সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
তালবাদ্য বিশেষত তবলার বাদনশৈলীর যেমন ঘরানা রয়েছে ঢাকের বোলচালের ক্ষেত্রেও রয়েছে তেমনি পার্থক্য, আঞ্চলিক বিভিন্নতা। ঢাক একান্তভাবেই বাংলার লোকবাদ্য, ফলে বাংলার ভৌগোলিক পরিবেশের তারতম্য ঢাকের বোলচালের ক্ষেত্রেও ধরা দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের বাদনশৈলীর সঙ্গে দক্ষিণবাংলার বাদনশৈলীর লক্ষণীয় তারতম্য রয়েছে। বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর বা বর্ধমানের ঢাকিরা যেভাবে ঢাকে কাঠি ঠুকে বোল তোলেন, নদিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা বা মুর্শিদাবাদ জেলার ঢাকিরা, যাঁদের সংখ্যাগুরু অংশই হল সাবেক পূর্ববাংলার আদি বাসিন্দা, ঠিক সেভাবে ঢাকের তাল লয়ের বিস্তার ঘটান না
আকাশপটের ক্যানভাস থেকে দামাল বর্ষার মেঘগুলো এদিক-ওদিক আড়ালে-আবডালে উধাও হয়ে, বছরের এই মনখুশির দিনগুলো পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেই একটা অন্যরকম অনুভূতি মনের ভেতরে পাক দিতে থাকে। ভোরের দিকে খুব হালকা ঠাণ্ডা, শীত শীত আমেজ, বাড়ির উঠোনে সাদা শিউলির আলপনা, হালকা হাওয়ায় ইতিউতি মাথা উঁচিয়ে খুশিতে দুলতে থাকা কাশফুলের সফেদ ঝালর— এ-সবই যেন জানান দেয় উৎসবের কাল দুয়ারে সমাগত। এখন ঢ্যাংকুড়াকুড় ঢাকের তালে কোমর দুলিয়ে খুশিতে মন মাতানোর দিন। ব্যস্ত শহরের বুকে শারদীয়া প্রকৃতির আগাম আভাস মেলা ভার, তাই শহরবাসীর জন্য কল্পবিলাসই একমাত্র সম্বল। অথচ মন উড়ুউড়ু। পাঁজিপুথির দিনক্ষণ মিলিয়ে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঢাকের বোল ফুটে উঠতেই অবশ্য টের পাওয়া যায় বছরভর অপেক্ষার কাল পেরিয়ে তিনি এসেছেন আমাদের দুয়ার আলো করে। ততদিনে ভেতরে বাইরে সকলের শরীর ও মন দুইই বেশ তেতে উঠেছে। মহারাষ্ট্রের লাভনির ঢোলকি, কেরালার চেন্ডা, আদিবাসী সমাজের ধামসা মাদলের মতো, বাংলার ঢাক উৎসবের আমেজে মানুষকে উন্মাতাল করে তোলে। ঢাক ছাড়া পুজো বিবর্ণ, অসম্পূর্ণ।
ঢাকের কাঠিতে যখন ঘা পড়ল তখন হরেনদার কথা বলতেই হয়। বালকত্বের পাট চুকিয়ে আমি সবে কিশোর বয়সে। আমাদের সাবেক পাড়ায় পুজোর নির্ঘন্ট ছাপা হলদে কাগজ বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়ে দেখি তার এককোণে এই অধমের নাম ছাপা হয়েছে ‘যাদের না হলে নয়’ এমন এক শিরোনামের আড়ালে। এমন পদোন্নতিতে আমি ও আমার বন্ধুমহল বেজায় খুশি। এতেই চালচলনে কৈশোরক চপলতা উধাও হয়ে বেশ একটা ভারিক্কি ভাব এসেছে। পাড়ার এক দাদা আমাদের এমন হাল দেখে খানিকটা ভরসা পেয়ে বলেই বসলেন— তোদের এখন অনেক কাজ। আমরা ঘাড় নেড়ে সায় দিই— বটেই তো, বটেই তো! শোন, তোরা কয়েকজন যাবি গোপালদার দশকর্মার দোকানে। এই লিস্টটা গোপালদাকে দিয়ে বলে আসবি, আজ সন্ধেবেলায় এসে পুজোর জিনিসগুলো সব নিয়ে যাব। সব যেন তৈরি থাকে। খোদ কম্মকত্তার নির্দেশ বলে কথা! একদল তাই নিয়ে ছুটল গোপালদার দশকর্মার দোকানে। দু-মিনিটের পথ।
আর আমরা? হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিতে দিতে দাদাটি বললেন— শোন, তোরা আরএন গুহ রোড চিনিস্? ওখানে যে ঢাকিদের পাড়া আছে ওখানে গিয়ে হরেনদাকে গিয়ে এই খামটা দিয়ে আসতে হবে। পারবি তো?
