বিশ্বনাথ উদিত
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে যদি সমাজের মগজ ভাবা যায় তাহলে বলা যায় যে বর্তমান শাসক সমাজের মাথায় ক্রমাগত বাড়ি মেরে চলেছে। এই কুকর্মের নগ্ন প্রকাশ বিদ্যালয়ে নিয়োগ দুর্নীতি। এত মিথ্যা, এত লোভ, নারীসঙ্গ ও দুর্বৃত্ততার এমন নিঃসঙ্কোচ তাড়না এ বঙ্গে স্বাধীনতার পর কখনও ঘটেনি
জিম্বাবোয়ে আফ্রিকার একটা ছোট রাষ্ট্র। হতদরিদ্র ও সার্বিকভাবে ব্যর্থ। ২০০০ সালে দেশের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক একটা লটারির আয়োজন করে যারা নভেম্বর মাসভর এই ব্যাঙ্কে নিজেদের অ্যাকাউন্টে কমপক্ষে ৫০০০ ডলার রেখেছে তাদের নিয়ে। লটারির অনুষ্ঠানে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। সভাপতি টিকিট তুলে নাম পড়তে গিয়ে থমকে গেলেন। ধাতস্থ হয়ে ভাল করে দেখে ধীরে ধীরে পড়লেন— র-বা-র্ট মুগাবে; দেশের প্রেসিডেন্ট। ব্রিটিশ দখলদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে এই ‘মাননীয়’ ব্যক্তি একজন নেতা ছিলেন। .১৯৮০ সালে স্বাধীনতা পেয়ে অন্যদের টপকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্রমশ আইন পাল্টে নিজে প্রেসিডেন্ট হন এবং একনায়ক হয়ে ওঠেন। তারপর প্রায় তিন দশক ধরে চলতে থাকে খুন্, ধর্ষণ, জেলে ভরা, অনুগতদের কাজ দিয়ে ও নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে বিরোধী দলকে গ্রাস করা এবং নির্বাচনী প্রহসন। কখনও ৮০ শতাংশ ভোট পেয়ে আইনসভার প্রায় সব আসন জেতা, যার প্রায় অর্ধেক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, তারপর জনপ্রিয়তা কমলে কোনওমতে জিতেই দমনপীড়ন চালিয়ে আবার ভোট-ব্যবধান বাড়িয়ে ক্ষমতা সুরক্ষিত করা। এমন দাপট যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থীরা সরে দাঁড়ান। এভাবে এই ব্যক্তি ক্ষমতার দম্ভে চাইলেই লটারিও জিততে পারেন।
ছকটা কম-বেশি পরিচিত লাগছে না? সে-দেশে তোলাবাজিটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিলেও স্কুলে চাকরির জন্য তোলাবাজির নির্দিষ্ট খবরটা আমাদের জানা নেই। তবে টাকা লুঠ, জাল-জুয়োচুরি, প্রতিশ্রুতিমান প্রতিবাদী তরুণকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া বা দুষ্কৃতীদের বোমা-বন্দুক জুগিয়ে মদত দেওয়া এবং পুলিশ দিয়ে এসব দমন করার পরিবর্তে প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে গাঁজাখুরি মামলা দিয়ে তাকে দমন করা, এসব কোনও নতুন কৌশল নয়। আমরা ভাবি আফ্রিকা! যেখান থেকে একসময় বন্দুকের বিনিময়ে ক্রীতদাস সরবরাহ হত ইউরোপের দেশগুলোতে, সেখানকার লোকেরা তো গণতান্ত্রিক চেতনায় তেমন সমৃদ্ধ হয়নি, তাই সেখানে আগুন লাগানো থেকে শুরু করে গৃহযুদ্ধ এবং স্বৈরাচার নতুন ঘটনা নয়। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দুর্ভাগা এই মহাদেশে গণতন্ত্র এখনও পায়ের তলায় শক্ত মাটি পায়নি তাই মানবাধিকার লঙ্ঘন যেন স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আমাদের ইতিহাসটা তো অন্যরকম। বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায়। রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, দেশবন্ধু, সুভাষদের ঐতিহ্য পৃথিবীর যে-কোনও দেশের কাছে ঈর্ষণীয়। বাংলার বাইরেও শিক্ষিত মানুষ এই আদর্শের কথা বলে। সে-আদর্শ নির্ভীক হতে শেখায়, মিথ্যাকে ঘৃণা করতে শেখায়। সেই আদর্শ ভুলে আমরা এত মিথ্যা আর জালিয়াতির মধ্যে ডুবে গেলাম কীভাবে? যেন প্রতারণায় প্রলেপ দিতেই যত্রতত্র সব মহাপুরুষদের মূর্তি, সে যত নিম্নমানেই গড়া হোক, বসানো হয়েছে।
