হান্নেলে পোহ্য়ানমিস
কথোপকথনে: নিরুপম চক্রবর্তী
হান্নেলে পোহ্য়ানমিস একজন ফিনিশ লেখক ও অনুবাদক, থাকেন হেলসিঙ্কির কাছেই এসপো-তে। গত বেশ কয়েকবছর ধরেই তিনি একনিষ্ঠভাবে বাংলা কবিতার অনুবাদ করে চলেছেন ফিনিশ ভাষায়। কাজটা নানা কারণেই অত্যন্ত কঠিন ও শ্রমসাপেক্ষ, ফলত বিশেষভাবে প্রশংসনীয়ও বটে, কিন্তু পরিতাপের বিষয়— হাতে-গোনা কিছু মানুষ ছাড়া বাংলার কেউই হান্নেলে ও তাঁর কাজের বিষয়ে আদৌ ওয়াকিবহাল নন। আমাদের মনে হয়েছে, এটাই সময় হান্নেলে ও তাঁর কাজের সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। হান্নেলের অনুবাদকর্মের প্রতি আমাদের আগ্রহের কথা জানতে পেরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক ও কবি, অধুনা প্রাগ-প্রবাসী নিরুপম চক্রবর্তী তাঁর সঙ্গে কথা বলেন, ও তাঁকে আমাদের ইচ্ছের কথা জানান। নিরুপমবাবুর প্রস্তাবে হান্নেলে খুশি হয়েই রাজি হওয়ায়, নিরুপমবাবু আলাপচারিতার ভিত্তিতে, এবং ই-মেল মারফত, তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন। সেই সাক্ষাৎকারটি আমরা এই সংখ্যায় প্রকাশ করলাম। সাক্ষাৎকারটি ঈষৎ দীর্ঘ, তা সত্ত্বেও আমরা এটির পূর্ণাঙ্গ পাঠই, একেবারে দাঁড়ি-কমা সমেত, প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, আমাদের মনে হয়েছে, কোন তাড়না থেকে একজন ফিনিশ কবি ও লেখক বাংলা কবিতার অনুবাদ শুরু করলেন, ভাষা ও সংস্কৃতির ব্যবধান অতিক্রম করার পথে কী কী বাধার পাঁচিল তাঁকে পেরোতে হল— ইত্যাদি প্রশ্নের আনুপূর্বিক উত্তর পেতে পুরো মানুষটিকেই আমাদের জানা দরকার। মূল সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে ইংরেজিতে; চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে সেটির তন্নিষ্ঠ বাংলা তরজমা প্রকাশ করা হল…
নিরুপম চক্রবর্তী: এটা একইসঙ্গে আশ্চর্যজনক এবং আক্ষেপের যে, বাংলা কবিতাকে ফিনিশ ভাষায় অনুবাদ করার একটা কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্যে তুমি দীর্ঘদিন ধরে রয়েছ, অথচ আমরা তার প্রায় কোনও খবরই রাখি না। আমরা চাই বাংলার কবিতাপ্রেমী মানুষের সঙ্গে তোমার একটা পারস্পরিক পরিচয় ও যোগাযোগের পথ তৈরি হোক— এবং সেখানে আমার ভূমিকাটা, আমি যতদূর ভেবেছি, হবে সেতুবন্ধনের। কীভাবে সেটা করে ওঠা যায় সেটা ঠিক করা দরকার, তবে তারও আগে আমি চাই আমার ভাষার পাঠকদের সঙ্গে তোমার একটা প্রাথমিক পরিচয় অন্তত করিয়ে দিতে।
বাঙালি পাঠকদের অবগতির জন্য এখানে উল্লেখ করতে চাই— হান্নেলে, তাঁর সাহিত্য এবং ব্যক্তিগত জীবনেও, রবীন্দ্রনাথে আদ্যন্ত ডুবে থাকা এক নারী। তাঁর বাড়ির দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের বিশাল প্রতিকৃতিটি আমি যতবারই দেখি, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় তাঁর এই ডুবে থাকার ব্যাপারটা আমি অনুভব করতে পারি। মনে হয়, যেন খুব অল্প বয়স থেকেই কবির সঙ্গে তাঁর এই যোগাযোগ তৈরি হয়ে উঠেছে।
কিন্তু, কেন রবীন্দ্রনাথ? কেন রবীন্দ্রনাথই? হান্নেল, যদি এই ব্যাপারটা তুমি আমাদের একটু বুঝিয়ে বলো…
হান্নেলে পোহ্য়ানমিস: ভাল প্রশ্ন! এবং, বেশ সময়োপযোগীও! অতি সম্প্রতি আমি একটা কাজ শেষ করলাম— একটা জীবনীমূলক প্রবন্ধসংগ্রহ ও বেশ কিছু কবিতা এবং ছোটগল্পের অনুবাদ— ‘টেম্প্ল অফ দ্য উইন্ড্স’— যে বইটা এই নভেম্বরেই প্রকাশিত হওয়ার কথা। আমার জীবনে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ও প্রাসঙ্গিকতা কতটা গভীর ও বিপুল, এ বইটার কাজ করতে গিয়ে তা আমার বারবার উপলব্ধি হয়েছে। ওঁর অনেকগুলো কবিতার অনুবাদ আমি এই বইটায় রেখেছি, এবং ওঁকে নিয়ে একটা প্রবন্ধও।
তুমি হয়তো জানো, আমার বাড়ি এবং পারিবারিক মূল্যবোধ ঠিক তথাকথিত ফিনিশ পরিবারের মতো নয়। আমাদের এটা ঠিক বাড়ি নয়, বলতে পারো, ছিল একটা মন্দির। আমার বাবা-মা ছিলেন অসম্ভব ধর্মপ্রাণ ও ঈশ্বরবিশ্বাসী, যাকে বলে একেবারে ‘ডিভোটেড থিওসফিস্ট’। ফলে ভারত সম্পর্কে, ভারতীয় ধর্ম সম্পর্কে খুব অল্প বয়সেই আমি অনেকটা জানতে পেরেছিলাম। বাবা ছিলেন লেখক ও সুরকার, মা-ও অসম্ভব ভাল কবিতা আবৃত্তি করতেন। ওঁরা দুজনে মিলে নিয়মিত কনসার্ট করতেন। ফলে, আমি একরকম কবিতা আর সঙ্গীতের মধ্যেই বড় হয়ে উঠেছি।
তো, সেভাবেই, রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গেও আমার পরিচয় ঘটে একেবারে ছোটবেলাতেই। তখন মোটে ওঁর দুটিই কাব্যগ্রন্থ পাওয়া যেত ফিনিশ অনুবাদে— একটা হল ‘পুতারহুরি’[1], আর একটা গীতাঞ্জলি[2]।
আমাদের বাড়িটা ছিল আদতে একটা খামারবাড়ি— যাকে তোমরা বলো ‘ফার্মহাউস’। আমি যখন পাঁচ বছরের, তখন থেকেই গরু-ভেড়াদের মাঠে চরাতে নিয়ে যেতাম আমি। পরে বড় হয়ে হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতিবিদ্যা ও ভূগোল নিয়ে পড়াশোনা করি। ১৯৭৫ সালে স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ করার পর, প্রায় ১০ বছর একটি এনসাইক্লোপিডিয়া-র সম্পাদনার কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই সূত্রে আমায় প্রচুর পড়তে হত, লেখা ও সম্পাদনার কাজও করতে হত অনেক। লিখতে হত মূলত মনস্তত্ত্ব, পরিবেশ, বৈশ্বিক নানা সমস্যা ও উন্নয়নশীল দেশগুলির বিষয়ে।
তো, এইসব করতে করতে আট দশকের মাঝামাঝি একটা সময়ে আমি আবিষ্কার করি, অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক কবিতা আছে, যা ফিনিশ অনুবাদে নেই। সেই থেকেই শুরু হয় খুঁজে-খুঁজে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ার একটা সচেতন চর্চা। ইংল্যান্ড ও জার্মানি থেকে অর্ডার দিয়ে ওঁর কবিতার বই আনাতে শুরু করি। সেই সঙ্গেই শুরু করি ওঁর কবিতা অনুবাদ করতেও— তবে শুরুতে সে ছিল কেবল নিজের জন্যই— নিজেরই ভালবাসার তাগিদে। আমার অতীত, আমার ঈশ্বরবিশ্বাসী পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার প্রভাব, এমনকী রাখালির কাজে মাঠে-মাঠে ঘুরে বেড়ানো— এই সবকিছুই, আমার বিশ্বাস, আমায় রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে বুঝতে সাহায্য করেছিল। মনে হতে পেরেছিল— তিনি আমার একান্ত আপনার লোক— আমার মাটির একেবারে কাছাকাছি।
এটাই, বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথকে আমার বুঝতে শুরু করার প্রাথমিক প্রেক্ষাপট। কিন্তু, যদি জিজ্ঞেস করো, এমন কী আছে ওঁর কবিতায়, যা আমায় এভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়… আমি বলব, তা ওঁর লেখার বহুস্তরবিশিষ্টতা। অর্থের ও দ্যোতনার কত গহীন সব স্তর! কত অন্তর্লীন সব স্রোত! কী গভীর প্রকৃতিচেতনা! তোমাদের বুদ্ধদেব বসু যেমন লিখেছেন, “নানা ক্রম-অপসৃয়মান মুহূর্তের কবি তিনি— ভোরের বেলাতেও মনে-রেশ-রেখে-যাওয়া রাতের স্বপ্নের মতো, অতীতের অসংখ্য স্মৃতির মতো— এমন সব অনুভবের যাদের আমরা কোনওভাবেই সংজ্ঞায়িত করতে পারি না…”[3]