হরেনদার সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। হরেনদা, শ্রী হরেন চন্দ্র দাস, সেবার পুজোয় ঢাক বাজাবেন আমাদের পাড়ায়। পঞ্চমীর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয় হয়, এমন সময় হরেন ঢাকি রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন। মালকোচা দিয়ে পরা ধুতি, গায়ে আকাশি রঙের ফতুয়া। ডান কাঁধে ঝোলানো একটা কাপড়ের ব্যাগ আর বাঁ কাঁধে ফুলেল সার্টিন কাপড়ে মোড়া হরেনদার ঢাকখানি। আমরা যেন ওঁত পেতেই ছিলাম। তাই হরেনদা মণ্ডপচত্বরে পা রাখতেই হইহই করে সমবেতভাবে স্বাগত জানাই তাঁকে।
“ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে-বিলে”
ঢাক শব্দটি এসেছে অস্ট্রিক শব্দ ‘ঢাকা’ থেকে। সংস্কৃত ভাষাতেও এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আর একদল গবেষকের মতে ডঙ্ক বা ডঙ্কা থেকে বিবর্তিত হয়ে বাংলা ঢাক শব্দের সৃষ্টি। নামসূত্রের তারতম্য থাকলেও ঢাক একান্তভাবেই একটি লোকবাদ্য। তাই বাংলা তথা বাঙালির লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে ঢাকের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
গঠন ও বাদনশৈলীর তারতম্য ভেদে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রগুলোকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। এরা হল—
- সুষির বাদ্য বা ফুৎকার বাদ্য, যেমন বাঁশি
- তৎ বাদ্য বা তার বাদ্য, যেমন সেতার
- অবনদ্ধ বাদ্য বা আবৃত বাদ্য, যেমন খোল
- ঘন বাদ্য, যেমন খঞ্জনি অঙ্ক
যে জনপ্রিয় লোকবাদ্যটি নিয়ে আজকে আলোচনা করব, ঢাক, তা এই তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত অর্থাৎ আবৃত অবনদ্ধ বাদ্য। এই ধরনের বাদ্যযন্ত্রকে ভরতমুনি তাঁর বিখ্যাত নাট্যশাস্ত্রে ‘পুষ্কর’ নামে অভিহিত করেছেন। এমন নামকরণ প্রসঙ্গে এক গল্প শুনিয়েছিলেন ভরতমুনি। কী সেই গল্প? সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। স্বাতী নামে এক মহাতপা ঋষি ছিলেন। একদিন আহারান্তে তিনি তাঁর পর্ণকুটির সংলগ্ন এক পুষ্কর অর্থাৎ পুকুরে গিয়েছেন মুখ-হাত-পদযুগল প্রক্ষালনের উদ্দেশ্যে। এমন সময়ে দেবরাজ ইন্দ্রের ইচ্ছায় প্রবল বারি বর্ষিত হল। বৃষ্টির জল পুষ্করের জলে ভাসমান শতদলপত্রের ওপর পড়ার ফলে সৃষ্টি হয় মধুর শব্দঝঙ্কার। ঋষি স্বাতী সেই শব্দে বিমোহিত হয়ে স্থির করলেন, এমন এক বাদ্যযন্ত্র তৈরি করবেন যা ওই স্বর্গীয় ধ্বনির সমতুল সুরনাদ সৃষ্টি করবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ঋষিবর ছুটলেন দেবশিল্পী কারিগর বিশ্বকর্মার কাছে। দুজনে একসঙ্গে নির্মাণ করলেন আজকের অবনদ্ধ বাদ্যের আদিতম রূপ ‘পণব’ ও ‘দারদূর’ নামের পুষ্কর। অবশ্য পাশাপাশি অন্য কাহিনিও প্রচলিত আছে ঢাকি সম্প্রদায়ের মধ্যে।
