সত্যব্রত ঘোষ
বিদ্যাচর্চার প্রতি ভারত উপমহাদেশের সাধারণ মানুষদের যে মোহ কালে কালে প্রগাঢ় হয়েছে, তা বিশেষ পুরনো নয়। মুঘল রাজত্বেও বিদ্যাচর্চা যে বিশেষ ব্যাপক ছিল না, তা নিয়ে বিশদ গবেষণার প্রয়োজন নেই। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগেও হাতে গোনা ভারতীয় বিদ্বানদের অধিকাংশকেই দেখে সাধারণ মানুষরা সম্ভ্রমে দূর থেকে প্রণাম করে দূরে সরে যেতেন।
কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজে রানি ভিক্টোরিয়ার আমল থেকে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনটি ঘটে, তার জন্যে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি তার নাম টমাস ব্যাবিংটন ম্যাকোলে। ১৮৩৪ সালে এই দেশে পদার্পণ তাঁর। তারপরে, ১৮৩৫ সালে ভারতের তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর সমীপে আসেন দক্ষিণ ভারতের উটিতে। দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকের সামনে একটি প্রস্তাব পেশ করেন ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। সেই শিক্ষা বিষয়ক এক কার্যবিবরণীতে (Minutes) ১৮১৩ সালে প্রযুক্ত চার্টার অ্যাক্ট-এর মূল্যায়ন দেন ম্যাকোলে, যিনি অতি দর্পে বলেও ছিলেন, “A single shelf of a good European library was worth the whole native literature of India and Arabia,”
সম্পূর্ণ জাগতিক কারণেই তাই তাঁর অতীব সুচিন্তিত মত ছিল যে ইংরেজি শিক্ষা চালু করলে আমরা এমন ভারতীয়দের পাব যারা বহিরঙ্গে ভারতীয় হলেও চিন্তাভাবনায় এবং জাগতিক বিষয়াবলিতে পাশ্চাত্য, না ইংরেজি দর্শন, বিজ্ঞান এবং সাহিত্যকে অনুসরণ করবে (‘Indian only in external features, but for all intellectual and practical purposes steeped in western, nay English philosophy, science and literature.”)। এবং সেই মিনিটস-এর ভিত্তিতে গভর্নর-জেনারেল এক লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেন যাতে ব্রিটিশ শিক্ষার প্রসার ঘটে ভারতে। ১৮১৩-১৮৫৭, অর্থাৎ ওই ৪৪ বছরে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার অবশিষ্টটুকুকেও তছনছ করে যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটছিল, তা ত্বরান্বিত হয়।
কথাগুলি বহুলার্থেই জানা অনেকের। তবে এই বিবরণীতে উপস্থাপিত তাঁর অন্য একটি তত্ত্ব হল Downward Filtration Theory। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সমাজের অভিজাত অংশটিকে শিক্ষিত করে তুললে তারাই অপেক্ষাকৃত নিচু শ্রেণির মানুষদের শিক্ষিত করে তুলবে (‘by providing education to the elite groups of the society, it will be filtered down to the lower class people in the country”)।
এবার এই শিক্ষার স্বরূপটি কেমন? তথাকথিত প্রাচ্যবিদদের তিরষ্কারকে মাথায় তুলেই স্পষ্ট বলি, এ শিক্ষা সম্পূর্ণ ব্যবহারিক শিক্ষা। অর্থাৎ, যে শিক্ষায় রুজিরুটির সংস্থান হবে। মনের বিকাশ একান্তভাবেই গৌণ। দীর্ঘ দুশো বছর ধরে এই শিক্ষায় শিক্ষিত করবার জন্যে আজও সন্তানদের জন্যে বাবা-মায়েরা নিঃস্ব হতে রাজি। নিজেদের বংশজদের মধ্যে বরাবরের মতো উপ্ত করতে চাইছেন সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিপত্তির এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা। এছাড়াও এই পরিস্রাবণ তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে আরও কিছু কথা পরে আলোচনা প্রসঙ্গে আসবে।