আর যখন টেগোরকে একজন ব্যক্তিমানুষ হিসেবে দেখি, তখন সবচেয়ে বেশি টানে ওঁর জীবনকে দেখার, তাকে নিজের অভিজ্ঞতার আলোয় অনুবাদ করে নেওয়ার সাহস! কী অসমসাহসী একজন মানুষ! কত দুঃখ এসেছে জীবনে! কত হতাশার অন্ধকার! কত ভয়! কত লড়াই! অথচ দ্যাখো, একবারের জন্যও সাহস হারাননি তিনি। কত দুঃখের তিমিরের মধ্যে দিয়ে নিজের জীবনকে তিনি মানে দিয়েছেন। গড়েছেন— শুধু নিজের জীবনকে নয়— এমনকী নিজের সময় ও সমাজকেও! এই লড়াইগুলোই আলো ফেলেছে তাঁর কবিতাতেও। ওঁর এই সাহস আর জীবনকে নতুন করে মানে দেওয়ার প্রগাঢ় দার্শনিকতার বোধ আমাকেও যে কতখানি শক্তি দিয়েছে, সে আমি বলে বোঝাতে পারব না।
বাঃ, সুন্দর বললে! এবার একটু জানতে চাইব তোমার করা রবীন্দ্রনাথের অনুবাদগুলির প্রসঙ্গে। তুমি যদি একটু বিশদে তোমার বাঙালি পাঠকদের জানাও কোন কোন কাব্যগ্রন্থ তুমি অনুবাদ করেছ, সেগুলি কোথা থেকে প্রকাশিত হয়েছে… এমনকী তাদের চমৎকার প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণগুলি কারা করেছেন, সে কথাও যদি খানিক বলো আমাদের…
এ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের ন-টি কাব্যগ্রন্থ আমি অনুবাদ করেছি। সেগুলি হল:
Rakkauden laulu, সংস অফ লাভ। এটি মূলত ওঁর প্রেমপর্যায়ের গানগুলির একটি ছোট সঙ্কলন। হেলসিঙ্কি থেকে ২০০২ সালে বইটি প্রকাশ করেছে কিরিয়াপায়া। Rakkauden lahja, লাভার্স গিফট, ১৯১৮ ও Hedelmätarha, ফ্রুট গ্যাদারিং, ১৯১৬। বই দুটি প্রকাশ করেছে মেমফিস বুকস, হেলসিঙ্কি থেকে, ২০০৬ ও ২০০৭-এ। তা ছাড়া রয়েছে Tähtitaivaan runot, পোয়েম্স ১৯৪২, মেমফিস বুক্স হেলসিঙ্কি ২০০৮; Toiselle rannalle, ক্রসিং ১৯১৮, কিরিয়াপায়া হেলসিঙ্কি, ২০০৯; Kuukeinu, দ্য ক্রেসেন্ট মুন, থেরাপিয়া-সাতিও, হেলসিঙ্কি ২০১০; Gitanjali, ব্যাসাম বুক্স, হেলসিঙ্কি ২০১৩; Sininen sari, দ্য ব্লু সারি [শাড়ি], আ সিলেকশন অব লাভ পোয়েম্স, ব্যাসাম বুক্স, হেলসিঙ্কি, ২০১৪; এবং Puutarhuri, দ্য গার্ডেনার, ব্যাসাম বুক্স, হেলসিঙ্কি, ২০১৯।
প্রতিটি বইয়ের ক্ষেত্রেই আমি বেশ দীর্ঘ, সবিস্তার মুখবন্ধ বা প্রাক্কথন লিখেছি— তার একটা কারণ, ফিনিশ পাঠকের সঙ্গে কবিকে পরিচিত করানোর একটা বড় দায় আমার ছিল। এবং, তুমি জানো যে, ফিনিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনও জীবনী নেই। ফলে, আমায় এই বাড়তি দায়িত্বটা নিতেই হয়েছে। যেমন, ‘লাভার্স গিফ্ট’ বইটির মুখবন্ধে তাঁর জীবন ও সাহিত্যকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছি; ‘ফ্রুট গ্যাদারিং’ বইটির মুখবন্ধে রেখেছি তাঁর ধর্মবিষয়ক ভাবনাচিন্তার কথা। ‘দ্য পোয়েম্স’ বইটির শুরুতেও আমি প্রায় ৩০ পাতা জুড়ে তাঁর কবিতা এবং জীবন নিয়ে খুঁটিয়ে আলোচনা করেছি। তুলনায়, ‘দ্য ক্রেসেন্ট মুন’ এবং ‘দ্য ক্রসিং’-এর ক্ষেত্রে অবশ্য ভূমিকার আয়তন ছোট। আবার ‘গীতাঞ্জলি’-র অনুবাদ করতে বসে আমি খুব বিশদ ভূমিকার আশ্রয় নিয়েছি— প্রায় ৩০ পাতা জুড়ে আলোচনা করেছি তাঁর গীতিকবিতার প্রধান সূত্রগুলি। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা দরকার যে, গীতাঞ্জলি-র অনুবাদে আমি সাহায্য নিয়েছি রদেনস্টাইন-পাণ্ডুলিপির (যার ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ সম্প্রতি প্রকাশ করেছে তোমাদের সাহিত্য সংসদ, ২০০৯ সালে) ও আরও একাধিক অনুবাদের। আবার, ‘দ্য ব্লু সারি’ (শাড়ি) এবং ‘দ্য গার্ডেনার’-এও আমি বেশ বড়— প্রায় ২০ পাতাজোড়া ভূমিকা রেখেছি।
অনুবাদের পাশাপাশি বইগুলিতে আরও আছে কবিতাগুলির ব্যাখ্যা, এবং বাংলা শব্দের অর্থও। বিশেষত, বাংলার গাছপালার উল্লেখ যেখানে রয়েছে, সেখানে আমি সেগুলির সম্পর্কে আমার পাঠককে অবগত করাতে চেয়েছি। এই প্রসঙ্গে যে কথা উল্লেখ না-করলেই নয়— কেবল এই কাজের জন্য উদ্ভিদবিদ আর্তো কুরতো এবং ফিনল্যান্ডের বায়োলজিক্যাল সোসাইটি মিলে অনেক ভারতীয় উদ্ভিদ এবং ফুলের ফিনিশ নাম উদ্ভাবন করে আমায় কৃতার্থ করেছেন। তাঁদের প্রতি আমার ঋণ শোধ হওয়ার নয়।
আর যার কথা আমি অবশ্যই উল্লেখ করতে চাইব সে হল আমার জামাতা অ্যালেক্স পোপভ। ও একজন অত্যন্ত দক্ষ ও অনুভবী এক শিল্পী। বুলগেরিয়ার ভেলিকো তারনোভো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প ও ললিতকলা নিয়ে ও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি অর্জন করেছে। অ্যালেক্স যেহেতু ইংরেজি ও ফিনিশ— দুইই পড়তে পারে, তাই জলরঙে করা তার প্রচ্ছদ ও অন্যান্য অলঙ্করণগুলি যেন পাঠককে একেবারে লেখার ভেতরে ঢুকে তাদের রসগ্রহণে সাহায্য করে। আমি তো বলব, ওর অলঙ্করণ বইগুলিকে আরও বেশি সুন্দর, আরও বেশি বিশেষ করে তুলেছে।
বাঃ, চমৎকার! এই প্রসঙ্গে তোমার কাছে আমার প্রশ্ন থাকবে, যদি তুমি তোমার এই পুরো রবীন্দ্র-অভিযাত্রার অনুপূর্ব আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নাও… কেমন ছিল সেই যাত্রাপথ, অনুবাদের এই প্রায় দুই দশকব্যাপী দীর্ঘ সময়ে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তোমায়, কীভাবে সেসব সমস্যাকে তুমি দেখেছ, পার হয়েছ, এবং সর্বোপরি, আজকের ফিনিশ পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কতটা— এবং কেন— প্রাসঙ্গিক বলে তোমার মনে হয়েছে? সে প্রসঙ্গেই আরও জানার কৌতূহল থাকবে, অনুবাদের কাজের সূত্রে কেতকীদির (ডঃ কেতকী কুশারী ডাইসন) সঙ্গে তোমার নানা আলাপ-আলোচনা এবং কথোপকথনের স্মৃতি… সেগুলো তোমায় কীভাবে সমৃদ্ধ করেছে… নতুন কোনও জানালা খুলে দিয়েছে কি না…
সমস্যা তো ছিলই। প্রচুর সমস্যা ছিল। প্রথম কথা হল— এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা— যে, আমি বাংলা বলতে বা পড়তে পারি না। ফলে, রবীন্দ্র-অনুবাদের জন্য আমায় পুরোপুরিই তাঁর রচনার ইংরেজি অনুবাদের ওপর ভরসা করে থাকতে হয়েছে। কেতকী কুশারী ডাইসনের করা রবীন্দ্রকবিতার অনুবাদগুলির ৩০টি এবং উইলিয়ম রাদিচে-র করা অনুবাদের ১২টি কবিতা আমি ফিনিশে অনুবাদ করেছি। এ ছাড়া শিশিরকুমার দাশের ভলিউমগুলো থেকে তো অনুবাদ করেইছি। সেই সবকটা ভলিউম আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রয়েছে। তো, সমস্যা যদি বলো— যে ভাষার কবিতা অনুবাদ করছি, সেই ভাষাটাকে সরাসরি না-জানার সমস্যাটাই সবচেয়ে বড় বলে মনে হয়েছে। কিন্তু, অনুবাদের জন্য ইংরেজি অনুবাদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আমার তো আর কিছু করারও ছিল না। যদিও, ফিনল্যান্ডে সামান্য হলেও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা বাংলা ভাষাটা জানেন, এমনকী বলতেও পারেন।
