গিনিপিগ-জীবন থেকে অতিচেতনায় : বারীন ঘোষালের কবিতা ও কিছু ব্যক্তিগত ঋণ

বারীন ঘোষাল

শৌভ চট্টোপাধ্যায়

 

বারীন ঘোষালের সঙ্গে আমার আলাপ ২০০৫ কিংবা ২০০৬ সালে, কলকাতা বইমেলায় কৌরবের স্টলে। তার আগে, কৌরব ও কুরুপক্ষের সঙ্গে অল্পবিস্তর আলাপ-পরিচয় যে ছিল না, এমন নয়। কমল চক্রবর্তী বা বারীন ঘোষালের কিছু-কিছু লেখা ততদিনে পড়ে ফেলেছি এদিক-ওদিক খুঁজে, কৌরব অনলাইন আর শমিত রায়ের ‘বইপাড়া ডট কম’-এর সৌজন্যেও কিছু। কৌরব অনলাইনে অর্ডার দিয়ে পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যাও জোগাড় করেছি। কফিহাউজে সুদেষ্ণাদির (মজুমদারের) সঙ্গে দেখা হয়েছে সেই সুবাদেই। কিন্তু তবু, ২০০৫ কিংবা ২০০৬-এর সেই বইমেলাতেই আমার প্রথম চাক্ষুষ ও ব্যক্তিগত পরিচয় কৌরবের সঙ্গে, বারীন ঘোষালের সঙ্গে।

মনে আছে, বারীন ঘোষালের “গিনিপিগ, একটি তথ্যচিত্র” বইটা কিনেছিলাম সেবার। স্টলের বাইরে চেয়ারে আসীন লেখকের সইও বাগিয়েছিলাম। ফলে, বারীনদা-র কথা ভাবলেই, “গিনিপিগ”-এর কথা, সেই প্রথম আলাপের কথা, স্বভাবতই, মনে পড়ে যায়।

“গিনিপিগ, একটি তথ্যচিত্র” আসলে একটি কবিতার বই। অথবা, আসলে হয়তো তা কবিতার বই নয়। বইয়ের ছোটো ছোটো গদ্যাংশগুলি, কবিতা আর ব্যক্তিগত গদ্যের এক ধোঁয়াটে সীমারেখায় ঝুলে থাকে, পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলে। বস্তুত, এই কবিতার বই জুড়ে ফিরে-ফিরে আসে যে-গিনিপিগের কথা, গিনিপিগ-জীবনের কথা, তা আসলে ঠিক কীসের প্রতীক, সে-বিষয়েও নিঃসন্দেহ হওয়া সম্ভব হয় না কিছুতেই। বইয়ের একেবারে প্রথম লেখায়, গিনিপিগের সঙ্গে এভাবেই পরিচয় করিয়ে দেন লেখক—

“গিনিপিগের ব্যবহার বন্ধুর মতো। দেখতে বিচ্ছিরি নয় এবং মানুষের কোনও অপকার করে না। মানুষ গিনিপিগের মাংস খায়ও না। ওদের দেখেই মনে হয় মানুষকে ভয় করার দরকার নেই

তথ্যসমৃদ্ধ লাইনগুলি প্রায় যেন প্রাণীবিদ্যার বই থেকে তুলে আনা হল, বা ‘গিনিপিগ বিষয়ে একটি রচনা লেখো’র উত্তরে যা লিখতে পারে এক মনোযোগী ছাত্র। অথচ, গিনিপিগের এই আপাত-সরল পরিচয়ের ভণিতাটি যে আসলে নিরীহ ও বেচারা পাঠককে ফাঁদে ফেলার কৌশলমাত্র, তা স্পষ্ট হয় দ্বিতীয় লেখার মাঝামাঝি পৌঁছে—

“কারো মধ্যে ঢুকে পড়া সহজ নয়। এবং নারী বা পুরুষের দরজা এমন বন্ধ থাকে যে বাইরে থেকে তাদের এক মনে হয়।

গিনিপিগ জন্ম যে চেয়েছে তার কষ্টটা আবার অন্যরকম। তাকে দরজা জানলার বাইরে নিয়ে এলে সে তোমার যা খুশী তাতেই হ্যাঁ করবে, আর একটুও দুঃখ পাবে না। তাই তার ভেতরে ঢোকার প্রয়োজনই নেই। এজন্যই সে কষ্ট পায়