ঢাক তৈরির কায়দা কানুনও বেশ শ্রমসাধ্য। একটি অভিজাত ঢাক তৈরির জন্য প্রয়োজন হল শক্তপোক্ত অথচ তুলনায় হালকা আম অথবা সারি কাঁঠালগাছের গুঁড়ি। ঢাক তৈরির জন্য আঁটির আমগাছের কাঠ কলমের আমগাছের কাঠের তুলনায় অধিকতর প্রশস্ত, কেননা এই ধরনের গাছের কাঠ হালকা অথচ টেকসই। এছাড়াও লাগবে বাঁশ বা লোহার তৈরি গোল চাকা বা বেড়, ছাউনির জন্য ছাগলের চামড়া আর চামড়ার দড়ি। লাগবে আরও কিছু টুকিটাকি হার্ডওয়ার উপকরণ যেমন রিং।
প্রথমে বেশ কিছুদিন ধরে রোদ জলে পাকিয়ে নেওয়া নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের কাঠের গুঁড়িকে হাত-কুড়াল দিয়ে সাবধানে কেটে কেটে একটা দুই মুখ খোলা পিপের আকার দেওয়া হয়। এই কাজের জন্য দক্ষ ছুতার মিস্ত্রির ওপর নির্ভর করেন ঢাকিরা। এই পিপে আকৃতির কাঠের গুঁড়ির মাঝখানের অংশের পরিধি দুই প্রান্তীয় অংশের তুলনায় খানিকটা বড় হয়। এরপর বিশেষ উপায়ে নিরেট গুঁড়ির ভেতরের অংশের কাঠ কুঁদে নিয়ে তৈরি করা হয় ঢাকের উপযোগী দুই মুখ খোলা পিপে। বর্তমানে বিদ্যুৎচালিত মেশিনের সাহায্যে নিরেট কাষ্ঠল পিপের ভেতরের অংশের কাঠ কুঁদে নেওয়া হয়। এরপর বাঁশ বা লোহার বেড়িতে বিশেষ কায়দায় পাকা ছাগলের চামড়া গুঁজে ঢাকের ছাউনি তৈরি করা হয়। এবার কাঠের পিপেয় সেই চামড়ার ছাউনি জুড়ে দেওয়ার পালা। এ-প্রসঙ্গে বলা দরকার যে দুই মাথার ছাউনির চামড়া একরকম হয় না। যে-দিকের মাথায় কাঠি ঠুকে ঢাকি নানান বোলের ফুলঝুরি ফোটাবেন সেইদিকের চামড়া একটু মোটা থাকে। ছাউনি জুড়ে নিয়ে ঘষেমেজে তাকে সুরেলা করে নিতে হয়। ঢাকের খোলের অংশটাকে তেলের গাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন উপকরণের মিশেলে তৈরি এক প্রলেপ দিয়ে ভাল করে মাজা হয় যাতে কাঠে ঘুণপোকা না ধরে। এখন অনেকে পিপের গায়ে গালা পালিশ করেন ঢাকের মান বাড়াতে। আসলে খোল যত পাকা হবে আওয়াজও তত সুন্দর হবে। দুই পিঠের ছাউনি ছাওয়া হলে ঢাকের বাঁয়া অংশের চামড়ার ওপর একটা ছোট্ট ফুটো করে দেওয়া হয় যাতে পিপের ভেতরের বাতাস ঠিকঠাক খেলতে পারে। পিপের ভেতরে এই বায়ু সঞ্চালনের ফলেই কাঠির আঘাতে কেঁপে কেঁপে ওঠা চামড়া সুন্দর আওয়াজ তৈরি করে। কাঠির আঘাতের দ্রুততার সঙ্গে সঙ্গে কম্পনাঙ্কের হেরফেরে ঢাকের শব্দনাদের মাত্রারও তারতম্য ঘটে।
পাশাপাশি ঢাকের মাপেও রয়েছে বিভিন্নতা। নদিয়া জেলার নগরউখড়ার বিশিষ্ট ঢাক ও ঢোলবাদক শ্রী বিশ্বজিৎ দাস জানিয়েছেন মূলত তিনটি মাপের ঢাক হয়।
