তপোধীর ভট্টাচার্য
এখন রাজ্য প্রশাসন খোলাখুলিভাবে সবকিছু কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে যা কয়েক বছর আগেও এই পর্যায়ে যায়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রে বরাক উপত্যকার বাঙালি আক্রান্ত। তার চাকরি নেই, আর্থিক নিরাপত্তা নেই, অতএব সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তাও শাসকশক্তি কেড়ে নিয়েছে। বরাক কার্যত অবরুদ্ধ, ইংরেজিতে যাকে demographic attack বলে, সেই সুচিন্তিত সন্ত্রাসী পরিকল্পনায় এই অঞ্চলের আনাচে-কানাচে অসমিয়াদের আমদানি করে এখানকার সহস্রাব্দ-ব্যাপ্ত জনবিন্যাসগত চরিত্র ও ভারসাম্য ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে
এই শিরোনাম পড়েই কি আঁতকে উঠছেন আপনি? সেকি! কেন! কারা!— হয়তো ভাবছেন, কীভাবে শনাক্ত করা গেল আত্মবিনাশ? যদি লিখি, প্রতি মুহূর্তে এই উপলব্ধি হচ্ছে ইদানীং— আপনার মনে নানা প্রশ্ন জেগে উঠবে। তাহলে স্পষ্টই লেখা যাক, এই আত্মবিনাশ আমাদের, মানে আমরা যারা বাংলাভাষায় কথা বলি। কারণ আমরা সর্বতোভাবে আক্রান্ত, নুনের পুতুলেরা সাগরে নেমে যেমন অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। না, এসব কথায় একটুও হেঁয়ালি নেই। বাঙালিরা নিজেদের অস্তিত্বের তাৎপর্য সম্পর্কে উদাসীন। তাদের রামও মারে, মারে রহিমেও। কোথায়? তাহলে জবাবটাও শুনে নিন, কোথায় নয়? কিংবা, কখন নয়? ১৮৭৪ সালে যে নিঃশব্দ বঙ্গভঙ্গে ধূর্ত ব্রিটিশ শাসক যে বাঙালি জাতির কোমর ভেঙে দিয়েছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির রংপুরের উত্তরাংশ থেকে গোয়ালপাড়া এবং সিলেট ও কাছাড় জেলাকে ছিনিয়ে নিয়ে— বাঙালিরা কি ইতিহাসের সেই তিক্ত কথা মনে রেখেছেন? রাখেননি কারণ আমাদের ঘর থেকে আঙিনা বিদেশ এবং আমাদের স্মৃতিও অতিশয় দুর্বল। বাংলাকে দুর্বল করে অসমকে ভেট দেওয়ার ফলে অসমিয়া সম্প্রসারণবাদের হল পোয়াবারো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে অজগর সাপের ঐক্যনীতি অনুযায়ী গোয়ালপাড়া থেকে বাংলামাধ্যমের স্কুল কর্পূরের মতো উবে গেল। অসমিয়াভূত গোয়ালপাড়ায় উত্তরপ্রজন্ম ভুলে গেল বহু হাজার প্রজন্ম ধরে চলমান বাঙালি জাতিসত্তার শরিক হয়েও তারা বেছে নিয়েছে আত্মবিনাশের সুড়ঙ্গ-পথ।
সিলেট অবশ্য ১৯৪৭ সালে রেফারেন্ডামের মধ্য দিয়ে অসমের সঙ্গে আরোপিত সম্পর্ককে ছিন্ন করে ফিরে গিয়েছিল পূর্ববঙ্গে, আবহমান বাঙালি-সত্তার স্বাভাবিক নীড়ে। কিন্তু অলীক দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন জনেরা তখন হিন্দুস্তান-পাকিস্তান ছাড়া অন্য কিছুই দেখতে পাননি। সিলেট-সংলগ্ন কাছাড় জেলার বাসিন্দা বাঙালিরাও ধর্মান্ধ রাজনীতিবিদদের লেজুড় হয়ে হিন্দু কিংবা মুসলমান হতে চেয়েছিলেন। মাতৃভাষা বাংলার চেয়ে যাঁরা হিন্দুয়ানিকে