দ্বিতীয় সমস্যা হল, আমার মনে হয়, কবিতার অনুবাদকর্মও কবিতা লেখারই একটা অন্য ধরন। কোনও কবিতার সার্থক অনুবাদের জন্য, তোমাকে একদিকে যেমন কবির ভাবনাটাকে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে পারতে হবে, তেমনই, অনূদিত কবিতাটিকেও হয়ে উঠতে হবে কবিতাই। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, যিনি অনুবাদ করছেন তিনিও এক অর্থে কবিই— তিনি কেবল শব্দগুলো অনুবাদ করছেন না— অনুবাদ করছেন ভাবনাটাও— অনুবাদ করছেন অনুভব, চিত্রকল্প ইত্যাদি সবই— এবং সবটা মিলিয়ে গড়ে তুলছেন নতুন একটা কবিতাই। অর্থাৎ, এজকটি কবিতার অনুবাদ করতে বসে তোমাকেও কবিই হয়ে উঠতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ, আমি যতটুকু জেনেছি, তাঁর কবিতাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পছন্দ করতেন না মোটেই। কেউ গিয়ে তাঁর কাছে তাঁর কবিতার অর্থ বুঝতে চাইলে তিনি কিছুতেই তা বুঝিয়ে বলতেন না। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল… কেউ যদি ফুলের ঘ্রাণের অর্থ না বোঝে, বাইরে থেকে সেটা তাকে বোঝানো কী করে সম্ভব? আমি তাঁর এই বক্তব্যের অর্থ বেশ বুঝতে পারি, এবং সমর্থনও করি। একটি ফুলের গন্ধকে তুমি কীভাবেই বা শব্দে অনুবাদ করতে পারো?
অন্য ভাষায় রচিত, অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে লগ্ন একটি কবিতাকে বুঝতে হলে তোমায় জানতে হবে সেই ভাষা ও সংস্কৃতির নানান খুঁটিনাটি, একই সঙ্গে সেই বিশেষ লেখককে তো বটেই। জানতে হবে তাঁর ভাবনাবিশ্বকে, তাঁর আবেগ-অনুভব, এমনকী ঠিক কীভাবে তিনি ভাবেন— তা-ও। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ফিনিশে অনুবাদ করে প্রকাশ করার আগে, আমি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর কবিতা পড়েছি। এখনও পড়ে চলেছি। আর, এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার হিসেবে ব্যবহার করেছি বুদ্ধদেব বসু, কেতকী কুশারী ডাইসন, কৃষ্ণ কৃপালনী, মার্টিন কেম্পশেন, উইলিয়ম রাদিচে, এবং অমর্ত্য সেনের বিভিন্ন লেখাপত্র। তবে, সবচেয়ে বড় তথ্যভাণ্ডার তো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই। এবং রথীন্দ্রনাথ। সব্যসাচী ভট্টাচার্যর ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর— অ্যান ইন্টারপ্রিটেশন’ ও চিত্রা দেবের ‘দ্য উইমেন অব দ্য টেগোর হাউসহোল্ড’ বইদুটিও খুব কাজে লেগেছে। সবমিলিয়ে এটা বোধহয় বলতে পারি যে, গত ৩০ বছর ধরে রবীন্দ্রনাথ-চর্চার পর, এখন হয়তো আমি তাঁকে সামান্য বুঝতে পারি, এবং তাঁকে ও তাঁর কবিতাকে নিয়ে বিভিন্ন বক্তৃতাসভা-সেমিনারে দু-চারকথা বলার যোগ্যতা অর্জন করেছি।
আর, যে কথাটা বলছিলাম… ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির কোনও কবিতা অনুবাদ করা মানে তো এক অর্থে সেই সংস্কৃতিটাকেই অনুবাদ করা— সে-ও একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষত ভারতের মতো দেশে, যেখানে ধর্ম ব্যাপারটা (আবারও বলি, এখানে ঠিক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কথা হচ্ছে না) নানা স্তরে সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকে, সেখানে তা আরও বড় চ্যালেঞ্জ। এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় ধর্মের এই বহুস্তর ব্যঞ্জনাকে যেভাবে দেখেছেন, সেগুলিকে যেভাবে নিজের লেখায় ব্যবহার করেছেন, সেগুলি ঠিকঠাক বুঝতে পারা ও অনুবাদে অপর একটি সংস্কৃতির মানুষের কাছে সেগুলির সঠিক দ্যোতনাসহ পৌঁছে দেওয়া খুব, খুব কঠিন। এ সমস্ত ক্ষেত্রে আমায় প্রায়ই কেতকীর শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ওর সাহায্য নিয়ে বিষয়গুলিকে বুঝতে হয়েছে। এবং, যত বুঝেছি তত অভিভূত হয়েছি।
কেতকীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের ঘটনাটাও এক অর্থে আমার রবীন্দ্র-অভিযাত্রারই একটা উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমি ওর ওয়েবসাইটটির খোঁজ পাই। সেখানে পৌঁছে, কপাল ঠুকে সরাসরি ই-মেল করি ওকে। তো, কেতকী মেলের জবাব দিলেন, এবং বোঝা গেল তিনি (এক অভারতীয়ের রবীন্দ্রচর্চায় এ হেন আগ্রহ দেখেই সম্ভবত) খুব খুশি হয়েই উত্তরটা লিখেছেন। আমার কাছে সেটা একটা মস্ত বড় ব্যাপার ছিল। মেলে ওঁর জবাব যখন আসে, তখন প্রায় মাঝরাত। আমি সেই মেল পেয়ে এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে, তৎক্ষণাৎ আমার স্বামীকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে খবরটা জানাই।
তো, এইভাবে আমাদের আলাপ শুরু, যা শিগগিরই বন্ধুত্বে পরিণত হল। সত্যি, ওঁকে বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করতে পেরে আমার যে কী গর্ববোধ হয়। এখন তো কেতকী খুবই ভুগছে চোখের সমস্যায়, পড়তে খুব কষ্ট হয়— আমি তাই প্রায়ই গান পাঠাতে থাকি ওকে। শাল আর ব্ল্যাঙ্কেট পাঠাই, ঠান্ডায় যাতে কষ্ট না পায় খুব। আমার কাছে কেতকী… কী বলব… মহাশূন্যে ভেসে থাকা এক স্যাটেলাইট যা রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসুর কবিতার তরঙ্গকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমার ডেস্কে পৌঁছে দেয়। ওর প্রতি কৃতজ্ঞতার আমার অবধি নেই।
আর, তোমার প্রশ্নের যে শেষ অংশ— ফিনিশ পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথ এখন কতটা প্রাসঙ্গিক— এর উত্তরে বলি, রবীন্দ্রনাথ এখন ক্রমশ আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক— শুধু ফিনিশ পাঠকের কাছে নয়, সারা পৃথিবীর কাছেই। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যে নিবিড়, নিগূঢ় সম্পর্কের কথা তিনি বলেছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির সমাধানে বিশ্বমানবিক ঐক্য ও সংহতির যে পথ তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন, তা সর্ব অর্থেই প্রমাণ করে সময়ের চেয়ে কতটা এগিয়ে ছিলেন তিনি। এই যে আমরা আর্থ ডে এবং আর্থ আওয়ার-এর কথা বলি… আমার তো মনে হয়— সারা পৃথিবীর জন্য একজন আর্থ পোয়েট থাকা দরকার আমাদের… এমন একজন যাঁর কাছে সারা পৃথিবীর মানুষ সমস্ত সমস্যায় আশ্রয় খুঁজে পেতে পারে… এবং রবীন্দ্রনাথ… রবীন্দ্রনাথই একমাত্র… হতে পারেন সেই আর্থ পোয়েট… বিশ্বকবি।
একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। জানতে খুব আগ্রহ হচ্ছে ফিনল্যান্ডে বসে রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদ-সঙ্কলনের জন্য কীভাবে প্রকাশক খুঁজে পেলে তুমি। সে কাজটা কতটা কঠিন ছিল… বা আদৌ কঠিন ছিল কি না…
দ্যাখো, রবীন্দ্রনাথকে, তাঁর সাহিত্যকৃতিকে, এবং ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি ফিনল্যান্ডের মানুষের কিন্তু বরাবরই খুব উঁচু একটা ধারণা রয়েছে। ফিনিশীয়রা খুবই শ্রদ্ধা করেন রবীন্দ্রনাথকে। এবং সেটা কেবল আজকের কথা নয়, সেটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য।