১) বড় ঢাক:
- উচ্চতা – ২৪ ইঞ্চি
- বাদন অংশের ব্যাস – ১৬ ইঞ্চি
- বিপরীত অংশের ব্যাস –১৫ ইঞ্চি
- পেটের অংশের পরিধি – ৭৮ ইঞ্চি
২) মাঝারি ঢাক:
- উচ্চতা – ২৩ ইঞ্চি
- বাদন অংশের ব্যাস – ১৫ ইঞ্চি
- বিপরীত অংশের ব্যাস– ১৪ইঞ্চি
- পেটের অংশের পরিধি – ৭২ ইঞ্চি
৩) ছোট ঢাক:
- উচ্চতা – ২২ ইঞ্চি
- বাদন অংশের ব্যাস –১৪ ইঞ্চি
- বিপরীত অংশের ব্যাস –১৩ ইঞ্চি
- পেটের অংশের পরিধি – ৫৬ ইঞ্চি
এই মাপের এদিক ওদিক হলেই ঢাকের শব্দের হেরফের হবে।
কাঠের ঢাকের ওজন বেশি, তাই হাল আমলে কাঠের ঢাকের বদলে টিনের তৈরি ঢাকের প্রচলন হয়েছে। পাশাপাশি মহিলারাও ইদানিং ঢাক বাজানোর কাজে সাগ্রহে যোগ দিচ্ছেন। কাঠের তৈরি ঢাক কাঁধে নিয়ে বহন করা কষ্টকর বলে টিনের তৈরি ঢাক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এছাড়া টিনের তৈরি ঢাক তুলনামূলকভাবে সস্তা হওয়ায় মরশুমি ঢাকিদের অনেকেই সাবেকি কাঠের ঢাকের বদলে এই হালকা পাতলা ঢাক বেছে নিচ্ছেন। খানদানি ঢাকিরা অবশ্য এই পরিবর্তনে মোটেই উদ্বিগ্ন নন, তাঁরা যন্ত্র ও বাদনশৈলীর শুদ্ধতাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তাঁদের মতে খানদানি ঢাকিদের কাছে কাঠের তৈরি ঢাকের কোনও বিকল্প নেই।
ঢাকের তালে, কোমর দোলে, খুশিতে নাচে মন
হাতের দুই কাঠির সাহায্যে ঢাকি নানানরকম বোল বাজান। এই বোল ও লয়কারি বেশ জটিল বিষয়। তালবাদ্য বিশেষত তবলার বাদনশৈলীর যেমন ঘরানা রয়েছে ঢাকের বোলচালের ক্ষেত্রেও রয়েছে তেমনি পার্থক্য, আঞ্চলিক বিভিন্নতা। ঢাক একান্তভাবেই বাংলার লোকবাদ্য, ফলে বাংলার ভৌগোলিক পরিবেশের তারতম্য ঢাকের বোলচালের ক্ষেত্রেও ধরা দিয়েছে। উত্তরবঙ্গের বাদনশৈলীর সঙ্গে দক্ষিণবাংলার বাদনশৈলীর লক্ষণীয় তারতম্য রয়েছে। বীরভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর বা বর্ধমানের ঢাকিরা যেভাবে ঢাকে কাঠি ঠুকে বোল তোলেন, নদিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগণা বা মুর্শিদাবাদ জেলার ঢাকিরা, যাঁদের সংখ্যাগুরু অংশই হল সাবেক পূর্ববাংলার আদি বাসিন্দা, ঠিক সেভাবে ঢাকের তাল লয়ের বিস্তার ঘটান না। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে ঢাকের মতো একটা জনপ্রিয় লোকবাদ্যের বাদনশৈলীর স্বকীয়তা তথা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে বংশপরম্পরাগত অনুশীলনের মাধ্যমে। পিতা থেকে পুত্র, পৌত্র… এক প্রজন্ম থেকে অন্যতর প্রজন্মের মধ্যে এই ধারা সঞ্চারিত হয়। ফলে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বাজনার কায়দা বা আঞ্চলিক বিভিন্নতা অক্ষুণ্ণ রাখার একটা সচেতন প্রচেষ্টা চলে। যেসব ঢাকি সম্প্রদায়ের মানুষজনেরা নিজেদের একান্তভাবেই এই পুরুষানুক্রমিক পেশার সঙ্গে যুক্ত রেখেছেন, তাঁরা কখনওই নিজেদের অনুশীলিত ধারা থেকে চট্ করে সরে আসতে চান না। এঁদের মাধ্যমেই ঘরানার স্বকীয়তা সময় থেকে সময়ান্তরে, এক প্রজন্ম থেকে অন্যতর প্রজন্মের মধ্যে বহমান থাকে। এমন ঢাকি পরিবারের সদস্যরা নিজেদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে থেকেও নতুন নতুন পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের বংশগত পেশার পরিসরকে নিরন্তর উন্নত করে চলেছেন। নগর উখড়ার শ্রী প্রিয়লাল দাস, মসলন্দপুরের বিখ্যাত গোকুল চন্দ্র দাস প্রমুখ এমন কাজে নিয়োজিত রেখেছেন নিজেদের।
গ্রামবাংলায় আর এক ধরনের ঢাকি সম্প্রদায়ের দেখা মেলে যাদের চিহ্নিত করা যায় মরশুমি ঢাকি হিসেবে। এইসব মানুষেরা প্রধানত ভিন্নতর পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষ— কেউ কৃষিকাজ করেন, কেউবা হয়তো ছোটখাটো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এইসব মানুষেরা পুজোর সময় কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় ঘরের কোণে সারাবছর ঝুলিয়ে রাখা ঢাকটিকে ঝেড়েপুঁছে কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এইসব ঢাকিদের কাছে ঘরানা বা পরম্পরাগত বাদনশৈলীর বাধ্যবাধকতা নেই। বাজারচলতি তালে ঢাক বাজিয়ে এঁরা কিছু বাড়তি রোজগার করেন উৎসবের সময়ে। উৎসবের মরশুম শেষ হলেই আবার পুরনো পেশায় ফিরে যান। এঁদের উপস্থিতির বিষয়টিকে মোটেও উপেক্ষা করা যাবে না। কেননা এঁরাই উৎসবকালে ঢাকের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য বজায় রাখেন।
ঢাকের বাজনার কথাই যখন হচ্ছে তখন তার দুই সহযোগীর কথা বাদ যায় কেন? ঢাকে কাঠি পড়লেই ‘কাইই নানা, কাইই নানা’ করে বেজে ওঠে কাঁসর। কাঁসর আমাদের অতিপরিচিত গৃহস্থালি বাদ্যযন্ত্র। এটা একটা ঘন বাদ্য। ঢাকের তালে তালে সঙ্গত করাই হল কাঁসরের একমাত্র কাজ। অভিজাত ঢাকিরা এই সঙ্গতের বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দেন। কাঁসর ঠিকঠাক বাজানো না হলে ঢাকের মহিমা সুপ্রকাশিত হয় না।
ঢাকের আর এক সহযোগী হল ঢোল। বাঘা বাইনের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? গলায় ঢোল ঝুলিয়ে বিচিত্র সব বোলে স্বয়ং ভূতের রাজাকেও বশ মানিয়ে ফেলেছিল বাঘা। ঢোলের এমনই মহিমা। ঢাকের জরাপের অংশের বাদন ঢাকবাদকের আভিজাত্য বা জাত চিনিয়ে দেয়। এর সঙ্গে দক্ষ ঢুলির সঙ্গত গোটা পর্বটিকেই এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে।