বর্তমান আলোচনার পরিধি আমরা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। যদিও ভয়াবহ ঘটনা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলেছে। যেমন মণিপুরে জাতিদাঙ্গা ও হরিয়ানায় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। দুই ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ বিচারব্যবস্থাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে মানুষের দুর্গতি থামানোর জন্যে। দুই ক্ষেত্রেই প্রশাসনের একপেশে সক্রিয়তা আমাদের চিন্তায় ফেলে কারণ নিরপেক্ষ প্রশাসন আইনসভা ও বিচারব্যবস্থা সম্বন্ধে আমাদের সংবিধানে যেমন ভাবা হয়েছে সেই কার্যকরী ভূমিকার জন্য, যার অর্থ গণতন্ত্রের সজীবতার জন্য, অপরিহার্য। আমরা এইসব ঘটনাকে প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয়ের লক্ষণ হিসাবে ধরতে পারি। এমন বিপর্যয় আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও ঘটে চলেছে। স্বল্প পরিসরের বর্তমান আলোচনায় আমরা প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের দিকেই নজর রাখব।
সাময়িক পদস্খলন দুর্ভাগ্যজনক হলেও তার প্রভাব দ্রুত মুছে ফেলা যায়। কিন্তু অবক্ষয় যখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় দুর্ভাগ্যের শিকড়ও গভীরে প্রোথিত হয়। এখানে বলে নেওয়া ভাল যে আমরা প্রতিষ্ঠান শব্দটা ব্যপক অর্থে ব্যবহার করছি। প্রতিষ্ঠান তা-ই যা সাধারণভাবে মানুষের মনে এবং আচরণে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারালয়, সংবিধান, মহাত্মা গান্ধি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সংবিধানে লিখিত ও সর্বোচ্চ আদালতের ব্যখ্যায় সমৃদ্ধ ব্যক্তিস্বাধীনতা, ইত্যাদি। কোনও কার্যালয় বা কর্মকর্তা থাকাটা আবশ্যিক নয়, মানুষের চিন্তায় ও কাজে ধারণার প্রভাবটাই বিবেচ্য। সমাজ গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠে, আবার সমাজের প্রগতি বা অধোগতিতে প্রতিষ্ঠান ভেঙেও যায়। যেমন আমরা সমাজের প্রয়োজনে জমিদারি প্রথা (প্রতিষ্ঠান) রদ করেছি। এটা সুচিন্তিত সামাজিক অগ্রগতি। আবার অন্ধ ব্যাভিচারী মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে রাজনৈতিক আস্ফালন, এগুলি রাষ্ট্রের ব্যর্থতার ইঙ্গিত। প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে বহু সভ্যতা ক্রমশ মলিন হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গেও এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট যা আমরা আলোচনা করব।
