অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সংরক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল পিছিয়ে পড়া মানুষদের ক্রমশ ব্যবহারিক সুযোগের ক্ষেত্রে, জীবন ও জীবিকার পরিসরে সমান জমিতে তুলে আনা। তদুপরি সংরক্ষণের প্রস্তাব ছিল একেবারেই সাময়িক একটি পরিকল্পনা, নির্দিষ্ট সময় পরবর্তীতে যে ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথাও স্পষ্টভাবে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো সুযোগে-বিভাজনের ব্যবস্থায় অভ্যস্ত একটি দেশের ক্ষেত্রে রাজনীতিকেরা এই সংরক্ষণ-নীতির মাধ্যমে এমনই একটি লোভনীয় অস্ত্র পেয়ে গেলেন, যার কারণে সমস্যার সমাধান একেবারেই গৌণ হয়ে দাঁড়াল। সংরক্ষণের বিষয়টি ভোটব্যাঙ্ক বাড়ানোর কারিগরি-ব্যবস্থা হিসেবেই ব্যবহৃত হতে লাগল। আজ সেই ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবেই তোষণ-নীতির সঙ্গে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে
এই নিবন্ধের মতামত ব্যক্তিগত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো politically incorrect বলেও মনে হতে পারে। কারণ জাতিগত সমস্যা, অস্পৃশ্যতা, সামগ্রিকভাবে এই বিষয়গুলির ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে বিশ্লেষণ করতে গেলে যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রয়োজন আমার তা নেই। পদবির ভিত্তিতে সংরক্ষণ, নীতিগতভাবে এই বিষয়টির আমি তীব্র বিরোধিতা করি। কারণ, প্রাথমিকভাবে শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে আমি চারপাশে যেমনটা দেখেছি অথবা এযাবৎকাল অবধি দেখে এসেছি, একই আর্থ-সামাজিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেও আমাদেরই পরিচিত-বন্ধুরা সংরক্ষণের সুবিধা ভোগ করেছে। কিন্তু, কিছুদিন আগে যখন অর্জুন ডাংলে রচিত ‘বিষের রুটি’ বা ‘Poisoned Bread’ গল্পটি পড়তে চেষ্টা করি, আরেক ভারতবর্ষের প্রতিচ্ছবি তখন ক্রমশই আমার সামনে ফুটে উঠতে থাকে। কিছুতেই এই দুই সমাজকে মিলিয়ে উঠতে পারি না। প্রান্তিক সমাজে যাঁরা দলিত, তাঁদের বাস্তবিক যে সামাজিক অবস্থান, আমরা কখনওই, আজ অবধি, কল্পনাতেও সেই বিষয় সম্পর্কে ধারণা করতে পারি না। ‘মাহার’ সম্প্রদায় থেকে আসা ভীমরাও আম্বেদকর ‘অস্পৃশ্য’ সম্প্রদায় থেকে এসেছিলেন। এর বাইরে আমরা কতটুকু জানি সেই ‘মাহার’দের বিষয়ে? কতজনে জানি, যে সেই ‘মাহার’ মানুষেরা ডোম তো বটেই, কিন্তু তাঁদের কারবার মানুষের শবদেহ নিয়েও নয়। ‘মাহার’ জাতি আদতে অস্পৃশ্যের চেয়েও অস্পৃশ্য বলে চিহ্নিত, কোনও গ্রামের মৃত গবাদি পশুদের দেহাবশেষ নিয়েই কারবার তাঁদের। কাজেই অস্পৃশ্যদের গ্রামেও, গ্রামের বাইরে, আরও অস্পৃশ্য হয়ে তাঁদের বেঁচে থাকতে হয়। অনেকে হয়তো বলবেন, চতুর্বর্ণের বাইরেও কি তাহলে আরও ‘অস্পৃশ্য’ বর্ণ রয়েছে? এর উত্তরে বলব, রয়েছে বলেই আমরা শহরের বাইরে, গ্রামীণ ভারতের প্রত্যক্ষ রূপটিকে ধারণা করে উঠতে পারি না।
ঋগ্বেদ অনুসারে, পুরুষ সূক্তের দশম মণ্ডলে চতুর্বর্ণ বিভাজনের ধারণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘Who Were the Shudras’ গ্রন্থে আম্বেদকর স্পষ্টতই দেখিয়েছেন ঋগ্বেদেরই অন্যান্য অংশে এ-ধরনের বর্ণ-বিভাজনের বিপরীতে সামগ্রিকভাবে মানুষের উৎপত্তি বা জন্ম সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে। আম্বেদকর মনে করেন ব্রাহ্মণ-আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজনে চতুর্বর্ণ বিভাজনের ধারণা পরবর্তীতে এমন সব শাস্ত্রীয় রচনাগুলিতে ঢোকানো হয়, এবং চতুর্বর্ণের বাইরে আরও একটি পঞ্চম স্তর সেই সময়ে উপস্থিত ছিল, যাঁদেরকে তিনি বলেছেন ‘অবর্ণ’, যাঁরা এ-ধরনের চামার, ডোম, মুচি, অথবা আরও নীচস্তরের মানুষ হিসেবে পদদলিত হয়ে বেঁচে থাকেন। অস্পৃশ্য এইসব জাতি বা বর্ণকেই গান্ধিজি ‘হরিজন’ বলে চিহ্নিত করেন ও পরবর্তীতে তাঁরা নিজেরাই সেই অভিধা ত্যাগ করে নিজেদেরকে ‘দলিত’ শব্দে চিহ্নিত করতে থাকেন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে জাতি-ভিত্তিক জনগণনার প্রশ্নে বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। প্রথমত, ২০১১ সালের পরবর্তীতে ২০২১ সালে নির্ধারিত জনগণনা হওয়ার কথা থাকলেও কোভিড-অতিমারির কারণ দেখিয়ে আজ অবধি কেন্দ্রীয় সরকার সেই জনগণনার বিষয়ে কোনও আগ্রহ দেখায়নি। ওয়াকিবহাল মানুষ মাত্রেই উপলব্ধি করবেন, কোনও দেশের আর্থ-সামাজিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সেই দেশের জনতা ও তাদের সঠিক আর্থ-সামাজিক অবস্থান প্রসঙ্গে নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ জরুরি। সঠিক ও সমকালীন তথ্যের অভাবে অধিকাংশ আর্থ-সামাজিক নীতি বা প্রকল্পই প্রণয়নের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। এই কারণে যত দ্রুত সম্ভব জনগণনার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়াও ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের বিষয়ে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘদিন যাবৎ যে একাধিক ভ্রান্ত তথ্য বা ধারণা সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে জনমানসে প্রচার করে এসেছে, সেই ভ্রান্তি দূর করতেও জনগণনার আশু প্রয়োজন রয়েছে।
এবারে আসা যাক, জাতি-ভিত্তিক জনগণনার প্রসঙ্গে। ১৯৩১ সালের পর থেকে আজ অবধি জনগণনার ক্ষেত্রে জাতি-ভিত্তিক তথ্য কখনওই জনসমক্ষে আনা হয়নি। অথচ, সেই গোপন তথ্যের উপর ভিত্তি করেই কিন্তু বিভিন্ন সময়ে সংরক্ষণ-বিষয়ক একাধিক নীতির ঘোষণা হয়েছে। আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে সত্যিই এই ‘দলিত’, ‘পিছড়েবর্গ’ বা ‘OBC’-সহ তফশিলি জাতি বা উপজাতি-ভুক্ত জনগণের, জনসংখ্যার নিরিখে প্রতিনিধিত্ব কেমন, এবং একই সঙ্গে তাঁদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানই বা কেমন জায়গাতে রয়েছে, সেই তথ্য সরাসরি সংখ্যার হিসেবে উঠে আসা প্রয়োজন বলে মনে করি। সাম্প্রতিক কালে বিহার সরকার তাঁদের নিজস্ব জাতি-ভিত্তিক সমীক্ষার ফলাফলে জানিয়েছেন, সেই রাজ্যের ৬৩ শতাংশেরও বেশি মানুষ বর্তমানে ‘দলিত’ বা ‘পিছিয়ে পড়া শ্রেণি’গুলির অন্তর্গত। এই সংখ্যাকে হাতিয়ার করে রাজনীতিকদের একাংশ ইতিমধ্যেই পদবি-ভিত্তিক সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সংরক্ষণের শতাংশ বাড়ানোর দাবিতে সওয়াল শুরু করেছেন। এই বিষয়ে মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, কোনওভাবেই কোনও ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি সংরক্ষণের ঘোষণা করা যাবে না। কিন্তু জনসংখ্যার নিরিখে পিছিয়ে পড়া মানুষেরাই যদি সংখ্যাগুরু হয়ে ওঠে, তাহলে আনুপাতিক হারে তাদের সংরক্ষণ বাড়ানোরও দাবি উঠবে, এই সত্য রাজনৈতিক। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব বাস্তবোচিত নয় বলে মনে করছি। সংরক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল পিছিয়ে পড়া মানুষদের ক্রমশ ব্যবহারিক সুযোগের ক্ষেত্রে, জীবন ও জীবিকার পরিসরে সমান জমিতে তুলে আনা। তদুপরি সংরক্ষণের প্রস্তাব ছিল একেবারেই সাময়িক একটি পরিকল্পনা, নির্দিষ্ট সময় পরবর্তীতে যে ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার কথাও স্পষ্টভাবে সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো সুযোগে-বিভাজনের ব্যবস্থায় অভ্যস্ত একটি দেশের ক্ষেত্রে রাজনীতিকেরা এই সংরক্ষণ-নীতির মাধ্যমে এমনই একটি লোভনীয় অস্ত্র পেয়ে গেলেন, যার কারণে সমস্যার সমাধান একেবারেই গৌণ হয়ে দাঁড়াল। সংরক্ষণের বিষয়টি ভোটব্যাঙ্ক বাড়ানোর কারিগরি-ব্যবস্থা হিসেবেই ব্যবহৃত হতে লাগল। আজ সেই ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবেই তোষণ-নীতির সঙ্গে সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থ-সামাজিক অবস্থানের কথা মাথায় না রেখে, পদবি-ভিত্তিক সরল সংরক্ষণ নীতির মাধ্যমে যে অবিশ্বাস্য প্যান্ডোরা-বাক্স আজ ডালা উলটিয়ে এদেশের রাজনীতিকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তার থেকে আমাদের মুক্তির উপায় দেখছি না।
তাহলে সত্যি করেই কি জাতি-গত জনগণনার কোনও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে? এই ক্ষেত্রে সরাসরি বলব, সেই তথ্য সামনে আসা প্রয়োজন। অস্পৃশ্যতার নিরিখে ভারতে পিছিয়ে পড়া ‘জাতি’র সংখ্যা ‘শাস্ত্র’ মানলে প্রায় ৩০০০-এর কাছাকাছি। এই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অস্তিত্বের বিষয়ে সম্পূর্ণ সমীক্ষা হওয়া প্রয়োজন। কারণ, কেবল অর্জুন ডাংলের গল্পগ্রন্থই নয়, ২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা-প্রবন্ধ ঘাঁটলেও সেখানে দেখা যাচ্ছে অস্পৃশ্যতার বিষ এখনও কতখানি গভীর, কতখানি মজবুত হয়ে আমাদের সমাজে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। ১৯৫৫ সালের অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইন কার্যত এই বিষয়ে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। তারই সঙ্গে যোগ হয়েছে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত সংরক্ষণ-নীতির ব্যবহার, যা সমস্যাকে কমানোর পরিবর্তে গভীরে সামাজিক বিদ্বেষ ও বিভাজনকেই ত্বরান্বিত করে। ২০১২ সালের ইন্ডিয়ান হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট সার্ভে বা আইএইচডিএস সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত রাশিতথ্যের সাহায্যেই গবেষক অমিত থোরাট ও ওমকার জোশি, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি পত্রিকায় এই বিষয়ে তাঁদের ফলাফল প্রকাশ করেন।
এই সমীক্ষা অনুসারে দেখা যাচ্ছে, এখনও অবধি গ্রামীণ জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ ও শহুরে জনতার প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ, অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাসী। নিঃসন্দেহে, বর্ণগত পরিচয়ের দিক থেকে দেখলে ব্রাহ্মণ জনতার তরফেই সবচেয়ে বেশি করে এই ঘৃণ্য প্রথার প্রতি সমর্থন রয়েছে। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্রাক্ষণ যাঁরা, তাঁদের ৫২ শতাংশই অস্পৃশ্যতার অভ্যাসকে সমর্থন করেছেন। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হল, OBC বা অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির তরফেও ৩৩ শতাংশ মানুষ, ও তফশিলি উপজাতিদের নিরিখে তাদের জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ এই প্রথার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, ধর্মের নিরিখে জৈন ধর্মাবলম্বীদের তরফেই সবচেয়ে বেশি করে অস্পৃশ্যতার অভ্যাস রয়েছে। সেই ধর্মের ৩৫ শতাংশ মানুষ এখনও অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাসী, হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি হল ৩০শতাংশ। মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনতার ১৮ শতাংশ, খ্রিস্টান মতাদর্শে বিশ্বাসী যাঁরা— তাঁদের ৫ শতাংশ ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ মানুষ অস্পৃশ্যতার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। অবাক হওয়ার মতো আরও একটি বিষয় হল, শিখ ধর্মাবলম্বীদের তরফেও ২৩ শতাংশ মানুষ অস্পৃশ্যতার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এই বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গবেষকরা জানিয়েছেন, পূর্বাশ্রমের বর্ণ অনুসারে অনেক অস্পৃশ্য ব্যক্তি সমানাধিকারের আকর্ষণে শিখ ধর্ম গ্রহণ করলেও, শিখতত্ত্ব অনুসারে তাঁরা মজহবি শিখ হিসেবে পরিচিত হন। পঞ্জাব রাজ্যে তাঁদের জন্য আলাদা গুরুদ্বার অবধি রয়েছে। সমীক্ষা অনুসারে দেখা গেছে, অন্যান্য সমস্ত রাজ্যের তুলনায় এখনও অবধি পঞ্জাবেই পিছিয়ে পড়া জাতি বা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশি। আমরা অনেকে মনে করি, এ-ধরনের প্রথা বা অভ্যাস, আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও স্রেফ সামগ্রিক অশিক্ষার কারণেই অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু, প্রথাগত শিক্ষার নিরিখেই যদি দেখি, অশিক্ষিত জনতার ৩০ শতাংশ, প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনতার ২৬ শতাংশ, ক্লাস এইট বা নাইন অবধি শিক্ষালাভ করেছেন এমন জনতার ২৯ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনতার ২৫ শতাংশ, উচ্চ-মাধ্যমিক স্তর অবধি পড়াশোনা— এমন জনতার ২৪ শতাংশ, স্নাতক অথবা ডিপ্লোমাধারী জনতার ২৪ শতাংশ, এখনও অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাস করেন। তাহলে অশিক্ষিত থেকে স্নাতক বা ডিপ্লোমা-স্তর অবধি শিক্ষিত হয়েও, অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাসের যে হার— শতাংশের নিরিখে কিন্তু সেই হিসেবে প্রায় কোনও পরিবর্তন নেই! দেশের সবচেয়ে গরিব মানুষ যাঁরা, তাঁদের প্রায় ৩৩ শতাংশ ও সবচেয়ে ধনী মানুষ যাঁরা, তাঁদের প্রায় ২৩.৫ শতাংশ মানুষ এই প্রথায় বিশ্বাসী। মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে কমবেশি ২৫ শতাংশ মানুষ এখনও অস্পৃশ্যতার প্রতি সমর্থন জানান। রাজ্য বা এলাকাগতভাবে দেখলে রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে অস্পৃশ্যতার হার সর্বোচ্চ। এই রাজ্যগুলির প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাস করেন। এরপরেই রয়েছে বিহার, উত্তরপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ড, যে রাজ্যগুলির প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাসী। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হল, এই সমীক্ষা অনুসারে গুজরাত, দমন ও দিউ, দাদরা ও নগর হাভেলি, মহারাষ্ট্র ও গোয়ার ক্ষেত্রে অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাসীর হার সবচেয়ে কম (১৩ শতাংশ) বলে উঠে এসেছে। এই সমীক্ষা প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় বলে নেওয়া জরুরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমীক্ষায় অংশ নেওয়া পরিবারগুলির যিনি প্রধান ব্যক্তি তিনিই সমীক্ষকের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর ও আলাপচারিতায় অংশগ্রহণ করেন। কাজেই, অস্পৃশ্যতার মতো স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে, ‘পরিবার-প্রধান’দের তরফে সরাসরি একতরফা বক্তব্য হিসেবে যে তথ্য উঠে এসেছে, তার নিশ্চিত সত্যতার ক্ষেত্রে আমাদের সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। তদুপরি এই পর্যবেক্ষণের কারণে কিন্তু আমাদের এও মনে হয়, আদতে এই সমীক্ষার মাধ্যমে অস্পৃশ্যতার প্রকোপের বিষয়ে যে-সকল তথ্য সামনে উঠে এসেছে, অনেকাংশে তা হয়তো লঘু বা সরলীকৃত মাত্রাতেই উঠে আসতে পেরেছে। বাস্তবে অস্পৃশ্যতার প্রকোপ আরও বেশি বই তো কম নয় কোনওভাবেই।
এমতাবস্থায়, এই বহুধা-বিস্তৃত ও বিভাজিত দেশের নাগরিক হিসেবে, পদবির ভিত্তিতে সংরক্ষণ অবাস্তব অথবা একেবারেই সমাধানের অস্ত্র নয় বলে জোর গলায় নিদান হেঁকে দেওয়া অসম্ভব। আবার বাস্তবতার দিক থেকে দেখলে, দীর্ঘমেয়াদে যতদিন অবধি পদবির ভিত্তিতে সংরক্ষণ থাকবে, ততদিন অবধি কিন্তু অবচেতনে এই বিভাজনকেই প্রশ্রয় দেওয়া হতে থাকবে। বিভাজন কখনও ঐক্যের প্রশ্নে সমাধান হতে পারে না। সেক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক, ভৌগোলিক অথবা আরও বিজ্ঞানসম্মত কোনও সূচককেই আমাদের চিহ্নিত করা উচিত যার ভিত্তিতে আমরা কোনও নির্দিষ্ট নাগরিককে ‘অগ্রসর’ অথবা ‘অনগ্রসর’ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে পারব। পদবি, গোষ্ঠী অথবা অন্য যে-কোনও ধরনের ‘সমষ্টি’র ব্যবহার যতদূর সম্ভব কমিয়ে এনে, নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি বা নাগরিককে, কেবলমাত্র তাঁর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির বিচারে প্রাপ্য সুবিধা পাইয়ে দেওয়াটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কথাটা ‘আকাশকুসুম’ বলে মনে হলেও, আধুনিক আদর্শ সমাজের ক্ষেত্রে বোধহয় এমনটাই নিয়ম হওয়া প্রয়োজন।
পুনশ্চ:
ঠিক যেভাবে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রসঙ্গে আমাদের ‘প্রশাসন থেকে সমস্ত ধরনের ধর্মীয় প্রভাবকে উচ্ছেদ করা’— এই সমাজতান্ত্রিক ধারণা বা তত্ত্বকেই গ্রহণ করা উচিত; কারণ যে-কারও অভিজ্ঞতা দিয়েই এ-কথা বিচার করা যায়— সকল ধর্মের প্রতি সমান পক্ষপাত সাংস্কৃতিক পরিসরে আদর্শ বোধ হতে পারে, কিন্তু প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানই একমাত্র ‘ধর্ম’গ্রন্থ, এই কার্যনীতিই প্রয়োগের দিক থেকে বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যবহারিক।
সূত্র:
- Dangle, Arjun (ed.). ‘Poisoned Bread – Translations from Modern Marathi Dalit Literature’. Orient Blackswan. 2009.
- Thorat, A. & Joshi, O. ‘The Continuing Practice of Untouchability in India: Patterns and Mitigating Influences’. Economic and Political Weekly, Vol.LV, No.02. January, 2020.
*মতামত ব্যক্তিগত