বড় করে দেখছিলেন, নিজের পায়ে কুড়ুল মারতেই দক্ষ ছিলেন তাঁরা। তাই ঘুঘু দেখেছিলেন, ফাঁদ দেখেননি। যে অসমের সঙ্গে ভৌগোলিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ভাষিক-ঐতিহাসিক নিরিখে কোনও সম্পর্কই ছিল না, তার লেজ আঁকড়ে থাকাতে কত অন্তহীন গ্লানি এবং সর্বনাশের আশঙ্কা যে-কজন বুঝেছিলেন, তাঁরা পূর্বাচল রাজ্যের দাবি পেশ করেছিলেন। কিন্তু দেশভাগ-পরবর্তী চরম অনিশ্চয়তার দিনগুলিতে দূরদৃষ্টির চুড়ান্ত অভাব দেখা গেল।
ফলে নিজেদের প্রকৃত ইতিহাস জানারও কোনও আগ্রহ দেখা গেল না। এমন নয় যে আবছা ধারণা নিয়ে কাছাড় মানে হিড়িম্ব-হিড়িম্বার দেশ, পঞ্চপাণ্ডবেরা এখানে আসাতেই ভীম হিড়িম্বাকে বিয়ে করেছিলেন। এজাতীয় মজাদার প্রত্নকথার আশ্রয় নিলেই দায়িত্ব শেষ। বরং গভীরে অবগাহন করলে বোঝা যেত, প্রত্নপ্রস্তর ও নব্যপ্রস্তর যুগে এখানকার দুর্গম অরণ্যভূমিতে প্রাগার্য জনগোষ্ঠীর বাসভূমি ছিল। তার মানে, প্রাগৈতিহাসিক যুগেই (খ্রিস্টপূর্ব দশম থেকে চতুর্থ সহস্রাব্দের মধ্যে) বৃহত্তর প্রত্নবঙ্গের এই প্রান্তিক অঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূমির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। আর, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় সহস্রাব্দে ময়ূরশাল্মলী অগ্রহার হিসেবে পরিচিত আজকের পূর্ব শ্রীহট্টের পঞ্চখণ্ড বা বিয়ানিবাজার এবং করিমগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত অরণ্যভূমির সংলগ্ন পূর্বপ্রান্তিক অঞ্চলই বরাক উপত্যকা। আরও পরবর্তীকালে, অভিপৌরাণিক যুগে সুব্বুঙ্গবর্ষই আজকের সুরমা-বরাক উপত্যকা। তাই আগ্রহোদ্দীপক প্রত্ন-ইতিহাস যারা জানে না, তারাই নিরাময়-অযোগ্য হীনম্মন্যতায় ভোগে।
সেইসঙ্গে এ-ও দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, আহোম ইতিহাস বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাভিত্তিক রাজবৃত্তের সঙ্গে বৃহত্তর প্রত্নবঙ্গের শরিক আজকের বরাক উপত্যকার কোনও সম্পর্ক ছিল না কখনও। অতএব অসমিয়া সম্প্রসারণবাদের উগ্র নায়েব-গোমস্তারা বাঙালি সত্তাকে গ্রাস করার জন্য উদ্ধত সরকারি আয়োজনে আহোম সেনাপতি লাচিত বরফুকনের বিজ্ঞাপন দিয়ে ছয়লাপ করলেও এবং লাচিতের মূর্তি স্থাপন করে মেরুদণ্ডহীন চাকরিজীবীদের ভয় দেখিয়ে অসমিয়া গামোছা-সহ অসমিয়া জাতীয় সঙ্গীত ‘অ’মোর চিকুনি দেশ’ সর্বত্র চাপিয়ে দিলেও রাত কি দিন হয়ে যায়? যায় না, চিরায়ত ইতিহাসকে নস্যাৎ করে বানানো ইতিবৃত্ত গদার মতো ব্যবহার করলেই বাঙালি সত্তাকে পিষে ফেলা যায় না। কিন্তু সঙ্কট দেখা দেয় যখন নিছক বৈষয়িক স্বার্থে প্রভুশক্তির কাছে আত্মবিস্মৃত বাঙালি আত্মসমর্পণ করে। অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদের হিংস্রতা এভাবে ভীরুর মতো বরদাস্ত করতে