বামফ্রন্টের সময়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে রাজনীতির দুরন্ত প্রবেশ ও শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক অধোগতির সূচনা। একথা মেনেও বলার থাকে যে অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন কাঠমো সেইসময় চূড়ান্তভাবেই গণতান্ত্রিক ছিল, যদিও এই কাঠামোর মধ্যে থেকেও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সমস্ত পন্থাই নিয়েছিলেন তখনকার শাসক। এটা প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে না ফেলে মোচড় দেওয়া বলা যেতে পারে, যাকে ‘অনিলায়ন’ নাম দেওয়া হয়েছে। তৃণমূল এসে ‘পার্থায়ন’ করল। বামফ্রন্টের কোনও শিক্ষামন্ত্রীর মাথায় আসেনি বা সাহস হয়নি এ-কথা বলার যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে “মাইনেটা তো আমিই দিই” কাজেই আমার কথা শুনতে হবে। যে সরকারের শিক্ষামন্ত্রী এমন দুরাত্মার মতো কথা বলেও নির্বিঘ্নে চলতে পারেন সে সরকার যে উচ্চশিক্ষার বহুদিনের স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর মর্ম বোঝে না, কাজেই তা ভেঙে ফেলতে দ্বিধা করবে না, তা সহজেই অনুমান করা যায়। এই ‘মাননীয়’ শিক্ষামন্ত্রী বান্ধবী-সহ টাকার পাহাড়ে পিছলে জেলে গেলেও তার ফরমান কার্যকরীই আছে। এই কাজের পদ্ধতি হল উপাচার্য ও অন্যান্য কর্মকর্তা হিসেবে অযোগ্য ও অনুগত ব্যক্তিদের নিয়োগ করা। বামফ্রন্ট এই কাজটা করেছিল অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন কাঠামোটাকে অটুট রেখে। তাদের সময়ে ক্রমাবনতির মধ্যেও দীর্ঘদিন বিরোধী শিক্ষকদেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, সরকার পরিবর্তনের পর বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালন-কাঠামোটাই বাস্তবিকপক্ষে গৌণ হয়ে গেছে, তার সঙ্গে শিক্ষকদের মান।
বর্তমানে রাজ্যের আর্থিক সাহায্যপ্রাপ্ত একত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভবত সবকটিতেই দীর্ঘদিন যাবত উপাচার্য পদটি খালি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এমন ছেলেখেলা কখনও কোথাও হয়েছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। এতে সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব মলিন হয়েছে। যুগ যুগ ধরে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, তাকে ভেঙে ফেললে নতুন করে গড়ে তোলাও যুগের প্রতীক্ষা, কারণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মানুষের মানসিকতা। একটু ব্যখ্যা করে বলা যাক। “মাইনেটা তো আমিই দিই” পর্যায় থেকে খেলাটা আরও উচ্চগ্রামে পৌছে গেছে। রাজ্যপালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আচার্য হবেন এবং সরাসরি উপাচার্য নিয়োগ করবেন। উপাচার্য ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় চলে, যেমন শিক্ষা ছাড়াও জীবন চলে। উপাচার্য হবেন ছেলেখেলার বস্তু, বাপুরাম সাপুড়ের সাপের মতো। তার মর্যাদা নেই কিন্তু পদ তো আছে! বামফ্রন্ট আমলেই এই ধারা দৃশ্যমান হয়েছিল, এখন তা ক্রমশ ক্ষুরধার নদীর আকার নিচ্ছে। এটা সংস্কৃতির অবক্ষয়। ক্যাম্পাসের মধ্যে এখন রাজনৈতিক আনুগত্য দিয়ে সুযোগসন্ধান চলছে। আনুগত্যের পুরস্কার ব্রিটিশ আমলেও ছিল, কিন্তু আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম আমাদের মাটিতে ভয়শূন্য চিত্তে মাথা উঁচু করে আমরা চলব।