শারদীয়া উৎসবের দিনগুলোতে ঢাকের শব্দ আমাদের আনন্দ বিলাসের নিভৃততম বিশ্বস্ত সঙ্গী। পুজো ছাড়া ঢাক আর ঢাক ছাড়া পুজোর কথা ভাবাই যায় না। একসময় ঢাক ও ঢোল এই দুই জুড়ি বাদ্যযন্ত্রকে ব্যবহার করা হত সাধারণ মানুষের কাছে কোনও বিশেষ বার্তা পৌঁছে দিতে। ঢাক ও ঢোলের উচ্চমাত্রায় শব্দনাদ তৈরির ক্ষমতাই এদের অন্যদের তুলনায় গ্রহণীয় করে তুলেছে। ‘ঢোল শোহরত’ শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত, তার অর্থ হল ঘোষণা করা বা প্রচার করা। আজও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনও জরুরি প্রশাসনিক বিষয় ঘোষণা করতে বা বিশেষ কোনও ফরমান জারি করতে ঢোল শোহরত করা হয়। এর সঙ্গেসঙ্গেই ধীরে ধীরে এই লোকবাদ্যটি আমাদের পুজোপার্বণের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। ঢাক ছাড়া মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার গম্ভীরা নাচের অনুষ্ঠান পরিবেশন করা অসম্ভব।
দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নানা পর্বে পুজোর আঙিনায় ঢাক বেজে ওঠে। সবসময়ই কি এক তাল আর লয়ে বাজে? একদম না।
খুব ভাল করে মন দিয়ে শুনলে বোঝা যাবে একদম দিনের শুরুর প্রভাতী আবাহনের বাজনা, নবপত্রিকার স্নানের সময়ের বাজনা, পুজো শুরুর বাজনা, দেবীর স্নানের বাজনা, সন্ধ্যারতির বাজনা, ভোগ সম্প্রদানের বাজনা, সন্ধিপুজোর বাজনা, বলির সময়ের বাজনা— সব আলাদা। হরেনদা, বৃন্দাবনদা, মধুসূদনদার মতো অভিজাত ঢাকশিল্পীরা বাজনার এতসব বিচিত্র কায়দাগুলো রপ্ত করেছিলেন দীর্ঘ অনুশীলন আর আন্তরিক আগ্রহে। এখনও যেন চোখ বুঝলে দেখতে পাই সন্ধ্যাবেলায় পাড়ার দুর্গামণ্ডপে মনুদা— মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য মশাই— আরতি করছেন। হরেনদার ঢাক সেদিন যেন নতুন সুরে কথা কইছে। ধুনুচির ধোঁয়া, ধুনো-গুগ্গুলের মন উতল করা সুবাস, সমবেত ভক্তদের মুখে থেকে থেকে বল দুর্গা মাঈকি শব্দের জয়ধ্বনি— সব মিলিয়ে এক ঐশী বাতাবরণ। মা যেন সত্যি সত্যিই মণ্ডপ জুড়ে ওই পরম মুহূর্তে বিরাজমানা। সোয়াঘন্টার আরতির পর্ব মিটলে দেখতাম ঘর্মাক্ত শরীরে কাঁধ থেকে ঢাকটা নামিয়ে ষাষ্টাঙ্গে মাকে প্রণাম করছেন হরেনদা, তাঁর দু-চোখ গড়িয়ে নেমে আসা অশ্রুজলে কোন্ নিবিড় অনুভব জড়িয়ে থাকত তার উত্তর আমরা কখনও জানতে পারিনি। আত্মনিবেদনের এই বিশেষ ক্ষণের ছবিটা আজও আমার মানসলোকে অমলিন।
