অভিষেক ঝা
এমন ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই দুইটি সাহিত্যকেন্দ্র গড়ে ওঠার কথা ছিল পশ্চিমবঙ্গে: কলকাতা বাংলা সাহিত্য ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা সাহিত্য। কিন্তু দ্বিতীয়টি একটা সুস্পষ্ট ধারা হিসাবে গড়ে উঠল না এখনও। কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক মনন ঔপনিবেশিক 'হোয়াইট ম্যান্স বার্ডেন'-এর সূত্র মেনে পশ্চিমবঙ্গকে বোঝাতে শুরু করে যে পশ্চিমবঙ্গ আসলে বাংলা এবং বাংলা আসলে কলকাতা। তাই বাংলাদেশি বাঙালির সমান্তরালে পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালির যে পরিচিতি গড়ে ওঠা উচিত ছিল সময়ের নিয়মে, সেই সমান্তরাল পরিচিতি হয়ে গেল 'কলকাতা'। তাই পশ্চিমবঙ্গকে 'কলকাতা' হয়ে উঠতে হবে
ঔপনিবেশিক সময়কাল থেকে বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্র কলকাতাকে ঘিরে না গড়লে সেটা অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার হত। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র যেখানে, সেইটাই সাহিত্য-সংস্কৃতির কেন্দ্রও হতে বাধ্য। সাহিত্য ও সংস্কৃতি দুটোই রাজনৈতিক হাতিয়ার। তাই ক্ষমতার স্বরের মতোই ক্ষমতার বিরুদ্ধ-স্বর দুটোই রাজনৈতিক কেন্দ্রে থাকতে চায়। ফলে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারার বিরোধিতা করে যে ধারাগুলি গড়ে ওঠে তারাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীভূত হতে চায় রাজধানীতেই। কৃত্তিবাসের নিজের রামায়ণের প্রচারের জন্য হোসেন শাহের গৌড়ে আসা, গৌড়ে রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামীর বাংলা ব্যকরণ নিয়ে কাজ, এমনকি ঔপনিবেশিক সময়কালের সূচনাপর্বে উইলিয়াম কেরীর মালদার মদনাবতীতে ছাপাখানা বসানোর চেষ্টা, বাইবেলের বাংলা অনুবাদ শুরু করা যতটা স্বাভাবিক, ফোর্ট উইলিয়াম ও ফোর্ট উইলিয়ামীয় রাজনীতিকে ঘিরে বাংলা ভাষার সাহিত্যের রাজধানী হিসাবে কলকাতার গড়ে ওঠাও ঠিক ততটাই স্বাভাবিক।
দেশভাগ না হলে কলকাতাই যে এখনও বাংলা সাহিত্যের একমাত্র কেন্দ্র হয়ে থাকত, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। বাংলাদেশের জন্ম ঢাকাকে বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ করে দেয়। ফলত আধুনিক সময়ে দুইটি কেন্দ্রের সুফল পাচ্ছে বাংলা ভাষার সাহিত্য। ঢাকাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাহিত্যের যে ধারা তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঙালির বহুস্বরকে ধরে বাংলাদেশের সাহিত্য হতে আগ্রহী। এখানেই কলকাতাকে ঘিরে প্রশ্ন আসে। কলকাতা কি পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পেরেছে এখনও? নাকি কলকাতা পশ্চিমবঙ্গকেই মেনে নিতে পারেনি এখনও? কলকাতা কি তার অবচেতনে এখনও ব্রিটিশ বেঙ্গল প্রভিন্সের অংশ? কলকাতার কসমোপলিটান মনন কি এখনও ইউরোপীয় কসমোপলিটান মননেরই অবশেষ? কলকাতা কি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পেরেছে, নাকি তা এখনও ফোর্ট উইলিয়ামীয় বাংলা সাহিত্যেরই রাজধানী?