শিক্ষাটি শুরু হয় কীভাবে? শিশুদের বাধ্য হওয়ার পাঠ দিয়ে। প্রথমে বাড়িতে, তারপরে স্কুলের দমবন্ধ ঘরে। যেখানে একসঙ্গে অনেকে বসে নির্দিষ্ট রীতি মেনে অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে জানবে দুনিয়াদারি বলতে কী বোঝায়। যে যত বেশি বাধ্য হয়ে ভাল অনুকরণ করতে পারবে, সে তত ‘ভাল’ ছাত্র/ছাত্রী। সেই একই মাপদণ্ডে যে অনুকরণে যত অক্ষম, সে ততটাই খারাপ এবং সেই শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
কে বা কারা নেবে এই সিদ্ধান্ত? একশ্রেণির সুবিধাভোগী, যাদের কোনও এক অর্বাচীনকালে শিক্ষক বলা হত। মনোজ বসুর লেখা ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ অথবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অনুবর্তন’-এ এই অতি-দরিদ্র, পরার্থপ্রেমী কতিপয় মানুষদের উল্লেখ পাই। ই আর ব্রেথঅয়েইট-এর উপন্যাস বা তা অবলম্বন করে সিডনি পোর্টার অভিনীত জেমস ক্যাভেল-এর ‘টু স্যার উইথ লাভ’ ছবিটায় যে বিনয়ী, সোজা শিরদাঁড়ার মানুষটিকে দেখলে আমাদের মনে হয় অন্য গ্রহের এক জীব। ভারতবর্ষে ‘শিক্ষক’ শব্দটিও অবলুপ্ত হতে বেশি দেরি নেই। হয়তো শীঘ্রই স্বাস্থ্যকর্মী প্রভৃতির মতো শিক্ষাকর্মী শব্দেও আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠব।
কেন বলছি কথাটা? উত্তরে, নিজেকে নিয়ে চট করে দু-চারটি কথা বলে নেওয়া যাক। যে স্কুলে পড়তাম, তার মাইনে আকাশছোঁয়া না হলেও বাবার সামান্য রোজগারের পক্ষে যথেষ্ট বেশিই ছিল। পরবর্তীকালে, বোধবুদ্ধি হলে বুঝেছি মাসের শেষ দশ-বারো দিন সংসারে প্রকট হয়ে ওঠা অভাবটি হাসিমুখে সহ্য করতেন বাবা-মা। আবার একটা মাস, একটা বছর, অনেক বছর পার হয়ে যাওয়ার পরে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কপিরাইটিং-এর কাজ (চাকরি নয়) করবার সময়ে বুঝতে পেরেছি, স্কুলজীবনে আমি কিছুই শিখিনি। অথবা, এমনভাবেও বলা যায়, শিক্ষার নামে যে আবর্জনা মাথায় জমিয়েছি, তা সাফ করতে হবে নিষ্ঠুরভাবে, যার সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে কৈশোরের নানান স্মৃতিও।
পরবর্তীকালে গৃহশিক্ষক হিসেবে নিজের জন্যে বই কেনা বা সিগারেটের খরচ তুলতে স্বনিযুক্ত হয়ে দুটো জিনিস অবধারিতভাবে টের পেয়েছি: এক, তথাকথিত ‘নামী’ স্কুলের ছাপটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং দুই, আমার ছাত্র বা ছাত্রীদের বাবা-মা শুধু এই ছাপটি সন্তানকে উপহার দেওয়ার জন্যে আমাকে মাসে মাসে টাকা দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই আমার বাবাকেই দেখতে পেয়েছি অভিভাবকদের চোখে। এমনকি কল্পনায় দেখেছি, আমার বাবার মতোই তাঁরা মাসের শেষ দিনগুলিতে ক্যালেন্ডারের দিকে চোয়াল শক্ত করে ঘণ্টা এবং খরচের আনুপাতিক হিসেব কষছেন।
আমি কি নিজেকে শিক্ষক হিসেবে দাবি করতেই পারি? একেবারেই নয়। এক, শিক্ষক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা অর্জন করিনি। দুই, আমার ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেলে গর্বিত হওয়ার বদলে লজ্জিত হয়েছি। শিক্ষা কতটুকুই বা আহরণ করেছে ওরা ডিগ্রি-ডিপ্লোমাহীন এক যুবকের থেকে? স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা নামক অহঙ্কারী, লোভী, স্ব-প্রেমী এবং কূট মানুষগুলোকে দেবতা বানিয়ে যে যেমন অক্ষর বা রাশি সাজানো ফুল বা নৈবেদ্যে খুশি হয়, সরবরাহ করেছি শিশু আর কিশোরদের। এবং আজ তাদের অনেকেই বড় হয়ে স্বপ্রতিষ্ঠিত, তাতে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই।