তবে, তার পাশাপাশিই, নোবেল-প্রাপ্তির পর ইউরোপের অন্যান্য দেশ কবিকে যেভাবে বরণ করে নিয়েছিল, ফিনল্যান্ডের পক্ষে তা করতে পারার কতগুলো সমস্যা ছিল। এক তো হল এই যে, দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ড অনেকটাই একটেরে— আমি ভৌগোলিক অর্থে বলছি— বেশ খানিকটা এককোণে পড়ে থাকা; এবং সাংস্কৃতিক অর্থেও ইউরোপের মূল স্রোত থেকে ফিনল্যান্ড ঐতিহাসিকভাবেই খানিক বিচ্ছিন্ন— যেহেতু তার কোনও ঔপনিবেশিক ইতিহাস ছিল না, ফলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিদিনের বহুমাত্রিক যোগাযোগের নিরিখেও সে ছিল যেন খানিক আলাদা। তার নিজের অর্থনীতিও ছিল দুর্বল, জনসংখ্যাও ছিল খুব কম— ফলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই বলো বা বইয়ের সুনির্দিষ্ট বাজার গড়ে ওঠার সম্ভাবনা— কোনওটাই আমাদের ছিল না। ভেবে দ্যাখো, কবির নোবেলপ্রাপ্তির পর যেখানে ইউরোপের নানা দেশে গীতাঞ্জলির তুমুল জনপ্রিয়তা, নানা ভাষায় তার অনুবাদ ছেপে বেরোচ্ছে, সেখানে ১৯১৭-র আগে ফিনিশ ভাষায় তার অনুবাদের কথা ভাবাই হয়নি। সে সময় একমাত্র ‘দ্য গার্ডেনার’-এর ফিনিশ অনুবাদ পাওয়া যেত। এবং ফিনল্যান্ড কিন্তু তাঁকে প্রাথমিকভাবে একজন প্রফেট হিসেবে চেনেনি, যা ইউরোপের অনেক দেশই চিনেছিল।
দ্বিতীয় কারণটা হল— যেটা এমনকী আজও খুব বেশি করে সত্যি— তা হল আমাদের দেশের জনসংখ্যা। আজকের দিনে তা মেরেকেটে ৫৫ লাখের মতো। অর্থাৎ যেটা বলতে চাইছি, বাজার হিসেবেও এটা খুবই ছোট্ট একটা সংখ্যা। বইয়ের বাজার যদিও বা আছে সামান্য, কবিতার বইয়ের বাজার তো তার অতি ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশ। তার পরে আবার বিদেশি কবিতার অনুবাদগ্রন্থের বাজার। ফলে, বুঝতেই পারছ— সেসব বইয়ের সম্ভাব্য ক্রেতা ও পাঠকের সংখ্যা খুব বেশি নয়— আর, প্রকাশকদের কাছে তো আগ্রহজনক নয়ই। অতএব, সহজবোধ্য কারণেই বড় প্রকাশকরা নতুন বই প্রকাশ করার আগে অনেকবার ভাবে। সেটা একটা বড় কারণ, যার জন্য আমি প্রায়ই প্রকাশক পাল্টাই। যেমন ধরো, মেমফিস যদিও রবীন্দ্রনাথের ফিনিশ অনুবাদ-সঙ্কলন ছাপার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী, তবু, একের পর এক রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ ছাপিয়ে যাওয়াটা তাদের পক্ষে অর্থনৈতিকভাবে একটু সমস্যার— ‘কমার্শিয়ালি ভায়াব্ল’ নয়। ফলে, প্রকাশক পাওয়াটা আমার কাছে ঠিক ‘কেক ওয়াক’ নয়, তার জন্য আমাকে খোঁজখবর করতে হয়, বিস্তর অপেক্ষা করতে হয়।
তবে, এটাও একইসঙ্গে বলব যে, আমার কাছে এই অনুবাদগুলো করে যেতে পারাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, প্রকাশিত সঙ্কলনগুলি প্রায়শই তেমন অর্থকরী সাফল্যের মুখ না দেখলেও। কতটা বড় প্রাপ্তি, একটু ব্যাখ্যা করে বলি। যেমন ধরো, আমার অনুবাদকর্মের একটা মস্ত স্বীকৃতি হিসেবে আমার কাছে সবসময় খুব তৃপ্তিদায়ক একটা অভিজ্ঞতা হল যেবার হেলসিঙ্কি-তে ভারতীয় দূতাবাসের শ্রী আলাদিয়ান মাণিকম ও শ্রী অশোককুমার শর্মা আমার করা একটি রবীন্দ্র-অনুবাদ সঙ্কলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগ্রহ দেখালেন। ওঁরা একটা মস্ত অনুষ্ঠান করেছিলেন, ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়-এর হাতে আমার বইটির[4] আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। বইটি প্রণববাবুর হাতে তুলে দেন ফিনিশ বিদেশমন্ত্রী এরকি তুয়োমিওয়া। আমিও ব্যক্তিগতভাবে প্রণববাবুকে একটি কপি, আমার তরফ থেকে, উপহার দিই, বলি “উইথ ভালবাসা…”। শুনে তিনি কী সুন্দর হেসেছিলেন, এখনও মনে আছে। উপস্থিত দর্শকমণ্ডলীও খুব হাততালি ইত্যাদি দিল। তারপরে তিনি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে অনেক কথা বললেন— একেবারে হৃদয় থেকে। পরে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তো যখন ভারতীয় রাষ্টপতির সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করলেন— সেখানেও আমাকে আর আমার স্বামীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়— প্রণববাবুর সঙ্গে আর একপ্রস্থ কথা হয়েছিল। এগুলো নিশ্চয় খুব বড় প্রাপ্তি।
তোমার স্বামী সেপ্পো ভাইয়ারভিইউ, যিনি কেবল একজন প্রতিষ্ঠিত এঞ্জিনিয়ারই নন, এক অত্যন্ত প্রতিভাবান সঙ্গীতকার ও সুরকারও। তোমরা দুজনে মিলে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়েও বেশ কিছু কাজ করেছ। শুনেছি কোনও কোনও গানে তোমরা কথা বা সুরের খানিক পরিবর্তন করেছ, আবার কোথাও কোথাও – যেমন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’-এর ক্ষেত্রে— সুরটি সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখেই ইম্প্রোভাইজ করেছ… এই বিষয়গুলি সম্পর্কে একটু বিশদে জানতে চাইব। কোন কোন গানগুলি নিয়ে তোমরা কাজ করেছ… কথা বা সুর পালটানোর প্রয়োজন কেন অনুভব করলে… যদি আমাদের জানাও…
সত্যি বলতে কী, রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আমরা সে অর্থে কোনও কাজ করিনি। একমাত্র ‘জনগণমন অধিনায়ক’ ছাড়া। বাকি যা করেছি, সেগুলি সবই মূলত আমার বাবার করা সুর নিয়ে। বাবার তৈরি করা অধিকাংশ সুরগুলোতেই কোনও লিরিক, যাকে তোমরা গানের বাণী বলো, তেমন কিছু ছিল না। সামান্য কয়েকটি ক্ষেত্রে লিরিক থাকলেও সেগুলো ছিল একেবারেই ধর্মীয় বার্তা ও অনুশাসন-গোছের— যেহেতু তিনি সে সময় চার্চের অর্গান-বাদক ছিলেন। কিন্তু, আমার বাবার করা মেলোডিগুলোয় আমি এক অদ্ভুত বিরহের সুর খুঁজে পেতাম। রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের সঙ্গে সেই মেলোডিগুলোর আশ্চর্য আত্মীয়তা আমায় অবাক করেছিল। তো, আমি যেটা করলাম, খানিক পরীক্ষামূলকভাবেই বলতে পারো… আমার করা কয়েকটি রবীন্দ্রকবিতার অনুবাদকে আমি বাবার মেলোডিগুলোর লিরিক হিসেবে বসাতে চাইলাম। সেই কাজটাই আমি আর সেপ্পো মিলে করি। পরে রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ে বিভিন্ন বক্তৃতায় আমি প্রায়ই সেই গানগুলো ব্যবহার করেছি, এবং শ্রোতাদের কাছে সেগুলো খুব প্রশংসাও পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যে কবিতাগুলো আমি সেখানে ব্যবহার করেছি তার প্রায় সবই খেয়া, ক্ষণিকা, উৎসর্গ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ থেকে নিয়ে আমারই করা অনুবাদ— অধিকাংশই প্রেমের কবিতা।
খুবই কৌতূহলোদ্দীপক এবং পরীক্ষামূলক কাজ। পরে কখনও সেগুলো শোনার আগ্রহ রইল। আপাতত আমি আরও একবার প্রসঙ্গ পালটাতে চাইব। জানতে চাইব বুদ্ধদেব বসুর কবিতা নিয়ে তোমার কাজকর্মের কথা। এ কথা ঠিক যে, বুদ্ধদেব বসুকে ফিনিশ পাঠকের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছ তুমিই। অনুরোধ করব, যদি তুমি বুদ্ধদেব বসুর কবিতার অনুবাদ-সঙ্কলনটির বিষয়ে আমাদের পাঠকদের জানাও…
আমার মনে আছে, তোমার করা বুদ্ধদেব বসুর কয়েকটি কবিতার অনুবাদ প্রথম বেরিয়েছিল একটি ফিনিশ কবিতা-পত্রিকায়, পরে সেগুলো তোমার অনুবাদ-সঙ্কলনে অন্তর্ভূত হয়। সে কি প্রকাশক পেতে সমস্যা হওয়ার কারণে?