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে যদি সমাজের মগজ ভাবা যায় তাহলে বলা যায় যে বর্তমান শাসক সমাজের মাথায় ক্রমাগত বাড়ি মেরে চলেছে। এই কুকর্মের নগ্ন প্রকাশ বিদ্যালয়ে নিয়োগ দুর্নীতি। এই লেখা যাঁরা পড়বেন তাঁরা সকলেই এ-বিষয়ে অবহিত। এত মিথ্যা, এত লোভ, নারীসঙ্গ ও দুর্বৃত্ততার এমন নিঃসঙ্কোচ তাড়না এ বঙ্গে স্বাধীনতার পর কখনও ঘটেনি। নেহাত একজন বিচারপতির দৃঢ়তায় দুর্নীতির গভীরতা অনেটাই প্রকাশ পেয়েছে, সম্ভবত অনেকটাই এখনও নয়। তবু নেই কোনও লজ্জাপ্রকাশ বা দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ। এর আগে আমরা দেখেছি সারদা বা নারদ কাণ্ডে তদন্ত বন্ধ হয়ে যেতে। মনে পড়ছে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের একটা অভিজ্ঞতা। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে তিনি ইংল্যান্ডে গেছেন জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ডের বছর খানেক পরে। সেই সময়ে খবর ছড়াতে অনেক সময় নিত। ইংল্যান্ডে বিস্তারিত খবর পৌঁছচ্ছে, আলোচনা ও ধিক্কার যখন তুঙ্গে তখন একজন ইংরেজ সহপাঠী মন্তব্য করেছিলেন— যে-দেশ এমন বর্বরতা মেনে নেয় তার এমনই প্রাপ্য। জেনারেল ডায়ারের বন্দুকের গুলির মতো নিয়োগ কেলেঙ্কারির একেকটি ঘটনা আমাদের বিবেক, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে, তা সহ্য করার জন্য আমাদের চেতনা অবশ হয়ে গেছে। গুলিটা চলেছিল একজন বিদেশি সৈন্যাধ্যক্ষের নির্দেশে, তার প্রায় একশো বছর পরে আঘাতটা এল কার নির্দেশে?
বিদ্যালয়গুলি একেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যা আমাদের মনে স্থায়ী আসন নিয়ে থাকে। সেখানে টাকার বিনিময়ে অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্তদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করলে যে বঞ্চনা হয় তা শুধু শিক্ষার নয়, ছেলেমেয়েদের সম্পূর্ণ সত্তার। বিদ্যালয়ে তো ছেলেমেয়েরা শুধু পাঠ্যবস্তুটুকুই শেখে না, তারা মৌলিক চারিত্রিক ও ব্যবহারিক শিক্ষাও পায়। এই বোধ যার নেই তার উপর যদি পরিচালনার দায়িত্ব থাকে তাহলে শিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয় রোধ করার সাধ্য কার? বিদ্যালয় যেভাবে ইচ্ছা চলুক আমরা নিজেদের স্বার্থ বুঝে নেব। একেই কি বলে এপাং ওপাং ঝপাং/আমরা সবাই ড্যাং ড্যাং?
দুর্নীতি যখন মজ্জায় প্রবেশ করে তখন তার প্রকাশ শুধু একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তা ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচন তেমনই একটি উদাহরণ। মণিপুরের মতো গৃহযুদ্ধ এখনে বাধেনি ঠিকই, তবে সেখানকার তুলনায় অর্ধেক মানুষ পশ্চিমবঙ্গে মারা গেছে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ভারতবর্ষের আর কোনও রাজ্যে এমন বর্বরতা দেখা যায় না। শিক্ষাব্যবস্থার যে ভগ্নপ্রায় অবস্থা তার কলুষ তো কিছু মানুষকে ছাগলে পরিণত করবেই, তারা ব্যালট কাগজ চিবিয়ে খাবে, গুঁতোগুঁতি করে ব্যালট বাক্স পুকুরে ফেলবে, তা দেখতেই হবে। শিশুর খেলার স্থানে বোম পড়ে থাকলে শিশু জখম হবেই। বোমা ফেটে বাড়ি উড়ে যাক, মানুষ মরে যাক, পুলিশ জানে কার বিরুদ্ধে গুরুতর আর কার বিরুদ্ধে লঘু কেস দিতে হবে। অর্থাৎ যে-কোনও ইতর কাজ করে পার পাওয়া যায় যদি তা উপযুক্ত রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় হয়। তখন ইতর কাজের পুরস্কার পেতে আর বাধা থাকে