তাহলে কি গিনিপিগ-জীবন আসলে মানুষেরই জীবন? যখন পড়ি— “একটু পরেই একটা হাত আসে ঘাড়ের চামড়ায়। আমাকে নিয়ে যাবে বিজ্ঞাপনের জগতে। আমি গিনিপিগ হলে সে সময়কেই বলতাম মজাদার। এখন আমি এই কিছুক্ষণ অন্ধকার ভ্রমণকে বলি জীবন”— তখন বুঝি, মানুষ আর গিনিপিগের জীবন কোথাও যেন মিলে যাচ্ছে তাদের অন্তর্নিহিত অসহায়তার বোধে। যেন, এক জটিল, দুর্নিরীক্ষ পরীক্ষার ছলে বাজি রাখা হয়েছে তাদের দুজনকেই।

কখনও আবার মনে হয়, জীবন নয়, বরং কবিতার কথাই বলছেন বারীন, বলছেন কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা। নীচের অংশগুলি পড়ে দেখি—

“সঞ্চারশীল গুণ ছাড়া কবিতা আবার হয় না কি? কবিতাদের পুরো শরীরটাই প্রায় ডাক্তারদের খপ্পরে। অবশিষ্ট ও অযোগ্য সামান্য যা আমাদের কাজে লাগে তড়িৎদল হিসেবে এবং আমাদের মনকে চালাতে থাকে, তা-ই কবিতা। ভাবনাই কবিতা

“এই যে কথাগুলো বলছি— আমি আসলে এসব কিছুই বলছি না। বলতে চাইও না। পৌঁছতে চাইছি এক বিশ্ব শব্দে। শুধু চেতনা স্রোত নয়। তাতে একটি নৌকাও আছে আমার। আমি দাঁড় বাইছি অন্ধকারে

মনে পড়ে, বইয়ের ইংরিজি শীর্ষকে “a collection of theoretical polemics” কথাটা ব্যবহৃত হয়েছিল। কীসের polemic? তখন বুঝিনি। এখন, ক্রমশ মনে হয়, হয়তো মানুষের সীমাবদ্ধ জীবনের বিরুদ্ধে, কবিতার প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে একটানা কথা বলে যাচ্ছে এই কবিতাগুলি, উগরে দিচ্ছে জমে-ওঠা যাবতীয় ক্ষোভ।

এইভাবেই, ‘গিনিপিগ’ একটা অস্থির, অনির্ণেয় প্রতীকব্যবস্থার জন্ম দেয়। যে-প্রতীক, দুটো নির্দিষ্ট ধারণাকে এক-সুতোয় জুড়ে দেওয়ার বদলে, পাঠককে কেবলই ঠেলে দিতে থাকে একটি অর্থ থেকে অন্য অর্থে, একটি সম্ভাবনা থেকে অন্য অনেক সম্ভাবনার দিকে। অনেক পরে, যখন রিচার্ড ব্র্যাটিগেনের ‘ট্রাউট ফিশিং ইন অ্যামেরিকা’-নামক আশ্চর্য কেতাবটি পড়ি, তখন দেখি, সেখানেও ‘ট্রাউট’ এবং ‘ট্রাউট ফিশিং’ শব্দবন্ধগুলি, কতকটা একই প্রক্রিয়ায়, ফুটিয়ে তুলছে একটি শব্দের আড়ালে, তার অর্থের অনিশ্চয়তা এবং অসম্ভাব্যতাকে। বাংলায় এ-জিনিশ যদিও আর কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই বইয়ের কবিতাগুলির সিনেমাটিক আঙ্গিক নিয়েও (বইয়ের নামে ‘তথ্যচিত্র’ শব্দটি লক্ষণীয়) অনেকে আলোচনা করেছেন, যদিও আমি সেসব বিশেষ বুঝিনি। ‘কবিতায় ব্যবহৃত জাম্প-কাট’, ‘কবিতার মন্তাজ’, ইত্যাদি প্রস্তাবনাগুলি, আমার কাছে কিঞ্চিৎ গোলমেলে ঠেকে। কিন্তু এই বই যে কবিতার একটি নতুন ভাষা-সন্ধানের কাজে আগাগোড়া ব্যাপৃত থেকেছে, তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ ছিল না।

এরপর, আস্তে আস্তে, বারীন ঘোষাল ক্রমশ আমার কাছে ‘বারীন-দা’ হয়ে ওঠেন। আর আমিও পড়ে ফেলি তাঁর কবিতাজীবনের একেবারে শুরুর দিকের দুটি বই— “মায়াবী সীমূম” আর “হাশিসতরণী”। লক্ষ করি, এই দুটি বইয়ের কবিতা-আঙ্গিক, প্রচলিত কবিতার একেবারে উল্টোদিকে না-হেঁটেও, একটা সচেতন নিজস্বতার ব্যবধান বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেখি, শব্দ নিয়ে খেলা, কব্জির সামান্য মোচড়ে তাকে তার অর্থ থেকে বিচ্যুত করা, কিংবা নতুন অর্থের কাছে নিয়ে আসা, সেই শুরুর দিনগুলি থেকেই বারীন ঘোষালের অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছিল। ‘পলাশের দিন’ কবিতাটি পুরোটা উদ্ধৃত করার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারি না—