কোথায় কীভাবে তারা আজ প্রতিষ্ঠিত? প্রায় প্রত্যেকেই হয় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, প্রযুক্তিবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী হিসেবে স্বহিমায় বিরাজমান। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও কয়েকজন যুক্ত এবং পদোন্নত। প্রায় প্রত্যেকেই আমাকে তাদের ব্যক্তিগত কৃতিত্বের আনন্দে শরিক হতে বলে। এবং প্রতিবার আমি সঙ্কুচিত হই।
কেন? কারণ, খুঁটে খেতে শেখবার প্রথম থেকেই প্রায় প্রত্যেকটি প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্তে অল্পস্বল্প পরিচিতি করতে হয়েছে এমন একটি কাজে যেখানে অন্তত ভান করতেই হয় যেন অনেক কিছু আমার নখদর্পণে। যেমন ধরা যাক, আইআইটি খড়্গপুর। সাকুল্যে দশ-এগারো দিন জনপ্রিয় এক বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে থাকবার সময় সেখানকার তৎকালীন ডিন অফ স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্স এবং কয়েকজন বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে পেশাগতভাবে এবং আন্তরিক কথোপকথনের কিছু মুহূর্ত একটি তথ্যচিত্রে গ্রন্থিত হওয়ার কাজে আমি ছিলাম এক সহযোগী নির্দেশক। ক্যামেরার সামনেই তাঁরা বারবার একটি কথাকেই বিভিন্নভাবে প্রকাশ করছিলেন।
বৈজ্ঞানিক মহোদয় ছিলেন এই তথ্যচিত্রের উপস্থাপক। ক্যামেরার সামনে আমাদের হয়েই উনি এই প্রাজ্ঞজনদের প্রশ্ন করেন, ছাত্রছাত্রীদের এই যে এতগুলি বছর ধরে ভর্তুকি দিয়ে পড়ানো হচ্ছে, তার বদলে উত্তীর্ণ হয়ে ছাত্রছাত্রীরা দেশকে কী প্রতিদান দিচ্ছে বলে আপনার মনে হয়। সবাই হতাশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু যিনি তাঁর হতাশাকে যে স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন ক্যামেরার সামনে, তিনি ডিন অফ স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্স। আক্ষরিক অর্থে উনি বলেছিলেন, ‘একটা বি-টেক উত্তীর্ণ ছেলে বা মেয়ে যে বিদ্যা অর্জন করেছে, তা ব্যবহার করবার সামর্থ্য বা সদিচ্ছা আমাদের অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়কদের নেই। বি-টেক বা এম-টেক উত্তীর্ণ ছেলে বা মেয়েকে দেশ যদি সাবান বেচার কাজে নিযুক্ত করে খুশি হয়, তাতে কে কী বলতে পারে বলুন। এবং ভর্তুকি দিয়ে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরা যদি নিজেদের অর্জিত বিদ্যার স্বীকৃতি পেতে বিদেশে চলে যায়, তাহলে তাদেরকে দেশে থাকতে বলিই বা কী করে?”
এই নিদারুণ কথাগুলো প্রায় ৩৫ বছর পরেও কেন মনে রয়ে গেছে? কারণ, সেইদিন— যখন আমার শিং সবে গজাতে শুরু করেছে— তখনই যদি ব্রেন ড্রেন কঠোর বাস্তব হয়ে থাকে, তাহলে তা আজ তা কতদূর অধঃপতিত হয়েছে তা অনুমান করা সহজ হলেও মেনে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন।
কিন্তু আমরা কি উটপাখি হয়েই সারা জীবনটা কাটিয়ে দেব? ঝড়ে বালি উড়লে মুখ মাটিতে গুজে কি ভেবে নেব সব দিকই বড় শান্ত? সুমন চাটুজ্জে বব ডিলানের গানের বাংলা অনুবাদ করেছেন বটে, তবে এখন মনে হয় তা যুৎসই হয়নি— ‘Answer my friend, is blowin’ in the wind/The answer is blowin’ in the wind.’