না— তোলাবাজির সুযোগ, নানাভাবে কমিশন আদায়ের সুযোগ, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সুযোগ, ইত্যাদি। এই সুযোগগুলেই ইতরামির হাতছানি। দুর্বল শিক্ষা, প্রসারিত দারিদ্র্য, কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা, তার সঙ্গে সামাজিক সহনশীলতা দুর্বলচিত্ত কিছু লোকের কাছে হাতছানিকে করে তোলে অমোঘ। এই দুষ্টচক্র ভাঙা সম্ভব, কিন্তু তার জন্য চাই একটা বিরাট ধাক্কা, যা আসতে পারে বিভিন্নভাবেই, তবে সেই আলোচনায় আমরা এখন যাব না।
সিয়েরা লিয়ন আফ্রিকার পশ্চিম উপকুলের একটা অতি দরিদ্র দেশ, আগে ক্রীতদাস সরবরাহের একটি কেন্দ্র ছিল। ১৯৮০ সালে সে দেশের প্রেসিডেন্টের আর্থিক নীতিকে অপব্যায়ী বলে সমালোচনা করেছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের (আমাদের যেমন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক) প্রধান। কিছুদিনের মধ্যেই সেই ব্যাঙ্কেরই ইমারতের সর্বোচ্চ তলা থেকে তাঁকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। তারপরেও প্রেসিডেন্ট সিয়াকা স্টিভেন্স দীর্ঘদিন স্বপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য মাত্র, সারা দেশ ও বিচারব্যবস্থা এখানকার কাজকর্ম দেখতে পায়। তবু, সিয়েরা লিয়নের সেই ঘটনার চার দশক পরে, এ রাজ্যের পুলিশের বিরুদ্ধে হাওড়ার আনিস খানের পরিবারের অভিযোগ গভীর রাতে থানা থেকে গিয়ে তারা ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে বিরোধী রাজনীতির এক প্রাণবন্ত যুবক আনিসকে। তদন্তের নামে অনেক নাটকের পরও আনিসের পরিবার মৃত্যু-তদন্তের গ্রহণযোগ্যতা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে, যদিও রাজ্য পুলিশের সে তদন্তেও পুলিশের যোগ অস্বীকার করা হয়নি।
প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা বা বিপরীত সক্রিয়তা একটা প্রাতিষ্ঠানিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত। গণতন্ত্রের দ্বিতীয় স্তম্ভ প্রশাসনই যদি আইন না মানে, বিচারব্যবস্থাকে নানাভাবে অকেজো করতে সচেষ্ট হয়, তাহলে সভ্য রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়ে যায়। সম্প্রতি উচ্চ আদালতের বিচারকদের নানাভাবে হেনস্থা করার চেষ্টার কথা সবারই মনে থাকার কথা। পুলিশি তদন্ত সম্বন্ধে মানুষ আস্থা হারিয়েছে অথচ অত্যন্ত মেধাবী ছেলে-মেয়েরা পুলিশের উচ্চ পদে কাজ করছে। মেধার এমন অপব্যবহার স্বৈরতন্ত্রেই ঘটে থাকে। আমাদের সংবিধান লেখা হয়েছে যথেষ্ট বিস্তারিতভাবেই, বস্তুত বিশ্বের সবচেয়ে বিস্তারিত সংবিধান আমদেরই। তারপর সর্বোচ্চ আদালতের ব্যাখ্যায় লিখিত সংবিধান আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তাতেই তো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না, বাস্তবে আইনকে কার্যকর করার দায়িত্ব প্রশাসনের। তারা যদি প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে নির্যাতন করে আর অপরাধীকে দেয় ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াবার নিরাপত্তা, তাহলে আদালতের পক্ষে আইন প্রতিষ্ঠা করা দুরূহ হয়ে ওঠে। এখানেই বিশ্বাসের প্রশ্ন। আন্যতম সংবিধানপ্রণেতা বি আর আম্বেদকর এই প্রসঙ্গেই বলেছিলেন সংবিধান ততটাই কার্যকরী হতে পারে আমরা তাকে যতটা হতে দেব। দুরাচারী শাসকেরা তা জানে তাই বিচারের জাঁতাকলে পড়লে ধৃষ্টতাও মাত্রাছাড়া হয়, ‘মাইনেটা তো আমিই দিই’ ধাঁচে বুক বাজিয়ে বলে ‘আমরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, বিচারকেরা নয়।’