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

পংক্তিবিন্যাসের ভেতর, পাঠকের উদ্দেশ্যে একটি মজাদার খেলার ডাক শুনতে পাই। লক্ষ করি, ‘জীবনকে প্রিয় করে, পাগল’, আর ‘পাগল দিন এলো পলাশের’, এই দুটি সম্ভাবনাকেই কীভাবে জীইয়ে রাখা হল কবিতার শরীরে। অথবা ‘পৃথিবীর শিশুকাল আর মানুষের(ও)’ এবং ‘মানুষের সবুজ-জল-বসন্ত’, দুটোই কেমন সম্ভব হয়ে উঠছে পাঠের তারতম্যে। এই কৌশল ক্রমশ আমিও আত্মস্থ করতে চেয়েছি, ব্যবহার করেছি আমার লেখাতেও। লক্ষ করুন, ‘শোক’ কবিতার শুরুর স্তবকটি—

 

 

 

 

 

 

ভ্রমরের উড়ে আসা, একটি মেয়ের কপালে সিঁদুরের টিপ, ফুলের মতো ফুটে ওঠা তার স্নানশেষের সৌন্দর্য, তার মুগ্ধতা, গার্হস্থসুখ, বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগান— এই সবকিছুই কী আশ্চর্য কৌশলে মিলেমিশে যায় শব্দের সামান্য টানে, বিচলনে। ওদিকে আবার, ‘নিরন্নের গান’ কবিতায়, শব্দের জাদুতে লেগে থাকে গভীর বেদনার ছোঁয়া—

 

 

 

 

 

‘একবার এসে আর কি যায় ভালবাসা’— এই বাক্যবন্ধটির অনবদ্য দ্ব্যর্থপ্রয়োগ লক্ষ করার মতো। ভালবাসার এই চিরস্থায়ী থেকে যাওয়া, এবং একইসঙ্গে, আদৌ ভালবাসা যায় কি না সেই সন্দেহের আবহে, আমাদের দেখা হয়ে যায় আশা-নামের সেই গ্রামের মেয়েটির সঙ্গে, যে হয়তো একদিন গ্রাম থেকে শহরে এসে আর কখনওই ফিরে যেতে পারল না নিজের ভিটেয়।

এই সময়পর্বে, স্বদেশ সেন, বারীন ঘোষাল, কমল চক্রবর্তী আর শংকর লাহিড়ী, জামশেদপুরে বসে, কবিতার যে অন্যভুবনটি নির্মাণ করে চলেছিলেন, তার প্রতি আমার মায়া এভাবেই বেড়ে যেতে থাকে।

পরবর্তীকালে, বারীনদা-র লেখা অন্যদিকে বাঁক নেয়। ‘অতিচেতনার কথা’ নামক কবিতাভাবনার বইটিতে ধৃত তাঁর নিজস্ব নন্দনতত্ত্বকে কবিতায় ফলিয়ে তোলার তাগিদ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই নন্দনতত্ত্বের সঙ্গে আমি কোনওদিনই একমত হতে পারিনি। কবিতাকে নিছক ধ্বনি-নির্ভর করে তোলার উদ্দেশ্যও সেভাবে স্পষ্ট হয়নি আমার কাছে। অবশ্যই, সে আমার নিজস্ব পাঠাভ্যাস, কবিতা-বিষয়ে আমার নিজস্ব ধারণার ফল। ব্যক্তিগতভাবে বারীনদা-র সঙ্গে আমার হৃদ্যতা বেড়েছে বই কমেনি। আমার প্রথম বই ‘অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য’ পড়ে, বারীনদা-র স্বতঃপ্রণোদিত ও উচ্ছ্বসিত ফোনকল আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। অনেকবার ভেবেছি, জিজ্ঞেস করব, উনি আমার নম্বর কোথা থেকে জোগাড় করেছিলেন। জিজ্ঞেস করা হয়নি। ‘মুনিয়া ও অন্যান্য ব্যূহ’ পড়ে বারীনদা আমাকে মেইল করেছিলেন। এই তো সেদিন, দিল্লিতে শুভ্র-দার (বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়িতে বসে ‘মায়াকাননে’র কবিতা পড়ে শুনিয়েছি তাঁকে। লেখা নিয়ে মত ও পথের পার্থক্য আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি কোনওদিন। অমন বড় মনের মানুষের অভাব সহজে পূর্ণ হবার নয়।

ছবিটি শ্রী প্রণব কুমার দে-র তোলা। বারীনদার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...