হ্যাঁ, বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ফিনিশে আমিই প্রথম অনুবাদ করেছি। অনুবাদগ্রন্থটির নাম KALKUTTA ja muita runoja[5]। প্রকাশ করেছে হেলসিঙ্কির ব্যাসাম বুক্স, ২০১৩-য়। এটা কিন্তু কেবল ফিনিশ ভাষায় বুদ্ধদেব বসুর কবিতার প্রথম অনুবাদ-সঙ্কলন নয়, বস্তুত রবীন্দ্রোত্তর যুগের কোনও বাঙালি কবির কবিতারও প্রথম ফিনিশ অনুবাদ।
আমার সঙ্গে কেতকীর যখন প্রথম আলাপ হয়, তার ঠিক আগেই তিনি বুদ্ধদেব বসুর কবিতার অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে। তোমার মনে থাকবে, ২০০৯-এ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস সে বইটি[6] প্রকাশ করে। ওঁর কাছে বইটির প্রসঙ্গে শুনে আমি সেটি আনানোর ব্যবস্থা করি। সেখানেই বুদ্ধদেবের কবিতার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তবে তখনই আমার তাঁর কবিতা অনুবাদের কোনও ভাবনা মাথায় আসেনি। নিছক পড়ার জন্যই পড়তে শুরু করেছিলাম। কিন্তু, তারপর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। ‘ক্যালকাটা’ কবিতাটি পড়ার পর, আচমকাই, আমি কাঁদতে শুরু করি। একবার নয়, বারবার। যতবারই আমি কবিতাটি পড়তে গিয়েছি, কে জানে কেন, চোখ জলে ভরে আসত। তো, খানিক ঘোরের মধ্যেই, কবিতাটি আমি অনুবাদ করে ফেলি। তারপর আরও একটা। তারপর আরও, আরও— একের পর এক।
এভাবেই একসময় একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে ওঠে। কিন্তু, যে কথা বলছিলাম— বিদেশি কবিতার অনুবাদ, তাও আবার ফিনিশ ভাষায় তখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এক কবির কবিতার— কে ছাপতে রাজি হবে সেসব? অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর ‘তুলি অ্যান্ড সাভু’ (ফায়ার অ্যান্ড স্মোক) পত্রিকা তিনটি লেখা ছাপতে রাজি হয়। যদিও, বইটির প্রকাশক খুঁজে পেতে আমার পুরো তিনটি বছর লেগেছিল।
এখান থেকেই আবার ফিরব কবিতার অনুবাদের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গে। যে-কথা রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুবাদের প্রসঙ্গে খানিক আগেও জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করছিলাম— অনুবাদের ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি তুমি হয়েছ, সেগুলোর সমাধানই বা কীভাবে করেছ… যেমন ধরো, এ ক্ষেত্রেও নিশ্চয় কেতকীদির কাছ থেকে বেশ কিছু সাহায্য তুমি পেয়েছ, কিন্তু তার পাশাপাশি দময়ন্তীদিরও (বুদ্ধদেব বসুর কনিষ্ঠা কন্যা, প্রয়াত দময়ন্তী বসু সিং) নিশ্চয় কিছু ভূমিকা ছিল? আমার মনে আছে, যখন তোমার বইটি প্রকাশিত হয়, কী খুশি তিনি হয়েছিলেন। সে কাহিনিও তোমার মুখ থেকে শুনব। আর হ্যাঁ, এর চমৎকার প্রচ্ছদটির বিষয়েও জানতে চাইব অবশ্যই।
কেতকীর বইটিতে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা সম্পর্কে অসামান্য একটি ভূমিকা রয়েছে। সেটা আমায় মস্ত সাহায্য করেছে তো বটেই। পাশাপাশি, আমি ইন্টারনেট থেকেও অনেক তথ্য পেয়েছি বুদ্ধদেবের কবিতা বিষয়ে। ওঁর কবিতা পড়তে গিয়ে বারবার আমার মনে হয়েছে, তিনি আমার আপনার লোক— কোথাও একটা গভীর সংযোগ, একটা ‘কানেক্ট’ তাঁর লেখার সঙ্গে তৈরি হয়ে উঠছে আমার। সে-কথা আমি কেতকীকে বলেওছিলাম, যখন ২০১২-য় বুদাপেস্ত-এ কেতকীর সঙ্গে আমার দেখা হয় টেগোর কনফারেন্স উপলক্ষে। বলেছিলাম যে, আমি গভীরভাবে অনুভব করেছি বুদ্ধদেব আমার আত্মার আত্মীয়— আমার ‘সোলমেট’। উত্তরে কেতকী বলে, এ বিষয়ে সেও আমার অনুভবের অংশীদার— বুদ্ধদেবকে পড়তে গিয়ে ওরও ঠিক তাই-ই মনে হয়েছে।
ফলে, রবীন্দ্রনাথকে বোঝার জন্য আমার যেভাবে বারংবার কেতকীর দ্বারস্থ হতে হত, বুদ্ধদেবের কবিতার ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি— ততটা হয়নি। অবশ্যই আমি তার সাহায্য নিয়েছি— আমাদের তো ইমেল চালাচালি হতেই থাকত সবসময়। তো, এভাবেই, ক্রমে ক্রমে ৭০টি কবিতার অনুবাদ সম্পূর্ণ হল একদিন, যার অধিকাংশই আবার বেশ দীর্ঘও, এবং এই পুরো সময়টায়, আমি টের পাচ্ছিলাম, কবিতাগুলো আমায় ভেতর থেকে বদলে দিচ্ছে। হ্যাঁ, খুব সচেতনভাবে বলছি এটা… অনুবাদগুলো করতে করতে আমি বদলে যাচ্ছিলাম। এবং, যেদিন সমস্ত অনুবাদ শেষ হল— খুব কষ্ট হয়েছিল। সে যে কী গভীর এক বিষাদ— যেন প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা।
বুদ্ধদেব বসু কোনও এক প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “আমার মনে হয়, যদি রবীন্দ্রনাথ না থাকতেন, আমার আজকের আমিটার অস্তিত্ব সম্ভব হত না।” আমারও ঠিক তাই মনে হয় নিজের সম্পর্কে— যদি বুদ্ধদেব বসু না হতেন, আমার আজকের আমিটাও হয়ে উঠতে পারত না। তবে তার সঙ্গে আমি আর একটু কথা যোগ করতে চাই। যদি বুদ্ধদেব বসু না থাকতেন, এবং কেতকী কুশারী ডাইসন যদি তাঁর কবিতাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ না করতেন, এবং সর্বোপরি সে অনুবাদ যদি আমার হাতে এসে না পৌঁছত, আমি আমার আজকের আমি হয়ে উঠতে পারতাম না।
তো, এটাই হচ্ছে কথা। কবিতার অনুবাদ সবসময়ই জরুরি। বুদ্ধদেব নিজে নানা প্রসঙ্গে অনুবাদের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন বারংবার— অবচেতন ও স্বপ্নের মধ্যে মিশে থাকা জীবনের কথা, যাকে বাদ দিয়ে কোনও জীবন পূর্ণ জীবন হয়ে উঠতে পারে না। অবচেতনের সেই জীবন থেকে উদ্ধার করে আনা মণিমাণিক্যকে তুমি, একমাত্র মাতৃভাষার সাহায্যেই, নিজের চেতনার জগতে এক সুবিন্যস্ত সজ্জার মধ্যে স্থান করে দিতে পারো। এই কাজে কবির ভূমিকা বস্তুত একজন অনুবাদকেরই যিনি অবচেতন ও চেতন জগতের মধ্যে যোগসূত্র ধারণ করে রাখেন— যেন তিনি এই দুই জগতের মধ্যে ক্রমাগত যাতায়াত করে চলেছেন। তাঁতযন্ত্রের দুই প্রান্তের মধ্যে যেমন সতত চলমান ভূমিকা পালন করে চলে মাকু, কবিও তেমনই— একবার তিনি অবচেতনের গভীর থেকে অনির্দেশ্য অনুভূতিমালাকে তুলে আনছেন চেতনের তীরে, আবার চেতনের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে দেখছেন অবচেতনের আলোয়।
আর, দময়ন্তীর ভূমিকার কথা জিগ্যেস করছিলে তুমি… ওর সমর্থন আর উৎসাহ ছাড়া তো বইটা হতই না। বইটির পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশ করার অনুমতি তো দিয়েইছিলেন, তার পাশাপাশি ওর প্রতিটি ইমেল-এর মধ্যে যে উৎসাহ আর খুশির সুর বাজতে থাকত তা আমায় অসম্ভব প্রাণিত করেছে সেই সময়। বোঝা যেত, এটা আমার কাছে যতটা, ওর কাছেও ঠিক ততটাই স্বপ্নের এক প্রজেক্ট।
আর, প্রচ্ছদ করেছে অ্যালেক্স পোপভ, আমার জামাতা, যার কথা আগেই বলেছি। ওর আঁকা যে ছবিটি প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি এক আশ্চর্য কাজ— নাম ‘দ্য সি অব হুইস্পারার্স’।
আমি যদি খুব ভুল না করি, তুমি ফিনল্যান্ডে বুদ্ধদেব বসুর কোনও একটি নাটকও মঞ্চস্থ করেছিলে এক সময়… সেটার বিষয়ে কিছু বলবে?