থাকলে বরাক উপত্যকাও অচিরে গোয়ালপাড়ার দোসর হয়ে যাবে। এখন রাজ্য প্রশাসন খোলাখুলিভাবে সবকিছু কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে যা কয়েক বছর আগেও এই পর্যায়ে যায়নি। এর কারণ ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র যদি শুম্ভ-নিশুম্ভের হাতে চলে যায়— প্রতিটি প্রান্তে অজস্র কালনেমি কিংবা রক্তবীজ তৈরি হবেই। এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে হিটলার-মুসোলিনি-আইখম্যানের আচরণ করবেই। প্রতিটি ক্ষেত্রে বরাক উপত্যকার বাঙালি আক্রান্ত। তার চাকরি নেই, আর্থিক নিরাপত্তা নেই, অতএব সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তাও শাসক শক্তি কেড়ে নিয়েছে। বরাক কার্যত অবরুদ্ধ, ইংরেজিতে যাকে demographic attack বলে, সেই সুচিন্তিত সন্ত্রাসী পরিকল্পনায় এই অঞ্চলের আনাচে-কানাচে অসমিয়াদের আমদানি করে এখানকার সহস্রাব্দ-ব্যাপ্ত জনবিন্যাসগত চরিত্র ও ভারসাম্য ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।
সেইজন্য উগ্রভাষিক সম্প্রসারণবাদ এবং ধর্মান্ধ ফ্যাসিবাদের যৌথ আক্রমণে বিধ্বস্ত বরাক উপত্যকার অন্তেবাসী বাঙালিরা কি প্রতিকারহীন বেদনা, অক্ষমের ক্রোধ ও নিশ্চেষ্ট আক্ষেপের মধ্যেই কালাতিপাত করবে? না কি অগ্রজদের যে-কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, তার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করে পুরনো ভুল সংশোধনের কথা ভাববে? ভাষিক সম্প্রসারণবাদীদের বেপরোয়া অত্যাচার যখন প্রকাশ্যে বাঙালির ভাষা-অস্তিত্ব-সংস্কৃতি-গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, ইতিহাসের ভ্রান্তি শুধরে নিয়ে লেজুড়বৃত্তি পরিহার করার মতো সাহস খুঁজে পাবে? অগ্রজরা যে পূর্বাচল রাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার স্বপক্ষে নতুন করে জনমত গঠনে অবিলম্বে সার্বিক উদ্যম গ্রহণ করাই সমীচীন। এই রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হোক মানসিক সমতাবোধ ও সহাবস্থান নীতির ভিত্তিতে। বর্ণহিন্দু-তফশিলি-মুসলমান প্রভৃতি নিরর্থক বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এভাবেই কেবল আত্মরক্ষা করতে পারবে। সেইসঙ্গে এই প্রস্তাবিত পূর্বাচল রাজ্যে গড়ে উঠবে বহু শতাব্দী ধরে পাশাপাশি জীবনযাপন করতে থাকা মৈতৈ মণিপুরী-বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী-ডিমাসা-কুকি-নাগা-মার প্রভৃতি জাতি-উপজাতির সর্বাত্মক জীবন-সৌধ। সার্থক সংশ্লেষণের ভিত্তিতে সহযোগিতার যথার্থ কাঠামো গড়ে উঠুক। প্রত্যেক গোষ্ঠীর আর্থসামাজিক অধিকার যদি সুরক্ষিত হয়, তবে নতুন ঊষার উদয়-মুহূর্ত সুনিশ্চিত হবে। হোক স্বপ্ন, সমস্ত প্রতিবেশী জাতি-উপজাতিকে সঙ্গে নিয়ে বরাক উপত্যকার আক্রান্ত বাঙালি পূর্বাচলের স্বপ্ন দেখুক।