাকে, তার জন্য আমি দুঃখিত। তবে, এত বিস্তারিত একটি সমালোচনা লিখতে আপনি যে সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন, তার জন্য আপনাকে আমি ধন্যবাদ দেব। সমালোচনা সব সময়ই আমার কাছে স্বাগত। এই বিষয়টি নিয়ে আমি যা যা বলতে চাই তার অনেক কিছুই এই লেখায় বলে ওঠা সম্ভব হয়নি, এবং ফলত, অনেক কিছুই হয়ত অনেকের কাছে পরিষ্কার হয়নি সেভাবে। এখন, আপনার সমালোচনার উত্তর দিতে গিয়ে হয়ত এ বিষয়ে আরও কিছু ব্যাখ্যা হাজির করার সুযোগ মিলবে। সে সুযোগ করে দেবার জন্যে আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।
আপনি আপনার সমালোচনাগুলো যে ক্রমে হাজির করেছেন, আমি তার জবাব দেবার সময়ে ঠিক সেই ক্রমই বজায় রাখব। আমার ধারণা, এতে করে বিষয়টি বুঝতে সুবিধে হবে। একে একে বলতে থাকি তবে।
(১) আমাদের মতো গরিব দেশের কাছে মহাকাশ-গবেষণা এক শ্বেতহস্তী পোষার মতো ব্যাপার কিনা, আমার একান্ত নিজস্ব এ প্রশ্ন আমি জনগণের নামে চালিয়েছি, এমন অভিযোগ আপনি করেছেন, এবং এ অভিযোগে আমি কিঞ্চিৎ বিস্মিত। মানুষের মধ্যে এমন কোনও প্রশ্ন আপনি কখনও শোনেননি বলছেন? আমি তো অহরহই শুনতে পাই! এ নিয়ে তর্ক করবার দরকার নেই, সোশাল মিডিয়াতে চোখ রাখলেই আপনিও শুনতে পাবেন। এখানে বরং এটাই ঘটনা যে, আমি এ প্রশ্ন থেকে কিঞ্চিৎ দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছি, এবং সেটা বোধহয় আপনি নিজেও লক্ষ করেছেন। দারিদ্র্য থাকলেও মৌল গবেষণা চালিয়ে যাওয়া উচিত, মহাকাশ গবেষণা সমেত, এটাই ছিল আমার বক্তব্য। দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতার সঙ্গে লড়বার জন্য গবেষণা এক অপরিহার্য হাতিয়ার — এটা আমি পরিষ্কার করেই বলেছি। আমার এ বক্তব্যে কোনও ধোঁয়াশা বা জটিলতা আছে বলে আমার মনে হয়নি।
(২) তার পরেই যে আমি গবেষণার নৈতিক ও সামাজিক ভিত্তির কথায় চলে গেছি, সেটা আপনার কাছে স্ববিরোধিতা মনে হয়েছে। যদ্দুর বুঝলাম, আপনি অবাক হয়ে ভেবেছেন, দারিদ্র্য থাকলেও গবেষণা করতে হবে এটাই যদি মেনে নিলাম, তাহলে আর ‘ইনিয়ে বিনিয়ে’ নৈতিকতা সমাজ সংস্কৃতি এইসবের কথা টেনে আনার দরকার কি? কিন্তু, আসলে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। অনুরোধ রইল, আরেকটু ভাল করে ভেবে দেখবেন, ‘দেশে দারিদ্র্য থাকলেও মৌল গবেষণা চালিয়ে যাওয়া উচিত’ — এ কথার সঙ্গে কিন্তু, ‘ভাল গবেষণার জন্য একটি পোক্ত নৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ভিত্তির প্রয়োজন হয়’ — এ কথার কোনও অনিবার্য বিরোধ নেই। বরং সত্যি বলতে কী, প্রথমটির জন্য দ্বিতীয়টি অপরিহার্য — দ্বিতীয়টি ঠিকঠাক গড়ে না উঠলে প্রথমটা হবেই না! কথাটা শুনতে একটু অদ্ভুত লাগতেও পারে, কিন্তু কথাটা আসলে খুব সহজ একটা কথা। সমাজ যদি বিজ্ঞানচর্চাকে নৈতিক ছাড়পত্র না দেয়, যদি বিজ্ঞানের পেছনে প্রশাসনিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমর্থন না পাওয়া যায়, যদি সমাজে অবাধে যুক্তিপূর্ণ তর্কবিতর্ক ও মতপ্রকাশের সংস্কৃতি না চালু থাকে, যদি সমাজ যুক্তি ও সত্যকে সম্মান করতে না শেখে, তাহলে সে সমাজে বিজ্ঞানের অগ্রগতি অসম্ভব। যে সমাজ বৈজ্ঞানিক অন্বেষণকে ঐশ্বরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করে, যে সমাজের বিজ্ঞানের পেছনে টাকা খরচ করার সাধ বা সাধ্য (বা দুটোই) নেই, যে সমাজের মূল রাজনৈতিক মতাদর্শ অযৌক্তিক এবং বিজ্ঞানবিরোধী, যে সমাজে প্রশাসন ও কর্তৃত্ব অবাধ জ্ঞানচর্চার জন্য অনুকূল পরিসর দেয় না, সে সমাজে বিজ্ঞান গবেষণা হবেনা। এই অতি সহজ কথাটাই তো আমি ওখানে ব্যাখ্যা করে বলতে চেয়েছিলাম। আরও বলতে চেয়েছিলাম, বিজ্ঞানের পেছনের এই যে নৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ভিত্তি, দরিদ্র পশ্চাৎপদ সমাজে এই ভিত্তিটা খুব পোক্তভাবে তৈরি থাকেনা, অনেক বিচক্ষণতার সঙ্গে অনেক ধৈর্য ও পরিশ্রম সহকারে একে নির্মাণ করতে হয় — যদিও আমাদের দেশে বর্তমানে অতি যত্ন সহকারে এবং অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সংগঠিতভাবে তার ধ্বংসসাধন হচ্ছে। খুব দুর্বোধ্য বা কঠিন কথা কিছু বলছিলাম কি?