সেই পরিস্রাবণ তত্ত্ব, অর্থাৎ Downward Filtration Theory নিয়ে কিছু অতিরিক্ত কথাটুকুও এই ফাঁকে সেরে নিই। কার্যসূত্রে, কলকাতার এক নাপিতকে নিয়ে যেতে হয়েছিল মুসৌরি-তে। লালবাহাদুর শাস্ত্রী ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ অ্যাডমিনিস্টেশনে। সেখানকার এক দক্ষিণ ভারতীয় অধ্যাপকের মস্তিস্কপ্রসুত ধারণা ছিল যে বাংলা তথা উত্তর ভারতে স্পষ্ট বা চোরাগোপ্তাভাবে যে জাতিভেদ প্রথা বর্তমান, তা সম্বন্ধে আগামী দিনের প্রশাসকদের অবগত করা। আমার কাজ ছিল সামান্যই— অনুবাদকের। নির্দিষ্ট ১ ঘণ্টা X ৩ দিনের এই পঠনে সহকারী হিসেবে দায়িত্বটুকু নির্বাহ করবার পরে আগামী প্রশাসকদের মানসিকতায় যে উন্নাসিকতার নমুনা দেখেছি, তা অন্য কোনও লেখার বিষয় হতে পারে।
এখানে বলে নেওয়া ভাল, যে-কোনও সামরিক প্রতিষ্ঠানের মতো এই অ্যাকাডেমিটিতেও শিক্ষার্থীদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার যাবতীয় ব্যবস্থা কার্যকর। যেমন ধরা যাক, বুটের লেসকে নিপুণ প্রজাপতিরূপে বাঁধতে শেখানোর জন্যে যথেষ্ট যত্ন নেওয়া হয়। শিক্ষাটি সমাপনের পরে এই কথাটিও শিক্ষার্থীদের কানে অতি সযত্নে তুলে দেওয়া হয় যে এই শিক্ষা একেবারেই আপতিক— অর্থাৎ, নিত্য-নৈমিত্তিক অভ্যাস হিসেবে এই শিক্ষা ব্যবহার না করলেও চলবে। পদভার গ্রহণের পর অধস্তন কর্মীদের দিয়েই এই কাজগুলি ‘করিয়ে নেওয়া বাঞ্ছনীয়’। ওখানকার উন্নাসিক হাওয়ায় রোজারিও-র সঙ্গে এক সহকারী শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হয়। উনি মণিমুক্তার মতো প্রশাসনিক শিক্ষার একটি নির্যাস দেন। শুধু তার চমকপ্রদ দৃষ্টিভঙ্গিটুকুই মনে রয়ে গেছে। তিনি বলেছিলেন, প্রশাসনিকের নিজের কাজ বলতে একটাই— অন্যদের দিয়ে কাজ করানো। যত বেশি এই কাজে একজন নবনিযুক্ত প্রশাসনিক হৃদয়হীন হতে পারবে, ততই তার পদোন্নতি ঘটবে। তুচ্ছ, এমনকি ব্যক্তিগত কাজগুলোকেও যদি অধস্তনদের দিয়ে করানো যায়, তাহলে একটি উদ্দেশ্য সাধিত হবেই। তুমি তাদের মনে একটা আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেবে— তার সন্তানও একদিন যাতে সাহেব বা মেমসাহেবের মতো ‘বড়’ হয়ে উঠতে পারে।
জানি, পাল্টা যুক্তি আছে। অনেকেই বলবেন প্রথা অনুযায়ী শিক্ষা শেষ করলেই বড় দরজা জানলা কুঠুরি খুলে যায়। নিশ্চয়ই যায়, হাজারবার যায়। ঠিক যেমনভাবে প্রতি বছর মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাধিকারী, যারা বিভিন্ন প্রকাশনীর সহায়িকা পুস্তকাবলির উপকারিতা সাব্যস্তকরণের পর হারিয়ে যায়।
***
তাহলে মোদ্দা কথাটা কী দাঁড়াল? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার মূল শর্ত— ছেলেমেয়েদের বাধ্য হতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাদের উপর যতই গুরুভার চাপাক না কেন, প্রতিবাদ করলেই নম্বর এবং নামসুদ্ধু কাটা যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সৈন্যসুলভ এই শৃঙ্খলাবোধকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে যারা উচ্চশিক্ষার আঙিনায় প্রবেশ করে, তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই নৈরাশ্যজনক এক শূন্যতা অপেক্ষা করে আছে। এমন অনেক কৈশোর-উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অদ্ভুত এক প্রলাপে বারবার যুক্ত হতে হয়েছে, যেখানে বয়সোচিত গাম্ভীর্য নিয়ে তাদেরকে ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হওয়ার পরামর্শ দিতে হয়েছে। এবং অনুতপ্ত হয়েছি, কারণ বিকল্প কোনও পথ আমার জানা নেই।