এই সময়ের ঢাকবাদকেরা কেমন আছেন? প্রতি বছর আমার সঙ্গে একালের ঢাকিভাইদের কথা হয়। পাড়ার পুজোয় এইসব মানুষেরা রাজ্যের নানান প্রান্ত থেকে আসেন। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগণা, হুগলি এমনকি সুদূর বীরভূম জেলার মানুষও এই সময়ে কাঁধে ঢাক নিয়ে শহরমুখী হন অনেক অনেক আশা নিয়ে। শিয়ালদহ স্টেশনচত্বরে পরিযায়ী ঢাকবাদকদের মেলা বসে যায় রীতিমতো। শহর আর শহরতলির পুজো-উদ্যোক্তারাও দল বেঁধে হাজির হন দরদাম করে পছন্দের বাদকদের নিজেদের জিম্মায় নেওয়ার জন্য। ঢাকিভাইদের সঙ্গে আসা কিশোর বয়সি ছেলে, ভাইপো, ভাইয়েরা অবাক ক্লান্ত চোখে সবকিছু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে। শহুরে জুলুস ওদের চোখে কোনও নেশা ধরায় কিনা জানি না। উদ্যোক্তাদের লক্ষ্য থাকে কম খরচে ঢাকিদের সঙ্গে রফা করার। দরকষাকষির এই আকচাআকচিতে এঁটে উঠতে না পেরে অনেকেই প্রত্যাশার থেকে অনেক অনেক কম পারিশ্রমিকে ঢাক বাজাতে রাজি হয়ে যায়। পুজোর কয়েক দিন ধরে চলে দাঁতে দাঁত চেপে টিকে থাকার লড়াই। বিশাল বাজেটের পুজোয় ঢাকবাদকদের জন্য বরাদ্দ থাকে নগন্য।
এর উল্টো ছবি কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। শহরের খানদানি মেগা বাজেটের পুজোর ঢাকিরা বেশ খাতির-যত্ন পান। রইস পৃষ্ঠপোষকরা অনেকেই বাজনা শুনে দিলখুশ হলে দু-চারশো টাকা বকশিস দেন। চুক্তির টাকার বাইরে এটা তাঁদের বাড়তি আয়। তবে সবাই তো আর তেমন ভাগ্যবান নন। ফলে অনেক কষ্ট স্বীকার করেই তাঁদের লড়াইয়ে টিকে থাকতে হয়। মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব ইত্যাদির কল্যাণে ঢাকিসমাজের একটা অংশ পৌঁছে যাচ্ছেন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের জায়গায়। এভাবেই মেদিনীপুর বা বীরভূমের ঢাকবাদকদের কাছে হয়তো পৌঁছে যাচ্ছে দেশ-বিদেশের আমন্ত্রণ। বিশ্বের যেখানে বাঙালির পায়ের ধুলো পড়েছে সেখানেই শারদীয়া উৎসবের আয়োজন। ঢাকিরা এভাবেই তাঁদের শিল্পীসত্তার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন বিদেশে, খানিকটা হলেও বাড়ছে রোজগার।
ইদানিং আঞ্চলিকভাবে গ্রামীণ গৃহস্থ পরিবারের গৃহবধূরাও পুজোর দিনগুলোতে ফাইবারের ছাউনি দেওয়া হালকা টিনের ঢাক কাঁধে নিয়ে পুজোর মণ্ডপে হাজির হচ্ছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই সমাজ তথা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। এককালের পর্দানসীন অবস্থা থেকে মা-বোনেদের এই উত্তরণ সত্যিই রোমাঞ্চকর। টিভির পর্দায় প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠেন যমুনা ঢাকি। হয়তো অনেকেই এতে উৎসাহ পান।