(৩) ভারতের মাথাপিছু জাতীয় আয় ও অন্যান্য যে সমস্ত সূচকের উল্লেখ করে আমি দুশ্চিন্তা প্রকাশ করেছি, সেগুলোকে আপনি ‘বিদঘুটে সূচক’ বলেছেন, কিন্তু কেন যে বলেছেন তার কারণ আমি বুঝতে পারিনি। অত্যন্ত খ্যাতনামা এবং যোগ্য সমাজবিজ্ঞানীরা এই সমস্ত সুচক বানিয়েছেন, এবং সেগুলো সারা পৃথিবীতে মান্য বলেই জানি। কোন সমাজবিজ্ঞানী এগুলোকে ‘বিদঘুটে’ বলেছেন, এবং কেনই বা বলেছেন, এবং এর চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য আরও কী কী সূচক তাঁরা সুপারিশ করেছেন, সে বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই। আপনার যদি জানা থাকে, সাগ্রহে জানতে চাইব।
(৪) আপনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশ পাকিস্তান এইসব দেশের অবস্থার খবরাখবর রাখলে নাকি বোঝা যাবে, ওই সূচকগুলো কেন ‘বিদঘুটে’। আপনার এই স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও আমি যে তার কারণ বুঝতে পারিনি, সে নিশ্চয়ই আমারই অক্ষমতা। এমনিতে, এইসব দেশের অবস্থা যে মোটেই খুব একটা ভাল নয়, সে নিয়ে তো আর তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ দ্বিমত নেই। কিন্তু, আমি তো আর ওইসব দেশের বাসিন্দা নই, আমি ভারতের বাসিন্দা, তাই আমার বেশি দুশ্চিন্তা ভারত নিয়েই। ওই বিদঘুটে সূচকগুলো অনুযায়ী ভারতের দশা মোটের ওপরে ওই দেশগুলোর মতই, এমন কি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ওর চেয়েও খারাপ। এখন, ওই দেশগুলোর দশা যে খারাপ সে বিষয়ে যদি আপনার সঙ্গে একমত হই, তাহলে আমাদের নিজের দেশের বিষয়ে দুশ্চিন্তা এড়ানো যায় কি? আমি তো এড়াতে পারিনা। আপনি সেটা ঠিক কীভাবে পারেন, জানলে নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। পাকিস্তানকে গালি দিতে দিতেই নিজে মনে মনে পাকিস্তান হতে চাওয়া — এ ব্যাপারটা আমার কাছে খুব আশ্চর্য রকম হাস্যকর লাগে। আপনার কাছে কেমন লাগে, সেটা জানতে পারলে আলোকিত হব আশা করি।
(৫) ইসরো গত পাঁচ বছরে ভিনদেশে প্রাযুক্তিক পরিসেবা বিক্রি করে ১১০০ কোটি টাকা আয় করেছে — এ খবর অতিশয় গর্বের এবং আনন্দের বইকি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নিছক এই টাকার অঙ্কটুকু দিয়ে ইসরো-র অস্তিত্বকে সমর্থন করা খুব কঠিন। বিগত বছরে ইসরো-র পেছনে খরচা হয়েছে ১৪০০০ কোটি টাকা, এবং বিগত পাঁচ বছরে প্রায় ৫০০০০ কোটি টাকা। দেশকে টাকা জোগানোই যদি একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তো ইসরো-কে লাটে তুলে দিলে সে উদ্দেশ্য সবচেয়ে বেশি সাধিত হতে পারত। এগারোশো কোটি আয় করবার জন্যে পঞ্চাশ হাজার কোটি খরচা করা নিতান্ত নির্বোধের কাজ, এ তো খুব সোজা হিসেব, তাই না? ওই একই রকম যুক্তি দেওয়া যায় কৃত্রিম উপগ্রহ বিষয়েও, জাতীয় জীবনে তার কৃতিত্ব স্বীকার করে নিয়েই, এবং সংশ্লিষ্ট ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বও স্বীকার করে নিয়েই। আমি জিজ্ঞেস করতে পারি, কৃত্রিম উপগ্রহ দিয়ে যদি দেশ তথা জাতির নানা উপকার হয় তো শুধু ওটাই করুন না, চাঁদে যান পাঠিয়ে কোন মোক্ষলাভটা হবে?