আমি ঠিক মঞ্চস্থ করিনি নাটকটা, সেখানে আমার ভূমিকা ছিল মূলত কেতকী ও দময়ন্তীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমতি ইত্যাদি আনানোর। আসলে যেটা হয়েছিল, আমার করা বুদ্ধদেবের অনুবাদ পড়ে আগ্রহী হয়ে মারিয়া স্কাফারি নামে তাম্পেরে-নিবাসী এক ফিনিশীয় অভিনেত্রী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি বলেন, ওই কবিতাগুলো নিয়ে তিনি একটা কম্পোজিশন-গোছের কিছু করতে চান এবং সেটা স্টেজে পারফর্ম করতে চান। সঙ্গে ভারতীয় সঙ্গীতের অনুষঙ্গও ব্যবহার করতে চান। পরে যখন সেই প্রডাকশনটা আমি দেখতে যাই, আবার সেই একই ঘটনা ঘটে। প্রেক্ষাগৃহে বসে গোটা সময়টা আমি কেঁদে গিয়েছিলাম।
এবার এমন একটা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে চাই, যেটা আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে খুব, খুব স্পেশ্যাল। তুমি ফিনল্যান্ড নিয়ে লেখা আমার কবিতাও অনুবাদ করেছ, যা তোমার Lumoojatar[7] বইটিতে সঙ্কলিত হয়েছে। আমি সত্যিই জানতে চাই, এমন কী তুমি দেখেছিলে কবিতাগুলোর মধ্যে যা তোমায় সেগুলো ফিনিশে অনুবাদের জন্য আকৃষ্ট করেছিল। একজন, যে সারাজীবন এই দেশেই কাটিয়েছে, সে ভিনদেশি কারও কবিতায় নিজের দেশ সম্পর্কে এমন কী পেল যেটা ফিনিশে অনুবাদের যোগ্য বলে তার মনে হল?
কী বলি বলো তো! আমি তো তোমার লেখা পড়ে, যাকে বলে একেবারে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম! তার একটা বড় কারণ বোধহয় এই যে, তোমার লেখার মধ্যে একটা ‘সুররিয়ালিজ্ম’-এর ছোঁয়া আমি পেয়েছি, যেটা আমায় সিরকা সেলিয়া-র লেখালেখির কাছে নিয়ে যায়। ওঁর কবিতা আমার অসম্ভব প্রিয়, তারও কারণ সেই প্রচ্ছন্ন একটা পরাবাস্তবতার বোধ, যা লেখাগুলিকে একটা অন্য মাত্রা দেয়। তা ছাড়া… তা ছাড়া… জল ওঁর লেখার একটা প্রধান ও মৌলিক বিষয়… একটা ‘ফান্ডামেন্টাল এলিমেন্ট’… বলতে পারো যেন বা একটা চরিত্র… আর তোমার লেখার মধ্যেও জল ব্যাপারটা বারবার ঘুরেফিরে আসে।
আমার স্বামী একজন এঞ্জিনিয়ার যিনি গাণিতিক পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি মাঝেমধ্যে তোমার ‘সফট কম্পিউটিং’ বিষয়ক পড়াশোনা ও গবেষণার বিভিন্ন দিক আমায় বোঝানোর চেষ্টা করেন। আমি ওঁর কথা খুব মন দিয়ে শুনে বুঝতে পেরেছি, তোমার কবিতার সঙ্গে সেলিয়ার কবিতার কোথাও একটা আত্মীয়তা রয়েছে। তোমার লেখা পড়ে আমি যেন আমার মনের মধ্যে শুনতে পাই, সেলিয়া খুশি হয়ে বলে উঠছেন, “আহা, কী সুন্দর…”! আমি নিশ্চিত, সেলিয়া তোমার লেখা পড়ে ঠিক ওভাবেই রিঅ্যাক্ট করতেন। সে যেন অন্য এক বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি— যা একইসঙ্গে আছে, এবং নেইও।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে উইলিয়ম রাদিচে-র ‘পার্টিকল্স, জটিংস, স্পার্ক্স: দ্য কালেকটেড ব্রিফ পোয়েম্স অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর’[8] বইয়ের ভূমিকায় উদ্ধৃত কবি রবীন্দ্রনাথের সেই অসামান্য উপলব্ধি… “জ্ঞানের আলো যতই দূরে অগ্রসর হয়, ততই তা আমাদের এক অন্ধকারের সমীপবর্তী করে তুলতে থাকে…, শেষ বিচারে বস্তুতই যা কবিতার শেষতম উৎস…।”[9] আশ্চর্য হয়ে ভাবি, এমন কথা কবি ভাবতে পেরেছিলেন তাঁর মাত্র ২০ বছর বয়সে!
আমি সত্যিই অভিভূত। কিন্তু, একটা কথা বলো… আমি তোমায় আমার লেখাগুলোর যে কাজ-চালানো-গোছের ইংরেজি অনুবাদ করে দিয়েছিলাম, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমার লেখাগুলোকে ফিনিশে অনুবাদ করলে কীভাবে? সে অভিজ্ঞতা তোমার পক্ষে নিশ্চয়ই খুব সুখকর ছিল না?
দ্যাখো, যে কথা একটু আগেই বললাম, অনুবাদ করার প্রক্রিয়াটা তো আসলে একরকম ব্যাখ্যা করাই, তাই সুররিয়াল কবিতার অনুবাদ করার ব্যাপারটা একটু জটিল। সুররিয়াল কবিতা রহস্যময় বলেই জটিল। আর, রবীন্দ্রনাথ আমি যেভাবে অনেকদিন ধরে পড়তে পড়তে তারপরে আমি অনুবাদে হাত দিয়েছিলাম, তোমার লেখার ক্ষেত্রে আমার তো সেই সুদীর্ঘ প্রস্তুতিটা ছিল না। ফলে তোমার ভাবনাবিশ্বর সঙ্গে আমি ঠিক ততটা পরিচিত ছিলাম না, যতটা ওঁর ক্ষেত্রে ছিলাম। সেটা অবশ্যই একটা সমস্যার জায়গা ছিল। তবে, অন্য একটা মস্ত সুবিধেও ছিল। তোমার লেখা নিয়ে কোনও প্রশ্ন থাকলে আমি সরাসরি তোমায় জিজ্ঞেস করে নিতে পেরেছি, যেটা সুবিধেটা ওঁর লেখার অনুবাদের সময় পাইনি। এটা কিন্তু সত্যিই একটা বড় সুবিধে— সরাসরি কবির সঙ্গে কথা বলে নিতে পারার সুবিধে— এবং আমি তো বলব, আমার সেটা খুবই কাজে লেগেছে।
আর, আমার ধারণা, শিল্পী অ্যালেক্স পোপভ ওর অনুভূতি দিয়ে, আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে ‘ইনট্যুইশন’ দিয়ে তোমার লেখার একেবারে মৌলিক সত্তাটা, একেবারে ভেতরটা খুব সুন্দরভাবে ছুঁতে পেরেছে। বইয়ের অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদ কিন্তু সরাসরি সেই অনুভবের ফসল।
এবার একটু সিরকা সেলিয়াকে নিয়ে কথা বলি। ফিনিশ কবিতার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হিসেবে ওঁর ভূমিকা ঠিক কী, কেমন ও কতদূর, সেটা তোমার কাছে জানতে লোভ হচ্ছে। একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করছে মনে… ওঁর লেখালেখির শুরুর দিকে কবি হিসেবে কতটা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি, বা ধরো, পরের দিকে, যখন তিনি পরপর অনেকগুলো জাতীয় পুরস্কার পেলেন— তখন ওঁর কবিতার সম্পর্কে পাঠকদের মূল্যায়ন কতটা পাল্টেছিল? সাবেক ও রক্ষণশীল ফিনিশ কবিতার ধারা থেকে নিজের লেখালেখিকে কীভাবে বের করে আনলেন তিনি? ফিনিশ কবিতায় সুররিয়ালিজমকে কীভাবে নিয়ে এলেন? সে কি কেবল ওঁর একার হাতেই ঘটল, নাকি পাশাপাশি আরও কেউকে তিনি পেয়েছিলেন? তারপর ধরো, সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক, বিশেষত পাবলো নেরুদার সঙ্গে— তুমি আমায় বলেছিলে, এমনকী আমিও ওঁর একটা সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম যে, নেরুদার সঙ্গে কোনও একটা সময় নাকি রোমান্টিক সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি?