মসলন্দপুরের আর এক পরিচিত ঢাকি পলাশ চন্দ্র দাসকে প্রশ্ন করেছিলাম— এই পরিবর্তনটাকে কীভাবে দেখছেন? একটু ভেবে নিয়ে পলাশবাবু যা বললেন তার মর্মার্থ হল, সময় বদলে গেছে। বেড়েছে মানুষের চাহিদা। মরশুমি রোজগারের অর্থে পরিবারের বেড়ে যাওয়া চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া পাবলিক এখন নতুনত্ব চাইছে। এতদিনের প্রথানুযায়ী মণ্ডপের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা একলা ঢাকি ও তাঁর পাশে ক্লান্ত চেহারা নিয়ে এলোমেলো হাতে কাঁসর বাজানো কিশোর— এই ছবিতে মানুষের মন ভরছে না। এখন শো-এর যুগ। তাই মহিলা ঢাকির দল তৈরির একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একই রকমের পোশাক, হালকা নাচের ছন্দে দুলে দুলে ঢাক বাজানো– এইসব এখন ক্রাউডপুলিং ফ্যাক্টর।
একটু রাতের ট্রেনে ফিরছি। সেখানেই আলাপ হয়েছিল মালতীদির সঙ্গে। শিয়ালদা থেকে ছেলেমেয়েদের জন্য পুজোর কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। কথায় কথায় পরিচয় জানতে পেরে প্রশ্ন করেছিলাম— পুজোর কটা দিন ছেলেমেয়ে, ঘরসংসার ছেড়ে এভাবে প্যান্ডেলে পড়ে থাকতে ভাল লাগে? মন কেমন করে না? মাথা আনত করে মালতীদি উত্তর দিয়েছিলেন— সে কি আর না কইরা পারে? কী করুম? এই কয়টা দিনের রোজগার আমাগো একটু খাড়া হইয়া দাঁড়াইতে সাহায্য করে এই আর কি! বছরের বাকি দিনগুলা তো হামা দিতে হয়।
কোনও জবাব দিতে পারিনি। আসলে বলার কিছু নেই। তাই শান্ত হয়ে থম মেরে চুপচাপ বসে থাকি, দশমীর পর নিশ্চুপ উদাসী ফাঁকা মণ্ডপের মতো। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যায়।
প্রণাম ও নিবেদন
এই বিষয়টি নিয়ে লেখার ইচ্ছে অনেকদিনের। একটু একটু করে তথ্য সংগ্রহ করতে করতে এই লেখার কাজ এগিয়েছে। বেশ কিছু মানুষ এই কাজে আমাকে সহায়তা করেছেন। যেমন:
শ্রী প্রিয়লাল দাস
শ্রী বিশ্বজিৎ দাস
শ্রী পলাশ চন্দ্র দাস
প্রয়াত রাধেশ্যাম দাস
MotilalDhaki.com
এঁদের সকলকে ধন্যবাদ ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। এঁরা পাশে না থাকলে এই লেখা তৈরি করা সম্ভব হত না।
লেখাটি বাংলার সমস্ত ঢাকবাদকদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হল।
এই অসামান্য তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটির রচয়িতাকে এবং এটি প্রকাশ করার জন্য সম্পাদকবৃন্দকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। উৎসবকালের সূচনায় এটি একটি মহার্ঘ উপহার হিসেবে গ্রহণ করলাম।
Opurbo legechey. Opurbo lekha! Dhaki der shomporkey ei prothom eto tothyo shomriddho lekha podlam! Beautiful!
Khub bhalo laglo. Dadake Obhinondon o pronam.
ঢাক নিয়ে আর ঢাকা ঢাকি কিছু থাকল না।সব বলে দিলেন 😊
অনেক অজানা কথা জানতে পারলাম।