কিন্তু লক্ষ করুন, আমি এ সমস্ত যুক্তি আমার লেখায় কোত্থাও দিইনি। আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি, ইসরো তথা এ দেশের সমস্ত মৌল গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব ও শ্রীবৃদ্ধি দেশের জন্য অতি জরুরি — তারা টাকা আয় করতে পারলে ভালই, কিন্তু তা পারছে কিনা সেটা বড় কথা না, বড় কথা হল নতুন এবং মূল্যবান জ্ঞান তারা কতটা সৃষ্টি করতে পারছে। আমার ধারণা, সম্ভবত আপনিও তাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু মোদিজিও ঠিক এটাই বিশ্বাস করেন, সে ব্যাপারে আপনি কি নিশ্চিত? যদি নিশ্চিত হন, চমৎকার, কিন্তু তাহলে অনুগ্রহ করে আমাকে কয়েকটা জিনিস বুঝিয়ে দেবেন। মোদিজির আমলে আমাদের জাতীয় গবেষণা-ব্যয় ক্রমাগত বামন থেকে বামনতর হয়ে ওঠে কেন? দশমিক নয় থেকে দশমিক ছয়ে নেমে আসাটা কী ধরণের বিজ্ঞানপ্রীতির নিদর্শন? এবং, চন্দ্রযান-৩ এতবড় সাফল্য অর্জন করার পরেও, পরবর্তী বছরের জন্য ইসরো-র বাজেট দু হাজার কোটি টাকা কমে গেল কেন (মনে রাখবেন, এটা কিন্তু জাতীয় আয়ের শতাংশ হিসেবে অবনমন নয়, একদম টাকার অঙ্কেই অবনমন)?
এর কোনও ব্যাখ্যা কি আছে আপনার কাছে? থাকলে, সেটা ভাল করে বুঝে নিতে চাইব আপনার কাছ থেকে।
(৬) আপনি বলেছেন, অর্থনৈতিক উন্নতি হতে থাকলে অসাম্য বাড়ে — এটাই অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম, কিন্তু তা বাড়লেও, তাতে গরিবদেরও উপকার হয় — উন্নতির সিংহভাগ বড়লোকের পকেটস্থ হলেও, তার কিছুটা অন্তত চুঁইয়ে নামে গরিবের নাগালে। ফলত, মোদ্দা হিসেবে দারিদ্র্য কমে শেষতক। ঠিকই বটে, মূলস্রোত অর্থনীতির এ এক সুপরিচিত দাবি। এবং এও ঠিক যে, অসাম্য কমানোটাই বেশি ভাল, না কি অসাম্য বাড়া সত্ত্বেও মোদ্দা হিসেবে দারিদ্র্য কমে যাওয়াটা বেশি ভাল, এ নিয়ে বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এক দীর্ঘকালীন ধ্রুপদী তর্ক আছে। অর্থনীতির এইসব ধ্রুপদী তর্কে এখন আমি ঢুকতে চাইনা, এবং এখানে তার দরকারও দেখিনা। আমার বরং কিছু বেশি আগ্রহ ওই ৪১.৫ কোটি সংখ্যাটি নিয়ে, আত্মপক্ষ সমর্থনে যা আপনি পেশ করেছেন। বিগত দেড় দশকে নাকি এই সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে এসেছেন এ দেশে। দেশে অসাম্য বাড়লেও, সত্যিই যে দারিদ্র্য কমছে, তার প্রমাণ হিসেবে আপনি এটি পেশ করেছেন। কিন্তু, পেশ করবার সময়ে তার এপাশ-ওপাশটা একটু দেখে নিয়েছিলেন কি? ইউ এন ডি পি-র তৈরি এ হিসেবটি কিন্তু দেড় দশকের! মোদি সরকারের তরফে যে হিসেবটা আসলে পেশ করা হয়েছে সেটা হচ্ছে এই যে, ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১৩.৫ কোটি (দশ শতাংশ) মানুষ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছেন। তার অর্থ হচ্ছে, মোদি সরকারের আগের এক দশকেই দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে গিয়েছিল ২৮ কোটি মানুষ! ওটা ভারতীয় অর্থনীতির দীর্ঘকালীন ঘটনা। তার মধ্যে মোদিজির কৃতিত্ব খুব ব্যতিক্রমী বলে মনে হল কি?
