অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী
বস্তার জেলার সবচেয়ে বড় নদীটির নাম ইন্দ্রাবতী। ওড়িশা রাজ্যের কালাহাণ্ডি জেলায় রয়েছে ‘জয়মাল’ নামের অঞ্চল। সেইখানে একটা ‘ডোঙ্গর’ (পাহাড়)–এর উপরে রয়েছে ‘ইন্দ্রো বাটী’ জলকুণ্ড। সেই জলকুণ্ডই নদীর উৎস। নদীর উদ্গম সম্বন্ধে কালাহাণ্ডি জেলার কোয়াবংশীয় গোণ্ড সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি কাহিনী প্রচলিত। এই কাহিনী অনুসারে, প্রাচীনকালে জয়মাল গ্রামে থাকতেন টিরকা মালু নামের এক কৃষক। টিরকা মালুর এক মেয়ে ছিল -– ইন্দ্রো। শৈশবে মা-হারা ইন্দ্রো তার বাবার সাথে খেতির এবং বাড়ির কাজ করে বড় হচ্ছিল।
এই ইন্দ্রো ছিল পঞ্চখণ্ড ধরিত্রীর রাজা ‘মারাং বুরু’ (শম্ভু মহাদেব)-এর উপাসক। জয়মাল গ্রামের পাশের সেই ডোঙ্গরের শিখরে ছিল সেই ‘মারাং বুরু’-র থান। সে ক্ষণে ক্ষণে পূজো করতে সেইখানে যেত। একবার কালাহাণ্ডি জেলায় ভীষণ শুখা পড়ল। লোক জলের জন্য ত্রস্ত হয়ে উঠল। এমনকি তার বাপ টিকরা পর্যন্ত গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চাইলে ইন্দ্রো চিন্তায় পড়ে গেল। সে ভাবতে লাগল কি -– এর পর ‘মারাং বুরু’র পুজো কে দেবে?
এই ভেবে সে সিদ্ধান্ত নিল যে সে তৃষ্ণায় মরে গেলেও তার ‘মারাং বুরু’-কে ছেড়ে যাবে না। এই ভেবে ইন্দ্রো ডোঙ্গরের চূড়ায় ‘মারাং বুরু’র থানে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করে বসল যে যতদিন না তার তৃষ্ণাতুর গ্রামবাসীরা জল পায় ততদিন ও থান থেকে যাবে না। এমন প্রতিজ্ঞা করে ইন্দ্রো সেই থানে তার মাথা ঠুকতে শুরু করল। মারাং বুরুর টোটেমশক্তি বৃত্তাকার নাগ এই দৃশ্য দেখে আর সইতে পারল না। সে ডোঙ্গরের ভিতর প্রবেশ করে সেই যেইখানে ইন্দ্রো মাথা ঠুকছিল ঠিক সেইখান থেকেই প্রবাহিত করে দিল এক জলধারা। জলধারার তীব্র গতিতে ভেসে গেল ইন্দ্রো। সেই থেকে সেই জায়গার নাম হয়েছে ‘ইন্দ্রো-বাটী’, অর্থাৎ ‘ইন্দ্রোর কুণ্ড’, আর সেইখান থেকে উৎসারিত জলধারা হয়ে উঠেছে ‘ইন্দ্রোবাটী’ (ইন্দ্রাবতী) নদী।
এই ইন্দ্রাবতী তার উৎস থেকে আনুমানিক ৫৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে কোরাপুট (কালীপুট) জেলার কোশীপুট তহসিল-স্থিত নবরংপুর হয়ে আরও ৮০ কিলোমিটার হুহুবেগে ধোঁয়াঢাকা জঙ্গুলে পথে জয়পুর অতিক্রমণ করে প্রবেশ করছে বস্তারের সীমায়। বস্তারে ইন্দ্রাবতী বইছে পুব থেকে পশ্চিমে। নদীপথের দুইধারে অজস্র গ্রাম; কয়েকটির নাম দেওয়া হচ্ছে -–
বেলগাঁও, গুমডেল, মালগাঁও, কুরুসপাল, সুকরাপাল, ধোবীগুড়া, আসনা, জগদগুড়া, তিতিরাও, ঘাটপদুর, তারপর সে’সব ছাড়িয়ে আসছে টিকরা-লোহঙ্গা, বালীকোটা, কোবী-আসনা, ঘাটকবালী, টিকরা-ধনোরা, ঘাটসরপাল, বোড়নপাল, পল্লীচকবা, গড়বোদরা, নারায়ণপাল, চিতরকোট (বর্তমান আর্য-হিন্দু নাম হিসেবে — চিত্রকূট), বোধঘাট হয়ে নদী প্রবেশ করেছে দান্তেওয়াড়ায়। সেইখানে ইন্দ্রাবতী বারসুর, ছিন্দনার, মুস্তলনার হয়ে বীজাপুর তহসিল ঘুরে করকাওয়াড়া, পসেওয়াড়া, মট্টী-মরকা, লিগপুরম ইত্যাদি পার করে ভোপালপট্টনম অঞ্চল ছাড়িয়ে মিশে গিয়েছে গোদাবরী নদীতে।
ইন্দ্রাবতী নদীর রয়েছে ত্রিশাধিক শাখা-নদী। বস্তার সম্ভাগের উত্তরাঞ্চলে সেইরকম মুখ্য শাখানদীগুলির নাম — কোতরী, ভওয়ারডীঙ, গুণ্ডরা, নিব্রা, নারঙ্গী প্রভৃতি; দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান শাখানদীগুলি হল -– দান্তেওয়াড়া, শঙ্খিনী, ডোঙ্কিনী, বেরুদী, মাণ্ডের, চিন্তাবগু ইত্যাদি। এই উপায়ে ইন্দ্রাবতী নদী ‘ইন্দ্রো কুণ্ড’ থেকে উৎসারিত হয়ে অনাদিকাল ধরে কোয়া বংশীয় গোণ্ড সম্প্রদায়ের ‘গণ্ড’ অর্থাৎ টোটেম-কেন্দ্রিক যাপনের সেবা করে চলেছে।
এরপর দ্বিতীয় উপকথা