মোটামুটি তৃতীয় বর্ষ থেকেই লক্ষ করা যায়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যে বিষাক্ত উপাদানগুলি দীর্ঘকাল ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বীজতলার মতো মজুত করে রেখেছি, তা ফোঁড়ার মতো ছাত্রসমাজের সর্বত্র ফুঁড়ে বেরোতে শুরু করে। এই যে তৃতীয় বর্ষ বলছি, তার একটা নির্দিষ্ট কারণ আছে— প্রথম বর্ষ অভিভূত হওয়ার সময়— মুক্তির বিহ্বলতা এবং ‘বড়’-দের অত্যাচার অর্থাৎ র্যাগিং-এর আঘাত সামলাতে; দ্বিতীয় বর্ষ কেটে যায় ড্রপ-আউট হব, না পড়াশোনা চালিয়ে যাব সেই বিষয়ে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে হয় পরীক্ষাটুকু উতরোতে অথবা পড়াশোনা ছেড়ে দিলে তার গ্লানিবোধ কাটাতে। যারা দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হচ্ছে, অধিকাংশের ক্ষেত্রেই ‘স্নাতক’ তকমাটি গায়ে সেঁটে গেছে। এবারে যে অনার্স হওয়ার পাঠক্রম, তা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মেজাজ এবং অনেক ক্ষেত্রেই চরিত্র বদলে দেয়। অন্তত ভারতবর্ষের স্নাতক-সমাজ যতটুকু দেখেছি তাতে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে।
কেন? এক, অধিকাংশ অধ্যাপকের অধ্যাপনায় যে দিনগত পাপক্ষয়ের অনিচ্ছা, তা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও জারিত হয়। অথবা, এমনভাবেও বলা যেতে পারে, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাগ্রহণে অনীহা লক্ষ করে অধ্যাপকদের অনেকেই কোনওমতে ক্লাস শেষ করাতে বেশি উৎসুক। এর ফলে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে ক্রমশ অবনতি ঘটে। দুই, অধাপক তথা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসকদের সুবিধাভোগী হয়ে ওঠার প্রকট চিহ্ন। বেতন কমিশনের উদারতাকে এক ধরনের অধিকারবোধ (entitlement) জন্মানোর ফলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কাদা মাখামাখিতে বেশি দড় হয়ে ওঠেন। এই প্রবণতাটিকে ‘যে থালায় খাচ্ছি, সেই থালাতেই ফুটো করছি’ ধরনের লক্ষণ হিসেবে বিশেষিত করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হচ্ছি না।
দুই লক্ষণ মিলিয়ে ঠিক কোনখানে এসে পৌঁছলাম? যেখানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হোস্টেলে র্যাগিং-এর শিকার এক প্রথম বর্ষের ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ এবং তদন্তের জেরে সেখানকার উপাচার্য পদে দক্ষিণপন্থী এক উপাচার্যের অভিষেক ঘটেছে। আমরা এতদিন জেনে এসেছি, রাজনীতি মানেই ভ্রষ্টাচার। কিন্তু কঠিন বাস্তবটি হল, ভ্রষ্টাচার আছে বলেই রাজনীতি স্বমহিমায় বিরাজ করছে।
ভাবতে চেষ্টা করছি, যে বারোজনকে পুলিশ হত্যা অপরাধে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করে বিচার প্রক্রিয়ার দায়রায় ফেলেছে, এই বারোজনের মধ্যে কয়েকজন এমনও তো আছে, যারা সরস্বতীকেই আরাধ্য দেবী বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে সগর্বে ভিতরে ঢুকেছিল। কিন্তু কী এমন হল, যে অসুরের মতো ঠান্ডা মাথায় প্রাণ নেওয়া এবং প্রমাণ লোপাটে তাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়ে গেল?