(৭) আপনি বলেছেন, বিক্রমের অবতরণ-স্থানের নাম ‘শিবশক্তি’ রাখবার কারণটা হচ্ছে ইসরো-র মহিলা গবেষকদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, যেহেতু, ‘শক্তি’ বলতে উপনিষদে নারীশক্তি বোঝানো হয়েছে। আপনি এও বলেছেন, এই ঔপনিষদিক কল্পনাটি নাকি মানুষের শ্রেষ্ঠ বিমূর্ত কল্পনা। সে হতেও পারে, ঔপনিষদিক ঋষিদের কল্পনাশক্তির ওপর আমার খুবই আস্থা আছে। কিন্তু, স্বীকার করতে হবে, আপনার কল্পনাশক্তিও তাঁদের চেয়ে কম কিছু নয়। এখানে আমার আফশোস শুধু এই যে, চন্দ্রের ওই আধ্যাত্মিকতা-মণ্ডিত পুণ্যস্থানে যিনি শিবমন্দির গড়বার প্রস্তাব দিয়েছেন, সেই হিন্দুবীরটি এ প্রস্তাব দেবার আগে বোধহয় আপনার সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পাননি!
(৮) আপনি বলেছেন, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সব ধর্মের প্রতিই শ্রদ্ধা বজায় রাখা, ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা নয় — ফলে চন্দ্রাবতরণস্থলের নাম হিন্দু দেবতার নামে রেখে ধর্মনিরপেক্ষতার হানি হয়নি। এখন, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা সত্যি সত্যি কতটা ধর্মনিরপেক্ষ, সে নিয়ে বহু আলোচনা দীর্ঘ দিন যাবৎই হয়েছে, এখানে তার পুনরাবৃত্তি অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু যেটা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই সেটা হচ্ছে এই যে, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা প্রথম থেকেই দুর্বল, বিকলাঙ্গ এবং প্রতারণা-দীর্ণ। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন না করে তার সঙ্গে গা ঘষাঘষি করা, এবং স্বভাবতই সংখ্যাগুরু ধর্মের সঙ্গে একটু বেশি বেশি গা ঘষা — এই ফাঁক এবং ফাঁকিটি ওর মধ্যে প্রথম থেকেই রাখা আছে। উদারতার নাম করে এই যে চতুর প্রতারণা — হিন্দুত্ববাদ একে চমৎকার ভাবেই ব্যবহার করেছে। তবে কিনা, আগে যা ছিল লুকোনো প্রতারণা, মোদিজির আমলে তা পরিণত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার এক অবাধ এবং প্রকাশ্য ধর্ষণে — তফাত বলতে এইটুকুই। ধর্মীয় হিংস্রতা ও ঘৃণার অবাধ প্রচার, সংসদ ভবনে মহা সমারোহে যাগযজ্ঞ পুজো আর্চা, খোদ রাষ্ট্রপতিকেও সেখানে জাতপাতের কারণে প্রবেশাধিকার না দেওয়া — এসব এখন আমাদের দেশে অবাধে চলতে পারে, কেউ টুঁ শব্দটিও করতে পারেনা।
এসব নিয়ে বেশি কথা বলতেও ঘৃণা হয়, তাই আর কথা বলব না। শুধু এইটুকু বলব, যে, আমরা বোধহয় মেকি ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে সত্যিকারের সুস্থ সবল ধর্মনিরপেক্ষতা চেয়েছিলাম, প্রতারণার বদলে প্রকাশ্য ধর্ষণটা মোটেই চাইনি।