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ ও তাদের আচরণ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে অভিযোগ চলে আসছে। নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, তা-ও হয়ে গেছে খেলার বস্তু। বিশ্বাসই হারিয়ে গেছে। অনৈতিক কাজকর্ম দীর্ঘদিন চলার একটা অবক্ষয়ী প্রভাব এই যে মানুষ তা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তার ফলে তা সহনসীমার মধ্যে এসে যায়, যেমন মিথ্যা বারবার শুনলে তা কখনও-বা সত্য বলে ভ্রম হয়। “যেন রসনায় মম/সত্য বাক্য ঝলি উঠে খরখড়্গসম/তোমার ইঙ্গিতে”— এ তো কবির কথা, পরিবার নিয়ে বাস করতে গেলে এসব গোঁয়ার্তুমি চলে না, বিষেশত গ্রামেগঞ্জে। বুঝে চলতে হয়, সহনশীল হতে হয়।
অথচ কী গৌরবময় আমাদের ঐতিহ্য!
দুশো বছরের বেশি আগে (১৮১৭ সালে) রাজা রামমোহন রায়ের পরম বন্ধু ডেভিড হেয়ার হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন (যা প্রায় চার দশক পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ নামে পরিচিত হয়)। এক দশক কাটতে না কাটতেই এই কলেজে অধ্যাপক হয়ে যোগ দেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। মুক্তচিন্তার দমকা বাতাসের মতো তিনি ছাত্রদের নাড়া দেন, খোলা মন নিয়ে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস ও নানা সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে যুক্তি বিস্তার করেন যা বহু বুদ্ধিমান ও দৃঢ়চেতা ছাত্রকে আকৃষ্ট করে। তারুণ্যের বাধভাঙা উচ্ছ্বাস অভিভাবকদের শঙ্কিত করে এবং তাদের চাপে পাঁচ বছরের মধ্যেই ডিরোজিও পদত্যাগ করেন। অচিরেই তিনি কলেরায় মারা যান কিন্তু বাংলার নবজাগরণে রামমোহন ও হিন্দু কলেজের মতো ডিরোজিও একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত হন। সম্ভবত এই ছিল বাংলার শিক্ষাজগতে প্রতিষ্ঠান গড়ার সূত্রপাত। তারপর আরও অনেক নক্ষত্র বাংলার আকাশ উজ্জ্বল করেছেন— বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ, মাঝে ও পরে আরও কত বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ। সেই সূচনার প্রায় দুশো বছর পরে, আজকে বাংলার শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রায় সব মাথাই— সদ্য-প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী-সহ— জেলে বন্দি। যে দৃঢ়চেতা বিচারপতির সক্রিয়তায় রাজ্য সরকারের সমস্ত বাধা পেরিয়ে দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে তিনি হয়তো প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য হবেন, ভবিষ্যত বলবে। বিচারের প্রতিষ্ঠানে এখন দুর্নীতিই আবার প্রতিষ্ঠান গড়বে, এটাই পরিহাস। তাই আমাদের রাজ্যে শিক্ষা, নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার মান আজকে গভীর সঙ্কটে। এই আবর্ত থেকে নিশ্চয় আমরা বেরিয়ে আসব তবে বর্তমান প্রজন্ম ইতিমধ্যেই অবক্ষয়ের ফলে প্রতিকারহীন ক্ষতিগ্রস্ত।
*মতামত ব্যক্তিগত