সত্যি কথা কী জানো? আমি তোমার লেখার মধ্যে দিয়ে যখন প্রথম টের পেলাম যে সিরকা সেলিয়া তোমার মনের খুব কাছাকাছি— তোমরা সোলমেট— আমি যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম। একজন ফিনিশ কবি ও প্রযুক্তিবিদ্যার এক ভারতীয় অধ্যাপক— তারা পরস্পরের সোলমেট! তা হলেই দ্যাখো, কবিতা কী করতে পারে!
সে যা হোক, সেলিয়ার সম্পর্কে বলি… এক আশ্চর্য ব্যক্তিত্ব তিনি! সুদীর্ঘ আট দশক ধরে কবিতা লিখেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪২-এ, আর শেষ বই ‘আ পিকক্স চাইল্ড’ এই সবে সেদিন বেরোল— ২০১০-এ। শেষ বইটার সম্পাদনা আমার, এবং প্রচ্ছদ পোপভের— সেটা আমার পক্ষে আরও বড় সুখের কথা। আমরা— আমি ও সেলিয়া— গত অর্ধশতাব্দী ধরে পরস্পরের বন্ধু, এবং ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমি ওঁর সেক্রেটারিও ছিলাম। অনেক পুরস্কার, অনেক সম্মান পেয়েছেন তিনি, পেয়েছেন প্রচুর মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। আরবি-সহ সাতটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা।
সেলিয়ার সম্পর্কে আমি আর নতুন করে কী বলব! তিনি ছিলেন, যাকে বলে, মন-ভাল-করে দেওয়া এক আশ্চর্য মানুষ! প্রত্যেককে সম্মান করে কথা বলতেন, অসম্ভব ইতিবাচক মনের অধিকারী ছিলেন, এবং অন্যের স্বাধীনতায় কদাচ হস্তক্ষেপ করা পছন্দ করতেন না। অথচ একইসঙ্গে, ছিলেন অত্যন্ত ‘আনপ্রেডিক্টেব্ল’— ওঁকে বোঝা কঠিন ছিল বেশ। কীরকম আনপ্রেডিক্টেব্ল? যেমন ধরো, ভালবাসতেন বেড়াল, গাধা ও মিশরকে! কী বিচিত্র কম্বিনেশন ভাবো একবার! আর হ্যাঁ, অসম্ভব ভালবাসতেন ভারতকে। হেলসিঙ্কিতে থাকতেন একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে, আর গ্রীষ্মকালটা কাটাতেন গ্রামের বাড়িতে— গোলাপি রঙের একটা বাড়ি, যার নাম ছিল ‘ওয়াইল্ড রোজ’। আপাতভাবে ওঁকে দেখে নরম, কখনও বা এমনকী লাজুক বলেও মনে হত, অথচ ভেতরে মানুষটা ছিলেন অসম্ভব দৃঢ়। সারাজীবন নিজের পথে চলেছেন, কে কী মনে করল তাতে পাত্তাও দেননি। লেখকদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল… কিন্তু, তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া বলতে যা বোঝায়… নাঃ, সমসাময়িকদের মধ্যে তাঁর কাজকে প্রভাবিত করতে পারেননি কেউই।
গতশতকের ছয়ের দশক থেকে ওঁর লেখায় একটা বড় বাঁক আসে। সেই সময় থেকেই সেলিয়ার কবিতায় সুররিয়ালিজমের ছায়াপাত শুরু হয়। এমনিতে ফিনিশ সাহিত্যের ধারায় সুররিয়ালিজমের প্রভাব তেমন নেই— মাত্রই হাতেগোনা কয়েকজন কবি সুররিয়ালিজম নিয়ে চর্চা করেছেন। তা ছাড়া, সেলিয়ার সুররিয়ালিজম ছিল অনেকাংশেই আলাদা— সেখানে তিক্ততা, বক্রোক্তি বা তির্যকতার স্থান প্রায় নেই, বরং আছে ইতিবাচক ও অনন্ত সম্ভাবনাময় এক রসোত্তীর্ণতা।
সিরকার সঙ্গে নেরুদার প্রথম দেখা হয় হেলসিঙ্কিতে, এক সাহিত্যসভায়। সেখানে দুজনে কিছুসময় একসঙ্গে কাটিয়েছিলেন। নেরুদা ওঁকে বলেছিলেন তাঁর দেশে যেতে, কিন্তু ভৌগোলিক দূরত্বটা ছিল খুবই বেশি। পরে, সেলিয়ার বইয়ের তাক গোছাতে গিয়ে আমি নেরুদার কয়েকটি বই খুঁজে পেয়েছিলাম। বইয়ের প্রথম পাতায় নিজে হাতে ফরাসি ও স্প্যানিশে লিখে দিয়েছিলেন নেরুদা— “Tout l’amour pour Selja… avec amitié et admiration… siempre, Pablo Neruda.”[10] সেই লেখার নিচে, তীরবিদ্ধ হৃদয়ের ছবিও নিজে হাতে এঁকে দিয়েছিলেন কবি।
সেলিয়ার কবিতা ব্যক্তিগতভাবে আমাকেও অত্যন্ত নাড়া দিয়েছে। তুমি যে শুধু আমায় সেলিয়ার কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়েছ তা-ই তো নয়, আমি যখন ওঁর কবিতা অনুবাদ করেছি আমার ‘বেস্কিড পাহাড়ের ভার্জিন মেরি!’ ও ‘ঈষৎ রঙিন!’ বইদুটিতে সঙ্কলনের জন্য, তুমি আমায় ওঁর কয়েকটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেও পাঠিয়েছ। তা ছাড়া ওঁর কবিতার যে ইংরেজি অনুবাদগুলি বাজারে পাওয়া যায় সেগুলির সঙ্গে মূল ফিনিশ পাঠের তুলনামূলক আলোচনা করে মূলের সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদের ফাঁকগুলো ধরিয়ে দিয়েছ। এ জন্য তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা শেষ হওয়ার নয়। সেলিয়াকে উদ্দেশ করে আমার লেখাগুলো যে তুমি মন দিয়ে পড়েছ এবং তোমার মতামত জানিয়েছ, সে জন্যও তোমায় অসংখ্য ধন্যবাদ।
ফিনল্যান্ডের শহর লাপ্পেনরান্তার প্রেক্ষাপটে আমার যে কবিতাটি আছে— যেখানে একজন ভিনদেশি আগন্তুক অচেনা শহরটিতে এসে পৌঁছয়, চারদিক ঘুরে দেখে এর রহস্যঘেরা সৌন্দর্যের মধ্যে খানিক সময় কাটায়, এবং তারপর শেষবারের মতো আরও একবার শহরটিকে দেখে চলে যায়— তুমি বলেছিলে, সেই লেখাটির সঙ্গে সেলিয়া ভারী চমৎকার ‘রিলেট’ করতে পারতেন। তুমি আরও বলেছিলে, আমার এই কবিতা ওঁকে নেরুদার স্মৃতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। সত্যি বলতে কী, আমার করা সেলিয়ার কবিতার অনুবাদগুলি আসলে ওঁর কবিতার প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি— এবং তুমি যে আমার বইগুলি সিরকা সেলিয়া এস্টেট-এর অন্তর্ভূত করেছ, তার জন্যও তোমায় অশেষ ধন্যবাদ।
দ্যাখো প্রফেসর চক্রবর্তী, আমার মনে ভারতীয় কবিতার একটা ছবি— বলতে পারো একটা ‘ল্যান্ডস্কেপ’— ধরা আছে। কীভাবে বলি… ধরো, নানা গাছপালা, ফুল আর পাখির ডাকে ভরা এক মস্ত বাগান— আমার চোখে সে হল রবীন্দ্রনাথের কবিতা। সে বাগানের মাঝখানে একটা ছোট্ট বাড়ি রয়েছে, সেখানে হয়তো বুদ্ধদেব বসু থাকেন। তারপর ধরো, সেই বনের পথে এক পথিক আসে… সে চারপাশ দেখতে দেখতে নানা কিছু ভাবতে ভাবতে আপনমনে চলেছে… যেন বা খুঁজছে কিছু— আমি সেই পথিককে দূর থেকে অনায়াসে প্রফেসর চক্রবর্তী বলে চিনে নিতে পারি। সেই বনবীথির প্রান্তে আমি দেখতে পাই এক পাহাড়, সেখানে বসে আছে এক নারী, পরনে টকটকে লাল পোশাক— সে কেবল চুপটি করে সব দেখছে, আর নিজের মনে হেসে চলেছে… জানো তো, সেলিয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল নিজের স্বপ্ন ও অবচেতনের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করার— হয়তো বা সে কারণেই তিনি ছিলেন এত শান্ত, নিজের মধ্যে পূর্ণ এবং সমাহিত।
আমি নিজে যেহেতু অনুবাদের কাজ করি, আমি ঠিক টের পাই সেলিয়ার কবিতার কোন অনুষঙ্গগুলি, কোন কোন চিত্রকল্প বিদেশি পাঠকের কাছে রহস্যময় ও অবগুণ্ঠিত বলে মনে হতে পারে। হয়তো বা সে কারণেই আমি তোমায় সেলিয়ার কবিতা অনুবাদের কাজে খানিক সাহায্য করতে পেরেছিলাম। তিনি যদি তোমার করা ওঁর কবিতার বাংলা অনুবাদগুলো দেখে যেতে পারতেন, আমি নিশ্চিত, তিনি অত্যন্ত খুশি হতেন। ভারত সম্পর্কে এতটাই অনুরাগ ছিল ওঁর— নিজের কবিতা কোনও ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে জানতে পারলে ওঁর আনন্দের আর অবধি থাকত না— এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
এবার শেষ প্রশ্ন। তোমার নতুন যে সব কাজ, যা হয়তো বা শিগগিরই আমাদের সামনে আসতে চলেছে, সে বিষয়ে কিছু বলবে আমাদের?