জন্মের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গ বড় অস্থির এক পরিসর। পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুর ঢল নামছে, এলিট মুসলমান বাঙালি শ্রেণির বড় একটা অংশ পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে, সুদীর্ঘকাল ধরে বঙ্গের অংশ হিসাবে থাকা অংশ কেটে বিহারে জুড়ে যাচ্ছে, অসম থেকে ‘বঙ্গালি খ্যাদাও’-এর ফলে নতুন উদ্বাস্তুরা ঢুকেই চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের রুচি, সংস্কৃতি ও ভাষা তাই কলোনিয়াল পিরিয়ডের বাংলা থেকে খুব দ্রুত পাল্টাতে থাকে। তাই পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাকে ইতিহাসের ধারা অনুযায়ী আমরা অভিন্ন কোনও পরিসর হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি না। অথচ পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতিতেও কলকাতা নিজের বাংলা (যা ব্রিটিশ অখণ্ড বেঙ্গল প্রভিন্সের চলতি নাম হিসাবেই আমরা ধরব) অবচেতনকে অতি-সচেতনভাবে ধরে রাখতে চায়। এর ফলে ঢাকাকেন্দ্রিক বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্ম হলেও, কলকাতাকেন্দ্রিক পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য বলে কোনও পরিসরের জন্ম হয় না।
সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক কলোনিয়াল ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণতম শহরগুলির একটি থেকে একটা তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশের কোমর ভেঙে যাওয়া একটা রাজ্যের কেন্দ্র— এই কালচারাল শকের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ও মেনে নেওয়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। যে শহর অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হতে থাকে, রাজনৈতিকভাবে সর্বভারতীয় স্তরে গুরুত্ব হারাতে থাকে, সাংস্কৃতিক গুরুত্বও কমতে থাকে, তার সামনে খুব অল্প কয়েকটি রাস্তাই পড়ে থাকে। প্রথম রাস্তাটি হল অতীতের গৌরবকে মিউজিয়ামসম করে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া। ফোর্ট উইলিয়ামীয় বাংলা ভাষা তার অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও লিখিত বাংলা ভাষার সিনট্যাক্সকে অখণ্ড বাংলায় সর্বজনগ্রাহ্য করে তুলেছিল। কলকাতার অবচেতন তাই এই ভাষাকেই বাংলা ভাষার ‘এক’ হওয়ার যোগসূত্র হিসাবে ধরে রাখে। এতে কোনও সমস্যা নেই। সমস্যার শুরু হয় যখন এই ‘এক’টিকে ‘একমাত্র’ হিসাবে চাপিয়ে দেওয়ার অতি সচেতন প্রয়াস শুরু হয়। ‘এক ও একমাত্র’ এই নীতি জীবনের নিয়ম মেনেই একটা মিউজিয়ামসম গঠনতন্ত্র তৈরি করে। যে মিউজিয়ামে বেঙ্গল প্রভিন্সের কলকাতা নিজেকে আঁটিয়ে নেয়, স্বাধীনতার পরের কলকাতা সেখানে নিজেকে আঁটাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সেই মিউজিয়ামে ঢোকার পথই খুঁজে পায় না।
এমন ব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই দুইটি সাহিত্যকেন্দ্র গড়ে ওঠার কথা ছিল পশ্চিমবঙ্গে: কলকাতা বাংলা সাহিত্য ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা সাহিত্য। কিন্তু দ্বিতীয়টি একটা সুস্পষ্ট ধারা হিসাবে গড়ে উঠল না এখনও। এখানেই কলকাতার আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্ব হারাবার ট্রমা ভুলতে চাওয়ার দ্বিতীয় রাস্তাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে: অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ। পশ্চিমবঙ্গ ও মিউজিয়ামায়িত ফোর্ট উইলিয়ামীয় বাংলার সেতু হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে আজকের কলকাতার সেই মনন যা সেই মিউজিয়ামের রক্ষণাবেক্ষণ করে। ঔপনিবেশিক ‘হোয়াইট ম্যান্স বার্ডেন’-এর সূত্র মেনে এরা পশ্চিমবঙ্গকে বোঝাতে শুরু করে যে পশ্চিমবঙ্গ আসলে বাংলা এবং বাংলা আসলে কলকাতা। তাই বাংলাদেশি বাঙালির সমান্তরালে পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালির যে পরিচিতি গড়ে ওঠা উচিত ছিল সময়ের নিয়মে, সেই সমান্তরাল পরিচিতি হয়ে গেল ‘কলকাতা’। তাই পশ্চিমবঙ্গকে ‘কলকাতা’ হয়ে উঠতে হবে।