তথাকথিত সমাজবিরোধী বলে আমরা যাদের দাগিয়ে দিই, তাদের চেহারা ও আস্ফালনগুলো গত শতকের আটের দশকে বড় হয়ে ওঠা অনেকের স্মৃতিতে রয়ে গেছে। পেটো বোমার আঘাতে মুহুর্মুহু কেঁপে উঠতাম আমরা যখনই দুই দলের মধ্যে এলাকা দখলের জন্যে লড়াই হত। অদ্ভুতভাবে, প্রকৃত শিক্ষকদের মতো, এই সমাজ-বিরোধীরা অদৃশ্য। অন্তত যেকোনও নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রস্তুতির সময় অবধি। নির্বাচন মিটে নেতারা যখন নিশ্চিন্তে নিজ নিজ কুর্সিতে আসীন, তারপরে এই সমাজবিরোধীরাও জনজীবন থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়।
তার এক অন্যতম কারণ, এই সমাজবিরোধীদের জাগতিক যা কিছু প্রয়োজন— আশ্রয়, নিরাপত্তা, নেশা ও অন্যান্য ফুর্তির জোগান, মোটা মাসোহারা ইত্যাদির জিম্মাদারি যখন রাজনৈতিক নেতারাই নিচ্ছেন, তখন অকারণে পেটো ফাটিয়ে তরোয়াল বা পিস্তল নিয়ে আস্ফালনের প্রয়োজনটাই ফুরিয়েছে। শুধু নেতা একবার হুকুম দিলেই সব ভুলে এই ছেলেরা অবিশ্বাস্য বিশ্বস্ততায় সক্রিয় হয়ে নেতার আরও কাছাকাছি পৌঁছাতে উৎসুক।
বিশ্বভারতী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও নেশা-সরবরাহকারীদের সঙ্গে বিভিন্ন নেতাদের যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়, তা এই স্ব-ঘোষিত ছাত্রনেতাদেরই বদান্যতায়। এই নেশা-সরবরাহকারী যারা তাদেরকে সমাজবিরোধী হিসেবে সবাই জানলেও, এদের পৃষ্ঠপোষক যে ছাত্র-নেতা ও তার সহচরেরা আছে, তারা যে গত তিরিশ বছর ধরে সরস্বতীর নামে অসুর বন্দনায় রত, তা জানলেও কেউ মানতে রাজি নয়।
এদের দাপট এতটাই যে অধ্যাপক এবং প্রশাসকেরা রীতিমতো চমকে যান এদের উপস্থিতিতে। কারণ, এই ছেলেমেয়েরা যখন তাঁদের সামনে কোনও দাবি জানায়, তা যে আসলে অধ্যাপক এবং প্রশাসকদের বিভিন্ন অনিয়ম এবং অন্যায়ের প্রশ্রয়দাতা রাজনৈতিক নেতারই দাবি, ততটুকু বুঝে নেওয়ার মতো এলেম আছে এই পদধারীদের। কাফিদার মতো কয়েকজন সংবেদনশীল মানুষও অবশ্য আছেন, যাঁরা শুধু অধ্যাপক হিসেবে নিজেদের দায়ভার বহনেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি। তবে বর্তমান জটিল পরিস্থিতিতে তাঁদেরকে আমি মহাভারতের বিদুরের মতো দেখছি। কিন্ত তাঁদের ভাষ্য তো তখনই শোনা যাবে, যখন অন্ধ (ধৃত)রাষ্ট্র তার আশেপাশে অনাবশ্যক তর্কবিতর্ক, বিক্ষোভ এবং আস্ফালন-পাল্টা আস্ফালনের প্রচণ্ড শব্দ থেকে কান ফিরিয়ে বিদুরের বিবরণী শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করবে। যেহেতু সাধারণ নির্বাচন আর বিশেষ দূরে নেই, সুতরাং বিদুরের না-শোনা বিবরণী সেই নির্বাচন প্রক্রিয়ার ঢাকঢোল বাজা স্থিমিত হওয়ার পরে তামাদিতে পরিণত হবে। আগের বিভিন্ন পর্বগুলির মতো।