দ্যাখো, নানা প্রসঙ্গে বহুবার বহু মানুষ আমায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথকে তাঁর বাংলা কবিতায় যতখানি পাওয়া সম্ভব, ইংরেজি অনুবাদে তার ভগ্নাংশও সম্ভব নয়। আমি নিজে যেটুকু তুলনামূলক বিচার করে দেখার সুযোগ পেয়েছি তাতে মনে হয়েছে ঘটনাটা বাস্তবিকই তা-ই— ওঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদ যদি হয় গাছের ডালে বা দাঁড়ে বসা পাখি, ওঁর বাংলা কবিতা যেন খোলা আকাশে হাজার পাখির উড়াল। এমনটা অবশ্যই নয় যে, গাছের ডালে বসে থাকা পাখির সৌন্দর্য আমার পছন্দের নয়— আমি তাদেরও পছন্দ করি খুবই— কিন্তু আকাশে উড়তে থাকা পাখির যে রূপ, আমার ইচ্ছে সেই রূপটিকে যথাসম্ভব নিজের অনুবাদে ধরার। সে কারণেই, আমি চাই, আরও বেশি করে মূল বাংলা থেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতাকে ফিনিশে অনুবাদ করতে। এ বিষয়ে কেতকীর সঙ্গে আমার বিশদ আলোচনাও হয়েছে। আমার পরিকলপনা আছে কেতকীর করা একশো রবীন্দ্র-কবিতার অনুবাদকে ফিনিশে পুনরনুবাদ করার। ২০১০-এ কেতকীর যে বইটি ব্লাড্যাক্স বুক্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে[11] আমি সেই বইটি নিয়ে কাজ করব। খুবই বড় কাজ, সময়সাপেক্ষও— কিন্তু ওই যে আগেই বলেছি, ওই কবিতাগুলিই হবে আমার পারিশ্রমিক।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ করা আমার কাছে মাটির নিচ থেকে মণিমাণিক খুঁড়ে বার করার সামিল। সে লেখা আমি যদি আমার মাতৃভাষায় পড়ার সুযোগ পাই, তখন তা আমার মনের অনেক গভীরে পৌঁছতে পারে। ইংরেজিতে করা কোনও অনুবাদ পড়ে যেখানে আমি হেসেছি, হয়তো বা ফিনিশে সেই একই কবিতার অনুবাদ আমার চোখে জল এনে দিয়েছে— সে অভিজ্ঞতা এতটাই আলাদা।
আর, সবশেষে বলব, ওঁর কবিতা বারবারই আমায় আকাশের বুকে ওড়া পরিযায়ী পাখির ঝাঁকের কথা মনে করিয়ে দেয়— যে কবিতা, পাখিদের মতোই, সার্থক অনুবাদের মাধ্যমে ভাষার সীমানা পার হয়ে যায়।
অনেক, অনেক ধন্যবাদ, হান্নেলে। আশা করি তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকরা খুশি হবেন… তাঁদের কাছে এই কথোপথন মনোজ্ঞ হবে।
*ইংরেজি ভাষায় মূল কথোপকথন থেকে বঙ্গানুবাদ করেছেন অভীক ভট্টাচার্য
[1] The Gardener, ১৯১৩ সালে প্রকাশিত।
[2] ১৯১৭ সালে প্রকাশিত।
[3] “He is the poet of the fleeting moments, of the dream still remembered at dawn, of memories of past existences, and of perceptions we can scarcely define…”
[4] Sininen sari, দ্য ব্লু সারি [শাড়ি]— রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতার একটি সঙ্কলন।
[5] ক্যালকাটা অ্যান্ড আদার পোয়েম্স।
[6] Selected Poems of Buddhadeva Bose.
[7] ‘দ্য এনচ্যান্ট্রেস’, বড পাবলিকেশন্স, ফিনল্যান্ড, ২০১৬।
[8] হারপার কলিন্স, ২০০০।
[9] “The further the light of knowledge advances, the closer it brings us to the darkness…, which may indeed be poetry’s ultimate source.’’
[10] all love for Selja… with friendship and admiration… ever, Pablo Neruda.
[11] আই ওন্ট লেট ইউ গো – সিলেক্টেড পোয়েম্স, নিউ এক্সপ্যান্ডেড এডিশন।
নিরুপম অভিজ্ঞ মানুষ; সাক্ষাৎকারকে কিভাবে বাঞ্ছিত পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, একজন লেখিকার জীবন, কর্ম, অনুভব, ও আদর্শের একটা সার্বিক ছবি তুলে ধরতে হয়, তা সম্যক্ জানেন । এই সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর সুরীয়ালিস্ট কবিচিত্তকে প্রশ্রয় না দিয়ে পোক্ত অধ্যাপকের চরিত্রে দেখা দিয়ে সাধারণ পাঠকের কাছে সহজগ্রাহী হয়ে উঠেছেন । সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার জন্য (এবং আমাদের দেওয়ার জন্য) তাঁকে, এবং স্বচ্ছ ও প্রাঞ্জল বাংলা অনুবাদের জন্য অনুবাদককে ধন্যবাদ জানাই । আমাদের গর্বের বিষয় যে রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, এবং নিরুপম চক্রবর্তী সেই তিন প্রধান বাঙালি কবি, যাঁরা এক ফিনিশ-ভাষীকে বাংলা কাব্যের অনুবাদে উদ্দীপিত করতে পেরেছেন ।
অনুবাদকর্মে হান্নেলের অভিজ্ঞতাও দীর্ঘদিনের । রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রাণে যে-আর্তি জাগিয়েছেন, বুদ্ধদেব যেভাবে তাঁর জীবনবোধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন, নিরুপমের কবিতা তাঁর মনে যে-তীব্র অনুরণন জাগায়, তার বিবরণ পড়ে বাঙালি হিসেবে যুগপৎ বিস্ময় ও গর্ব বোধ করি । এ আমাদের সাংস্কৃতিক প্রাপ্তি । সেই সঙ্গে একটা আক্ষেপও হয় এই ভেবে যে রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা কবিতার প্রতি হান্নেলের এই সুতীব্র মরমিয়া আকর্ষণ এই অভিজ্ঞ অনুবাদককে সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরেও বাংলা ভাষা শিখতে অনুপ্রাণিত করল না । সে আমাদের সাংস্কৃতিক লোকসান ।
সাক্ষাতকারটি খুবই মনোজ্ঞ। দূর বিদেশে বসে এক নারী যে এমন নিষ্ঠায় রবীন্দ্র চর্চা করে চলেছেন এই প্রতিবেদন না পড়লে আমরা জানতেই পারতাম না। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম কে ধন্যবাদ। একটা অনুরোধ, এই লেখায় ওঁর বাবার করা মেলডিতে রবীন্দ্র কবিতার প্রয়োগ নিয়ে যে প্রসঙ্গ উচ্চারিত তার কয়েকটা উদাহরণ কি পাঠক হিসেবে আমরা শুনতে পারি। চার নম্বরের একটি ভিডিও চ্যানেল আছে, সেখানে যদি এমন কিছু আপলোড করা যায়, বড় ভাল হয়। ভেবে দেখবেন।
প্রবুদ্ধ বাগচী: আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানাই। ওই গানগুলির আমার সংগ্রহে থাকা একটি সিডি আমি এই সাক্ষাৎকারের অনুবাদক ও চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য সঙ্গীতরসিক অভীক ভট্টাচার্যকে উপহার দিই বছর দেড়েক আগে। আপনার অনুরোধ তিনি বিবেচনা করবেন আশা রাখি।