এই ‘কলকাতা’ করে তোলার প্রোজেক্টের সবচেয়ে বড় হাতিয়ারটিই হল সাহিত্য। কী লিখবে, কী লিখবে না, কীভাবে লিখবে, কীভাবে লিখবে না— এই সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা নিয়েই সাহিত্যসভাগুলি পশ্চিমবঙ্গের মফঃস্বলগুলোই অনুষ্ঠিত হতে থাকে। জেলা বইমেলাগুলিও এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অংশ। তবে এই অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কোণে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, ইস্কুলের সাহিত্যের ক্লাসগুলি। এই শতাব্দীর আগে যখন পোস্টকলোনিয়াল, সাব-অল্টার্ন, আইডেন্টিটি এই শব্দগুলি ফ্যাশন হিসাবেও উচ্চারিত হত না, তখনকার সাহিত্য ক্লাসগুলিতে ‘শাশ্বত ও সুন্দর’ বলে যা চালানো হত তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দিক দিয়ে ‘কলকাতা’ হয়ে ওঠার চেষ্টা। এর ফলাফল হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য বলে কিছু গড়ে ওঠার সুযোগই হয়নি। ‘আঞ্চলিক সাহিত্য’ নামে একটা বমি উদ্রেককারী শব্দের জন্ম দেওয়া হয়েছে। যা শুধুই আঞ্চলিক তা যে কখনওই সাহিত্য নয়, তা ভাল করে জেনেই এই শব্দবন্ধের জন্ম দেওয়া হয়েছে।
আর এই শব্দবন্ধের বাইরে যারা থাকতে চান, তাদের ‘কলকাতা’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। ফলাফল হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের আলাদা আলাদা ভৌগোলিক অঞ্চলে থেকে একইরকম অদ্ভুত কৃত্রিম ভাষায় সাহিত্যচর্চা হয়ে চলে। এদের সাহিত্যের ভাষা, সমাজ, আচার, চেতন, অবচেতন, সিম্বল, মোটিফ, সব একরকম হয়ে উঠতে চায় এবং এই সাহিত্যের পুরোটাই ‘কলকাতা মিমিক্রি’। এরা বাংলার উত্তরতম প্রান্তে বসবাস করে এই অঞ্চলে গ্রামীণ দুশো বছরের পুরানো ব্রাহ্মণবাড়ির দুর্গাপূজার কথা ফিকশনে লিখে ফেলেন নির্দ্বিধায়। এদের ছোটবেলার স্মৃতিকথার সঙ্গে উত্তর কলকাতায় বড় হয়ে ওঠা একজন মানুষের মননের পার্থক্য করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই কলকাতায়ন শুধুমাত্র কলকাতা অভিমুখী হয়ে ওঠে তাই নয়, যখন দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের কলকাতায়ন প্রায় সম্পূর্ণ, তখন মিমিক্রির সূত্র মেনেই কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের সবকিছু নিয়ে বলার অধিকারী ভেবে বসে নিজেকে। এই কলকাতায়নের বলে বলীয়ান হয়েই পপুলার ফিকশন লেখকের কোচবিহারের ‘গোসানীমঙ্গল’ নিয়ে ফেকলোর বানাতে দ্বিধা আসে না, এই কলকাতায়নের বলে বলীয়ান হয়েই সাতাশ ডিগ্রি উষ্ণতার পশ্চিমবঙ্গের অংশে অতি গ্রীষ্মের জন্য ছুটি ঘোষণা করতে এক সেকেন্ডও ভাবতে হয় না।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হল কলকাতার অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের কোল্যাটেরাল লাভ হিসাবে কলোনিয়াল কলকাতার কোনও সুফল পশ্চিমবঙ্গ পেল না। এই সময়ের কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামীয় বাঙালিয়ানা পচে যাওয়া একটা ফ্যাশন যার সঙ্গে ইউরোপীয় কসমোপলিটান মননেরও কোনও সংযোগ নেই। তাই পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে সাহিত্যে যে কলকাতায়ন হয়েছে তার না রয়েছে পশ্চিমবঙ্গীয় শিকড়, না আছে পূর্ববঙ্গ অসম ও বাকি উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে বয়ে আনা উদ্বাস্তু বাঙালির মিশেল ভাষা, না রয়েছে দণ্ডকারণ্য ও আন্দামান ফেরত যন্ত্রণাবিদ্ধ বাঙালিয়ানা, না রয়েছে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া মানভূমের ডায়াস্পোরা, না আছে পশ্চিমবঙ্গে স্বাধীনত্তোর সময় থেকে এখন অব্ধি গড়ে ওঠা ভারতীয় নেপালি, রাজবংশী-কামতাপুরী, সাঁওতালি, কুড়মি এবং আরও অনেক পরিচিতি রাজনীতির মিশেলে গড়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গীয় তৃতীয় ও চতুর্থ দুনিয়ার কসমোপলিটান স্বর, না রয়েছে ইউরোপীয় কন্টিনেন্টাল কসমোপলিটান মনন। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যের কেন্দ্র হতে গেলে মৃত কলোনিয়াল কলকাতাকে সংরক্ষণ না করে তৃতীয় বিশ্বের ও চতুর্থ দুনিয়ার স্বর হিসাবে তাকে নতুনভাবে জন্মাতে হবে। তহালেই এই কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের বহুস্বরকে ধারণে সক্ষম হবে। আস্তে আস্তে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হয়ে উঠবে, বেঙ্গল প্রভিন্সের অবলুপ্ত হওয়ার যন্ত্রণা ভুলে।
‘কলকাতার অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ’। চমৎকার বিশ্লেষণ। অভিষেক ঝা-র গল্পের মতোই ধারালো।