(৯) আপনি বলেছেন, সব দেশই মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত নানা জিনিসের নাম দেবার সময়ে পৌরাণিক নাম ব্যবহার করে। কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু, এ ব্যাপারে আপনাকে আগে যা বলেছিলাম সেটা আবারও বলি — ইউরোপ আমেরিকা চিন এইসব জায়গায় পুরাণ মানে নেহাতই প্রাচীন সাহিত্য ও লোককথা, ধর্ম নয় — ও দেশের চরম ধার্মিকেরাও আর ওসবে বিশ্বাস করেনা, আর সেকুলারদের তো প্রশ্নই ওঠেনা। সেখানে, ভারতে পুরাণ মানে শুধু ধর্ম নয়, তা বর্তমানে মৌলবাদী রাজনীতির হাতিয়ার। ফলত, ‘শিবশক্তি’ নাম শুধু পৌরাণিক বলেই চলনসই — এটা স্রেফ অপযুক্তি, বদ অভিপ্রায়কে ওভাবে ঢাকা যায়না। এমনকি, গান্ধি পরিবার সব কিছুতে নিজেদের নাম খোদাই করতে চাইত, সেই অজুহাতেও এ সর্বনাশকে সমর্থন করা যায়না।
(১০) আপনি বলেছেন, বিজ্ঞানীর বৈজ্ঞানিক সক্রিয়তা ও যোগ্যতার সঙ্গে তার ধর্মবিশ্বাসের কোনও সম্পর্ক নেই — যোগ্য বিজ্ঞানী অত্যন্ত ধার্মিক হতেই পারেন, আবার একজন বস্তুবাদী নাস্তিক আদৌ বিজ্ঞান না জানতে পারেন। এই যুক্তিতে আপনি ইসরো-প্রধানের প্রকাশ্য ধর্মাচরণকে সমর্থন করতে চেয়েছেন। যুক্তিটি দু দিক থেকে ভুল। প্রথমত, ব্যক্তি হিসেবে তাঁর ধর্মাচরণের অধিকার অবশ্যই আছে, কিন্তু একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের প্রধান হিসেবে সে ধর্মাচরণকে প্রকল্পের সঙ্গে জড়ানোর অধিকার মোটেই নেই, সেটা অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতার অবমাননা। কংগ্রেস আমলেও এ সব হত, অতএব হতেই পারে — এ যুক্তি প্রতারণামূলক। দ্বিতীয়ত, ধার্মিক ব্যক্তি কৃতী বিজ্ঞানী হতেই পারেন এটা যেমন ঠিক, তেমনি এটাও ঠিক যে, ধর্মমুক্ত বস্তুবাদী দর্শন বিজ্ঞানচর্চার পক্ষে অনেক বেশি অনুকূল। বেশি কথা বলার দরকার নেই, বিজ্ঞানের ইতিহাসের সঙ্গে নাস্তিকতা যুক্তিবাদ বস্তুবাদ এইসবের ইতিহাস পাশাপাশি রেখে পড়লেই সেটা আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারবেন। আপনি যে পরিসংখ্যান দিয়েছেন তার তাৎপর্য আপনি নিজেই অনুধাবন করতে পারেননি। খেয়াল করে দেখুন, ওর অর্থ হচ্ছে, আমেরিকার পঞ্চাশ শতাংশ বিজ্ঞানীই ধর্মবিশ্বাসী নন। এবার সর্বসাধারণের সঙ্গে তুলনা করুন, নিজেই বুঝবেন।
(১১) আপনি এতক্ষণ যা বলেছেন আমি তার বিরোধী হলেও, আপনার বক্তব্যগুলো অন্তত বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আপনার শেষ অনুচ্ছেদটির বক্তব্যটাই আদৌ বুঝিনি। মানুষ জীবনের অর্থ বুঝতে চায়, এবং যখন সে বিজ্ঞান জানত না তখন নানা কাল্পনিক জিনিস দিয়ে সেই অর্থ বানিয়ে নিত। আজ যখন সে বিজ্ঞান জানে, তখন আর কল্পনায় সেইসব উদ্ভট জিনিস বানানোর দরকার পড়বে না, সত্যিকারের অর্থ খোঁজার জন্য তখন সে প্রস্তুত। কাজেই, ধর্মবিশ্বাস থেকে মানুষ কেন বেরিয়ে আসতে পারবে না, এটা মোটেই বোঝা গেল না। আপনি বলেছেন, বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্য তখন ধর্মের স্থান নিয়ে নেবে, সেটাই তখন হবে বিকল্প ধর্ম।
আমার প্রশ্ন, সে তো নেবেই, কিন্তু তাকে আপনি ‘ধর্ম’ বলবেন কেন? ওটা ধর্মের বিকল্প, বিকল্প ধর্ম নয়।
— দেবাশিস্ ভট্টাচার্য